আহমদ ছফার ব্রত
প্রবীণ বয়সী বট
তরুর সমাজে তুমি
অতিকায় জটাধারী
রবীন্দ্র ঠাকুর।
—আহমদ ছফা, ‘একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা’
আমরা যাহারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সশরীরে দেখিবার সৌভাগ্য অর্জন করি নাই তাহাদের কাছে আহমদ ছফা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিকটতম তুলনা। দুঃখের মধ্যে, তিনি নিজেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎ-দর্শন লাভ করেন নাই। কথাটা বলিলাম বাংলায় ‘দর্শন’ কথাটার দুই অর্থেই। আহমদ ছফা ছিলেন—আমাদের মতে—গরিবের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আহমদ ছফা জন্মিয়াছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর গোটা দুই বছর পর। আর তিনি যখন বড় হইয়া উঠিতেছিলেন তখন পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান কায়েম হইয়াছে। শুরু হইয়া গিয়াছে অন্যান্যের মধ্যে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঐতিহ্যও ‘বাংলাভাষী পাকিস্তানি’দের ঐতিহ্য কি না সেই তর্ক। (আহমদ ২০১৬ : ১৪৯-৫৬)
সকলেই জানেন, ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের একশত বছর পুরা হয়। ঐ বছরের দুয়েক বছর আগে-পরে আহমদ ছফা উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে গ্রাম ছাড়িয়া ঢাকায় আসিয়া পৌঁছিলেন। ১৯৬১ সালের পর পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও একটি চরিত্র আকারে—নিদেনপক্ষে অনুষঙ্গ হিশাবে—হাজির হইয়াছিলেন। এই আন্দোলনের শক্তিবিয়োগ করিবার মতলবে পাকিস্তানের শাসকশ্রেণি ১৯৬৭ সাল নাগাদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ও কবিতার প্রচার সীমিত করিবার উদ্যোগ নতুন করিয়া নিলে পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবীসমাজ সেই উদ্যোগের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছিলেন। সেই প্রতিরোধ আন্দোলনের অঙ্গ আকারেই শুরু হয় প্রতি বছর ঢাকা শহরে ঘটা করিয়া বাংলা নববর্ষ (পহেলা বৈশাখ) এবং রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন (পঁচিশে বৈশাখ) পালন।
এই আন্দোলনের অলিখিত মুখপত্র আকারে আনিসুজ্জামান সম্পাদিত ‘রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থটি আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩৭৫ সালের ( মোতাবেক ১৯৬৮ ইংরেজির) বাইশে শ্রাবণ নাগাদ। ঐ দিনটি ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিরোধান দিবস। এই গ্রন্থের মুখবন্ধযোগে সম্পাদক অকপটে লিখিয়াছেন, এই সংকলন গ্রন্থের প্রস্তাব যাঁহারা প্রথম পেশ করিয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে আহমদ ছফা। সংকলনের পাঁচ সেরা লেখার একটি নিঃসন্দেহে ছিল আহমদ ছফার নাতিদীর্ঘ রচনা ‘রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি সাধনা’। (ছফা ২০০৯) মজার বিষয়, তিনি ছিলেন সংকলনের অন্তর্গত লেখকদের মধ্যে বয়সে সকলের ছোট।
আহমদ ছফার গোটা জীবন কাটিয়াছিল এক অর্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধ্যানেই। তিনি নানান জায়গায় ঠাকুরের বন্দনা নানান ভাষায় করিয়াছেন। এক জায়গায় তিনি লিখিয়াছেন, ‘ভারতবর্ষে গৌতম বুদ্ধের পরে রবীন্দ্রনাথ [ঠাকুর] সত্যিকারের একজন বড় মানুষ। রবীন্দ্রনাথ এবং বুদ্ধের মাঝখানে আমি হজরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতির নাম করতে পারলে খুশি হতাম। কে কিভাবে নেন এই ভয়ে খাজা মঈনুদ্দীনের গুণগ্রাম ব্যাখান করা থেকে বিরত থাকলাম।’ (ছফা ১৯৯৪ : ৬৬)
অন্য এক জায়গায় অন্য স্বরে কথা বলিতে বলিতে তিনি ধর্মসাধনায় শ্রীচৈতন্য আর রাজনীতিতে শেখ মুজিবুর রহমান—মাত্র এই দুইটি নামোচ্চারণের পরপরই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম মুখে লইয়াছিলেন। ছফা বলিয়াছিলেন, ‘তিনি [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর] বাঙালিকে বিশ্বসমাজে [আর] বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যকে বিশ্বের চিন্তাভাবনার জগতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।’ (ছফা ১৯৯৬ : ৮৫) আহমদ ছফার মতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারাজীবনের সাধনায় বাংলার মত একটি ‘প্রাদেশিক’ ভাষাকে বিশ্বভাষায় উন্নীত করিয়াছিলেন। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের যে দান, আহমদ ছফার ভাষায়, ‘এক কথায় তাকে অন্তহীন বললে খুব বেশি বলা হবে না।’
এখানেই অবশ্য গল্পের শেষ নয়। ১৯৮৬ সালে জার্মানি হইতে প্রচারিত এক বেতার বক্তৃতায় আহমদ ছফা উচ্চারণ করিয়াছিলেন, ‘গ্যেটের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আমার জীবনের মহত্তম মানুষ, জীবনের সমস্ত রকম সমস্যা-সংকটে আমি রবীন্দ্রনাথের রচনা থেকে অনুপ্রেরণা সঞ্চয় করতে চেষ্টা করেছি।’ (ছফা ১৯৯৪ : ৬৫)
প্রসঙ্গক্রমে আহমদ ছফা এক জায়গায় জানাইয়াছিলেন, মহান জার্মান কবি বোলফগাং গ্যেটের ‘ফাউস্ট’নামা কাব্যের সহিত তাঁহার পরিচয় ঘটে ঢাকায়—১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়। (ছফা ১৯৮৯ : ৬২)
পরবর্তীকালে—১৯৭০ সালে—রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন উপলক্ষে প্রকাশিত এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে ‘ফাউস্ট’-পড়ুয়া আহমদ ছফা লিখিয়াছিলেন, ‘অন্তত এই একটি দিনে সহস্র সমস্যা জর্জরিত পূর্ব বাংলার গণমানুষ অনুভব করতে পারবেন একটি মনুষ্যকণ্ঠের সুর কত ঊর্ধ্বে উঠতে পারে, একটি সৃষ্টিশীল মনের ভাবনা কতদূর গভীরে যেতে পারে, প্রসারিত হয় কতদূর একটি বলবান চিত্তের উদার মৈত্রীচিন্তা।’ (ছফা ২০১৫ : ১২০)
বিশ-বাইশ বছর পর—খুব সম্ভব ১৯৯৩ সালে—একটি দৈনিক পত্রিকাযোগে আহমদ ছফা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সামনে রাখিয়া দুই-চারিটি নতুন প্রশ্ন—নতুন প্রশ্ন না হইলেও নতুনভাবে—উচ্চারণ করিয়াছিলেন। এই নিবন্ধে আমরা আহমদ ছফার সেই সকল প্রশ্নের তাৎপর্য কি জানিতে চাহিব।
১
১৯৯৩ সালের দিকে ‘বাংলাবাজার পত্রিকা’ নামক একটি দৈনিকে আহমদ ছফা ‘আমার কথা’ শিরোনামে একপ্রস্ত কলম লিখিতেন। অন্যান্য লেখার সহিত মিলন দিয়া পরের বছরের ফেব্রুয়ারি নাগাদ তিনি ক্ষুদ্রকায় একটি নিবন্ধসংগ্রহ বাহির করিয়াছিলেন। ঐ সংগ্রহের অন্তর্গত নাতিদীর্ঘ এক গোঁজামিলনের নাম ‘জীবিত থাকলে রবীন্দ্রনাথকেই জিজ্ঞেস করতাম’। আমরা পত্রিকার পাতা মিলাইয়া দেখিতে সমর্থ হই নাই। ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘আনুপূর্বিক তসলিমা এবং অন্যান্য স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ’ শীর্ষক নিবন্ধসংগ্রহের ভূমিকায় আহমদ ছফা যতটুকু জানাইয়াছেন মাত্র তাহার দৌলতে অনুমান করিতেছি, এই নিবন্ধটিও খুব সম্ভব ‘আমার কথা’ নামক কলমের ফসল। (ছফা ১৯৯৪ : [৬])
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। সেইদিন বর্তমান ভারতের অঙ্গরাজ্য উত্তর প্রদেশের অযোধ্যা নগরে পাঁচশত বছরের পুরানা একটি মসজিদ পূর্ব হইতে ঘোষণা দিয়া ধ্বংস করা হয়। ইহার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ শুদ্ধ ভারত জুড়িয়া নহে, বাংলাদেশেও রাজনৈতিক দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু হইয়া যায়। যতদূর কল্পনা যায় দেখিতেছি, আহমদ ছফাকে এই রক্তের হাঙ্গামা বড়ই বিচলিত করিয়াছিল। এই পটভূমিটা ভুলিয়া না যাই তো আশা করি আহমদ ছফার ব্রত বুঝিতে সহায় হইবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমীপে প্রশ্নপত্রটা পেশ করিবার আগে আহমদ ছফা প্রথমে বন্দনাটুকু সারিয়া লইলেন। লিখিলেন : ‘তাঁর সম্পর্কে যেটুকু পড়েছি যেটুকু জেনেছি, তা থেকে বলতে পারি রবীন্দ্রনাথ সত্যি সত্যি একজন বড় মানুষ। হিমালয় পর্বতকে যদি আরো পাঁচ মাইল উচুঁও করে দেয়া হয়, আমার বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের উচ্চতা স্পর্শ করতে পারবে না।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি পর্বত, সন্দেহ নাই। তবে আহমদ ছফা যে তিনটি প্রশ্নমুষিক প্রসব করিবেন তাহারাও সেই পর্বতের কাছে উপেক্ষিত হইবে না—এই তাঁহার আশা। আহমদ ছফা লিখিলেন, ‘আমার বোধবুদ্ধি যখন একটু সেয়ানা হয়ে উঠল, একটা প্রশ্ন নিজের মধ্যেই জন্ম নিল। আমি মুসলমান চাষা সম্প্রদায় থেকে আগত একজন মানুষ। রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিয়ে কিছু লিখেননি কেন?’
