আফরা বেন
প্রথম পেশাদার নারী সাহিত্যিক
‘নারীরা শেকসপিয়ারের মতো লিখতে পারে না কেন?’ এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে গিয়ে ব্রিটিশ নারীবাদী লেখিকা ভার্জিনিয়া উলফ (১৮৪২-১৯৪১) একটা মৌলিক প্রশ্ন তুলেছিলেন : শিল্পে, সাহিত্যে, উপন্যাসে কেন নারীরা পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে?
এই পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে লেখিকা দায়ী করেছিলেন সমাজ বাস্তবতাকে—নারীর অর্থনৈতিক পরাধীনতা ও নিজের একটি কক্ষ না থাকাকে, যেখানে নারী একমনে তাঁর মতো করে সাহিত্যচর্চা করবে।
লেখিকা যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন, জেইন অস্টেন (১৭৭৫-১৮১৭) থেকে ব্রন্টি-বোনেরা (চার্লট ব্রন্টি ও এমিলি ব্রন্টি), জর্জ এলিয়ট (১৮১৯-১৮৮০), আসল নাম মেরি অ্যান ইভানস (সাহিত্য প্রকাশের স্বার্থে পুরুষের নাম নিতে হয় লেখিকাকে) ও মেরি কারমাইকেল পর্যন্ত সব লেখিকাই অনেক প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও শেকসপিয়ারের মতো স্তরে উঠতে পারেননি শুধু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নানা সীমাবদ্ধতার কারণে। যদি নিজস্ব একটা ঘর আর ৫০০ পাউন্ডের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়, তাহলে নারীরাও অনেক উন্নতমানের সাহিত্য উপহার দিতে পারত—এই ছিল ভার্জিনিয়া উলফের যুক্তি।
ভার্জিনিয়া উলফ রচনা করেছিলেন নারী স্বাধীনতার প্রথম সনদ ‘এ ভিনডিকেশন অব রাইটস অব উইম্যান’। তাঁর ওই রচনারও প্রায় ২০০ বছর আগে ইংল্যান্ডের ক্যান্টাবেরির কাছে ১৬৪০ সালের ১৪ ডিসেম্বরে জন্মেছিলেন বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম পেশাদার নারী সাহিত্যিক আফরা বেন (Aphra Behn)। ভার্জিনিয়া উলফের তোলা প্রশ্নগুলো সামনে রেখে আমরা আফরা বেনকে স্মরণ করছি।
‘এ রুম অব ওয়ানস ওউন’ গ্রন্থে ভার্জিনিয়া উলফ আফরা বেন সম্পর্কে বলেছেন : ‘All women together ought to let flowers fall upon the tomb of Aphra Behn, ...for it was she who earned them the right to speak their minds.’ বোঝা যায় যে উলফ আফরা বেন সম্পর্কে খুবই উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন।
ব্রিটিশ লেখিকা আফরা বেন বিখ্যাত হয়েছিলেন তাঁর রচিত নাটক, গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও অনুবাদ সাহিত্যের কারণে। এখনকার সময়ের চেয়েও পিছিয়ে থাকা সময়ে নারী হয়ে তিনি লিখেছিলেন তৎকালীন সমাজের রূঢ় বাস্তবতাগুলো নিয়ে। জীবিত অবস্থায় তিনি ছিলেন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তাঁর লেখায় সমাজ সচেতনতা, লিঙ্গসমতা ও বর্ণবাদ বিরোধিতা তাঁকে সাহিত্যজগতে করে তুলেছে অনন্য। নিজেকে একজন পেশাদার লেখক হিসেবে তিনি দাবি করতেন। শুধু লেখালেখি করেই তিনি স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহ করেছিলেন ওই সময়ে। সে হিসেবে পৃথিবীর প্রথম পেশাদার নারী লেখক হিসেবে তাঁকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
তাঁর সাহিত্যকর্মগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি উপন্যাস ‘অরুনোকো’ (Oroonoko), যেটিকে আজও ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে ধরা হয়। তাঁর মৃত্যুর এক বছর আগে ১৬৮৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল উপন্যাসটি।
আফ্রিকার সুরিনাম দেশের রাজপুত্র অরুনোকোর দাস মালিকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কাহিনী নিয়েই এই উপন্যাস। অরুনোকোর কাহিনী ছিল অনেকটা এমন :
অরুনোকোর পিতামহ (দাদা) ছিল আফ্রিকার একটি সম্প্রদায়ের রাজা। প্রচণ্ড লোভী ও বর্বর এই রাজার ছিল অনেক পত্নী-উপপত্নী ও সেবা দাসী। অরুনোকো ভালোবেসেছিল ইমোইন্ডাকে, গোপনে বিয়েও করেছিল তারা। কিন্তু অরুনোকোর দুশ্চরিত্র দাদা ইমোইন্ডাকে বিয়ে করতে চায়। তাতে রাজি না হওয়ায় জোর করে ইমোইন্ডাকে বানায় তার সেবাদাসী।
