কে হবেন পরবর্তী পোপ?

ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস সোমবার (২১ এপ্রিল) মারা যান। তার মৃত্যুর পর নতুন পোপ কে হবেন–এ নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল সিএনএন এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
পোপ নির্বাচন প্রক্রিয়াই বেশ জটিল। এ ক্ষেত্রে কয়েকশ বছরের পুরোনো রীতি অনুসরণ করে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের প্রধান ধর্মগুরু নির্বাচন করা হবে। নতুন পোপ নির্বাচনের দায়িত্ব থাকে ক্যাথলিক চার্চের সবচেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, যারা ‘কলেজ অব কার্ডিনালস’ নামে পরিচিত।
যখন একজন পোপ মারা যান অথবা পদত্যাগ করেন (যেমনটি ২০১৩ সালে পোপ বেনেডিক্ট ষোড়শের ক্ষেত্রে ঘটেছিল, যেটি ছিল বিরল ঘটনা), তখন ভ্যাটিকানে কার্ডিনালদের একটি সম্মেলন ডাকা হয়। তারপর কনক্লেভ অনুষ্ঠিত হয়, যেটি পোপ নির্বাচনের সময় হিসেবে পরিচিত।
বর্তমান পোপের মৃত্যুর পর থেকে নতুন পোপ নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়কালে ‘কলেজ অব কার্ডিনালস’ই গির্জার যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
পোপ নির্বাচনের ভোট অনুষ্ঠিত হয় চিত্রশিল্পী মাইকেলেঞ্জেলোর আঁকা বিখ্যাত সিস্টিন চ্যাপেলের ভেতরে। কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে সেখানে কার্ডিনালরা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেন। নতুন পোপ নির্বাচনের এই প্রক্রিয়ায় বেশ কয়েক দিন সময় লেগে যেতে পারে। অতীতে এক সপ্তাহ, এমনকি এক মাস সময় ধরেও ভোট চলতে দেখা গেছে। ভোট চলাকালে কার্ডিনালদের মধ্যে কেউ কেউ মারা গেছেন, এমন ঘটনারও নজির আছে।
এই সময় নতুন পোপ নির্বাচন কতটুকু এগোলো, সেটি বোঝার একমাত্র উপায় হলো ধোঁয়া। নির্বাচন চলাকালে প্রতিবার ভোট শেষে নির্দিষ্ট চুল্লিতে ব্যালট পেপার পুড়িয়ে ফেলা হয়। এর ফলে দিনে দু’বার যে ধোঁয়া বের হয়, সেটিই নতুন পোপের বিষয়ে ইঙ্গিত দেয়। কালো ধোঁয়ার অর্থ হলো পোপ নির্বাচন হয়নি। আর সাদা ধোঁয়া দেখার মানে হলো নতুন পোপ নির্বাচিত হয়েছেন।
ঐতিহ্যগতভাবে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে : ‘যিনি পোপ হিসেবে কনক্লেভে প্রবেশ করেন, তিনি কার্ডিনাল হিসেবে বের হন।’ অর্থাৎ ‘ভোটের আগে কোনো প্রার্থীকে সুস্পষ্ট ফেভারিট মনে করা হলেও, চূড়ান্ত ফল ভিন্ন হতে পারে’। ২০১৩ সালের কনক্লেভে কার্ডিনাল অ্যাঞ্জেলো স্কোলা ছিলেন অন্যতম ফেভারিট। এমনকি সাদা ধোঁয়া বের হওয়ার পর ইতালির এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের কাছে স্কোলার নির্বাচিত হওয়ার আনন্দ প্রকাশ করে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত কার্ডিনাল হোর্গে মারিও বারগোগ্লিও পোপ নির্বাচিত হন।
পোপ ফ্রান্সিস তার কার্যকালে সেই নির্বাচকমণ্ডলীর গঠনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছেন। তিনি বিশ্বব্যাপী চার্চের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। পুরোনো প্রথা ভেঙে দিয়ে, কিছু নির্দিষ্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্ডিনাল করার নিয়ম বাতিল করেছেন।