এতদিন এ প্রশ্ন তোলেন নাই কেন? কেহ পশ্চাতে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া বসেন এই ভয়ে আহমদ ছফা জানাইলেন, ‘এ প্রশ্নটা মনের মধ্যে জাগলেও প্রকাশ্যে উচ্চারণ করতে সাহস করিনি। আমাদের দেশের গোঁড়া মুসলমানেরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে সকল অপপ্রচার করে থাকে, [পাছে] আমার প্রশ্নটিকেও তাদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে আমাকে রবীন্দ্রবিরোধীদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড় করায় সেই ভয়ে অনেকদিন চুপচাপ ছিলাম।’
শেষমেশ তিনি সাহস সঞ্চয় করিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে বিশ্বাসের জোরে। লিখিলেন :
‘এখন আমার একটা উপলব্ধি এসেছে, যে যেভাবে ইচ্ছা গ্রহণ করুক, আমার মন যেভাবে বলছে আমি প্রশ্নটা সেভাবে উচ্চারণ করব। এখানকার রবীন্দ্রভক্তরা হয়ত একটু রুষ্ট হবেন। তবে আমি নিশ্চিত রবীন্দ্রনাথের রুহ-মোবারক আমার প্রশ্নে কষ্ট পাবে না।
রবীন্দ্রনাথের অনুভূতি ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম। তিনি ফুলের গন্ধ, পাখির গান, এমনকি গোধূলির আলোর কাছেও নিজেকে ঋণী ভাবতেন। সম্প্রতি ‘ফায়ার অব বেঙ্গল’ শীর্ষক এক হাঙ্গেরিয়ান মহিলার একটি চমৎকার উপন্যাস আমি পেয়েছি। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা। ঐ উপন্যাসের এক চরিত্রের উক্তি : রবীন্দ্রনাথ যখন ধ্যানে বসতেন, ঘাসের অঙ্কুর গজানর শব্দও তিনি শুনতে পেতেন। এই কথাটা আমার আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে।’ (ছফা ১৯৯৪ : ৬৫)
আহমদ ছফার দুইটা দাবি। এক নম্বরে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুসলমান প্রজারা তাঁহার নিজের এবং তাঁহার পূর্বের ঠাকুর জমিদারদের অন্নসংস্থান করিত। সুতরাং ঠাকুরকে তাহাদের কথা লিখিতে হইবে। দ্বিতীয় কথা, ‘এই মুসলমান প্রজাদের জীবনের সমস্যা-সংকট সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যত বেশি জানতেন, গোটা ভারতবর্ষে সেরকম আর একজন মানুষও ছিলেন কি না সন্দেহ।’ অতয়েব তাঁহার না লিখিবার কোন অজুহাত থাকিতে পারে না।
আহমদ ছফা আমাদের মনে করাইয়া দিতেছেন, ‘এই প্রজাদের কথা রবীন্দ্রনাথ বারবার উচ্চারণ করেছেন। কিসে তাদের মঙ্গল হয় সে বিষয়ে চিন্তা করেছেন এবং নানা বাস্তব কর্মকাণ্ডের আয়োজন করেছেন। এ প্রজাদের কল্যাণের আকাঙ্ক্ষায় একমাত্র পুত্র রথীন্দ্রনাথকে আমেরিকা থেকে কৃষিবিদ্যা শিখিয়ে এনেছিলেন।’ প্রশ্নটা এখানেই : ‘তারপরও রবীন্দ্রনাথ মুসলমান চাষাদের নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গল্প লিখতে পারলেন না কেন?’
আহমদ ছফার এই নাতিশীতোষ্ণ প্রশ্নের উত্তর আমরা জানি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহু আগেই দিয়া রাখিয়াছিলেন। উত্তরটা আহমদ ছফার কানে পৌঁছায় নাই—এমন ভাবারও অবকাশ নাই। ‘আপনি মুসলমান চরিত্র নিয়ে গল্প উপন্যাস বিশেষ লেখেননি কেন?’—বন্দে আলী মিয়ার এই জিজ্ঞাসার উত্তরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাহা বলিয়াছিলেন তাহা শ্রুতিলেখকের ভাষ্য অনুসারে এইরকম : ‘মুসলমান সমাজ সম্পর্কে বিশেষ কিছু আমি জানি না। শিলাইদায় যদিও অনেককাল ছিলাম তথাপি গভীরভাবে মিশবার সুযোগ করে উঠতে পারিনি।’ (মিয়া ১৩৭৩ : ৫৬; মিয়া ১৪০৪ : ৩৭৫)
শুদ্ধ অজ্ঞতা বা অনভিজ্ঞতা নয়, অন্য ভয়ও ছিল। বন্দে আলী মিয়াকে তিনি বলিতেছিলেন :
‘এক একবার ভাবি—লিখব, কিন্তু সাহসে কুলায় না। বঙ্কিমচন্দ্রের মত গালমন্দ খেতে হবে ভয়ে পিছিয়ে আসি। সাম্প্রদায়িকতাকে আমি প্রশ্রয় দিই না। এর প্রমাণ কেউ আমার শান্তিনিকেতনে গেলেই বুঝতে পারবে। কিন্তু গল্পে মুসলমান চরিত্র সৃষ্টি করতে গেলে মনে হয়, হয়ত ঠিকভাবে আঁকতে পারছি না। হয়ত যথার্থ রূপটি দিতে পারছি না। তবে একেবারে যে লিখিনি তা নয়। আমার ‘গল্পগুচ্ছ’ পড়ে থাকলে নিশ্চয়ই সাক্ষাৎ পেয়েছ।’ (মিয়া ১৩৭৩ : ৫৬; মিয়া ১৪০৪ : ৩৭৫-৭৬)
বন্দে আলী মিয়া পদ্মাপারের লোক। তাঁহার সহিত ঠাকুরের আরেক সাক্ষাতেও একই প্রশ্ন উঠিয়াছিল। মিয়া গিয়াছেন তাঁহার ‘ময়নামতির চর’ বহিটির জন্য কবির ‘একটা অভিমত’ আদায়ের মতলবে। ‘একসময় মুখ তুলে [কবি] বললেন : যৌবনের অধিকাংশ দিন আমার পদ্মার চরে কেটেছে। আমি যখন শিলাইদহে ছিলাম তখন একটা ঘটনা ঘটেছিল। বিষয়টা অতিশয় চিত্তাকর্ষক। ভেবেছিলাম, আমি লিখব। কিন্তু মুসলমান সমাজের পারিবারিক ঘটনা। হয়ত ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকবে, সেই জন্যে লিখতে সাহস করিনি। তোমাকে বলছি, তুমি লিখ।’ (মিয়া ১৩৭৩ : ৮৭-৮৮; মিয়া ১৪০৪ : ৩৯৪)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখে শোনা আখ্যায়িকা ভর করিয়া বন্দে আলী মিয়া পরে একখানি উপন্যাস লিখিয়াছেন বৈকি! সেই বইয়ের নাম ‘শেষ লগ্ন’। উহার মুখবন্ধযোগে মিয়া সাহেব পুনশ্চ সেই কীর্তি স্মরণ করিয়াছিলেন এইভাবে :
‘মেঘাচ্ছন্ন আকাশের নিচে উত্তরায়ণের বারান্দায় রবীন্দ্রনাথের সম্মুখে আমি আর আমার জনৈক শিল্পীবন্ধু বসেছিলাম। কথার পর কথা, প্রসঙ্গের পর প্রসঙ্গ চলছিল। এক ফাঁকে আমার ‘ময়নামতির চর’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো সম্পর্কে আলোচনা উঠল। সেই প্রসঙ্গে তাঁর যৌবনদিনে শিলাইদহ বাসের কথা তাঁর মনে পড়ল। তিনি বললেন, দেখ, শিলাইদহের কাছারিবাড়ির কিছুটা দূরে একজন খোঁয়াড়ালা ছিল। তার জীবনকথা আমি জানি। কাহিনীটা লিখবার জন্য মনের মধ্যে আমার লোভ এখনো আছে। কিন্তু অতি কষ্টে নিজেকে সম্বরণ করে রেখেছি। মুসলমান পরিবারের খুঁটিনাটি খবর আমার জানা নেই। অথচ গল্প লিখতে ওটা নিতান্তই অপরিহার্য। লিখলে কোথায় কি ত্রুটি থেকে যাবে যার জন্য সমালোচকদের তীক্ষ্ণ আক্রমণ আমার ওপর হতে থাকবে। এই বুড়ো বয়সে সেটা মোটেই প্রীতিকর নয়। সুতরাং কাহিনীটা তোমাকে বলছি, তুমি এ বিষয়ে চেষ্টা কর। (ইকবাল ২০১২ : ৩৭৮)
