কুরোসাওয়া কথা
মোরিমুরা গাকুয়েনের প্রাথমিক বিদ্যালয়
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/03/23/photo-1490238905.jpg)
ভূমিকা
জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া (২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘ড্রিমস’সহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, ‘কুরোসাওয়া কথা’ শিরোনামে, ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে এখানে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।
আমি ফিল্মমেকার হয়ে ওঠার পর একদিন আজব এক কাণ্ড ঘটে গেল। টোকিওর নিচিগেকি থিয়েটারে আমার সমসাময়িক ফিল্মমেকার ইনাগাকি হিরোশির ‘ফরগোটেন চিলড্রেন’ [১৯৪৯] ফিল্মটির শো চলছিল; ফিল্মটি মন্দীভূত বা মন্থর-বিকাশের শিশুদের নিয়ে। একটা দৃশ্যে দেখা যায়, ক্লাসভর্তি শিশুরা যখন শিক্ষকের কথা মন দিয়ে শুনছে, একটি নিঃসঙ্গ শিশু তখন ক্লাসের একপাশে, নিজের ডেস্কে বসে, অন্যদের উপস্থিতির কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে নিজেকে আমোদ দিচ্ছে। এ দৃশ্যটি দেখামাত্রই আমার মনটা ধীরে ধীরে আনমনা হয়ে গেল, আর বিষণ্ণ হয়ে পড়লাম আমি। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। এই শিশুটিকে কোথাও-না-কোথাও দেখেছি। কিন্তু কে হতে পারে?
আচমকা নিজের আসন থেকে উঠে, মুভি-থিয়েটারের লবিতে গিয়ে, একটা সোফার ওপর দুম করে বসে পড়লাম আমি। মনে হচ্ছিল, জ্ঞান হারাচ্ছি; মাথা নিচু করে, হেলে পড়লাম। থিয়েটারের একজন নারীকর্মী এসে জানতে চাইলেন, ঠিক আছি কি না। তাঁকে বললাম, ‘হ্যাঁ, ঠিক আছি; কিছু হয়নি আমার;’ আর চেষ্টা করলাম উঠে দাঁড়ানোর। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা করতেই বিপজ্জনকভাবে মুখ থুবড়ে পড়লাম। অবশেষে তাঁকে মিনতি করলাম, যেন আমাকে বাড়ি ফেরার জন্য একটা ট্যাক্সি ডেকে দেন।
কিন্তু কোন বিষয়টি সেই মুহূর্তে আমাকে এতটা অসুস্থ করে তুলেছিল? এর উত্তর হলো, আমার নিজেরই স্মৃতি। রাশির ‘ফরগোটেন চিলড্রেন’ দেখে নিজেরই একটি বাজে অনুভূতি মনে পড়ে গিয়েছিল : যে অনুভূতিটি আমি কখনোই সত্যিকার অর্থে মনে করতে চাইনি।
মোরিমুরা গাকুয়েনের প্রাইমারি স্কুলে আমি যখন প্রথম বর্ষের ছাত্র, আমার কাছে স্কুলটাকে একটা জেলখানা বলে মনে হয়েছিল। মাথাভর্তি তিক্ত ও বেদনার্ত যত ভাবনা নিয়ে, ক্লাসরুমে নিজের চেয়ারটিতে চুপচাপ বসে থাকতাম; আমার একমাত্র কাজ ছিল কাচের দরজা দিয়ে পারিবারিক সেই কাজের লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকা—যিনি আমাকে স্কুলে আনা-নেওয়া করতেন : করিডোরের বাইরে তাঁর উদ্বিগ্ন উপস্থিতি, তাঁর পায়চারি দেখতাম।
নিজেকে একজন মন্থর-বিকাশের শিশু ভাবতে ভালো লাগে না আমার; তবে ঘটনা হলো, আমি ছিলাম ধীরজ। কারণ, শিক্ষক কী বলছেন—কিছুই বুঝতাম না; স্রেফ নিজেকে আমোদ দেওয়ার আকাঙ্ক্ষাই ছিল আমার। অবশেষে বাদবাকি ছাত্রদের কাছ থেকে আমার ডেস্ক ও চেয়ার সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল; এবং আমাকে বিশেষ ট্রিটমেন্ট দেওয়ার ভেতর দিয়ে এ পর্ব শেষ হয়।
