জন্মশতবর্ষে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে স্মরণ
১.
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে বলা হয় বাংলাদেশের সাহিত্যে আধুনিক গদ্যের জনক। তিনি তার সুচিন্তিত মেধা এবং প্রজ্ঞায় নির্মাণ করেছেন বাংলার আধুনিক সাহিত্য ঐতিহ্যের এক বিশিষ্ট এবং গতিশীল ধারা। তিনি তার গভীর সাহিত্যিক অভিনিবেশ, অন্তর্দৃষ্টি এবং সৃষ্টিশীল ভাষার ব্যবহারে কথাশিল্পকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তুলেছিলেন। তিনি পাঠককে প্রভাবিত করেছিলেন তো বটেই, তার সাহিত্যে প্রভাবিত হয়েছেন আরও অনেক সাহিত্যিক।
দিন যত যাবে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উজ্জ্বলতা তত বাড়বে এবং এতে কোনো সংশয় নেই আগামী দিনেও ওয়ালীউল্লাহ বহুল পঠিত ও আলোচিত হবেন। সৃজনী জীবনশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জন্মশতবর্ষ (জন্ম: ১৫ আগস্ট ১৯২২- মৃত্যু: ১০ অক্টোবর ১৯৭১) চলতি বছরের ১৫ আগস্ট শুরু হলেও কোথাও কোনো উল্লেখযোগ্য আয়োজন নজরে আসেনি।
তবে মুক্ত চিন্তাচর্চার, আনন্দময় সহশিক্ষার সৃজনশীল আয়োজন ‘মঙ্গল আসর’-এর প্রতি সপ্তাহের নিয়মিত জুম আলোচনায় গত ১৮ অক্টোবর ২০২২ মঙ্গলবার রাত ৯.০০ টায় নানা দৃষ্টিকোণে জন্মশতবর্ষে স্মরণ করা হয় মুক্তচিন্তার সারথি, জীবনের সমগ্রতা-সন্ধানী বুননশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে।
২.
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কথাসাহিত্যিক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে অধিষ্ঠিত। মানুষের মনোবাস্তবতার সাথে বহির্বাস্তবতার মিশেল ঘটিয়ে বাস্তবধর্মী জীবননির্ভর কাহিনি নির্মাণের নিপুণ বুননশিল্পী হিসেবে তিনি অসাধারণ। অথচ মজার ব্যাপার হলো তার সৃষ্টিকর্ম একেবারে হাতে গোনা। তার রচনার পরিমাণ সংখ্যায় বেশি না হলেও প্রত্যেকটিই গুরুত্বপূর্ণ এবং দিক-উন্মোচনকারী। উপন্যাস, গল্প, নাটক-সর্বক্ষেত্রেই তিনি বিশিষ্টতার দাবিদার। জীবনকালের তিন দশক জুড়ে তিনি তার সৃষ্টিশীলতাকে সক্রিয় রেখেছিলেন। কিন্তু এই সময়ে তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা মাত্র ৯ (নয়), যা সংখ্যা বিচারে মোটেই সুপ্রচুর নয়। তার প্রকাশিত উপন্যাস: লালসালু, চাঁদের অমাবস্যা, কাঁদো নদী কাঁদো, কদর্য এশীয়। ছোটগল্পগ্রন্থ: নয়নচারা, জাহাজী, পরাজয়, মৃত্যু-যাত্রা, খুনী, রক্ত, খন্ড চাঁদের বক্রতায়, সেই পৃথিবী, দুই তীর ও অন্যান্য গল্প, দুই তীর, একটি তুলসী গাছের কাহিনী, পাগড়ী, কেরায়া, নিষ্ফল জীবন নিষ্ফল যাত্রা, গ্রীষ্মের ছুটি, মালেকা, স্তন, মতিন উদ্দিনের প্রেম ইত্যাদি। নাটক : বহিপীর ,উজানে মৃত্যু, সুড়ঙ্গ, তরঙ্গভঙ্গ। বাংলাদেশের উপন্যাসের ধারায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নিঃসন্দেহে উজ্জ্বল।
নাটক কিংবা ছোটগল্প রচনায়ও স্বাতন্ত্র্যসূচক ছাপ সুস্পষ্ট। সাহিত্যের সমঝদার হিসেবে ওয়ালীউল্লাহ আমাদের পছন্দের লেখক। কারও কাছে তিনি জাতশিল্পী। আধুনিক শিল্পাদর্শে, মতবাদগত তাৎপর্যে, প্রকরণ বিচারে কিংবা পাশ্চাত্য শিল্পরীতিকে এ দেশীয় সমাজ জীবনের অনুগামী করে শিল্প-বুননে কিংবা রূপায়ণে তিনি অনন্য।
তার লেখনশৈলী, দৃশ্য বিন্যাস ও গল্প নির্মাণের ধরণের ভিত্তিতে তাকে ভাষাশিল্পীও বলেছেন অনেক সমালোচক।
৩.