নির্বাচকদের চার্চের অগ্রাধিকার এবং পরবর্তী প্রার্থীর প্রোফাইল বিবেচনা করবেন। তাদের আরও বিবেচনা করতে হবে যে, পরবর্তী পোপ ফ্রান্সিসের শুরু করা সংস্কারগুলো চালিয়ে যাবেন নাকি অন্য পথে হাঁটবেন।

তারা এমন কাউকে খুঁজবেন যিনি একটি বিশ্বব্যাপী চার্চের নেতৃত্ব দিতে এবং বিশ্ব মঞ্চে বিশ্বাসযোগ্য নৈতিক নেতৃত্ব প্রদান করতে সক্ষম হবেন। কেউ কেউ মনে করেন যে চার্চের ভবিষ্যৎ এশিয়াতে নিহিত, যা থেকে অনুমান করা হচ্ছে—পরবর্তী পোপ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে হতে পারেন।
বয়সও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ শেষ দুটি কনক্লেভে অপেক্ষাকৃত বয়স্ক পোপদের নির্বাচন করা হয়েছে। যাতে তাদের পোপপদ তুলনামূলকভাবে কম সময়ের হয়।
পোপ পদের প্রার্থীদের ‘পাপাবিল’ বলা হয়, যার ইতালীয় অর্থ ‘পোপ হওয়ার যোগ্য’। বেশিরভাগ পাপাবিলকেই পোপ ফ্রান্সিস নিয়োগ করেছেন।
সিএনএন তাদের প্রতিবেদনে সম্ভাব্য কয়েকজন প্রার্থীর নাম উল্লেখ করেছে—
১। কার্ডিনাল মাতেও জুপি (৬৮) : বোলোনার আর্চবিশপ, যিনি ফ্রান্সিসের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত এবং তার সংস্কার অ্যাজেন্ডাকে সমর্থন করেন।
২। কার্ডিনাল লুইস আন্তোনিও তাগলে (৬৭) : ফিলিপাইনের আর্চবিশপ এবং ভ্যাটিকানের প্রচার বিভাগের প্রধান। এশিয়া থেকে পোপ হওয়ার আলোচনায় তার নাম উঠে এসেছে।
৩। কার্ডিনাল পিটার টার্কসন (৭৬) : ঘানার কার্ডিনাল এবং ভ্যাটিকানের শান্তি ও ন্যায়বিচার পরিষদের সাবেক প্রধান। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত পোপ হওয়ার দৌড়ে তিনি অভিজ্ঞ মুখ।
৪। কার্ডিনাল মাইকেল জের্নি (৭৮) : কানাডিয়ান জেসুইট এবং ভ্যাটিকানের অভিবাসন ও শরণার্থী বিভাগের প্রধান। সামাজিক ন্যায়বিচার ও পরিবেশগত সমস্যা সমাধানে তার শক্তিশালী ভূমিকা রয়েছে।
৫। কার্ডিনাল জোহান টোবিন (৭২) : নিউ জার্সির নেওয়ার্কের আর্চবিশপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্যাথলিক চার্চের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।
এদের পাশাপাশি আরও কয়েকজন প্রার্থীরাও নাম উঠে এসেছে। তারা হলেন—কার্ডিনাল মারিও গ্রেচ (৬৮), তিনি মাল্টার সিনড অফিসের প্রধান। হংকংয়ের বিশপ কার্ডিনাল স্টিফেন চৌ (৬৫), তার কূটনৈতিক দক্ষতার জন্য পরিচিত।
এছাড়া, জেরুজালেমের প্যাট্রিয়ার্ক ইতালীয় কার্ডিনাল পিয়েরবাত্তিস্তা পিজ্জাবাল্লা (৬০)। ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের সময় তার নেতৃত্বদানের দক্ষতার জন্য তিনি আলোচনায় রয়েছেন। ব্রাজিলিয়ান কার্ডিনাল জাইমি স্পেংলার (৬৪) ও নজর কাড়তে পারেন। তিনি ব্রাজিলিয়ান বিশপস কনফারেন্স এবং ল্যাটিন আমেরিকান এপিস্কোপাল কনফারেন্সে প্রধান নির্বাচিত হয়ে শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রমাণ দিয়েছেন।
পরবর্তী পোপ কে হবেন, তা সময়ই বলবে। তবে এটা স্পষ্ট যে, এই নির্বাচন ক্যাথলিক চার্চের ভবিষ্যতের গতিপথ নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।