জয়নুল আবেদিন, মানবাত্মায় ব্রহ্মপুত্রের সুশীতল জল

(শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মারা যান ১৯৭৬ সালের ২৮ মে। দিনটি স্মরণে বর্তমান রচনাটি শিল্পাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলিস্বরূপ ।)
ভরা বর্ষায় ব্রহ্মপুত্রের কল্লোলিত স্নিগ্ধ ঢেউয়ের মতো জয়নুল আবেদিন আমাদের শিল্পকলায় এসেছেন পাললিক আশীর্বাদ হয়ে। ফুল-ফল আর ভবিষ্যৎ রোপিত শিল্পাধারে ছড়িয়ে দিয়েছেন মায়া; মনন-কাননের রহস্যময়তায় মেখে দিয়েছেন মানবিকতার অনুরণন। জয়নুল আমাদের সেই কালোত্তীর্ণ প্রতিভা, যাঁর ছোঁয়ায় মরণকাঠিকে জীয়নকাঠিতে বদলের মতো বাংলার চিত্রশিল্প নতুন করে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠেছে। চিত্রশিল্পে নবপ্রাণের উদ্গাতা এই ক্ষণজন্মা শিল্পীকে আমরা বরণ করে নিয়েছি শিল্পাচার্য অভিধায়। প্রকৃত গুরুর মেধা, বুদ্ধিমত্তা এবং ভালোবাসায় তিনি শিখিয়েছেন শিল্পমানবতার বর্ণমালা।
’৪৩-এর দুর্ভিক্ষে কলকাতার অমানবিক পাষাণ শহরে তাঁর চিত্রপটে নেমে এসেছিল বুভুক্ষু মানুষের জন্য দয়ার্দ্র হৃদয়ের মর্মস্পর্শী রেখার টানে। সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠী যখন দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে তাদের খাদ্যভাণ্ডারকে ক্রমান্বয়ে স্ফীত করায় ব্যস্ত, বাংলার পথে-প্রান্তরে তখন ক্ষুধার ভয়াবহ দাপট। এসব বিদেশি বেনিয়া লুটেরার বিরুদ্ধে জয়নুলের ব্রাশের স্ট্রোক সপাং সপাং চাবুকের মতো বাজতে থাকে। জয়নুল আবেদিন তাঁর দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা সম্পর্কে নিজেই বলেছেন, ‘আমি দুর্ভিক্ষের দৃশ্যগুলো এঁকেছি প্রায় উন্মাদের মতো। কেন আমি এমন করেছিলাম? কেনই বা ওসব স্কেচ এঁকেছিলাম? ওটা আমার একটি ক্রুদ্ধ অভিব্যক্তি; একটি প্রতিবাদ। ওই সময়কার পরিস্থিতির বিরুদ্ধে, মানুষের ভয়াবহ ভোগান্তির বিরুদ্ধে আমার একটি বক্তব্য। আজও আমি ভাবি সেই দুর্ভিক্ষের কথা, যা ছিল মানুষেরই তৈরি।...আমি কখনই আমার পারিপার্শ্বিকতা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারি না।’ দুর্ভিক্ষের ছবিগুলো থেকেই আমরা পেয়ে যাই এক আশ্চর্য ক্ষমতাধর শিল্পীর সন্ধান, জয়নুল তখন ২৯ বছর বয়সের টগবগে তরুণ। তারুণ্যের এমন শৈল্পিক বিদ্রোহ কেবল বাংলা নয়, বিশ্বশিল্পের ইতিহাসেই বিরল দৃষ্টান্ত। ১৮০৮ সালে বিখ্যাত শিল্পী ফ্রান্সিসকো দ্য গ্যয়ার ‘দ্য থার্ড অফ মে’, ১৮৯৩ সালে এডওয়ার্ড মুঙ্কের ‘দ্য স্ক্রিম’ অথবা ১৯৩৭ সালে পাবলো পিকাসোর ‘গুয়ের্নিকা’, বিশ্বশিল্পের এমন বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলো সামনে নিয়ে যদি আমরা জয়নুলের দুর্ভিক্ষের চিত্রমালাকে পর্যবেক্ষণ করি, তাতে জয়নুলকে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পরিয়ে দিতে কুণ্ঠা থাকার কথা নয়।
