সাহিত্যে রেলগাড়ি
জেমস ওয়াটের বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কার আমাদের সম্ভাবনার যে দ্বার খুলে দিয়েছিল, তার নাম রেলওয়ে। যাতায়াত ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে রেলওয়ে অর্থনীতিতে একটা বিপ্লব এনেছে। সম্প্রতি ফ্রান্সে সবচেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন রেলগাড়ি চালু হয়েছে। এটা তারা আজ গর্ব করে বলে কারণ, গর্ব করার মতো বিষয় এটি। ফ্রান্সের অর্থনীতি বদলে দিতে এটি বিশেষ অবদান রাখবে।
শুধু ফান্স কেন, রেলওয়ে ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে জাপান তার কৃষি অর্থনীতিকে পুরো বদলে দিয়েছে। আর আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের রেল উন্নয়ন ঈর্ষণীয় অবস্থায় চলে গেছে। ব্যয়-সাশ্রয়ী, মালামাল পরিবহনে সুবিধা এবং সাধারণ মানুষের পরিবহন যা চলেও দ্রুত সব মিলিয়ে রেল বদলে দিয়েছে সারা বিশ্বের অর্থনীতি। এখানে নানা মুনির পরামর্শে বাংলাদেশের রেল ধসের পথে। এ চিত্র কারো অচেনা নয়।
বাংলাদেশে রেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে মন্তব্য করা অনুচিত হবে। বর্তমান আদৌ উপভোগ্য নয়। তবে অতীতের দিনগুলো অন্তত গত শতকের পাঁচের দশক পর্যন্ত সত্যিই ছিল রোমাঞ্চকর। নানাবিধ শিহরণ, উত্তেজনা এবং রোমাঞ্চে ভূতপূর্ব ছিল বাঙালির রেল জীবন। রেলে রোমাঞ্চও ছিল। কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, সিনেমায় তার প্রমাণ মেলে।
বাংলাদেশে রেলগাড়ির যাত্রা শুরু হয় উনিশ শতকের পাঁচের দশকে। রেলগাড়ি দেখে এক তর্কালঙ্কার পণ্ডিত মন্তব্য করেছিলেন, অগ্নিদেবের এই রথে অতিরিক্ত ভ্রমণে ফল আশু মৃত্যু। রেলভ্রমণ অবশ্য তাতে ঠেকানো যায়নি। তবে রেল নিয়ে বিস্ময় দূর হতে সময় লেগেছিল।
বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের গোড়ার দিকের বিখ্যাত যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক প্রাবন্ধিক অক্ষয় কুমার দত্তের নাম বিস্মৃত হওয়ার নয়। বিজ্ঞানের অনেক পারিভাষিক শব্দও তিনি তৈরি করেছিলেন। তাঁর তৈরি উপন্যাস কুমেরু, সুমেরু, প্রবালদ্বীপ, মানমন্দির, অনুবীক্ষণ যন্ত্র, দূরবীক্ষণ যন্ত্র, প্রাণিবিদ্যা ইত্যাদি অনেক পারিভাষিক শব্দেরই পরে আর কোনো বিকল্প খুঁজতে হয়নি। অক্ষয় কুমার দত্তের বিখ্যাত সব প্রবন্ধ গ্রন্থের ভিড়ে চাপা পড়া বিস্মৃত এক ছোট গ্রন্থের নাম বাষ্পীয় রথারোহীদিগের প্রতি উপদেশ বাষ্পীয় রথারোহণসিধি। এই বই থেকে রেলগাড়ি নিয়ে তৎকালীন বাঙালির নানাবিধ আনন্দ ও সংকটের পরিচয় পাওয়া যায়।