তবুও অরুনোকো আর ইমোইন্ডার প্রেম বাধা মানে না। একদিন ধরা পড়ে যায় ওরা। রাজা ইমোইন্ডাকে ক্রীতদাসী হিসেবে বেঁচে দেয় জঙ্গলে আর অরুনোকোকেও ক্রীতদাস বানিয়ে বিক্রি করে দেয়। অনেক জায়গায় হাতবদল হয়ে অরুনোকো একদিন সেই জঙ্গলেই নির্বাসিত হয়ে ফিরে আসে, যেখানে তার প্রেমিকা ইমোইন্ডা আছে।
আবার মিলন ঘটে অরুনোকো আর ইমোইন্ডার। সেখানে তারা নিয়মিত মিলিত হতে থাকে। ফলে ইমোইন্ডা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। নিরাপদ প্রসবের জন্য অরুনোকো ইমোইন্ডাকে দেশে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু এই আবেদন নাকচ করে দেয় ব্রিটিশ দাস মালিক ট্রেফরি ও ডেপুটি গভর্নর বিয়াম। প্রতিবাদী হয়ে ওঠে অরুনোকো। অন্যান্য ক্রীতদাসকে সঙ্গে নিয়ে মালিকের বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে। সেই যুদ্ধে ক্রীতদাসরা পরাস্ত হয়। ইংরেজ ডেপুটি গভর্নর বিয়াম অরুনোকোর ওপর বর্বরতম নির্যাতন চালায়। তারপর শর্ত চাপিয়ে তাকে মুক্তি দেয়।
মুক্তি পেয়ে বিদ্রোহী অরুনোকো বিয়ামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার প্রস্তুতি নেয়। সেই যুদ্ধে তার মৃত্যুর আশঙ্কা আছে। তার মৃত্যুতে স্ত্রী ইমোইন্ডার জীবনে যে অপমান নেমে আসবে, তা থেকে মুক্তি দিতে স্ত্রীর সম্মতিতে যুদ্ধের আগেই অরুনোকো ইমোইন্ডাকে হত্যা করে। কিন্তু বিয়ামকে মারতে পারে না অরুনোকো। বন্দি অরুনোকোকে মেরে রক্তাক্ত করে তার সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে সর্দারদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়।
দাসপ্রথার বিরুদ্ধে যোদ্ধা অরুনোকো যেন রোমের দাস বিদ্রোহের কিংবদন্তি নেতা স্পার্টাকাসেরই উত্তরসূরি। একই সঙ্গে অরুনোকো আমাদের সামনে একজন প্রেমিক ও স্বামীর প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে, যে তার স্ত্রীর সম্মান রক্ষার জন্য যুদ্ধ করে।
আফরা বেনের জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। তথ্য খুবই কম, নির্ভরযোগ্য তথ্য আরো কম। পৈতৃক নাম আফরা জনসন। তাঁর শৈশব-কৈশোরের সময়টা ছিল ইংল্যান্ডের রাজতন্ত্রের সংকটকাল, যাকে ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের কাল হিসেবে ধরা হয়।
ধারণা করা হয়, তিনি ১৬৬৩-৬৪ সালের দিকে আফ্রিকার সুরিনামে ছিলেন। আর সেখানেই তিনি অরুনোকোর কাহিনী বর্ণনাকারীর দেখা পান। ১৬৬৪ সালে লন্ডনে ফিরে তিনি মিস্টার বেন নামের এক বণিককে বিয়ে করেন। মিস্টার বেন ১৬৬৫ সালে মারা যান। তবে অনেকে মনে করেন, লেখিকা আত্মরক্ষার স্বার্থে নিজেকে বিবাহিত বলে দাবি করতেন, বাস্তবে তিনি বিয়েই করেননি।
ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের সুনজরে থাকায় কিছুদিন তিনি ব্রিটিশ সরকারের গুপ্তচর হিসেবেও কাজ করেছেন। বিনা বেতনের চর হিসেবে কাজ করতে গিয়ে অনেক দেনা করে ফেলেন লেখিকা, ফলে ঋণের দায়ে তাকে জেলখানায় কাজ করতে হয়েছিল। এর পর তিনি গুপ্তচরবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে নাটকে মনোনিবেশ করেন।
তাঁর প্রথম নাটক ছিল ‘দ্য ফোর্সড ম্যারেজ’ (১৬৭০), যা তাঁকে খ্যাতি ও অর্থ, দুই-ই এনে দেয়। ১৬৭১ সালে করেন ‘দি আমোরাস প্রিন্স’। এরপর একে একে ‘দ্য ডাচ লাভার’ (১৬৭৩), ‘আবদেলাজার’ (১৬৭৬), ‘দ্য টাউন ফপ’ (১৬৭৬), ‘দ্য ডেবাউচে’ (১৬৭৭), ‘দ্য কাউন্টার ফিট ব্রাইডগ্রুম’সহ (১৬৭৭) বেশ কয়েকটি সফল নাটক রচনা করেন।
ইংল্যান্ডের সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে জটিলতা তৈরি হলে (১৬৭৯-৮১) সেই সংকট নিয়ে মন্তব্য করার কারণে আফরা বেনকে আইনি হাঙ্গামা পোহাতে হয়।
