গল্প
পারফিউম

এক
পারফিউমের খুব পরিচিত ভীষণ মিষ্টি একটা গন্ধের উৎস খুঁজতে গিয়ে অনু ভদ্রমহিলাকে প্রথম দেখল। ক্যাপসুল লিফটে ওর প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। পরনে সরু পাড়ের সস্তা ধরনের মাড়হীন তাঁতের শাড়ি। চেহারায় কোনো বিশেষত্ব নেই, তবে জি বাংলায় আসক্ত অন্য দশটা সাধারণ বাঙালি রমণীর মতো সুখী সুখী মধুবালা ধরনেরও নয়। নাটবোল্ট দিয়ে জোড়া লাগানো ধাতব কাঠামোর ন্যায় ঋজু শরীর। লিফটের গায়ে জ্বলে ওঠা নম্বরগুলোর দিকে ক্লান্ত চোখ দুটি নিবদ্ধ করে রেখেছিল। ভদ্রমহিলা সাততলায় নেমে গেলে পারফিউমের নামটি অনুর জানা হয়নি।
দুদিন বাদেই বাংলা নববর্ষ। একটা দিন বাঙালি সাজার জন্য কয়েক মাস ধরে মানুষের প্রস্তুতি চলছে। বিপণিবিতানগুলো সুযোগ বুঝে তাদের পুরোনো পসারে নতুন মূল্যের ট্যাগ ঝুলিয়ে দিয়েছে।
এমনিতে জিন্স, টি-শার্ট, পাকিস্তানি লন, ভারতীয় মণিপুরি বা পশ্চিমার আঁটসাঁট টপস-লেগিংসে অভ্যস্ত হলেও বাংলা নববর্ষে দেশীয় শাড়ি-চুড়িতে একদিনের বাঙালি সাজা হালের ফ্যাশন।
আজ ছুটিবার। আটতলা পর্যন্ত বিশাল মার্কেটে মানুষ গিজগিজ করছে। বিশেষ করে লোকজ পোশাকে সমৃদ্ধ শোরুমগুলো নারী-পুরুষে বোঝাই। অনু টাইডাইয়ের ওপর সুতির কাজ করা একটি শাড়ি দেখছিল। মূল্য ট্যাগ দেখে চোখ কপালে উঠল। কাজ ছাড়া টাঙ্গাইল শাড়িটার দাম বড়জোর আটশ টাকা হবে। তাতে পাড় আর আঁচলে একটু সুচ ছুঁয়ে দাম হাঁকিয়েছে চার হাজার পাঁচশ।
অনুর অত বড় বাজেট নেই। অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করে সে আড়াই হাজার টাকায় একটি শাড়ি কিনে কাউন্টারের সামনে দাঁড়াল। লম্বা কিউ ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। লিফটের সেই পারফিউমওয়ালি ভদ্রমহিলা অনুর ঠিক সামনে, হাতে বাচ্চাদের অনেক পোশাক। পারফিউমের গন্ধটা ওকে বিবশ করে ফেলছে। এত পরিচিত গন্ধ অথচ নাম মনে করতে পারছে না। নামটি জিজ্ঞেস করবে কি না যখন সে ভাবছে, তখন ভদ্রমহিলা নিজেই ঘুরে তাকায়—
অনুপমা আমাকে চিনতে পেরেছ?
অনুর পুরো নাম অনুপমা নূর। তার স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর, কিন্তু এই চেহারা কোথাও কখনো দেখেছে বলে স্মরণ করতে পারছে না।
অনুর বিভ্রান্ত চেহারা দেখে ভদ্রমহিলার কপালে বিস্ময়ের ভাঁজ পড়ে।
আমাকেই ভুলে গেলে? মনে করে দেখ, যশোর বেগম রোকেয়া কলেজ হোস্টেল। রুম নম্বর ১০৫। মিলা, অনু, রিমা, রুবা ছাড়াও আর একজন ছিল।
অনুর সামনে ঝুপ করে নব্বই দশকের দুটি বছর নেমে আসে। ওর মুখ থেকে সমস্ত রক্ত উধাও হয়ে গেছে।
লুবনা...!