সংকট মোচনের বিধি ইংরেজি গ্রন্থ হতে সংকলন করে বাতলে দিয়েছিলেন অক্ষয় কুমার দত্ত। রেলগাড়ি সম্পর্কে বিস্ময় তাঁর নিজেরও ছিল। তিনি লিখছেন, ‘বাষ্পীয় রথ পরমদূত বস্তু। উহা দ্বারা এক মাসের পথ এক দিবসে ভ্রমণ করিয়া অক্লেশে অশেষ বিষয়ের বাসনা সুসিদ্ধ করা যায়। উহার দ্বারা, দূরদেশীয় পণ্য সামগ্রী সকল অনায়াসে অবিলম্বে নানা স্থানে নীত হইয়া লোকের ভোগতৃষ্ণা চরিতার্থ করিতে পারেন স্বদেশ দর্শনোৎসুক দূর প্রবাসী ব্যক্তিরা।’
রেলগাড়ি সম্পর্কে অনেক কথা লিখলেও রেলের কামরায় বসে থাকা মানুষের চোখে দিনচক্রাকাল একইভাবে আবর্তিত হয়। শিশুমন বিহ্বলকারী সেই তথ্য অক্ষয় কুমার দত্ত অবশ্য দেননি। এ প্রলোভন তিনি কীভাবে পরিত্যাগ করেন, তা বলা মুশকিল। যদিও বাষ্পীয় রথে কীভাবে উঠতে হয়, কীভাবে বসতে হয় এ রকম বিশদ বিবরণ তিনি প্রদান করেছেন ১৩টি নিয়ম বর্ণনা করে। এসব নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে তিনি রথারোহীদের প্রতি বিশেষ অনুরোধ জানিয়ে ছিলেন। কারণ তিনি জেনেছিলেন, সেসব নিয়ম অবহেলন করাতে অন্যান্য দেশে অনেক লোকে অঙ্গভঙ্গ ও প্রাণ সংহার হইয়াছে।
আমরা সংক্ষেপে কতিপয় নিয়মের বর্ণনা তুলে ধরছি :
প্রথম নিয়মে তিনি বলেছেন, ‘যে সময় বাষ্পীয় রথ গমন করিতে থাকে সে সময় তাহাতে আরোহণ ও তাহার হইতে অবতরণ করা কর্তব্য নহে।’ অবতরণ করলে কী হয় উদাহরণ সহযোগে তিনি তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এমন উদাহরণ প্রতিটি নিয়মের সঙ্গে তিনি তুলে ধরেছেন। স্টেশনে কীভাবে বসে থাকতে হবে তার নিয়মও তিনি বাতলে দিয়েছেন ষষ্ঠ নিয়মে, তিনি বলছেন, ‘যে সকল ব্যক্তি বাষ্পীয় রথে আরোহণ করিবার বাসনায় কোনো আড্ডায় গিয়া প্রতীক্ষা করিয়া থাকে তাহাদিগের অতি সাবধানে বিশিষ্ট রূপ সতর্ক হইয়া থাকা অবশ্যক। নতুবা হঠাৎ গাড়ি আসিয়া মারা পরিবার সম্ভাবনা। ইংল্যান্ডে অনেক অনেক ব্যক্তি এরূপ স্থানে অনবহিত ও নিদ্রিত থাকাতে রথ চক্রে আহত হইয়া হত হইয়াছে।’
অক্ষয় কুমার দত্ত যুগ বাংলা গদ্যকে সুঠাম ভিত্তির ওপর গড়ে তোলার যুগ উনিশ শতকের সেই ইংরেজ রাজত্বের সময় বাঙালি লেখকেরা তাদের চেতনায় সহজে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতেন না। খুঁজতেন বাংলা প্রতিশব্দ অথবা বাংলা পারিভাষিক শব্দ। ইংরেজি শব্দ অযথা ব্যবহারের বাহানা খুঁজতেন না। অক্ষয় কুমার দত্তের যুগে রেলগাড়ি বাংলা হয়েছিল বাষ্পীয় রথ, বাষ্পীয় শকট। রেললাইন ছিল লৌহবম্ম। অক্ষয় কুমার দত্ত স্টেশনের বাংলা করেছিলেন আড্ডা।
রেলগাড়িতে প্রথম ওঠার চাঞ্চল্য ও সতর্কতা বহুদিন বিদ্যমান ছিল। রবীন্দ্রনাথ রেলগাড়িতে প্রথম ওঠেন নিতান্ত বালক বয়সে, ‘সত্য বলিয়াছিল, বিশেষ দক্ষতা না থাকিলে রেলগাড়িতে চড়া এক ভয়ঙ্কর সংকট, পা ফসকাইয়া গেলেই আর রক্ষা নাই। তারপর গাড়ি যখন চলিতে আরম্ভ করে, তখন শরীরের সমস্ত শক্তিকে আশ্রয় করিয়া খুব জোর করিয়া বসা চাই, নহিলে এমন ধাক্কা দেয় যে মানুষকে কোথায় ছিটকাইয়া পড়ে তাহার ঠিকানা পাওয়া যায় না।’
বলাবাহুল্য, সত্যপ্রসাদও তখন বালক। অক্ষয় কুমার দত্তের বইটি সম্ভবত তাঁর পড়া ছিল। সে জন্যই বর্ণনায় তার কোনো ঘাটতি ছিল না বরং বেশিই ছিল। তবে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, ‘স্টেশনে পৌঁছিয়া মনের মধ্যে বেশ একটু ভয় ভয় করিতেছিল। কিন্তু গাড়িতে এত সহজেই উঠিলাম যে মনে সন্দেহ হইল, এখনো হয়তো, গাড়ি অঙ্গটাই বাকি আছে। তাহার পরে যখন অত্যন্ত সহজে গাড়ি ছাড়িয়া দিল তখন কোথাও বিপদের মনটা বিমর্ষ ইইয়া গেল।’
কোনো অঘটন ঘটল না দেখে রবীন্দ্রনাথ রেলগাড়িতে চড়ার সতর্কতা সম্পর্কে মনমরা হয়েছিল, কিন্তু নিরাসক্ত হননি। চাঞ্চল্য ঠিক সময়েই জেগেছিল। তিনি লিখেছিলেন, ‘বোলপুরের উদ্দেশ্য রেলগাড়িতে চড়িলাম, এ আমার প্রথম রেলে চড়া। গাছপালা, মাঠ, মাঝে মাঝে গ্রামের কুটিরগুলি যখন দুইটি শ্যামল প্রবাহ আকারে গাড়ির দুই ধার দিয়া মরীচিকার বন্যার মতো ছুটিয়া যাইতে লাগিল তখন পিতার কাছে সম্ভ্রমে সংযত হইয়া বসিয়া থাকা আমার পক্ষে বড়ই কঠিন হইয়া উঠিল।’
রেলগাড়ির রোমাঞ্চ ও রোমান্সের দিনগুলো অবসিত হয় কয়লার ইঞ্জিন উঠে গিয়ে ডিজেল ইঞ্জিন চালু হওয়ার পর। আমেরিকায় ডিজেল ইঞ্জিনচালিত রেলগাড়ি চালু হওয়ার কিছুদিন পর এক মার্কিন বিজ্ঞানী দুঃখ করে বলেছিলেন, প্রথম সাক্ষাতের নীরব প্রেম এবং প্রিয়জনকে বিদায় জানানোর মাধুর্য কয়লার ইঞ্জিন উঠে যাওয়ায় নষ্ট হয়ে গেল কারণ, ডিজেল ইঞ্জিনে বাড়লো গাড়ির গতি। বাড়লো মানুষের ব্যস্ততা।
এখন যাঁরা বৃদ্ধ অথবা পৌঢ়, কথাটা অন্যভাবে ঘুরিয়ে বললে গত শতকের তিন-চার অথবা পাঁচের দশকে যাঁরা ছিলেন তরুণ, তাঁদেরও অনেকেরই স্মৃতিপটে রেল রোমান্সের অনেক চিত্র এখনো বিদ্যমান। আগের দিনে তো বটেই, অন্তত সেই সময়টাতে বিশেষত, যাঁরা ছিলেন গ্রামের তরুণ। নিজেদের চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো বোনদের বাইরে জীবনের প্রথম তাঁরা অনাত্মীয়, অচেনা কোনো তরুণীর সঙ্গে শিহরণ-জাগানিয়া সাক্ষাৎ লাভ করতেন রেলস্টেশন, রেলগাড়িতে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় তো অনেক পরের ব্যাপার।
