হে বাতিঘর, আপনার জন্য নিরন্তর শুভকামনা
‘কলম হাতে নিয়ে ঠিকমতো লিখতে পারেন না, তারপরও ঘুম থেকে উঠে কলম হাতে নিয়ে বসে থাকেন।’ কথাটি ঔপন্যাসিক শওকত আলীর মেজো ছেলে আশিক শওকতের স্ত্রী ফারজানা আফরোজ পারুলের। শওকত আলীর সাম্প্রতিক অবস্থা প্রসঙ্গে তিনি এই কথাটি বলেন। একজন শক্তিমান কথাসাহিত্যিকের জন্য এ যে কত বড় বেদনার, তা তো আর বলার দরকার হয় না। এমন একটি কথা শুনে আমাদের বুকটাও ভারী হয়ে আসে। চোখের কোণে অশ্রু জমা হয়। হায়! জীবন এতটা নিষ্ঠুর! এতটা নির্মম!
বেশ কয়েক বছর ধরে স্মৃতিরা প্রতারণা করছে বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিক শওকত আলীর সঙ্গে। বছর পাঁচেক আগে তাঁর বাসায় প্রায়ই যেতাম, প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে, আড্ডা দিতে বা আশীর্বাদ নিতে। স্যারও মাঝেমধ্যে তাঁর ল্যান্ডফোন থেকে ফোন করতেন। নানা বিষয়ে কথা বলতেন। একবার কথা শুরু করলে আর থামতে চাইতেন না। মনে আছে, একদিন রাত ৯টায় ফোন দিয়ে সাড়ে ১০টায় ছেড়েছিলেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা। কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’র গল্প শুরু করলেন। ইলিয়াসের সঙ্গে তাঁর নানা স্মৃতি এবং ইলিয়াসের লেখার শিল্পগুণ সম্পর্কে নানা কথা বলছিলেন। একই প্রসঙ্গ বারবার বলছেন, খেই হারিয়ে ফেলছেন, আমি আবার মূল প্রসঙ্গ ধরিয়ে দিচ্ছি। আমিও ফোনটা কেটে দিতে পারছিলাম না। বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ, পাছে কী মনে করেন!
আরেকদিন, আমার মোবাইলের চার্জ ছিল না। এত দীর্ঘ সময় তিনি কথা বলছিলেন, হঠাৎ মোবাইলটা বন্ধ হয়ে গেল। তখন তাঁর স্মৃতিশক্তি বর্তমানের মতো এত খারাপ ছিল না। কথা রিপিটেশন করতেন, ধারাবাহিকতা হারাতেন, তারপরও ইতিহাস কিংবা জীবনের নানা স্মৃতির চারণ করতে পারতেন।
‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ ছাড়াও শওকত আলীর আরো দুটি অসাধারণ উপন্যাস, ‘নাঢ়াই’ ও ‘মাদারডাঙার কথা’। সম্ভবত ২০১০ সালের কথা। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ প্রসঙ্গে তাঁর কাছে জানতে চাইলাম। দু-হাতে তালি বাজিয়ে, তাঁর বলার ভঙ্গিটা ছিল ঠিক এ রকম, ‘শোনো, মিথ কীভাবে বিপ্লব সৃষ্টি করতে পারে তা ইলিয়াস দেখিয়েছেন। দেখ না মৃত মুনসি বয়তুল্লা শাহ কীভাবে জীবিতদের শাসন করেন? ওরেব্বাপ্।’
পরের বছর শওকত আলীর ‘মাদারডাঙার কথা’ প্রকাশিত হয়। স্যারের বাসায় যাওয়া হয়েছিল কি এক কাজে। বললাম, ‘স্যার, মাদারডাঙাবাসীও কিন্তু মিথকে কেন্দ্র করেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠে।’ স্যার আমার চোখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। ঠিক মনে আছে, তাঁর উত্তরটা ছিল এমন, ‘ধরতে পেরেছ? ধরতে পেরেছ? হ্যাঁ হ্যাঁ...।’
আমি মনে করি না শওকত আলী ইলিয়াসপ্রভাবিত হয়ে ‘মাদারডাঙার কথা’ লিখেছেন। হতে পারে বড়জোর ‘খোয়াবনামা’র অন্তর্নিহিত ভাব নিয়ে থাকবেন। কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নেই যে এই উপন্যাস গত দশ বছরে লেখা বাংলা ভাষার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে একটি। ‘দলিল’, ‘উত্তরের ক্ষেপ’ কিংবা ‘ওয়ারিশ’ পাঠক হিসেবে আমাকে সেভাবে টানেনি, কিন্তু ‘নাঢ়াই’ অসাধারণ একটি উপন্যাস। পাঠক কেন শওকত আলী বলতে কেবল ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ বোঝেন বা বলেন, কেন ‘মাদারডাঙার কথা’ বা ‘নাঢ়াই’র কথা বলেন না, ঠিক বুঝে আসে না। শওকত আলী বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে নিঃসন্দেহে বড় ঘটনা। অন্তত প্রদোষে প্রাকৃতজন, নাঢ়াই ও মাদারডাঙার কথার জন্য।
অনেকদিন আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। ২০১৫ সালের জানুয়ারির এক রাতে, প্রায় ৯টার দিকে তাঁর সেই হাটখোলার বাসায় গেলাম, জাগৃতি প্রকাশনীর প্রয়াত প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন ভাইসহ। স্যার দরজা খুললেন। বললাম, ‘স্যার, আমি স্বকৃত নোমান।’ বললেন, ‘আচ্ছা। তা এত বিখ্যাত মানুষ কী মনে করে?’
আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম স্যার আমাকে চিনতে পারেননি। চিনতে পারলে অবশ্যই এমন একটা হাস্যরসাত্মক কথা বলতেন না। বলতেন, ‘কেমন আছো স্বকৃত? এতদিন পর এলে!’
ভেতরে গিয়ে বসলাম আমরা। সিঁড়ি বাইতে পারেন না বলে এখন তিনি চারতলা বাড়ির নিচতলায় থাকেন। অগোছালো ঘর। জানালার শিকে, দরজার পাশে, দেয়ালে, এখানে-ওখানে অসংখ্য পোঁটলা-পুঁটলি টাঙানো। খাটের ওপর ওষুধের বাক্স। বইগুলোতে ধুলোবালি জমে কালো হয়ে গেছে। স্যার স্মৃতি তো হারিয়েছেনই, সেই সঙ্গে হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিসও তো আছে।
স্যার বললেন, আদেশ করুন।
বললাম, আদেশ তো স্যার আপনি করবেন, আমরা কী আদেশ করব।
: না বলছি, আপনাদের জন্য কী করতে পারি সেই আদেশ করুন।
: কিছুই না স্যার, এমনি দেখা করতে এলাম। দীপন ভাই ইতোপূর্বে আপনার দুটি বই প্রকাশ করেছেন। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে।
না, স্যার মনে করতে পারলেন না কোন দুটি বই জাগৃতি থেকে বেরিয়েছিল। কিচ্ছু মনে নেই তাঁর। কথার একপর্যায়ে বললেন, আচ্ছা, তুমি স্বকৃত নোমান, না? স্বকৃত নোমান...। আচ্ছা, তোমার নাম স্বকৃত কেন? কে রেখেছে নামটা?
বললাম, আপনাকে আমি অনেকবার বলেছি নামটা সেলিম আল দীন রেখেছিলেন। কেন বলতে পারব না। এর পেছনে আমার কোনো হাত ছিল না। আপনার বুঝি মনে নেই?
: কী জানি বাবা, মনে নেই। সেলিম কেমন আছে?
: স্যার, তিনি তো সেই কবেই চলে গেছেন।
: ওহ্, কিছুই মনে রাখতে পারি না।
আমি একজন শক্তিমান কথাসাহিত্যিকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। ভাবি, জীবনের কাছে মানুষ কত না অসহায়। বার্ধক্য কত না নিষ্ঠুর। যত বড় লেখকই হোন না কেন, বার্ধক্যের কাছে তাঁর কোনো মূল্য নেই।
জানালার তাকে রাখা একটা বৈয়াম থেকে বিস্কিট বের করে খেতে দিলেন আমাদের। বললেন, এই খেয়ে নাও। আমি মরে গেলে লিখো, শওকত আলী তার বৈয়াম থেকে বিস্কিট খাইয়েছিলেন।
বললাম, তথাস্তু স্যার।
একে তো স্মৃতিশক্তি হারিয়েছেন, তার ওপর বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে এখন তিনি প্রায় শয্যাশায়ী। হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে। এখন খুব একটা ভালো নয় তাঁর শারীরিক অবস্থা।
আমরা আশাবাদী, নিশ্চয়ই তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। জানি, হয়তো আর লিখতে পারবেন না, তবু আর কটা দিন বেঁচে থাকুন আমাদের মাঝে। আমাদের বাতিঘর হয়ে।
আমাদের বাতিঘরের খুব সংকট। বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকদের মধ্যে বাতিঘরের মতো যে কজন ঔপন্যাসিক রয়েছেন, তিনি তাঁদের একজন।
আপনার জন্য নিরন্তর শুভকামনা, হে কথাসাহিত্যের বাতিঘর।