কুণ্ঠা যদি কিছু থাকে, আমাদের বিবেচনায় সেটি শিল্পমানের জন্য নয়, বরং সেই কুণ্ঠার জন্মভূমি উপনিবেশিত মননের ফসল। আমরা নিজেদের শিল্পী-শিল্পকর্ম বা অন্য কোনো কৃতিত্ব-ঐতিহ্যকে পশ্চিমের শিখিয়ে দেওয়া মানদণ্ডে যখন মূল্যায়ন করতে যাই, তখন বুঝে অথবা না বুঝে শুরুতেই নিজেদের অবমূল্যায়িত বা অধস্তনতাকে প্রতিষ্ঠিত করি। জয়নুলের শিল্প বিচারেও আমাদের আলোচক-সমালোচকদের এই অবস্থান দেখা যায়; তার শিল্পকর্মকে যখন রিয়েলিজম ইম্প্রেশনিজম এক্সপ্রেশনিজমের পাল্লায় মাপা হয়, তখন জয়নুলকে বোঝা দুরূহ হয়ে ওঠে। পাশ্চাত্যের অধিকাংশ ইজমই মূলত ল্যাঙ্গুয়েজ ডেভেলপমেন্ট, বর্ণমালার বিবিধ বিন্যাস; সেখানে বিশেষ কোনো ভাব অথবা বক্তব্যের স্থান নেই।
জয়নুল আবেদিন সেই ভাষা রপ্ত করেছিলেন বটে, কিন্তু তিনি সেই বর্ণমালার অর্থহীন বুনন অথবা কম্পোজিশন করেননি। তাঁর কাজে আমরা সুনির্দিষ্ট ভাব-বক্তব্য-দায়বদ্ধতার প্রকাশ দেখতে পাই, তার মাটি-মানুষ-জল-ভূগোলকে খুঁজে পাই, তার আত্মার গভীরতা, অন্তরের বিস্তৃতিকে অনুভব করা যায়। তাই জয়নুলকে বোঝার জন্য পাশ্চাত্য পদ্ধতি যথেষ্ট নয়, তাকে বোঝার জন্য প্রাচ্য দর্শনের দ্বারস্থ হতে হবে। মানুষের দ্বৈতাদ্বৈত সত্তা, শরীর ও মনকে যেমন একীভূত করে দেখতে হয়, তাঁর শিল্পকর্মকেও ভেতর-বাহির আলাদা করে দেখলে ভুল হওয়াটা অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। তাঁর সাবজেক্ট-ফর্ম-কনটেন্ট, কম্পোজিশন, দক্ষতা, অভিব্যক্তি কোনো দিক থেকেই অবমূল্যায়নের সুযোগ নেই। নান্দনিক বিবেচনায় যদি সাবলাইমের প্রসঙ্গ আসে, তাতে অবলীলায় জয়নুল আবেদিনের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা যায়।
জয়নুল আবেদিন তাঁর শৈল্পিক মানবতাবোধ, স্বাদেশিকতা এবং স্বজাতি-স্বজনের প্রতি দায়কে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন বহুমাত্রিক কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে। প্রথমত, তিনি চিত্রশিল্পী, তাই তাঁর যাবতীয় অভিব্যক্তির প্রকাশ মুখ্যত চিত্রকলা মাধ্যমে। ’৪৭-এ দেশভাগের পর তিনি প্রথমেই শিল্পশিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠান নির্মাণে মনোযোগ দেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় গড়ে তোলেন স্বাধীন বাংলার প্রথম আর্ট স্কুল ‘গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস’। প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পেছনে তাঁর সহযোগী শিল্পীদেরও ছিল উদ্যমী ভূমিকা। জয়নুল অনুধাবন করেছেন, এ অঞ্চলের মানুষের জন্য শিল্পশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা শিল্পী হলে তিনি কলকাতায়ই থেকে যেতে পারতেন, ভারত বিভাজনের সময়ে তিনি ছিলেন কলকাতা আর্ট কলেজের স্বনামধন্য শিক্ষক। কিন্তু তিনি পূর্ববঙ্গের মানুষ, তার রক্তপ্রবাহে ব্রহ্মপুত্রের সঞ্জীবনী ধারার উত্তাল তরঙ্গ খেলা করে, শ্যামল প্রকৃতির মায়াময় আহ্বান তিনি উপেক্ষা করতে পারেন না। তিনি ফিরে এসেছেন তাঁর আত্মার নবগঠিত বিষণ কুটিরের সদর দরজায় এবং দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন তাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে হাস্যোজ্জ্বল আনন্দময় করে তোলার।