বাংলা কথাসাহিত্যের ‘নিঃসঙ্গ রাজপুত্র’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জন্মশতবর্ষ আমাদের তার রচনা, চেতনা গভীরভাবে স্পর্শ করে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও তিনি ছবির ব্যাকরণ আত্মস্থ করেছিলেন স্বভাববশত, আত্মপ্রচেষ্টায়- শখের বশে ছবি আঁকতেন। নিজ রচনার প্রচ্ছদও এঁকেছেন। ওয়ালীউল্লাহ জীবনের গভীর তলে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সমাজের অভ্যন্তরীণ নিগূঢ় সত্য, জীবনের অতলস্থ জীবন অর্থাৎ অস্তিত্বের মৌল সংকট এবং আধুনিক জীবনে সর্বত্রগামী মানবচেতনার অভাবনীয় প্রভাব কতটা কার্যকর তা আবিস্কার প্রয়াসী।
তার লেখনীতে উঠে এসেছে বাংলার সমাজব্যবস্থার ছবি। ছোট গল্পলেখক হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও পরবর্তীতে একজন সফল ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও তার লেখায় ফুটে উঠেছে সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া। এক্ষেত্রে তার সহায়ক হয়েছে তার জীবনদর্শন, যা তিনি অর্জন করেছিলেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাবার চাকুরির বদলির সুবাদে। পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে প্রখর রাজনীতি সচেতন কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নিবিড় একাত্ম বোধ করতেন। তার রচনায় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ধর্মকে ছাপিয়ে মনুষ্যত্ব তার রচনায় সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে গরিমাপূর্ণ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায়।
সমাজের অসংগতি, ধর্মীয় গোড়ামি,কুসংস্কার এসব চিত্রায়িত করেছেন তিনি নিপুণ লিখনীতে। তিনি তার সাহিত্যকর্মে ধর্মের নামে ভণ্ডামির বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার ছিলেন যা আজকের দিনেও সমান প্রাসঙ্গিক।
৪.
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সাহিত্যের মনস্তত্ত্ব নিয়ে আলোচনাকালে মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাশনা রশীদ বলেন, তিনি অস্তিত্ববাদ ও ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বকে সাহিত্যচর্চার বাহন করেছিলেন। অর্থাৎ এ দু’টি ছিল তার রচনার দার্শনিক ভিত্তি। প্রথমোক্তটি ছিল তার সমাজ মানুষের বিদ্যমান সামাজিক অস্তিত্বের সংকট, দ্বন্দ্ব ও আকাক্সক্ষা প্রকাশের মাধ্যম; অপরটি মনোজাগতিক বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কীরূপে অভিব্যক্তি পায় তার মাধ্যম। ব্যক্তিলোকের নিজস্ব উপলব্ধির সামগ্রিক তাৎপর্য প্রকাশে সচেতন ও সার্থক তিনি। সেইসাথে সৃষ্ট চরিত্রাবলীর মনোগত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সুনিপূণ উদঘাটনেও ছিলেন সফল শিল্পী। দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. বজলুর রহমান রফিক সাহিত্যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের প্রভাব বিষয়ে বলেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কোনো দার্শনিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাননি কিন্তু তার উপন্যাস বা গল্পে অস্তিত্ববাদই ভিত্তি হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তিনি জীবনকে যে গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তা আধুনিক দার্শনিক চেতনাকেই উপস্থাপন করে। সাহিত্য ও দার্শনিক নানা মতবাদ ও প্রবণতাও তার রচনায় দৃশ্যমান এবং যার প্রয়োগে তিনি সচেতন থেকেছেন সব সময় যেন উপন্যাস তার নান্দনিক কাঠামো ও মূল চরিত্র না হারায়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর রচনার সামগ্রিক দিকের মূল্যায়নক্যালে ভাসানটেক সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মাহমুদা খাতুন বলেন, পাশ্চাত্যের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গণে যে আঙ্গিকগত রূপান্তর ঘটেছে, সেই সমস্ত কলাকৌশল নিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাংলা সাহিত্যে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। তিনি সাহিত্যের আঙ্গিক পরিচর্যায় পাশ্চাত্য রীতিকে অনুসরণ করলেও বিষয়বস্তু বা পটভূমি নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশের শাশ্বত গ্রামীণ আবহকেই আশ্রয় করেছেন। বাংলাদেশের সমাজ পটভূমিতেই তিনি মানবমনের বিচিত্র ও অন্তর্গূঢ় পরিচয়কেও উদঘাটন করেছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ, চেতনা প্রবাহরীতি, এবসার্ডবাদের প্রবর্তক। আবার তিনিই প্রথম সাহিত্যে ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামি আর কুসংস্কারের বিরূদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামির ঘেরাটোপে আবদ্ধ অধ:পতিত সামাজিক জীবন এবং সেই সমাজের মানুষের জীবন-জিজ্ঞাসা, মানবীয় আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে তার সাহিত্য-কর্মে। তার লেখায় সমাজচেতনা স্পষ্ট হলেও ব্যক্তিচৈতন্য অর্থাৎ মানবচরিত্রের অন্তর্গত মানুষটিকেই তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
৫.
ওয়ালীউল্লাহর লেখনী ছিল স্বাতন্ত্র্য মণ্ডিত নিরন্তর সংশোধন, সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে তিনি তার লেখনীতে ব্যক্তি বিশিষ্টতা নির্মাণ করতেন। তার শিল্পী স্বভাবই ছিল এমন। তবে তিনি যা লিখতেন প্রাণের তাগিদেই লিখতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, স্বতঃস্ফূর্ততাই লেখকের মূল সম্পদ। যে-লেখায় স্বতঃস্ফুর্ততা নেই, তা লেখাই নয়।