দুই
সে সময়ে মেয়েদের কলেজ হিসেবে যশোর বেগম রোকেয়া কলেজের বেশ নামডাক। দূর-দূরান্ত থেকে মেয়েরা হোস্টেলে লেখাপড়া করতে আসে। লিখিত মৌখিকের বৈতরণী পেরিয়ে বহু অ্যাপ্লিক্যান্টকে পেছনে ফেলে তবেই ছাত্রী হোস্টেলে জায়গা পাওয়া গিয়েছিল। যেদিন অনু ছাত্রীনিবাসের ১০৫ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করেছিল, সেদিনই প্রথম লুবনার সঙ্গে পরিচয় হয়। খাটের পাশে চেয়ারে অসহায় ভঙ্গিতে বসে ছিল। পায়ের কাছে বিশাল দুটি স্যুটকেস, আট ইঞ্চি পুরু ফোমের সঙ্গে তোশক, ফ্লাস্ক, ইস্ত্রিসহ রাজ্যের জিনিস!
রুমের আর তিনটি সিটে তখনো কেউ আসেনি। অনুপমা নিজের বিছানা-টেবিল গুছিয়ে যখন খাটে বসে শুকনো বিস্কিট খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন হাই হিলের খটখট আওয়াজ তুলে মেয়েটি কাছে আসে।
তোমার নাম কী?
অনুপমা। তোমার?
লুবনা ফয়েজ চৌধুরী। আমাকে একটু হেল্প করবে প্লিজ?
প্রথম পরিচয়েই হেল্প? অনুপমা একটু অবাক হয়ে বলেছিল, কী করতে হবে বলো?
আমার সঙ্গে জিনিসগুলো একটু গুছিয়ে দেবে?
লুবনা সাধারণ মেয়েদের তুলনায় দীর্ঘাঙ্গী। তার ওপর তিন ইঞ্চি ক্ষুরতোলা স্যান্ডেলের কারণে আরো বেশি লম্বা লাগছে। এককথায় চেহারা আর পোশাক-পরিচ্ছদে রাজনন্দিনী।
দুজন মিলে বিছানা, স্যুটকেস ইত্যাদি গোছগাছ করার ফাঁকে দুজন দুজনের প্রোফাইল আদান-প্রদান করে ফেলল। যশোরের সবচেয়ে নামকরা ডাক্তার ফয়েজ চৌধুরী লুবনার বাবা। এই শহরের মেয়ে হয়ে হোস্টেলে কেন এলো, সে প্রশ্ন মনে জাগলেও অনু কিছু জানতে চায়নি।
পরদিন মিলা, রুবা ও রিমা যার যার সিট দখল করে উঠলে ১০৫ নম্বর রুম স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। মেয়েদের মধ্যে খাতির হতে সময় লাগে না। খুব দ্রুত তারা বাড়ি থেকে আনা লাড্ডুটা, আচারটা ভাগাভাগি করে একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলল। কিন্তু লুবনা নিজেকে ওদের কাছে ঠিক বন্ধুভাবে মেলে ধরতে পারছিল না। নিজেকে একটু আলাদা করে গুটিয়ে রাখে। বাঁচিয়ে চলে।
নামের পাশে বাপের বিখ্যাত নামের তকমা, অর্থ, সৌন্দর্য সব দিক বিবেচনায় সে অন্যদের চেয়ে সিঁড়ির কয়েক ধাপ ওপরের মানুষ। এ বিষয়ে অতি সচেতনতা তাকে হয়তো দূরে রেখেছিল। দেমাগি ভেবে অন্য মেয়েরাও আগ বাড়িয়ে তার সঙ্গে ভাব করতে যায়নি।
একদিন রাত বেশ গভীর। সবাই যার যার বিছানায় ঘুমাচ্ছে। কী কারণে যেন অনুর ঘুম ভেঙে গেল। তখন শুনল, লুবনা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কাছে গিয়ে আলতো করে গায়ে হাত রেখে বলল,
কী হয়েছে লুবনা?
মাকে মনে পড়ছে।
মায়ের কথা শুনে অনুর চোখ ছলছল করে। কত দিন হলো মায়ের সঙ্গে দেখা হয়নি। ও সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
আমাদের সকলের মা-ই তো দূরে, তাই না? ঘুমাও।
লুবনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,
আমার মা দুনিয়াতেই নেই !
অনু কিছু সময়ের জন্য বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। মাত্র তিন মাস আগে ওর মা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। বাবা সারা দিন চেম্বারে ব্যস্ত থাকেন। বাসায় একা মেয়েকে রাখার সাহস পাননি, তাই হোস্টেলে পাঠিয়েছেন।
পরদিন থেকেই রুমে লুবনার অবস্থান বদলে গিয়েছিল। রুবা বা রিমা কেউই আর আড়ালে বলেনি দেমাগি; বরং আগ বেড়ে ওর মনকে ছুঁতে চেয়েছিল বারবার। অনু হয়ে উঠল লুবনার আত্মার আত্মীয়।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে লুবনাকে নিতে ওর বাড়ি থেকে গাড়ি আসত। একবার লুবনা অনুকে প্রায় জোর করে ওদের বাড়িতে নিয়ে গেল।
অনুর বাবা ধনী না হলেও বেশ সচ্ছল। কিন্তু লুবনার বাড়িতে এসে যেটা দেখল, সেটা সে শুধু সিনেমায় দেখেছে। ঢাকা-যশোর হাইওয়ের পাশ ঘেঁষে অত্যাধুনিক বাংলো টাইপের বিশাল বাড়ি। উঁচু লোহার গেটে সেকেলে রাজা-বাদশাহর প্রাসাদরক্ষীর মতো উর্দি পরা দারোয়ান। গেট থেকে ব্রিক সোলিং করা রাস্তার দুপাশে বাহারি ফুলের বাগান। মাঝেমধ্যে ছোট ছোট লাইটপোস্ট। সিমেন্টের তৈরি ছাতার ছাউনির নিচে বসার চেয়ার।
অনু মুগ্ধ হয়ে এসব দেখতে দেখতে ওদের মূল বাংলোয় ঢোকে। নিচের তলায় বিশাল হলরুম। ঝাড়বাতি, রং-বেরঙের ঝালরে বিদেশি স্টাইলে সাজানো হিমঠান্ডা ঘর। একপাশের ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে ওরা দোতলায় লুবনার রুমে উঠে আসে। ঘরজুড়ে ভারী কার্পেট। ওয়ালে গোলাপি রঙের পেইন্টের মধ্যে নীল নীল তারা জ্বলছে।
লুবনা বলে,
This is my heaven
অনু স্বগতোক্তি করে—
"Heaven"—is what I cannot reach!
তখন রাত প্রায় ১০টা। লুবনার খাটের স্প্রিংওয়ালা নরম গদির মধ্যে শরীর ডুবিয়ে দুই বান্ধবী গল্প করছিল। এমন সময় দরজায় নক হলো,
আমার মা জননী কই?
ভরা পুরুষ কণ্ঠে ঘর গমগম করছে।
বাপী এসেছে, অনু ওঠ।
বাপী, তুমি এত দেরি করলে কেন? তুমি জানতে না আজ আমি আসব?
সরি মা, চেম্বারে প্রচুর রোগী ছিল। কিন্তু তুমি মনে হচ্ছে এবারো ওয়েট লস করে এসেছ।
আহ বাবা! কী যে বলো না। লস কোথায়? বল গেইন করেছি। আমার ওয়েট দুই পাউন্ড বেড়েছে।
অনু একপাশে দাঁড়িয়ে বাবা-মেয়ের সংলাপ শুনছিল।
ভাবনায় ছিল, লুবনার বাবাও অনুর প্রফেসর বাবার মতো রাশভারী বয়স্ক, আপাদমস্তক ভদ্রলোক হবেন। যার পরনে স্যুট-টাই থাকবে, মুখে পাইপ। কিন্তু ডাক্তার ফয়েজ চৌধুরীকে লুবনার বড় ভাই বলে অনায়াসে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে। পাকা মরিচ রঙের টি-শার্টে যুবক যুবক লাগছে। মাথায় ব্যাক ব্রাশ করা ঘন কালো চকচকে চুল। সম্ভবত জেল লাগানো। পৌরুষদীপ্ত চেহারায় যে ধরনের কাঠিন্য রয়েছে, সেটা সুঠাম দেহের সঙ্গে চমৎকার মানিয়ে গেছে।
বাবা, ও অনুপমা। আমার রুমমেট, বন্ধু।
লুবনা পরিচয় করিয়ে দিলে ডাক্তার ফয়েজ আহমেদ অনুর দিকে তাকালেন। অনু একবার তাকিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। চাপা রহস্যে বিচ্ছুরিত এই পুরুষ চোখে অন্য রকম কিছু আছে, যেটার সঙ্গে ওর আজ প্রথম পরিচয়।
অনুপমা! চমৎকার নাম। তোমার বন্ধু তো আফ্রোদিতির মতো সুন্দর। গ্রিক দেবী আফ্রোদিতিকে চেন অনু?
সবাই ওকে অনু ডাকে, তবুও ফয়েজ চৌধুরীর মুখে নামটা শুনে শরীরে শিহরণ উঠল কেন? মুখে লাল আভা।
আরে, তুমি দেখি লজ্জা পেয়েছ। হা হা হা! আচ্ছা, তোমরা খাবার টেবিলে বসো, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
লুবনার বাবা সম্প্রতি একটি মেডিকেল কনফারেন্সে জার্মান থেকে ঘুরে এসেছেন। খাবার টেবিলে তিনি সেসব গল্প শোনাচ্ছিলেন। অনুর মনে হলো, এত সুন্দরভাবে এত আকর্ষণীয় করে কেউ গল্প করতে পারে না। ও মোহাবিষ্ট হয়ে শুনছিল।
প্লেটে মাংসের টুকরো তুলে দিতে গিয়ে অনুর হাতটিকে তিনি অসাবধানতাবশত ছুঁয়ে ফেলেছিলেন, আর তাতেই ওর শরীরজুড়ে অভূতপূর্ব আনন্দ ঘণ্টি বেজে উঠল।
কিন্তু আমেজটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। অকস্মাৎ অনুতাপে মন ছেয়ে গিয়েছিল। এ কী ভাবছে সে? বন্ধুর বাবা তো তার বাবারই সমান। ছি ছি! পোলাও-রোস্ট মাটির দলার মতো গলায় আটকে যেতে থাকে। কিছুতেই ভেতরে ঢুকছে না। মাথা উঁচু করতেও পারছে না। পাছে ওর মনের ভাবনাগুলো সামনের দুজন জেনে ফেলে।
এই অনু, খাচ্ছিস না কেন?
এই তো খাচ্ছি।
লুবনার কথায় মাথা গুঁজে কোনোরকমে খাবারগুলো গিলে সে দ্রুত উঠে পড়ে।
সে রাতে অনু দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি। আঠারো বছর বয়সের মেয়ে হয়ে কীভাবে বাবার বয়সী একজনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। লুবনার বাবাকে সে একবারের জন্য চাচা বা আঙ্কেল অ্যাড্রেস করেনি। নিজের ওপর ঘৃণায় মন রি রি করছে।
পরদিন কাকডাকা ভোরে অনু লুবনাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলেছিল,
আমি হোস্টেলে চলে যাচ্ছি। তুই পরে আসিস।
লুবনা চোখ খোলার আগেই ঘোর কাটা মাতালের মতো প্রাসাদসম বাড়ি থেকে অনু বেরিয়ে এসেছিল।
তিন
অনু চল, কোথাও বসি।
লুবনার কথায় অনু বর্তমানে ফিরে আসে।
ফুডকোর্টে দুজনে দুটো চেয়ার দখল করে মুখোমুখি বসেছে। এই লুবনাকে একসময় কত খুঁজেছে। আজ সামনে অথচ কোনো প্রয়োজন নেই। অনুর ভেতরে ভাংচুর চলছে। সে বুঝতে পারছে না, লুবনা আজ কোন পথে এগোবে।
কী খাবে?
লুবনা নীরবতা ভাঙে।
তোমার যেটা ইচ্ছা।
লুবনা স্যান্ডউইচ আর কফির অর্ডার দিয়ে আসে।
এত দিন কোথায় ছিলে? এবার অনুই লুবনাকে প্রশ্ন করে।
জেনে কী হবে? বেঁচে যখন আছি, তখন নিশ্চয়ই কোথাও ছিলাম।
সেদিন তো আমাকে কোনো কৈফিয়ত দেওয়ারই সুযোগ দাওনি।
আমি তো কৈফিয়ত চাইনি। শুধু তোমাদের মাঝ থেকে সরে গিয়েছিলাম।
বিয়ে করেছ?
তোমাদের দেখার পর বিয়ের প্রতি বিদ্বেষ ছাড়া কিছু নেই।
এখনো এত ঘৃণা করো?
হ্যাঁ।
তাহলে ডাকলে কেন?
জানি না, হঠাৎ দেখা হলো, সামলাতে পারিনি হয়তো।
বাচ্চাদের জন্য অনেক কাপড় কিনেছ দেখলাম।
অরফানেজের বেবিদের জন্য।
অরফানেজে কাজ করো?
হু।
বাবার কথা জানতে চাও না?
এই প্রশ্নের জবাবে লুবনা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে অনুর দিকে তাকায়।
ওর দীঘল কালো চোখে টলটলে নীল সমুদ্র।
অনুর বিবমিষা ভাব হয়। লুবনার সামনে নিজেকে ক্ষুদ্র কীটের মতো মনে হচ্ছে।
চার
সেদিন ভোরে লুবনার বাড়ি থেকে নেশা কেটে যাওয়া মাতালের মতো ফিরে এসেছিল সত্য, কিন্তু অনুর মনের সেই রি রি করা ঘৃণা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। পিতার বয়সী ভদ্রলোকটি কোনো এক মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বলে ওকে ক্রমাগত কাছে টানছিল। সেই দুর্দমনীয় আকর্ষণকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা অনুর ছিল না। ফলে পরের সপ্তাহে সে আবার লুবনার সঙ্গী হয়ে ওদের বাড়িতে গিয়েছিল।
অনুকে দেখে এবার ফয়েজ চৌধুরীর চোখের রহস্য অনেকটাই উন্মোচিত হলো।
গাঢ় করে নিচু স্বরে বলেছিল, শোন আফ্রোদিতি, আমার মনে হয়েছিল তুমি আজ আসবে। আমি খুব খুশি হয়েছি। থ্যাংকস।
একটুখানি নিচু স্বর, কিন্তু এ যে নিষিদ্ধ মধুবচন! অনু আমূল কেঁপে ওঠে।
সে রাতে লুবনা ঘুমিয়ে পড়লেও ওরা ঘুমায়নি। লিভিং স্পেসে টিভি দেখতে দেখতে দেশ-বিদেশের নানা গল্পে ডুবে গিয়েছিল। অনু বুঝতে পারছিল, জাদুর অদৃশ্য জালে ও আটকে পড়েছে। ওর প্রজাপতি মন নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে অবিরাম ঘুরতে থাকে। সেখান থেকে বেরোনোর কোনো পথ ওর জানা নেই।
হোস্টেল থেকে মেয়েদের বের হওয়া বেশ কঠিন ছিল। নিয়মের খুব কড়াকড়ি। কিন্তু নিয়ম যেখানে থাকে, সেখানে নিয়মের ফাঁকও থাকে। অনু আরো অনেক মেয়ের মতো দারোয়ান মামাকে হাত করে নিল। ফয়েজ চৌধুরীর চেম্বার আর বাসা হয়ে উঠল ওর তীর্থস্থান।