১৯৬৯ সালে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের প্রবল আক্রমণে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা। লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু, অসংখ্য গবাদিপশুর প্রাণহানি, বিপুল পরিমাণ ফসলের ক্ষতিসহ কয়েকটি দ্বীপ পানিতে সম্পূর্ণ তলিয়ে যায়। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার অসহায়-বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কোনো তাগিদ বোধ করেনি। মানবতার এমন দুঃসময়ে জয়নুল আবেদিনের শিল্পীসত্তা অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। জলোচ্ছ্বাসের পরপরই তিনি উপকূলবর্তী এলাকায় ছুটে যান। তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময় কলকাতার পথে পথে দুর্ভিক্ষপীড়িত অসহায় মানুষের আর্তিতে বাতাস যেমন ভারী হয়ে উঠেছিল, সমুদ্র তীরবর্তী মনপুরায়ও তেমন বিকৃত গলিত শবদেহের সঙ্গে অর্ধমৃত সহায়-সম্বলহীন, খাদ্য-বস্ত্র-আশ্রয়হীন নিঃশেষিত মানুষের পক্ষে ক্ষুরধার হয়ে ওঠে তার চিত্রপট; সৃষ্টি হয় কালজয়ী স্ক্রল পেইন্টিং ‘মনপুরা’। মহাপ্রলয়ে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া মানুষ, গরু-মহিষ, ঘরবাড়ি, পশু-পাখি সব চরাচর যেন স্তূপাকার হয়ে পড়ে আছে এক সুবিশাল মৃত্যুপুরীর মতো; চিত্রপটের সর্বশেষ প্রান্তে একমাত্র জীবিত মানুষ হাঁটুতে মুখ গুঁজে অব্যক্ত হাহাকারের কুণ্ডলী হয়ে বসে আছে। বিস্তীর্ণ মৃত্যু উপত্যকায় ভবিষ্যতের হাল ধরার বিপর্যস্ত নাবিক।
জয়নুল আবেদিন আমাদের দিশাহীন চিত্রশিল্পকে সুদক্ষ নাবিকের মতো ফিরিয়ে এনেছেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত মৃত্তিকা বন্দরে। বাংলার শিল্পী-সাহিত্যিক, জ্ঞানী-গুণী বুদ্ধিজীবী মহলে তিনি একটি বার্তা পৌঁছে দিলেন যে, বাংলাই হওয়া উচিত আমাদের চিন্তা-চেতনা ও প্রেরণার কেন্দ্রভূমি। তিনি এক অভিভাষণে বলেন, ‘বাংলাদেশ সত্যিই এক অতি সুন্দর দেশ। এ রকমটি বলছি শুধু এ জন্যই নয় যে, বাংলাদেশ আমার নিজের দেশ। আমার মতো ভ্রমণ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন শিল্পীর পক্ষে যতটা বস্তুনিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব, আমি ততটাই নিরপেক্ষ হতে চেষ্টা করছি। এ দেশের প্রকৃতিতে নিশ্চয়ই বিশেষ একটা কিছু রয়েছে। তা যদি না হতো, তাহলে এখানে কী করে এত সব মহান সংগীতজ্ঞ, কবি-সাহিত্যিক আর শিল্পী সৃষ্টি হলো। এ দেশের মাটি শুধু অসংখ্য শিল্পীর জন্ম দিয়েছে তাই নয়, একই সঙ্গে যুগ যুগ ধরে আকর্ষণ করেছে বহু বিদেশি গুণীজনকে। শত শত বছর থেকেই অসংখ্য বিদেশি পর্যটক, অভিযাত্রী ও গুণগ্রাহী এ দেশে এসেছেন। এ দেশের প্রেমে বন্দী হয়েছেন এবং এ দেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। আমি নিশ্চিত, ভবিষ্যতেও বহু বিদেশি এ দেশে আসতে থাকবেন। তাঁরা জানতে চাইবেন, কী আছে এখানে, যা শৈল্পিক এক জাতি সৃষ্টি করে?’ জয়নুল আবেদিন বর্ণিত এই শৈল্পিক জাতিরই উচ্চতর প্রতিনিধি তিনি স্বয়ং। তাঁর কাছে আমাদের রুচিশীলতার অশেষ ঋণ। একজন জয়নুল তাঁর জীবনব্যাপী কর্মযজ্ঞ, মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি অপরিসীম ভালোবাসার উদাহরণ হিসেবেই অক্ষয়, অমর হয়ে থাকবেন।