আফরা বেনের সবচেয়ে সফল নাটক ছিল ১৬৭৭ সালে মঞ্চস্থ করা ‘দ্য রোভার’। ‘দ্য রোভার’-এর দ্বিতীয় অংশ মঞ্চস্থ করা হয় ১৬৮১ সালে। তাঁর অনেক নাটকেই যৌন বিষয় উপস্থাপনের কারণে সমসাময়িক সময়ে তিনি প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছেন।
তাঁর কবিতার বইয়ের মধ্যে ‘পোয়েমস আপন সেভারেল অকেশনস’ (১৬৮৪), ‘লাভ লেটারস বিটউইন এ নোবেল ম্যান অ্যান্ড হিজ সিস্টার’, ‘দি আমোরস অব ফিল্যান্ডার অ্যান্ড সিলভিয়া’ (১৬৮৭) উল্লেখযোগ্য।
মৃত্যুর আগে তিনি রিউমেটয়েড আর্থ্রাইটিস রোগে ভুগেছিলেন। ১৬৮৯ সালের ১৬ এপ্রিলে লেখিকা মারা যান। তাঁকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে সমাহিত করা হয়।
আমরা আফরা বেনকে কেন স্মরণ করছি? শুধু কি একজন নারী লেখক হিসেবে? না, তা নয়। তিনি নারীর পাশে জীবনসঙ্গী হিসেবে যে পুরুষকে দেখতে চেয়েছিলেন, সে কারণেও। যেমনটি তিনি দেখিয়েছিলেন অরুনোকোকে।
কদিন আগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন সার্ভে-২০১৫’ শীর্ষক দ্বিতীয় জরিপের ফলাফলে এসেছে, ৭২ দশমিক ৭ শতাংশ নারী স্বামীর নির্যাতনের শিকার হলেও তা কখনোই অন্যদের জানায়নি। তার মানে কথিত ‘সভ্য’ সমাজে বসবাসরত নারীরা অপমানিত হচ্ছে তাদেরই জীবনসঙ্গীর দ্বারা এবং সেই অপমান মুখ বুজে সহ্যও করছে নারীরা।
নারীর কথিত ‘সম্মান’ বাঁচাতে বাংলাদেশের আইনও বাল্যবিবাহকে বৈধতা দিয়েছে সম্প্রতি। তাতে করে একটা মেয়েশিশুকে ধর্ষণকারী পুরুষটির সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ‘সম্মান’ রক্ষা করা যাবে! অর্থাৎ বাংলাদেশের নারী আজও তার জীবনসঙ্গীর কাছ থেকে সম্মান ও মর্যাদা পাওয়ার জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। এ পরিস্থিতি শুধু বাংলাদেশে নয়, দুনিয়ার প্রায় সর্বত্র।
আফরা বেনের ওই যুগ থেকে মানবসভ্যতা আজ অনেকদূর এগিয়েছে। কিন্তু নারীরা কতদূর এগিয়েছে? আগের চেয়ে এখন অনেক নারীই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করেছে। কিন্তু মানসিক দাসত্ব, যা যুগ যুগ ধরে নারীদের মননে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ঢুকিয়ে দিয়েছে, সেটা থেকে মুক্ত হয়েছে কজন নারী? কজন নারী অরুনোকোর মতো বিপ্লবী হয়েছে তাদের প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অন্যায়-অপমানের বিরুদ্ধে?
অনেক লড়াই-সংগ্রাম করে নারীরা আজকের এই অবস্থান পর্যন্ত আসতে পেরেছে। অনেক শৃঙ্খল ভেঙেছে, অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছে, কিন্তু এখনো সব অধিকার পাওয়া হয়নি। এখনো অনেক লড়াই বাকি আছে এই ঘুণে ধরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে। সেই লড়াইয়ে নারীদের যেমন সবচেয়ে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখতে হবে, পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে সচেতন পুরুষদেরও।
মানুষ হিসেবে নারী-পুরুষের সমান ও ন্যায্য অধিকার, সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করা গেলে আমরা অনেক রোকেয়া, মহাশ্বেতা দেবী, সিমন দ্য বুভ্যেয়ার, মাদামকুরি, হাইপেশিয়া, আলেক্সান্দ্রা কোলনতাই, ক্লারা জেটকিন, ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা, কল্পনা চাকমাদের হারাতে থাকব।
নারী দিবসের ইতিহাস নারীদের সংগ্রামের ইতিহাস, ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করার ইতিহাস। সত্যিই যদি কেউ এই দিবসের গুরুত্ব বুঝে থাকেন, তাহলে বুলিসর্বস্ব করপোরেট ‘নারী দিবস’ পালন না করে নারীদের সত্যিকার মুক্তির দাবিতে কাজ করার শপথ নিতে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই নারী দিবসের চেতনাকে সম্মান করা হবে, মানুষ হিসেবে নারীর প্রকৃত মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে।