দ্রাক্ষারসে উৎসারিত স্বাদু শরবত
‘পাখিরোষ’ নামে একটি ছোটগল্পের বই প্রকাশ হতে চলেছে। গল্পকার আশরাফ জুয়েল। তার আগে এর পাণ্ডুলিপি পাঠের সুযোগ হলো। সুযোগ না বলে সৌভাগ্য বলাই সম্ভবত শ্রেয়; এই কারণে যে পাণ্ডুলিপিটি পড়া না হলে বইটি পড়া হতো কি না, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না; যা দুর্ভাগ্যই হতো। কেননা, তাতে মিস করে যেতাম আকালে কিছু কালীন ফল ভোগের স্বাদ।
আশরাফ জুয়েলকে আগে পড়িনি, এমন নয়। তার পূর্বোক্ত গ্রন্থ না হলেও প্রথম শ্রেণির সাময়িকীতে প্রকাশিত কয়েকটি গল্প পড়েছি। একটি ধারণাও তৈরি আছে তার সম্পর্কে। কিন্তু ‘পাখিরোষ’ পাণ্ডুলিপির গল্পগুলো আগের ধারণাকে ভেঙে দিয়ে নতুন চিন্তায় দাঁড় করিয়েছে। সিরিয়াস, একটু কঠিন, প্রবল প্রতীকী অথচ স্পষ্ট, ঝরঝরা, কুলীন, কর্দমাক্ত সন্ধ্যা খুঁড়ে দিবালোকের নির্যাস তুলে আনার পূত প্রচেষ্টা। যেন কোমল কঠিন তুলি হাতে সমকাল ব্যবহারে যাপিত জীবনের মুখ আঁকা।
ছোটগল্পের ছক-ছবি-ছত্র নির্ণয় করে পাণ্ডিত্য প্রকাশের শক্তি আমার নেই; ভালোলাগার, খারাপলাগার অনুভূতিটুকু ব্যক্ত করার সামর্থ্য আছে বলে বলতে দ্বিধা নেই, পাণ্ডুলিপিটির পাঠ সন্তুষ্ট করেছে তার নিজগুণে, বৈশিষ্ট্যে, বিশিষ্টতায়। ক্ষয় ধরা রক্তিম, খুনি, ভণ্ড, ভণ্ডুল সময়কে নির্ভর করে নির্মিত নির্মাণ এই পাণ্ডুলিপির স্বতন্ত্র সারমর্ম। যা পাঠে নৈত্যিক দিনকে, রাতকে দেখা যায় আয়নার সমনে উপবিষ্ট হয়ে।
গল্পকারের ভাষ্যে আকারে-ইঙ্গিতে কোনো গল্প পরাবাস্তবতার আদলে অঙ্কিত, কোনো গল্পে জাদুবাস্তবতার অবিমিশ্র রেখা আঁকা। আবার কোনো গল্প ইশারাপ্রবণ। পাঠ করতে গিয়ে এমন উপমা-ইঙ্গিতের মুখোমুখি হতে হয়, আগে যা অধিত ছিল না অন্য কোথাও। হয়তো ছিলও। তবে উপস্থাপনের ভঙ্গি প্রাজ্ঞ মুন্সিয়ানার স্বাক্ষর রাখে। বাস্তবতার নিরিখে আঁকা যে গল্পটি, তাও রূঢ় বাস্তবতার বোতাম উন্মুখ করে চেনার ভেতর অচেনার গাম্ভীর্যে। যেখানে ছোট ছোট করে নোটের মতো বাক্য, যেখানে জীবন এক শিশিরবিন্দু, ফের চৈত্রের দাবানলে ঝরা লবণ ফোটা! যেন জীবনকে ছেড়ে যাওয়া দুরহ কর্মক্লান্তি কিংবা বহন করা এক নন্দিত নরক নিরিখ।
‘পাখিরোষ’ পাণ্ডুলিপিতে মোট গল্প দশটি। মনে করি, পাণ্ডুলিপিটিতে গল্পসংখ্যা যদি দুই, তিন বা চারও হতো, তাতে পাণ্ডুলিপিটির আবির এতটুকু ম্লান হতো না এই কারণে যে, এই পাণ্ডুলিপিটিতে ‘ছায়াসন্দেহ, ঘন বাতাসের সুলেখা, বিজ্ঞাপিত সুখ, পাখিরোষ, হত্যাখামার’ নামক চারটি সূক্ষ্ম সেলাইয়ের গল্প আছে। প্রকৃতপক্ষে একটি বইয়ে কয়টি ভালো লেখা হলে বইটিকে