ফয়েজ চৌধুরীর স্ত্রী গত হয়েছে বছর ঘুরেছে। ইতোমধ্যে কিছু আত্মীয়-শুভাকাঙ্ক্ষী কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার ভার কমাতে তার দ্বারস্থ হয়েছিল। কিন্তু এত বড় মেয়ে ঘরে রেখে বিয়ে? লোকে কী বলবে? অথচ অনু মেয়েটি এসে সব হিসাব উল্টেপাল্টে দিয়েছে। হাঁটুর সমান বয়সী মেয়েকে বিয়ে করলে সমাজ কী বলবে, সেটা এখন মামুলি। তার চিন্তা একটাই, লুবনা অনুকে বাবার স্ত্রী হিসেবে মেনে নেবে কি না।
আর অনু? ফয়েজ চৌধুরীর বাংলোর দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত দারোয়ান তাকে দেখে সসম্মানে সালাম করে। বাড়ির ঝি দৌড়ে এসে জানতে চায়, সে কী খাবে। নিজেকে রানীমহলের মহারানী ভাবতে শুরু করেছিল। এতবড় নামকরা একজন ডাক্তার শুধু তার জন্য চেম্বার বাদ দিয়ে বাসায় অপেক্ষা করছে ভাবতেই এক অনির্বচনীয় সুখে শরীর-মন আচ্ছন্ন হয়ে যেত। একজন বালিকার প্রতি পরিণত পুরুষের যে প্রশ্রয়, সেটা মায়ার মতো ওকে অষ্টপ্রহর ঘিরে রেখেছিল।
সবকিছু ভালোই চলছিল, কিন্তু এক রোববারে লুবনা বাড়ি থেকে ফিরে গম্ভীর মুখে ওকে প্রশ্ন করল,
একটা সত্যি কথা বল, তুই কি এর মধ্যে আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলি?
কী বলিস এসব? তোকে ছাড়া কেন যাব?
কিন্তু মালী কাকা বলল, বাপীর সঙ্গে তোকে দেখেছে।
ছি! ওই বুড়ো পুরো মিথ্যাবাদী। তোদের বাসায় যাব আর তুই জানবি না?
লুবনা কথা বাড়ায়নি। অনু ভেবেছিল, লুবনাকে সে বিশ্বাস করাতে পেরেছে। কিন্তু সে জানত না, ইতোমধ্যে হোস্টেলজুড়ে তার নামে চর্চা শুরু হয়ে গেছে। ওর শরীরে জমা বাড়তি মেদ, স্বপ্নকাতর চোখ, উড়ু উড়ু মন সবকিছুর মধ্যে বড় রকমের পরিবর্তনের আভাস ছিল।
অনুর অন্তঃকরণ এত বেশি মোহাবিষ্ট ছিল যে, তার প্রতি মেয়েদের বাঁকা দৃষ্টি বা ছুটে আসা বক্রোক্তি সবকিছুই নজরের আওতামুক্ত থেকে যাচ্ছিল। আর এ জন্য সবাই যখন ক্লাসে ব্যস্ত, সেই ভরদুপুরে অনু ফয়েজ চৌধুরীর বাংলোর দিকে রওনা হলো।
কে জেনেছিল, চরের মতো লুবনা ও মিলা ওর পিছু নেবে। লিভিং প্লেসের ডিভানে তখন ও আর ফয়েজ চৌধুরী। ভিসিআরে একটা রোমান্টিক ইংলিশ মুভি চলছে, কিন্তু সেদিকে কারো মনোযোগ নেই। টি টেবিলে টাটকা কমলার জুস সেভাবেই পড়ে রয়েছে। অনু মনে মনে ভাবছিল, এখানে তার অমরাবতী। এটিই দেবালয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সে দেবালয় থেকে মর্ত্যে ছিটকে পড়ে।
সামনে লুবনা ও মিলা। লুবনার চোখ বিস্ফারিত, মিলার মুখে চটুল হাসি। ফয়েজ চৌধুরী দ্রুত সামলে নিয়ে মেয়ের দিকে এগোয়,
লুবনা! তুই কখন এলি মা?
খবরদার, আমাকে মা বলবে না? ছি! শেষ পর্যন্ত মেয়ের বয়সী মেয়ের সঙ্গেই?