এই পুরানা যুক্তির খবরও আহমদ ছফা আগেভাগেই পাইয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন : ‘হ্যাঁ, কথা উঠতে পারে, তিনি মুসলমান সমাজ সম্পর্কে জানতেন না, তাই লিখেননি। যদি সঠিকভাবে মুসলিম চরিত্র উপস্থিত করতে না পারেন, হিতে বিপরীত ঘটে যাবার সম্ভাবনা ছিল বেশি। সে কারণে রবীন্দ্রনাথ কোন ঝুঁকি গ্রহণ করেননি। সেক্ষেত্রে আমার কথা হল, রবীন্দ্রনাথ ইচ্ছা করলে তাঁর অনভিজ্ঞতা এবং মুসলিম সমাজ সম্পর্কে অজ্ঞতা কি কাটিয়ে উঠতে পারতেন না? আমার তো মনে হয় না এটা রবীন্দ্রনাথের মত একজন অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তির পক্ষে অসম্ভব কিছু ছিল।’ (ছফা ১৯৯৪ : ৬৬)
ফল যাহা ফলিবার নিশ্চয় ফলিয়াছে। সেকালের প্রসিদ্ধ পণ্ডিত বিনয়কুমার সরকার অনেক আগেই ফলনির্ণয় করিয়া রাখিয়াছিলেন। সরকারের মতে, মুসলমান নরনারীর কথা যে রবীন্দ্রনাথ বেশি একটা লিখিতে পারেন নাই তাহা ঠাকুরের ‘একটা বড় দুর্বলতা’। আর এই দুঃখেই তিনি বলিয়াছিলেন, ‘মুসলমান পাঠকেরা ভবিষ্যতে রবীন্দ্র সাহিত্যকে হয়ত খানিকটা কম আদর করতে পারে।’
হরিদাস মুখোপাধ্যায়ের সহিত বিনয়কুমার সরকারের এই আলাপটি অনুষ্ঠিত হইয়াছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাপ্রয়াণের কিছুদিন পর—১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এই সংবাদটি মনে রাখিলে আমাদের বিশেষ উপকার হয়। সরকার আরো কহিয়াছিলেন, রবীন্দ্রনাথের রচনায় ‘মুসলমানবিরোধী’ কথা বিশেষ নাই—এ কথাও মিথ্যা নহে। সমস্যার মধ্যে, ‘পাঠকমাত্রের একটা দুর্বলতা আছে। সকলেই নিজ পরিচিত পল্লী, দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি সম্পর্কিত ব্যক্তি ও অবস্থার বিশ্লেষণকে দেখতে চায়।’
ভালয় মন্দয় মিলাইয়া বিনয় সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল অসীম ক্ষমায় মণ্ডিত : ‘মুসলমান কথাবস্তু সম্বন্ধে রবীন্দ্র সাহিত্য কিছু দরিদ্র। এই দোষের জন্য রবীন্দ্র সাহিত্যকে ভবিষ্যতে ভুগতে হবে। এই জন্য আমি দুঃখিত।’ (সরকার ২০০৩ : ৭২)
এতদিনে অনেকখানি তাঁহার কথারই প্রতিধ্বনি করিলেন আহমদ ছফা। লিখিলেন : ‘... যদি আমার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হত, পদধূলি নেয়ার পর খুব বিনীত ভাষায় আমার বক্তব্য তাঁকে শোনাতাম। আমি বলতাম, আপনাকে আমি পুরোপুরি আমার আপন করতে চাই, কিন্তু পারি না।’ (ছফা ১৯৯৪ : ৬৬)
২
আহমদ ছফার দ্বিতীয় প্রশ্নটিও ষোল আনা আনকোরা কি স্বাধীন প্রশ্ন নয়। এই প্রশ্নে পৌঁছিয়া তিনি মাখনের মধ্যে ছুরির মতই সাবলীল হইলেন। লিখিলেন, ‘সারাজীবন আপনি অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন। ইসলাম এবং ইসলামের ঋষিদের সম্পর্কে এমন মৌন থেকে গেলেন কেন?’ এখানেও আহমদ ছফার দাবি, রবীন্দ্রনাথ ইসলাম বিষয়ে বিশেষ লিখেন নাই। অথচ যে ব্রাহ্মধর্ম তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে পাইয়াছিলেন তাহার সহিত ইসলামের তো একটা আঁতের সম্পর্ক ছিলই। সেটা অগ্রাহ্য করা—সেই আঁতে ঘা দেওয়া—কি ন্যায় পদবাচ্য? কথাটা আহমদ ছফার ভাষাতেই শোনা যাইতে পারে :
‘রামমোহন রায়ের ঘরানা থেকেই আপনার উৎপত্তি। রাজা রামমোহন রায় সর্বপ্রথম ইসলামের মধ্যেই ব্রাহ্মধর্মের উৎস খুঁজে পেয়েছিলেন। সেটি তিনি প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন; যদিও পরে ব্রাহ্ম মতামতের সঙ্গে বেদ-উপনিষদের সম্পর্ক আবিষ্কারের চেষ্টা করেছিলেন। অনেক কীর্তিমান গবেষক এখনো তো মনে করে থাকেন আসলে ব্রাহ্মধর্ম ইসলামের প্রভাবসঞ্জাত একটি রূপান্তরিত মতবাদ। আপনার মহর্ষি পিতা দেবেন্দ্রনাথও এই সত্য একেবারে উড়িয়ে দিতে পারেননি। তাই ধ্যানের নির্জনে তিনি ইরানি কবি হাফিজের বয়েত উচ্চারণ করতেন। ব্রাহ্মধর্মের যে ঘরানা ইসলামের সঙ্গে তার দূরত্ব খুব অধিক নয়।’ (ছফা ১৯৯৪ : ৬৬)
আহমদ ছফার দ্বিতীয় দাবি, রবীন্দ্রনাথ আর আর ধর্ম বিষয়ে অনেক কথা লিখিয়াছেন। এই সত্যে সন্দেহ কি! উদাহরণ না বাড়াইয়া শুদ্ধমাত্র বৌদ্ধধর্ম বা খোদ গৌতম বুদ্ধের কথাটা স্মরণ করাই যথেষ্ট। রবীন্দ্রনাথ গৌতম বুদ্ধকে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ মানব’ বলিয়া অন্তরের মধ্যে অনুভব করিতেন। অন্তরের কথা নিয়া তর্ক করা চলে না। ১৯৩৫ সালের আঠারই মে তারিখে বৈশাখী পূর্ণিমা উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলিকাতায় একটি আবেগোদ্দীপক ভাষণ দেন। ঐ ভাষণে তিনি বলিলেন, ‘একদিন বুদ্ধগয়াতে গিয়েছিলাম মন্দিরদর্শনে, সেদিন এই কথা আমার মনে জেগেছিল—যাঁর চরণস্পর্শে বসুন্ধরা একদিন পবিত্র হয়েছিল তিনি যেদিন সশরীরে এই গয়াতে ভ্রমণ করছিলেন, সেদিন কেন আমি জন্মাই নি, সমস্ত শরীর মন দিয়ে প্রত্যক্ষ তাঁর পুণ্যপ্রভাব অনুভব করি নি?’ (ঠাকুর ১৩৭৯ : ৯)
কবির ভাইপো দ্বিপেন্দ্রনাথের স্ত্রী শ্রীমতি হেমলতা ঠাকুর অনেকদিন পরে—১৯৬০ সালের কিছু আগে-পরে হইবে হয়ত—এক সাক্ষাৎকারপ্রার্থীকে জানান, সেবারের বুদ্ধগয়া ভ্রমণে তিনিও কবির অনুগামিনী হইয়াছিলেন। হেমলতাদেবীর বাক্যে জানা যায়, ‘প্রতিদিন প্রাতরাশের পর গুরুদেব বুদ্ধমন্দিরে গমন করতেন একাকী এবং প্রায় দু তিন ঘণ্টা তিনি সেখানে অবস্থান করতেন।’
সঙ্গের কিংবা বাহিরের কেহ সেই সময় মন্দিরে যাইতে পারিবে না—এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকা সত্ত্বেও হেমলতার মনে দারুণ কৌতূহল জাগিল। তিনি মনে মনে প্রশ্ন করিলেন, ‘কাকামশাই এত সময় মন্দিরে কি করেন? মূর্তিপূজার বিরোধী ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তক মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পুত্র—রবীন্দ্রনাথ—বুদ্ধমন্দিরে কেন অতিবাহিত করেন অতটা সময়?’
‘মহিলাদের স্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের কর্ত্রী অমিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় জানাইতেছেন, ‘কৌতূহল নিরসনে অধীর হয়ে একদিন তিনি অন্যের অজ্ঞাতসারে নিষিদ্ধ সময়েই যান মন্দিরে এবং ভেজান দরজা ঈষন্মুক্ত করে দেখতে পান উচ্চ বেদিতে উপবিষ্ট বিরাট বুদ্ধমূর্তির সম্মুখে দণ্ডায়মান কবিগুরুর ধ্যানগম্ভীর নিশ্চল প্রতিমূর্তি, দুই চক্ষে দরবিগলিত অশ্রুধারা!’