ঘটনাচক্রে এসব তরুণের প্রাথমিক প্রেমজীবন কিন্তু শুরু হতো বিরহ দিয়ে। সিনেমা আর গ্রামোফোন রেকর্ডের কল্যাণে বিরহের গানের তখন বেশ রমরমা ছিল। পরে যুক্ত হয়েছিল যাযাবর রচিত দৃষ্টিপাত। বিরহ বিলাসী কারো কণ্ঠে বিরহের গান অথবা দৃষ্টিপাতের বিরহ ঘন পঙক্তিগুলো আকস্মিক আবির্ভাব ঘটলে অভিজ্ঞরা বুঝে নিতেন বালকের সঙ্গে রেলস্টেশন অথবা রেলগাড়িতে কোনো এক বালিকার চোখাচোখি হয়েছিল একবার নয়, সম্ভবত বেশ কয়েকবার। তাতেই বালকের এই বিরহ দশা। এ অবস্থা ছয়ের দশকের প্রথমার্ধের তরুণ বয়সীদের মধ্যেও বিদ্যমান ছিল।
রেলের রোমান্সকে সর্বপ্রথম সাহিত্যে ঠাঁই দিয়েছিলেন সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রেলগাড়ি এমনিতেই তাঁর প্রিয় ছিল। রেলগাড়ির প্রসঙ্গত অনুষঙ্গ তাই বারবার এসেছে তাঁর রচনায়। প্রবন্ধেও তিনি রেলগাড়িকে উপমা হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ‘শিক্ষার বিকিরণ’ প্রবন্ধে এক জায়গায় তিনি বলেছেন, এই শিক্ষাবিধি রেলকামরার দীপের রচনা।
রেলগাড়ি প্রসঙ্গ অবশ্য বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধতেও রয়েছে, ‘ঐ দেখ লৌহ বর্ম্মে লৌহতুরঙ্গ কোটি উচ্চশব্দ অতিক্রম করিয়া এক মাসের একদিকে যাইতেছে।’ বঙ্কিমচন্দ্র রেলকে দেখেছিলেন অন্যভাবে। স্ত্রীকে নিয়ে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র নতুন কর্মস্থলে যোগদান করতে যাচ্ছেন। স্টেশনে ট্রেন থেমেছে। স্ত্রী জেনীনা কামরায়। বঙ্কিমচন্দ্র প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করছেন। হঠাৎ দেখলেন এক তরুণ তাঁর স্ত্রীর কামরার পাশে বারবার ঘুরঘুর করছে। জীবনীকারেরা জানাচ্ছেন, বঙ্কিমচন্দ্র রেল রোমান্সকে কখনো তাঁর রচনার উপজীব্য করেননি। সম্ভবত রেলের প্রতি তার বিতৃষ্ণা জন্মেছিল।
রেল প্রসঙ্গ এবং রোমান্স এসেছে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় নানাভাবে। হঠাৎ দেখা কবিতাটি ব্যর্থ প্রেমিকের বিরহের অসাধারণ চিত্র :
রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা
ভাবিনি সম্ভব হবে কোনদিন।
থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা
চেনা লোককে দেখলাম অচেনার গাম্ভীর্যে।
রেলগাড়ি ছাড়া এ ঘটনা ঘটানো সম্ভব হতো না। রবীন্দ্রনাথের এই কবিতা থেকে বীজ সংগ্রহ করে সুবোধ ঘোষ সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত গল্প ‘জতুগৃহ’। গল্পের শুরু এভাবে, ‘এত রাতে এটি কোন ট্রেন? এই শীতার্ত বাতাস, অন্ধকার আর ধোঁয়া বৃষ্টির মধ্যে ট্রেনটি যেন হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে ছুটে এসে রাজপুর জংশনের প্ল্যাটফর্মের গায়ে লাগল।’
রেলগাড়ির এমন উপস্থিতি বাংলা সাহিত্যে বহুবার এসেছে, বহুভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এ থেকেই বোঝা যায়, রেল ও রেলগাড়ি বিদেশ থেকে আগত হলেও তা এ জনপদের মানুষের মনে ঠাঁই করে নিয়েছিল স্থায়ীভাবে।