শিক্ষক যখন কোনোকিছু পড়াতেন, তখন তিনি ক্ষণে-ক্ষণে আমার দিকে তাকাতেন, আর বলতেন, ‘আকিরা বোধহয় বুঝতে পারোনি, তবে...’ কিংবা ‘এটার সমাধান করা আকিরার পক্ষে অসম্ভব, তবে...’। বাদবাকি শিশুরাও আমার দিকে ফিরে তাকাত, আর আমাকে নিয়ে মস্করা করত : আমার কতটা খারাপ লাগছে, সে ব্যাপারটি পাত্তা দিতেন না তিনি [শিক্ষক]। সাবজেক্ট যাই হোক, তা আমার কাছে একেবারেই বোধাতীত লাগত। কষ্ট হতো আমার, মন খারাপ হতো।
শরীরচর্চার সময়, যখন ‘সাবধানে দাঁড়াতে’ বলা হতো, জ্ঞান-হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থা হয়ে যেত আমার। কিছু কারণে, ‘সাবধান...’ নির্দেশটি শোনামাত্র, আমি শুধু শক্তই হয়ে যেতাম না, বরং আমার দমও বন্ধ হয়ে আসত। পরে নিজেকে আমি শোয়া অবস্থায় আবিষ্কার করতাম স্কুলের মেডিকেল অফিসে—নার্সের শুশ্রূষার সান্নিধ্যে।
একদিনের খেলাধুলার একটা ঘটনা মনে পড়ে। সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। ফলে ডজ-বল খেলার জন্য জিমনেশিয়ামে গিয়েছিলাম আমরা। বলটা যখন আমার দিকে ছুড়ে মারা হলো, ধরতে পারলাম না। এ দেখে অন্যরা বেশ আমোদ পেল। বলটা বারবার আমার দিকে ছুটে আসতে আর আমাকে আঘাত করতে থাকল। কখনো কখনো বেশ জোরেই লাগছিল এবং যেহেতু এটা আমার নিজের জন্য মজার ব্যাপার নয়, ফলে বল আমি ধরে, বাইরে, বৃষ্টির মধ্যে ছুড়ে ফেলে দিলাম। শিক্ষক রেগে গিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ‘কী করলে তুমি?’ এখন আমি ভালোভাবেই বুঝতে পারি, কেন তিনি এত বিরক্ত হয়েছিলেন সেদিন; তবে সেদিন সে সময়ে আমাকে ব্যথা দেওয়া বলটিকে এভাবে ছুড়ে ফেলে দেওয়াটাকে আমার মোটেও দোষের মনে হয়নি।
ফলে প্রাইমারি স্কুলের প্রথম দুটি বছর জীবন আমার কাছে এক নারকীয় শাস্তির বিষয় হয়ে উঠেছিল। মন্থর-বিকাশের শিশুদের স্কুলে পাঠানোটা এককথায় এক ভয়ংকর ব্যাপার; কেননা, কিছু নিয়মকানুন তাদের মানতেই হয়। নানা ধরনের শিশু [স্কুলে] আসে। পাঁচ বছর বয়সী কিছু কিছু শিশুর বুদ্ধিমত্তা হয়ে থাকে সাত বছরের শিশুর মতো; আবার সাত বছর বয়সী কিছু কিছু শিশু নিজের পাঁচ বছরের সময়কালকে অতিক্রম করে আসতে পারে না। বুদ্ধিমত্তার বিকাশ তো নানাভাবেই ঘটে থাকে। একটি বছরে এ বিষয়টি ঠিক সে বছরটির পরিমাপেই ঘটতে হবে; কম বা বেশি ঘটা যাবে না—এমন হুকুম-জারি করাটা নিশ্চয়ই সঠিক কিছু নয়।
আমি সম্ভবত খেই হারিয়ে ফেলছি। কিন্তু আমার বয়স যখন সাত বছর ছিল, আমি ভীষণ নিঃসঙ্গ ছিলাম; আর স্কুল-জীবনটা আমার জন্য এতই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল যে তার একটা দাগ পড়ে আছে মনে; এবং একজন শিশুর দৃষ্টিকোণ থেকে সে বিষয়টি নিয়ে লিখতে গিয়ে আমি অবচেতনেই খেই হারিয়ে ফেলি।
এ সময়টিকে আমি স্মরণ করি, যেন কুয়াশার মতো কিছু একটা আমার মস্তিষ্কে জুড়ে রয়েছে, আর বাতাস এটিকে বইয়ে নিয়ে শেষ পর্যন্ত অদৃশ্য করে দেবে। কিন্তু টোকিওর আরেক অঞ্চল, কোইশিকাওয়ায় আমার পরিবার পাড়ি জমানোর আগপর্যন্ত আমার চোখ দুটি স্পষ্ট বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে খোলেনি। কুরোদা প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে আমি পড়ার সময় ঘটেছিল এ ব্যাপারটি।
(চলবে)