ইহাতে কিন্তু সনাতন হিন্দুধর্মের গুণগ্রহণে কোথাও বাধা হয় নাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। হেমলতা ঠাকুর জানাইতেছেন, ‘আমার ইচ্ছা হল গয়ার প্রাচীন বিখ্যাত বিষ্ণুর মন্দির ও হিন্দুর পূর্বপুরুষকে পিণ্ডপ্রদানের স্থান দেখার। উদারচিত্ত কাকামশাই অনুমতি দিলেন।’ (বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৬৪ : ১২৪)
এক্ষণে আমরা আহমদ ছফার বিশেষ প্রশ্নটির খবর লইতে প্রস্তুত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রীচরণে তিনি নিবেদন করিলেন : ‘আপনি মনে মনে নিজেকে ‘হিন্দু’ ভেবেছেন। তাতে তো দোষের কিছু নেই। সমস্ত ভারতীয়—হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে—[নিজেকে] ‘হিন্দু’ ভাবতে পারে। পরবর্তীকালে নানারকম রাজনৈতিক প্রশ্ন এসে বিষয়টিকে জটিল করে তুলেছে। পৃথিবীর মানুষ আপনাকে হিন্দু কবি—মানে হিন্দুস্থানের কবি—বলে সম্মান করেছে কিন্তু গড়পড়তা হিন্দু কি আপনাকে তাদের একজন হিশেবে গ্রহণ করেছে?’ (ছফা ১৯৯৪ : ৬৭)
এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আগাম দিয়া রাখিয়াছেন। ১৯৩২ সালে নতুন বাদশাহের আমন্ত্রণে ইরান দেখিতে গিয়াছিলেন তিনি। সেই দেখার কাহিনী ‘পারস্য-যাত্রী’ নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধও করিয়াছেন। এক পর্যায়ে তিনি ইস্পাহান শহরের ময়দান-ই-শাহ অর্থাৎ বাদশাহি ময়দানের দক্ষিণ সীমানাবর্তী মসজিদ-ই-শাহ বা বাদশাহি মসজিদ দেখিতে গেলেন। কবি লিখিয়াছেন, ‘প্রথম শা আব্বাসের আমলে এর নির্মাণ আরম্ভ, আর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় শা আব্বাসের সময়ে তার সমাপ্তি। এখন এখানে ভজনার কাজ হয় না।’ তবে ইহার পাশের আরেকটি মসজিদে ভজনার কাজ এখনো চলিতেছে। ইহার নাম ‘মাদ্রাসে-ই-চাহার বাগ’। কবি লিখিতেছেন :
‘এক দিকে উচ্ছ্রিত বিপুলতায় এ সুমহান, যেন স্তবমন্ত্র, আর-এক দিকে সমস্ত ভিত্তিকে খচিত ক’রে বর্ণসংগতির বিচিত্রতায় রমণীয়, যেন গীতিকাব্য। ভিতরে একটি প্রাঙ্গণ, সেখানে প্রাচীন চেনার গাছ এবং তুঁত, দক্ষিণ ধারে অত্যুচ্চ-গুম্বজ-ওয়ালা সুপ্রশস্ত ভজনাগৃহ। যে টালিতে ভিত্তি মণ্ডিত তার কোথাও কোথাও চিক্কণ পাৎলা বর্ণপ্রলেপ ক্ষয়প্রাপ্ত, কোথাও-বা পরবর্তীকালে টালি বদল করতে হয়েছে, কিন্তু নূতন যোজনাটা খাপ খায় নি। আগেকার কালের সেই আশ্চর্য নীল রঙের প্রলেপ এ কালে অসম্ভব। এ ভজনালয়ের যে ভাবটি মনকে অধিকার করে সে হচ্ছে এর সুনির্মল সমুদার গাম্ভীর্য। অনাদর-অপরিচ্ছন্নতার চিহ্ন কোথাও নেই। সর্বত্র একটি সসম্ভ্রম সম্মান যথার্থ শুচিতা রক্ষা করে বিরাজ করছে।’ (ঠাকুর ১৩৯২ : ৫৯)
কবি মসজিদটি কতখানি খুঁটাইয়া খুঁটাইয়া দেখিয়াছিলেন উপরের কয়েকটি বাক্যে তাহার সামান্য সাক্ষ্য মাত্র মেলে। ইহার পর তিনি আরো খুঁটাইয়া আপন অন্তরের মধ্যে দেখিতে শুরু করিলেন। তিনি লিখিয়াছেন, ‘এই মসজিদের প্রাঙ্গণে যাদের দেখলেম তাদের মোল্লার বেশ। নিরুৎসুক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখলে, হয়তো মনে মনে প্রসন্ন হয় নি। শুনলুম আর দশ বছর আগে এখানে আমাদের প্রবেশ সম্ভবপর হত না। শুনে আমি যে বিস্মিত হব সে রাস্তা আমার নেই। কারণ, আর বিশ বছর পরেও পুরীতে জগন্নাথের মন্দিরে আমার মতো কোনো ব্রাত্য যে প্রবেশ করতে পারবে সে আশা করা বিড়ম্বনা।’ (ঠাকুর ১৩৯২ : ৫৯-৬০)
আহমদ ছফা এ কথা পড়িয়া বাকরুদ্ধ হইলেন না। শুদ্ধ তাঁহার মুখটা ফসকাইয়া গেল। একই কথা স্থানান্তরে প্রকাশ পাইল : ‘আপনি যখন পারস্যে গেলেন, হাফিজের মাজার জেয়ারত করলেন, তখন এই প্রশ্নটা হঠাৎ করে আপনার মনে কেন জেগেছিল—যেভাবে আপনি সম্মানের সঙ্গে হাফিজের মাজার দর্শন করতে পারলেন [সেভাবে] জগন্নাথদেবের মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবেন কি না? হিন্দু মন্দিরের দুয়ার বিশ্বজোড়া স্বীকৃতি অর্জনের পরও আপনার জন্য কতটুকু উন্মুক্ত হয়েছিল?’ (ছফা ১৯৯৪ : ৬৭)
না, আহমদ ছফা ভুল করেন নাই। রবীন্দ্রনাথের মনে ঐ প্রশ্নটা জাগিয়াছিল ঠিক হাফেজের মাজারে নহে, জাগিয়াছিল ইস্পাহানের ‘মাদ্রাসে-ই-চাহার বাগ’ মসজিদে প্রবেশ করিবার পর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইহার আগে একদিন হাফেজের মাজারেও গিয়াছিলেন। সেখানে গিয়া না বসিতেই তাঁহার মনে নিজের দেশের কথাটা ভাসিয়া উঠিয়াছিল ঠিকই। কবির কথায় :
‘এই সমাধির পাশে বসে আমার মনের মধ্যে একটা চমক এসে পৌঁছল, এখানকার এই বসন্তপ্রভাতে সূর্যের আলোতে দূরকালের বসন্তদিন থেকে কবির হাস্যোজ্জ্বল চোখের সংকেত। মনে হল আমরা দুজনে একই পানশালার বন্ধু, অনেকবার নানা রসের অনেক পেয়ালা ভরতি করেছি। আমিও তো কতবার দেখেছি আচারনিষ্ঠ ধার্মিকদের কুটিল ভ্রুকুটি। তাদের বচনজালে আমাকে বাঁধতে পারে নি; আমি পলাতক, ছুটি নিয়েছি অবাধপ্রবাহিত আনন্দের হাওয়ায়। নিশ্চিত মনে হল, আজ কত-শত বৎসর পরে জীবন-মৃত্যুর ব্যবধান পেরিয়ে এই কবরের পাশে এমন একজন মুসাফির এসেছে যে মানুষ হাফেজের চিরকালের জানা লোক। (ঠাকুর ১৩৯২ : ৪৩-৪৪)
আহমদ ছফার আরেকটি প্রশ্নের উত্তরও ঠাকুর দিয়াছেন—হইতে পারে সে উত্তর কিছুটা আংশিক।
পারস্যদেশ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সহজে গ্রহণ করিয়াছিল। তিনি লিখিয়াছেন, ‘কাছের মানুষ বলে এরা যখন আমাকে অনুভব করেছে তখন ভুল করে নি এরা, সত্যই সহজেই এদের কাছে এসেছি। বিনা বাধায় এদের কাছে আসা সহজ, সেটা স্পষ্ট অনুভব করা গেল। এরা যে অন্য সমাজের, অন্য ধর্মসম্প্রদায়ের, অন্য সমাজগণ্ডীর, সেটা আমাকে মনে করিয়ে দেবার মতো কোনো উপলক্ষই আমার গোচর হয় নি।’ (ঠাকুর ১৩৯২ : ২৮-২৯)
ভারতবর্ষে—নিদেন বাংলা প্রদেশে—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাত্য হইতে পারেন। পারস্যে কিন্তু তিনি সত্যসত্যই পংক্তি পাইয়াছেন। সে কি শুদ্ধমাত্র কবি বলিয়া! রবীন্দ্রনাথ কবুল করিয়াছেন : ‘পারসিকদের কাছে আমার পরিচয়ের আরও-একটু বিশিষ্টতা আছে। আমি ইন্দো-এরিয়ান। প্রাচীন ঐতিহাসিক কাল থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত পারস্যে নিজেদের আর্য-অভিমানবোধ বরাবর চলে এসেছে, সম্প্রতি সেটা যেন আরও বেশি করে জেগে ওঠবার লক্ষণ দেখা গেল। এদের সঙ্গে আমার রক্তের সম্বন্ধ।’ (ঠাকুর ১৩৯২ : ২৮)
রবীন্দ্রনাথের এই স্বীকারোক্তি একান্তই অজ্ঞাতসারে। আর অজ্ঞাতসারে বলিয়াই তাহার মাহাত্ম্য আলাদা।
৩
১৯৯৫ সালে পৌঁছিয়া দেখিলাম এক জায়গায় আহমদ ছফা আপনকার প্রশ্নের উত্তর আবার আপনিই লিখিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেন মুসলমান চাষা সম্প্রদায়ের কাহিনী নিজ হস্তে লিখিতে রাজি হন নাই, তাহা ঠাকুর রচিত ‘গোরা’ উপন্যাসটি নাড়াচাড়া করিলেও খানিক মালুম হয়। ‘রবীন্দ্রনাথের “গোরা” উপন্যাস : নতুন ভাবনাচিন্তা’ নাম দেওয়া নাতিদীর্ঘ নিবন্ধের এক জায়গায় ছফা লিখিয়াছেন : ‘এটাকে যদি নিছক একটি প্রেমের উপন্যাস বলে ধরে নেয়া হয় তাহলে আমার মনে হয় সেটা খুবই যথার্থ হবে। গোরা এবং সুচরিতার প্রেম নানা অভিঘাতের মধ্য দিয়ে যে চূড়ান্ত মিলনান্তক পরিণতি লাভ করল সেটাই “গোরা” উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু। হিন্দু এবং ব্রাহ্ম সমাজের মধ্যে যে বিরোধ-সংঘাত চলে আসছিল তারই পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ গোরা এবং সুচরিতা চরিত্র দুটি সৃষ্টি করেছেন।’ (ছফা ১৯৯৫ : ৩৬)
এই সত্যে সন্দেহ নাই—এ কথা সত্য। সমস্যার মধ্যে, আহমদ ছফা এইটুকুতে সন্তুষ্ট হওয়ার মতন মানুষ নহেন। তিনি তাই যোগ করিলেন, ‘দুটি ভিন্ন সম্প্রদায়ের যুবক-যুবতীর মধ্যে প্রেম নতুন কোন ঘটনা নয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ভিন্নরকম উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল। “গোরা” প্রেমের উপন্যাস, কিন্তু এ কারণে তা সকলের আলোচনা এবং অভিনিবেশের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠেনি। অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তি মনে করেন রবীন্দ্রনাথ গোরা চরিত্রটিকে ভারতপথিক হিশেবে সৃষ্টি করেছেন।’ (ছফা ১৯৯৫ : ৩৭)
এ কথাও অসত্য নহে। তবে কথা আরো আছে। আহমদ ছফা বলেন, ‘প্রথম দিকে আমার কাছে এই শর্ত একান্তই সঙ্গত বলে মনে হয়েছিল। সর্বভারতীয় জনগণের মুক্তির প্রতীক হিশেবে গোরা চরিত্রটিকে মেনে নিতে আমার কোন আপত্তি তখন ছিল না।’ ‘তখন’ মানে ১৯৬৮-৬৯ সালের আগে। ততদিনে ধরিয়া লওয়া চলে আহমদ ছফা রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে অন্তত গোটা দুই নিবন্ধ—‘রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি সাধনা’ (১৯৬৮) এবং ‘তুমি ডাক দিয়েছ’ (১৯৬৯)—শেষ করিয়াছেন। তখন পর্যন্ত ছফা আপন বিশ্বাসে দৃঢ় ছিলেন।
তাঁহারও সত্যসত্য বিশ্বাস ছিল রবীন্দ্রনাথ গোরাকে সর্বভারতীয় জনগণের মুক্তির প্রতীক আকারে গড়িয়া তুলিয়াছিলেন। এই বিশ্বাসের গোড়ায় জল ঢালিবার উদ্দেশ্যেই আহমদ ছফা যুক্তি দেখাইতেছিলেন, ‘একসময় গোরার উপলব্ধি জন্মাল, তিনি ভারতীয় জনগোষ্ঠীর কেউ নন, তিনি ব্রাত্য এবং জাতহারা।’ (ছফা ১৯৯৫ : ৩৭)
‘ব্রাত্য’ এবং ‘জাতহারা’ এই দুইটি অভিধা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেশ কয়েকবার নিজের বেলায়ও প্রয়োগ করিয়াছেন। সে কথা আহমদ ছফা যে জানেন না তাহা নয়। ১৯৬৮ সালেও তিনি তাহার প্রমাণ রাখিয়াছেন :
‘রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম ‘নিকষিত হেম’ যেন। দেশের প্রতি অন্ধ না হয়ে সত্তার আলোময় স্বরূপ দিয়ে দেশের মাটিকে এমনভাবে কেউ কোন দেশে ভালবেসেছেন কি না আমাদের জানা নেই। যাঁদের শতাব্দীব্যাপী দুঃখ-দুর্দশা তিনি চোখে দেখেছেন, কানে শুনেছেন, ইতিহাসে পড়েছেন তাদেরকে—হিংসার দিকে নয়—শান্তির উদার দিগন্তের পানে আপন বাণীর মন্ত্রশক্তিতে আকর্ষণ করার জন্য সে কি অনিদ্র প্রচেষ্টা!
আপন দেশের হতভাগ্যের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বিশ্বের হতভাগ্য দেশসমূহকে ভালবেসেছেন। ফ্যাসিবাদবিরোধী ভূমিকায় নেমেছেন, ‘নাইট’ খেতাব পরিত্যাগ করেছেন, শান্তিনিকেতন আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং আরো কত গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। বিচিত্র কর্মধারার মধ্যে তিনি সর্বপ্রকারের আত্মশ্লাঘা জলাঞ্জলি নিয়ে সর্বাঙ্গীণ মনুষ্যত্বের প্রতীক হিশেবে ফুটে উঠেছিলেন। সেজন্য দেখি বৃদ্ধবয়সের জড়তাকেও উপেক্ষা করে ‘ব্রাত্য জাতহারা’ রবীন্দ্রনাথ সর্বহারাদের রাষ্ট্র সোবিয়েত দেশ দর্শন করতে গেছেন।’ (ছফা ২০০৯ : ২৫৮)
শুদ্ধ সোবিয়েত দেশে পৌঁছিয়া নহে, আর্য জাত্যাভিমানী অধ্যুষিত পারস্যদেশে পৌঁছিয়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরেকবার বুঝিতে পারিয়াছিলেন বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জনের পরও স্বদেশে তিনি ব্রাত্য বৈ নহেন। (ঠাকুর ১৩৯২ : ৬০)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে আহমদ ছফার অচলা ভক্তির দেওয়ালে একটা সূক্ষ্ম ফাটল ধরাইয়া দিয়াছিলেন এমন একজন মানুষ যাঁহাকে এককালে অনেকেই ‘কঠোর রবীন্দ্রবিদ্বেষী’ বলিয়া ধরিয়া লইতেন। এই তথাকথিত ‘রবীন্দ্রবিদ্বেষী’ হইবা সত্ত্বেও মোহাম্মদ মোর্তজা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর হাত হইতে পরিত্রাণ পান নাই। আহমদ ছফা জানাইতেছেন, ১৯৬৮ সালের দিকে ডাক্তার শহিদ মোহাম্মদ মোর্তজার সঙ্গে তাঁহার এই বিষয়ে একবার আলোচনা হয়। বয়ানের এক পর্যায়ে আহমদ ছফা যুক্তি দেখাইলেন, রবীন্দ্রনাথ গোরাকে সর্বভারতীয় জনগণের মুক্তির প্রতীক হিশাবে গড়িয়া তুলিয়াছেন। ইহার জবাবে মোর্তজা—আহমদ ছফার ভাষায়—‘ফস করে বলে বসলেন, আপনার এই ব্রাত্য জাতহারা গোরাকে রবীন্দ্রনাথ ইউরোপীয় রমণীর গর্ভে দিলেন কেন? তিনি যে সত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য উপন্যাসটি লিখতে প্রবৃত্ত হয়েছেন সেটা প্রমাণ করার জন্য গোরাকে মুচি, মেথর, কিংবা মুসলমানের ঘরে জন্ম দিলেও তো পারতেন।’ (ছফা ১৯৯৫ : ৩৭)
আহমদ ছফা কবুল করিয়াছেন, মোর্তজার যুক্তির ধারা দেখিয়া তিনি ‘একটুখানি চমকে’ উঠিয়াছিলেন। তবে তিনি ‘নিজের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা’ হারান নাই। তাঁহার বিশ্বাস ছিল, রবীন্দ্রনাথ যে সত্যের প্রতিষ্ঠা দেওয়ার চিন্তা করিয়াছিলেন, মর্মবস্তুর বিচারে এয়ুরোপিয়া নারীর গর্ভে গোরার জন্ম দিয়া সেই সত্যের ওপর কোন অবিচার তিনি করেন নাই। কিন্তু চিরকাল কাহারও সমান যায় না। নিরবধি কালের বাজারে মোহাম্মদ মোর্তজার মতন অনেক শহিদের রক্তের বিনিময় ঘটিয়াছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিপ্লবের সহায়ক শক্তি ভাবিতে পারিতেছিলেন না বলিয়াই মোহাম্মদ মোর্তজা গোরা সম্পর্কে এ ধরনের একটি ‘নিষ্ঠুর কথা’ বলিতে পারিয়াছিলেন—এই ছিল ১৯৬৮ সালের আহমদ ছফার সন্দেহ। সেই বিপ্লব আজো দিল্লির মতন দূরেই রহিয়াছে। কিন্তু আহমদ ছফার মনে একটা বিপ্লব ঘটিয়া গিয়াছে।
১৯৯০ সালের দশকে—খুব সম্ভব ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসের পর—আহমদ ছফার ভাবজগতে পরিবর্তনের একটা সূত্রপাত হইয়া থাকিবে। তিনি লিখিতেছেন, ‘তারপরও আমি অনেকবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে “গোরা” পড়েছি। কতবার বলতে পারব না। গত বিশ-পঁচিশ বছরে অন্তত একশবার তো হবেই। মোর্তজা সাহেব আমার মনে যে প্রশ্নের বীজটি জন্ম দিয়ে গিয়েছিলেন আমি সেটি মন থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলতে পারিনি।’ (ছফা ১৯৯৫ : ৩৭)
এই নাছোড়বান্দা চিন্তার শস্যস্বরূপ এতদিনে তিনি কয়েকটি নতুন প্রস্তাবে আস্থা স্থাপন করিয়াছেন। আহমদ ছফা এখন মনে করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গোরা চরিত্রটি গঠিয়াছিলেন বিশেষ কোন ‘উচ্চ আকাঙ্ক্ষা’র বশীভূত হইয়া : ‘রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় জনগণের মধ্যে সংস্কারমুক্তি ঘটিয়ে এখানে মানবমুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। তার প্রতীক হিশেবে গোরাকে সৃষ্টি করেছিলেন—তাতে কোন সন্দেহ নেই।’ (ছফা ১৯৯৫ : ৩৭)
রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষে মানবমুক্তির স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন কি দেখেন নাই তাহা মোটেও বিতর্কের কথা নহে। কথা হইতেছে, গোরা সেই মুক্তির দিশারি বা প্রতীক হইতে পারেন কি না। আহমদ ছফার ধারণা :
‘ভারতীয় চিন্তাভাবনার একনিষ্ঠ প্রবক্তা হিশেবে সারাবিশ্বে রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি থাকলেও ভারতীয় প্রাণবস্তুর উত্থানের সাহায্যে ভারতের মুক্তি সম্ভব—এ কথা রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন না। পশ্চিমা বিজ্ঞান এবং কৃৎকৌশলের প্রতি রবীন্দ্রনাথের একধরনের বিশ্বাস ছিল—সে কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। এই নিয়ে মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে তিনি দীর্ঘ বিতর্কে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।
আহমদ ছফা নিজে অবশ্য এই প্রশ্নে দীর্ঘ বিতর্কে প্রবেশ করিতে চাহেন নাই। ধরিয়া লইলাম, এই প্রশ্নে তিনিও রবীন্দ্রনাথের পথ ধরিতে রাজি—অন্তত নিমরাজি তো বটেনই। সমস্যার কথা, তাঁহার পরের জিজ্ঞাসার বায়ু এখানে আরেকটু চড়িয়াছে। তিনি লিখিতেছেন :
‘রবীন্দ্রনাথ গোরা এবং সুচরিতার মিলনের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের হিন্দু এবং ব্রাহ্ম সমাজের মধ্যবর্তী সংকটের একটা সমাধান নির্দেশ করতে পেরেছিলেন।
কিন্তু ভারতবর্ষ তো কেবল হিন্দু এবং ব্রাহ্মদের দেশ নয়। এখানে হিন্দু-ব্রাহ্ম ছাড়া মুসলমান, শিখ, [আদিবাসী], খ্রিস্টান এবং অচ্ছুৎ সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস রয়েছে। সে বিষয়টি রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় কোনরকম প্রভাব ফেলতে পেরেছে—এ কথা তো একেবারেই মনে হয় না।’ (ছফা ১৯৯৫ : ৩৭)
হিন্দু এবং ব্রাহ্ম সম্প্রদায়ের ঝগড়াঝাঁটি পরাধীন ভারতের—বিশেষ বাংলা প্রদেশের, একটি বড় ঘটনা—এ কথা মানিয়া লইলেও লওয়া যায়। কিন্তু—আহমদ ছফা কহিতেছেন—‘হিন্দু এবং ব্রাহ্মদের মধ্যবর্তী বিবাদ মিটে গেলে ভারতের সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সম্প্রীতি সৃষ্টি হবে—এটা তো কিছুতেই সত্য হতে পারে না।’ এক্ষণে আহমদ ছফা একটা কাজের কথা বলিয়াই ফেলিলেন : ‘গোরার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের যে চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটেছে তা দিয়ে ভারতীয় জনগণের মুক্তি সম্ভব হতে পারে—সেটা দূরতম কল্পনাতেও সঠিক বলে মনে হয় না।’
পরিশেষে দেখি, তিনি এককাঠি তোলাও দিলেন আমাদের। তো এই গোরাটা আসলে কি বস্তু? এই স্তব্ধতার কানে কানে ফিসফিস করিলেন তিনি : ‘গোরা চরিত্রের মধ্যে এমন একটা অবাস্তবতা রয়েছে [যাতে] অনায়াসে তাকে বিবেকানন্দ-শিষ্যা পুরুষ নিবেদিতা মনে করা যায়। নিবেদিতা যেমন ভারতীয় না হয়েও ভারতের কল্যাণে সর্বস্ব বিসর্জন দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ নিজের অজান্তে গোরার মধ্য দিয়ে সেরকম একটি পুরুষ চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন।’ (ছফা ১৯৯৫ : ৩৭)
রবীন্দ্রনাথ এই কাজের কাজটা ‘নিজের অজান্তে’ করিয়া ফেলিয়াছিলেন বলিয়া আহমদ ছফার দাবি। মহাজনের পথ ধরিয়া আমরাও কি দাবি করিতে পারি না, আহমদ ছফাও কথাটা অনেকটা ‘নিজের অজান্তে’ বলিয়া ফেলিয়াছেন? প্রমাণ, দুই বছরের মাথায় তিনি এই কথাটা সামান্য ঘুরাইয়া আবারো বলিলেন : ‘নিবিষ্ট পাঠকের মনে হবে সিস্টার নিবেদিতাকে পুরুষ চরিত্রে রূপান্তরিত [করে] গোরাকে সৃষ্টি করেছেন রবীন্দ্রনাথ।’ (ছফা ২০০৮খ : ৩৯৫)
আমরা আগেই দেখিয়াছি, রবীন্দ্রনাথ তাঁহার শিলাইদহের মুসলমান প্রজাদের লইয়া লিখিতে বড় রাজি হয়েন নাই। সেটা যতটা না উহারা মুসলমান বলিয়া ততটা হ্যাঁ লোকগুলি প্রজা বলিয়াও। ১৯৯৫ নাগাদ আহমদ ছফার সিদ্ধান্ত দাঁড়াইল : ‘রবীন্দ্রনাথ গোরার মধ্য দিয়ে ভারতের যে মুক্তি চিন্তা করেছিলেন সেটা রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর শ্রেণির মুক্তিচিন্তা। কিছুতেই সর্বভারতীয় জনগোষ্ঠীর মুক্তিচিন্তার প্রতীক হিশেবে গোরাকে দাঁড় করান যাবে না।’ (ছফা ১৯৯৫ : ৩৭)
আর ১৯৯৭ সালে আসিয়া দেখি একটি অনুসিদ্ধান্তও যোগ হইতেছিল। আহমদ ছফার মতে, ‘সমস্ত উপন্যাসটাই ঔপনিবেশিক পাটাতনের ওপর ভিত্তি করে রচিত।’ আহমদ ছফা আরো এক কদম আগাইয়া যাইতেছেন : ‘রবীন্দ্রনাথের সমস্ত আয়ুষ্কালটা ঔপনিবেশিক শাসনামলের মধ্য দিয়েই অতিবাহিত হয়েছে। ঔপনিবেশিক চিন্তাচেতনা তাঁর সৃষ্টিকর্মে ছাপ ফেলেনি—এ কথা সত্যি নয়।’ (ছফা ২০০৮খ : ৩৯৫)
৪
আহমদ ছফা যে সিদ্ধান্তটি আপাতদৃষ্টিতে নিছক একটা কথার কথা আকারে গ্রহণ করিয়াছেন তাহা আমাদের দেশের—শুদ্ধ আমাদের দেশের কেন, গোটা পৃথিবীরই—ঔপনিবেশিক বা পরাধীন যুগের ইতিহাস দ্বারাও আমরা সমর্থন করিতে পারি। জগৎপ্রসিদ্ধ ফ্রানৎস ফানোঁ তাঁহার ‘দুনিয়ার মজলুম’ গ্রন্থের এক জায়গায় দেখাইয়াছেন, পরাধীন দেশের লেখককুলের ইতিহাস তিন যুগে ভাগ করিয়া লেখা চলে। প্রথম যুগের লেখকেরা বিজয়ীজাতির সংস্কৃতি—বিশেষ করিয়া তাহাদের ভাষা ও সাহিত্য—আপনার করিয়া লইতে গ্রীবা বাড়াইয়া দেন। পারতপক্ষে তাঁহারা ইংরেজ কি ফরাশি হইতে পারিলেই বাঁচেন। তাঁহাদের কেহ বাংলার মিল্টন, কেহ বাংলার স্কট আর কেহ বা বাংলার শেলী বলিয়া অভিহিত হন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বসিয়া তাঁহারা জন ব্রাইটের বক্তৃতায় আপ্লুত থাকেন। এই যুগের নাম এই লেখকদের সন্তানেরাই পরে রাখিয়াছেন, ‘বাংলার রেনেসাঁস’। ফানোঁ লিখিয়াছেন, ‘এই আপাদমস্তক একাকার হইবার যুগে আমরা পরাধীন জাতির লেখকদের মধ্যে ‘পার্নাস পথুমতি’, নিশান ব্যবসায়ী আর পরাবাস্তব ব্যবসায়ীদের দেখা পাইতে থাকি।’ (ফানোঁ ২০০২ : ২১১; ফানোঁ ২০০৪ : ১৫৯)
পরাধীনতা ব্যবসায়ের দ্বিতীয় যুগে দেখা যায় এই লেখকদের কাঁহারও কাঁহারও পালে উল্টা বাতাস লাগিতে শুরু করিয়াছে। ফানোঁ প্রস্তাবিত এই যুগকে অনেকেই ‘স্বদেশি যুগ’ বলিয়া থাকেন। সমস্যার মধ্যে, স্বদেশের জনসাধারণের সহিত এই যুগের বুদ্ধিজীবীদের একটা বিরাট ফারাকও ততদিনে তৈয়ার হইয়া গিয়াছে। ইঁহারা তখন পুরাকালের কাহিনী আবিষ্কারে মগ্ন হইয়াছেন, কেহ বা লোকসাহিত্য আর রাজস্থানের গল্প লিখিতে বসিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই এই যুগের নাম রাখিয়াছিলেন বাংলা সাহিত্যে ‘রাজপুতানার যুগ’।
এই যুগ হইতে বাহির হইয়া আসিয়া আপনকার যুগ প্রবর্তনের বাসনাতেই বোধ করি রবীন্দ্রনাথ ‘গোরা’ প্রভৃতি কাহিনীর সূত্রপাত করিয়াছিলেন। বিশেষের মধ্যে, আপন যাপিত জীবনের শেষ দুই কি তিন দশকে জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সহিত রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ কম হইয়া আসিয়াছিল। তাহার প্রমাণ ঢের। উদাহরণস্থলে জসীম উদ্দীন বিরচিত ‘ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়’ নামক স্মৃতিকথার দৌলতে আমরা জানিতে পারি রবীন্দ্রনাথের বৃদ্ধ বয়সে এই বিরহ আরো বাড়িয়া যায়। বিরহের অনুষঙ্গ পরকীয়া—তাহাও ভুলিলে চলিবে না। জসীম উদ্দীন এক জায়গায় যাহা লিখিয়াছেন তাহা স্মরণীয়।
একদিন আমি কবির সঙ্গে দেখা করিতে যাইতেছি, কবির পুত্র রথীন্দ্রনাথ আমাকে একান্তে ডাকিয়া বলিলেন, ‘এখন বাবার শরীর অসুস্থ। আপনাকে দেখলেই তিনি হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। তাতে মাঝে মাঝে বড়ই উত্তেজিত হয়ে পড়েন। অসুস্থ শরীরে এই উত্তেজনা খুবই ক্ষতিকর। আপনি কিছুদিন বাবার সঙ্গে দেখা করবেন না।’
আমি তখনকার মত কবির সঙ্গে কিছুদিন দেখা করিলাম না।
মুসলমানদের প্রতি কবির মনে কিছু ভুল ধারণা ছিল। তিনি সাধারণত হিন্দু পত্রিকাগুলিই পড়িতেন। মুসলমানী পত্রিকার এক-আধ টুকরা মাঝে মাঝে কবির হাতে পড়িত।
কবির ভুল ধারণার প্রতিবাদ করিয়া উপযুক্ত কারণ দেখাইলেই কবি তাঁহার ভুল সংশোধন করিয়া লইতেন। কবির মনে একদেশদর্শী হিন্দুত্বের স্থান ছিল না। মুসলমানদের মধ্যে যাঁহারা স্বাধীন মতবাদ লইয়া ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থার সমালোচনা করিতেন, তাঁহাদের প্রতি কবির মনে প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল। কিন্তু তাঁহাদের বিষয়ে কবির পক্ষে বেশি কিছু অনুসন্ধান করা সম্ভব ছিল না। কবির নিকটে যাঁহারা আসিতেন, কবি শুধু তাঁহাদিগকেই জানিতেন। এই বয়সে ইহার বেশি খবরাখবর লওয়া কবির পক্ষে সম্ভবও ছিল না। (উদ্দীন ২০০৩ : ৩১-৩২)
ফ্রানৎস ফানোঁ তৃতীয় অর্থাৎ সর্বশেষ একটি যুগের কথাও বলিয়াছিলেন। এই যুগের নাম—তাঁহার কথায়—‘লড়াইয়ের যুগ’। এই যুগের লেখকেরা জনগণের মধ্যে হারাইয়া যাইতে চাহিলেও ঠিক হারাইয়া যাইতে পারেন নাই। ইঁহারা তখন জনগণকে মাতাইয়া তুলিবার মতন গান গাহিতে শুরু করিলেন, লিখিতে শুরু করিলেন সব নব নব জাগরণের, জাতীয় উদ্দীপনার কবিতা। জনগণের পিছু পিছু না হাঁটিয়া, বরং অগ্রপথিক বা সেনাদলের জায়গা দখল করিলেন ইঁহারা। বাংলাদেশে এই যুগের একনম্বর পথিক কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি শুদ্ধ লিখিলেনই না, কারাগারেও গেলেন, অনশন করিয়া একদিন এমনকি প্রায় প্রাণ বিসর্জনেও রাজি হইলেন।
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশে হিন্দু ও মুসলমানের মিলনের গানও গাহিতে শুরু করিয়াছিলেন। এই ধরনের গান স্বদেশি যুগের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কদাচ গাহিতে পারেন নাই। নজরুল ইসলামের ভাষার মধ্যে যে নতুন যুগের—লড়াইয়ের যুগের—আঁচ লাগিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাহাতে পুড়িয়া গেলেন। কিভাবে পুড়িলেন তাহা একটা উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হইবে।
আমাদের দুর্ভাগা যুগের জনৈক যশস্বী মনীষী লিখিয়াছেন, ‘... সমালোচনার ব্যাপারে মুসলমানদের সহনশীলতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সন্দেহ ছিল।’ মনীষী আনিসুজ্জামান (পদ্মভূষণ) একটা মেসাল দিয়াছেন :
‘পাঠ্যবই ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে সেকালে মুসলমান সমাজের পক্ষ থেকে যে বাগবিতণ্ডা বিস্তারলাভ করেছিল, তাও রবীন্দ্রনাথকে ক্ষুব্ধ করেছিল। ইউরোপীয় সাহিত্যের দৃষ্টান্ত টেনে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে অনেক সময়ে সাহিত্যে এমন কিছু কথা এসে যায় যা একটি সম্প্রদায়কে আঘাত করতে পারে, কিন্তু সে কারণে যা সাহিত্য পদবাচ্য তার পঠনপাঠন বন্ধ হয় না (তিনি ‘ওথেলো’ নাটকেরও উল্লেখ করেছিলেন)। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনায় সম্প্রদায়-বৈরিতার উদাহরণ শোচনীয় মনে করলেও তেমন রচনা নির্বাসিত করার দাবি তিনি অযৌক্তিক ভেবেছিলেন।’ (আনিসুজ্জামান ২০১২ : [৮])
এখানেই ঘটনার শেষ নয়। ইংরেজি ভাষায় যাহাকে বলে ‘অ্যাপোলজি’ বা ‘অপলাপ’—বাংলা জবানে তাহাকে আমরা ‘সাফাই’ বলিতে পারি। আনিসুজ্জামান আরো যাহা লিখিয়াছেন তাহাকে সাফাই ছাড়া আর কিই বা বলা যায়! তিনি অধিক যাহা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন তাহা সত্যের অধিক :
‘এই পটভূমিকায় বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের দাবি ও প্রবণতা তিনি [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর] অনুমোদনযোগ্য মনে করেননি। আরবি-ফারসি শব্দ, এবং পূর্ববঙ্গের আঞ্চলিক শব্দও, আমাদের সাহিত্যে যেমন স্বাভাবিকভাবে চলে এসেছে, তাতে তাঁর আপত্তি ছিল না—জসীম উদ্দীন ও বন্দে আলী মিয়ার গুণগ্রাহিতা এই প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য। কিন্তু অনেকটা স্বাতন্ত্র্যবাদী চেতনা থেকে যখন অধিকতর আরবি-ফারসি শব্দ প্রয়োগের দাবি উঠল, তখন রবীন্দ্রনাথ তাতে আপত্তি জানালেন। ইংরেজির ক্ষেত্রে স্কটিশ বা ওয়েলশরা এমন দাবি করেনি, এ কথা তিনি একাধিকবার বলেছেন। মুসলমানদের নিত্যব্যবহার্য শব্দ ব্যবহারের দাবির মত ইউরেশীয়রাও যদি বাংলা ভাষায় তাদের নিত্যব্যবহার্য শব্দ প্রয়োগের দাবি তোলে, তাহলে ভাষার চেহারা কেমন হবে, সে কথাও তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন।’ (আনিসুজ্জামান ২০১২ : [৮])
আনিসুজ্জামানের সত্যনিষ্ঠা এই পর্যন্ত আসিয়া বিশুদ্ধ ওকালতির—বা রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাবিত পরিভাষায় ‘অধিবক্তা’র—ভূমিকায় নামিয়া আসিল। কোন সাক্ষ্য-প্রমাণের তোয়াক্কা না করিয়াই তিনি মিছামিছি লিখিলেন : ‘এই প্রসঙ্গেই “রক্ত” অর্থে “খুন” শব্দের ব্যবহারে তাঁর আপত্তির কথা বলেছেন কবি, যদিও “খুন-খারাবি”তে তাঁর আপত্তি নেই। আমরা জানি, “খুন” সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য নজরুল ইসলামকে লক্ষ্য করে কথিত বলে নজরুল স্বয়ং মনে করেছিলেন, তবে কথাটা ঠিক নয়।’ (আনিসুজ্জামান ২০১২ : [৮])
কথাটা যে ঠিক নয়, তাহা আপনি কিভাবে জানিলেন, মহাশয়? কোন প্রমাণের জোরে? এই বিতর্কের আয়ু একশত বছর হইতে আর বেশিদিন বাকি নাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই দুর্ভাগ্যজনক মন্তব্যটি নজরুল ইসলামকে লক্ষ্য করিয়া না করা হইয়া থাকিলে আর কাঁহাকে যে লক্ষ্য করিয়া করা হইয়াছিল সে সত্য আজ পর্যন্ত কেহ নির্দেশ করেন নাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর করেন নাই, প্রমথ চৌধুরী করেন নাই, আনিসুজ্জামানও আবিষ্কারটা করিলেন না। একটা সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হইয়া গেল। একটা দুঃখ থাকিয়াই গেল। অদূর ভবিষ্যতে কেহ এই আবিষ্কারটুকু করিবেন—এমন ভরসাও রহিল না। আপাতদৃষ্টে মনে হয়, সুমিতা চক্রবর্তীর লেখা—যাহাকে এই বিষয়ের চূড়ান্ত মীমাংসা গণ্য করা যাইতে পারে—আনিসুজ্জামানের নজরে আসে নাই। (চক্রবর্তী ২০০৭)
আনিসুজ্জামানের সততা লইয়া অধিক মন্তব্য সমীচীন হয় না। কারণ, সবিনয় নিবেদন করি, একই বিষয়ে আমিও আমার বিশ্লেষণ পত্রিকান্তরে প্রকাশ করিয়াছি। (খান ২০১১) তদুপরি তিনি ছিলেন আহমদ ছফার শিক্ষক। আর আহমদ ছফা আমার শিক্ষক বটেন। জীবজন্তুর শেষ নিঃশ্বাসের ন্যায় যে বিশ্বাসের বায়ু গতকালও আমার প্রাণে আসা-যাওয়া করিতেছিল এই অতিভাষণ পাঠ করিবার পর তাহাও আর রাখিতে পারিলাম না। বুঝিতে পারিলাম, আমাদের পরাধীনতার যুগ আজো শেষ হয় নাই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নমস্য। তিনি পরাধীনতার দুই দুইটি যুগ সাফল্যের সহিত পার হইয়াছিলেন। দুঃখের বিষয়, তৃতীয় যুগটা তিনি আমলই করিতে পারেন নাই। আর পদ্মভূষণ প্রমাণ করিতেছেন তিনি আজো দ্বিতীয় যুগেই আটক রহিয়াছেন। তবে কি না বলিতে হয়, রবীন্দ্রনাথের যুগে যাহা ট্রাজেডি, আনিসুজ্জামানের জমানায় তাহা প্রহসনের রূপ ধরিয়াছে।
ফ্রানৎস ফানোঁ বৃথা বলেন নাই, ‘যাহার যাহা কর্তব্য তাহার তাহা—তুলনার ভাষায় বলিতে খানিক আবছায়ার মধ্যে—পুরুষ হইতে পুরুষান্তরে নতুন করিয়া নির্ণয় করিতে হয়। এই কর্তব্য তাহারা হয় পালন করিবেন, নয় তাহার সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিবেন।’ (ফানোঁ ২০০২ : ১৯৭; ফানোঁ ২০০৪ : ১৪৫)
দোহাই
১ আনিসুজ্জামান, ‘ভূমিকা,’ ভূঁইয়া ইকবাল সম্পাদিত, রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ, ২য় সংস্করণ (ঢাকা : প্রথমা প্রকাশন, ২০১২), পৃ. [৭]-[৯]; ১ম প্রকাশ ২০১০।
২ _______ সম্পাদিত, রবীন্দ্রনাথ, পুনর্মুদ্রণ (ঢাকা : অবসর, ২০০৯); ১ম সংস্করণ ১৯৬৮।
৩ মহিউদ্দিন আহমদ, আওয়ামী লীগ : উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০ (ঢাকা : প্রথমা প্রকাশন, ২০১৬)।
৪ ভূঁইয়া ইকবাল সম্পাদিত, রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ, ২য় সংস্করণ (ঢাকা : প্রথমা প্রকাশন, ২০১২); ১ম প্রকাশ ২০১০।
৫ জসীমউদ্দীন : ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়, ৭ম মুদ্রণ (ঢাকা : পলাশ প্রকাশনী, ২০০৩)।
৬ সলিমুল্লাহ খান, ‘বাঙ্গালাভাষায় রক্তের ব্যবসায়,’ পাক্ষিক অন্যদিন, ঈদ সংখ্যা ২০১১।
৭ সুমিতা চক্রবর্তী, ‘বাংলা সাহিত্যে খুনের মামলা : অন্তিম রায়,’ সৃষ্টি-স্বাতন্ত্র্যে নজরুল (কলকাতা : পুস্তক বিপণি, ২০০৭), পৃ. ১৬১-৬৮।
৮ আহমদ ছফা, শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ (ঢাকা : বুক সোসাইটি, ১৯৮৯)।
৯ _______ আনুপূর্বিক তসলিমা এবং অন্যান্য স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ (ঢাকা : স্টুডেন্ট ওয়েজ, ১৯৯৪)।
১০ _______ ‘রবীন্দ্রনাথের “গোরা” উপন্যাস : নতুন ভাবনাচিন্তা,’ রোববার, ১৩ আগস্ট ১৯৯৫।
১১ _______ আহমদ ছফা বললেন... : সাক্ষাৎকার পুস্তক (ঢাকা : র্যামন পাবলিশার্স, ১৯৯৬)।
১২ _______ ‘একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা,’ আহমদ ছফা রচনাবলি, নূরুল আনোয়ার সম্পাদিত, ১ম খণ্ড (ঢাকা : খান ব্রাদার্স, ২০০৮ক), পৃ. ৪৮৭-৫১১।
১৩ _______ ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : শতবর্ষের ফেরারি,’ আহমদ ছফা রচনাবলি, নূরুল আনোয়ার সম্পাদিত, ৫ম খণ্ড (ঢাকা : খান ব্রাদার্স, ২০০৮খ), পৃ. ৩৫৩-৪০০।
১৪ _______ ‘রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি সাধনা,’ আনিসুজ্জামান সম্পাদিত, রবীন্দ্রনাথ, পুনর্মুদ্রণ (ঢাকা : অবসর, ২০০৯), পৃ. ২৫৪-৫৮; ১ম সংস্করণ ১৯৬৮।
১৫ _______ [‘জয়তু রবীন্দ্রনাথ’], আহমদ ছফার ‘স্বদেশ’, সলিমুল্লাহ খান সম্পাদিত (ঢাকা : আগামী প্রকাশনী এবং এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভা, ২০১৫), সম্পাদকীয়, পৃ. ১২০; ১ম প্রকাশ : আহমদ ছফা সম্পাদিত, স্বদেশ, ১ম বর্ষ ২য় সংখ্যা, চৈত্র ১৩৭৬ [১৯৭০]।
১৬ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব, পুনর্মুদ্রণ (ঢাকা : ন্যাশনাল বুদ্ধিষ্ট ইয়ুথ ফেডারেশন, ১৩৭৯)।
১৭ _______ পারস্য-যাত্রী, পুনর্মুদ্রণ (কলকাতা : বিশ্বভারতী, ১৩৯২)।
১৮ অমিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়, মহিলাদের স্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ (কলিকাতা : বিশ্বভারতী, ১৯৬৪)।
১৯ তারেক মাসুদ, চলচ্চিত্রযাত্রা, ক্যাথরিন মাসুদ সম্পাদিত (ঢাকা : প্রথমা প্রকাশন, ২০১২)।
২০ বন্দে আলী মিয়া, জীবনের দিনগুলি (ঢাকা : আহমদ পাবলিশিং হাউজ, ১৩৭৩)।
২১ _______ বন্দে আলী মিয়া রচনাবলী, আলাউদ্দিন আল আজাদ সম্পাদিত (ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৪০৪)।
২২ [বিনয় কুমার সরকার], বিনয় সরকারের বৈঠকে, হরিদাস মুখোপাধ্যায় ও অন্যান্য সম্পাদিত, ১ম ভাগ, পুনর্মুদ্রণ (কলকাতা : দে’জ পাবলিশিং, ২০০৩); ১ম সংস্করণ ১৯৪২।
২৩ Franty Fanon, Les damnés de la terre (Paris : La Decovuerte, 2002).
২৪ _______ The Wretched of the Earth, trans. Richard Philcox (Nwe York : Grove Press, 2004).
(সলিমুল্লাহ খান সম্পাদিত ‘আহমদ ছফা স্মৃতি’ গ্রন্থমালার প্রথম খণ্ড ‘গরিবের রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ের ভূমিকা হিসেবে লিখিত। প্রকাশক : মধুপোক। পরিবেশক : বাতিঘর ও কাক বইঘর। পৃষ্ঠা ১৪৪। মূল্য ২৯৫ টাকা।)