ভালো বলা যায়? খুব বেশি মনে হয় প্রয়োজন হয় না। দু-তিনটি হোঁচটহীন লেখা হলেই পাঠক খুশি থাকে। হোক তা গল্পের, কবিতার, প্রবন্ধের, ভ্রমণ বা অন্য গ্রন্ধ। আলোচিত বইটি যদি শুধু ‘পাখিরোষ ও হত্যাখামার’ গল্প দুটি নিয়ে প্রস্তুত হতো, তা হলেও এর কথা কথালাপে বলতাম গল্প দুটির প্রতি নির্মোহ ভালোলাগার হেতু। কোথাও যদি ছোটগল্প নিয়ে আড্ডা করি, অবশ্যই এই গল্পকারের এই দুটি ছোটগল্পের কথা টানব। কম সময়ে ভাবনায় অধিক জমিন দখল করে নেওয়ার দক্ষতার জন্যে। বাকি ‘সুখনিদ্রা পারত্যাজ্যে, জাগো মৃগরাজতেজে’, ‘একটি নোংরামূল্যের গল্প’, ‘গর্ভনাশ’, ‘এতো নিশ্চিত হইয়া মানুষ নিজের মৃত্যুকে খায় ক্যামনে’, অপ্রকাশিত ভাবনার কাফকা’ গল্প ছয়টি ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যাবে এমনটিও নয়। ভালোর মধ্যে ভালোর কথা টানতে এর স্থান পরে হলেও বিষয়ে ব্যতিক্রমী টান স্পর্শ করে এই গল্পগুলোর ভেতরে প্রবেশ করতে পারলে।
আশরাফ জুয়েল পূতচর্চার কল্লোলিত মানুষ; তার গল্প তার সম্পর্কে এ কথা স্বীকার করায়। স্বীকার করায় বলেই তার গল্পের গভীরে একটা চিৎকার ঘুরে বেড়ায়। হাহাকার হাউমাউ করে কাঁদে। সে কান্নাটা দিনক্ষয়ের কান্না। খুন হয়ে যাওয়ার পর সুজনের শক্ত কান্না। স্বজনের সব হারানোর শোকাচ্ছন্ন বেদনা। তার পর আজীবন তার রেশ বহন করে চলার যন্ত্রণা। এই যে আমাদের চারপাশ, বোবা পরিবেশ, বধির সমাজ, রাষ্ট্র, দেশ, উশৃঙ্খল পৃথিবী; এর বিপরীতে কী অমানবিক পোড়ন লতার মতো লতিয়ে উঠছে, কী অবক্ষয় ঘটছে, কতটা নিচে নেমে যাচ্ছে সভ্যতা, স্বচ্ছতা, সদাচরণ; তার কি কোনো খোঁজ আছে তাদের কাছে, যারা রোজ রক্তস্নান না করলে ঘুমাতে যেতে পারে না, নাশতার টেবিলে বসতে পারে না? খোঁজ কি আছে তাদের কাছে, যারা অনৈতিকতায় না মাতলে তাদের মাদল বাজে না? আশরাফ জুয়েল সেই চিত্রটা ভিন্ন ও বিভিন্ন ফর্মে চিহ্নিত করে এক মলাটের মধ্যে পরিবেশন করেছেন। পরিবেশনটা সবার সমান উপভোগ্য হবে এমন কথা নেই, কিন্তু অনেকের হবে বিশ্বাস।
তবে পাণ্ডুলিপিতে কয়েকটি ছেদ চোখে পড়েছে। দু-একটি গল্পের শিরোনাম সরলের দাবি রাখে। পরা ও জাদুবাস্তবতায় আরেকটু ঘনবুনন হলে ভালো। ইশারা যেন ইঙ্গিতের ঙ-এ বিলীন না হয়ে দৃষ্টির সীমায় থাকে, তার দিকে নজর ঋজু হওয়া উৎকৃষ্ট। তদতিরিক্ত আশরাফ জুয়েলের কথা বিন্যাস প্রশংসার। সাধুবাদ পাওয়ার। পাণ্ডুলিপি থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ‘পাখিরোষ’ বইটি পাঠকের সমাদর পাবে, বড় মুখ করে বলছি। সব ঠিক থাকলে বইটি প্রকাশ হবে ‘ঐতিহ্য’ প্রকাশনী থেকে।