লুবনা, একটু শান্ত হও। আমার কথা শোন, আমি তোমাকে সব খুলে বলছি। সময় হলে তোমাকে আমি সবকিছু জানাতাম।
অনু খুব অবাক হয়ে দেখল, একজন দুর্দান্ত প্রেমিক কত দ্রুত অসহায় পিতায় পরিণত হয়েছে।
সেদিন লুবনা তার বাবার কোনো কথাই শোনেনি। মিলাকে সঙ্গে নিয়ে দমদম করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গিয়েছিল। লুবনার সঙ্গে সেই শেষ দেখা, তার পর আজ আবার।
পাঁচ
মুখোমুখি ভাষাহীন হলেও অন্তরে অন্তরে অবিরাম বাকবিতণ্ডায় বেশ খানিকটা সময় কেটে গেছে। আশপাশের টেবিল থেকে আনন্দ হাসির টুকরো টুকরো গল্পে ওদের প্রত্নতাত্ত্বিক সময়ে ছায়া ফেলতে পারছে না।
লুবনার হাত দুটি টেবিলে আলগোছে পড়ে ছিল, অনু সে হাত স্পর্শ করে বলে,
তোমাকে কোথায় না খুঁজেছি। এতদিন কোথায় ছিলে? সত্যি বলবে না?
লুবনা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আমি যাচ্ছি। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
সেই জিদ! সেই তাড়াহুড়ো!
আর একটু বসো। একটা সত্য তোমার জানা দরকার।
কী সত্য?
তোমার বাবাকে সত্যি আমি ভালোবেসেছিলাম। বাবার বয়সী হলেও বেসেছিলাম। কেন, সেটা আমি জানি না। তোমার বাবাও আমাকে ভালোবাসতেন, কিন্তু তোমার চেয়ে বেশি নয়।
হুহ! এ জন্যই তো মেয়েকে ভুলে তোমাকে বিয়ে করেছে, তাই না? এসব কথা বাদ দাও। আমি আমার মতো যেমন আছি, তেমন থাকব। আমি এখন লুবনা ফয়েজ চৌধুরী না। আমি লুবনা ডি কস্তা। আমি যাচ্ছি। তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।
কার কাছে অভিযোগ করবে? তোমার অভিযোগ শোনার মতো কেউ নেই।
মানে?
তুমি চলে আসার কিছু সময় পরেই তোমার বাবার বুকে প্রচণ্ড ব্যথা ওঠে। সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। দুদিন ছিলেন।
হাসপাতালে নেওয়ার সময় আমি পাশে ছিলাম। তার চোখ দেখে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, সে চোখ শুধু তোমাকে খুঁজছে। কিন্তু যে নিজেই হারিয়ে যায়, তাকে আমরা কোথায় পাব, বলো?
লুবনার মুখ বিবর্ণ। ওর নাটবোল্ট লাগানো ইস্পাতে গড়া শরীর টেবিলের ওপর নুয়ে আসে।
কিন্তু অনু থামে না।
তুমি যেমন তোমার দুর্ভাগ্যের জন্য আমাকে দোষারোপ করো, তেমনি তার মৃত্যুর জন্য, আমার এই একাকী জীবনের জন্য আমি তোমাকে দোষী মনে করি। তোমার মাত্রাছাড়া জিদ তিনটা জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
লুবনার দুই চোখের কোল বেয়ে নিঃশব্দে ভেসে যাচ্ছে অলকানন্দার স্রোত। এ কান্না বাবা হারানোর শোকে, নাকি অনুতাপে সে হিসাব অনু করে না। কোনো সান্ত্বনাও দেয় না; বরং উঠে লিফটে পা রাখে।
অত্যাধুনিক ক্যাপসুল লিফটটি শাঁ শাঁ করে নিচের দিকে নামছে। চারপাশে ভিড়ে ঠাসা মানুষের শরীরে মিশেল গন্ধ। পারফিউমটির নাম জানা হলো না, অথচ হারিয়ে যাওয়া মানুষটির বুকপকেটের এই সুগন্ধ অনুকে নেশাগ্রস্ত করে ফেলত। আচ্ছা, লুবনা কি তার বাবাকে জড়িয়ে রাখার জন্যই পুরুষদের এই পারফিউম ব্যবহার করে? হয়তো বা। লিফট গ্রাউন্ড ফ্লোর স্পর্শ করেছে। অতঃপর অনু সেই দুনিয়ার দিকে পা বাড়ায়, যে দুনিয়ার কেউ তার জন্য অপেক্ষায় নেই।