গল্প পড়ার গল্প
ধনঝরি পাহাড় আর নদীর ধারে বাড়ি
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় পাঠে শুরু হয়েছিল যেন আমার এই জীবন। সিনেমায় ‘পথের পাঁচালী’ দেখে কী যে বিস্ময়! তখন আমার বয়স আর অপুর বয়স এক। আমি একটা রাংতার মুকুট তৈরি করতে আরম্ভ করেছিলাম অপুকে দেখে। পথের পাঁচালী, আরণ্যক, ইছামতী, দৃষ্টিপ্রদীপের বিভূতিভূষণ যে চোখে এই জীবন, এই জন্ম, এই সভ্যতাকে দেখেছেন, তা আমাদের সাহিত্যে তো হয়নি। তিনি মানুষের মনের গহনে প্রবেশ করে প্রাণের সৌন্দর্যকে খুঁজে বের করে আনতেন। জীবন সুন্দর। অনেক অন্ধকারের ভেতরেও জীবনের ভেতরে যে অস্ফুট আলো লুকিয়ে থাকে, বিভূতিবাবু সেই আলোর রেখাটুকু তাঁর গল্পে খুঁজে আনতেন। না, এ কিন্তু ইচ্ছাপূরণের গল্প নয়। তিনি তো কাহিনী লিখিয়ে ছিলেন না। তিনি জীবন লিখতেন। জীবন উদারতার, নিষ্ঠুরতারও।
এমন জীবন লেখা তাঁর উপন্যাসে যেমন হয়েছে, তেমনি হয়েছে তাঁর গল্পে। তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকত তাঁর ইতিহাসবোধ। তিনি সেই মানুষের কথা লিখতেন, যে মানুষের চাওয়া ছিল কম। অল্পতে খুশি। যে মানুষের কিছুই নেই প্রায়, কিন্তু যেটুকু আছে, তাই নিয়ে সে আনন্দময়, সেই মানুষের কথাই লিখতেন তিনি। মনে করা যাক ‘আমোদ’ নামের গল্পটিকে। সেই গল্পে একেবারে ভূমিহীন চাষা যাত্রা দেখতে গেল। কত ভিড় সেখানে, সে আর বসবে কী করে, সমুখে গিয়ে দেখবে কী করে? সেখানে বাবুদের জায়গা সামনে। পরে যারা আছে, তারা আগে এসেছে। প্যান্ডেলের বাইরে একেবারে পেছনে দাঁড়িয়ে, ডিঙি মেরে মেরে সমস্ত রাত সে দেখল যেটুকু দেখা যায়। আসলে অতদূর থেকে সে কিছুই শোনেনি, কিছুই দ্যাখেনি, কিন্তু যা দেখেছে, যা শুনেছে তাইই অনেক। সকাল হয়ে গেল যাত্রা শেষ হতে। চলল সে তার কাজে। যাই হোক আমোদটা তো হয়েছে। সামান্য পেলেই খুশি সে। এই গল্পের সঙ্গে আমাদের পরিচয় তেমন কই? কত গভীর কথা কত সহজে না তিনি বলে গেছেন। কত নির্ভার তাঁর কাহিনী!
‘তুচ্ছ’ গল্পটির কথা মনে করি। সেই গল্পে দরিদ্র কামারের ১৩-১৪ বছরের মেয়ে বিয়ের পর বাপের বাড়ি ফিরে বাবু ঘরে গেছে। বাবুদের বাড়ির বউ, মেয়েরা তার সঙ্গে কী আর কথা বলবে? সে মেঝেতে বসে চার দেয়াল দেখে। এই বাড়ির প্রবীণ মানুষটি আর তাকে নিয়েই এই গল্প। মেয়েটি দেওয়ালের ক্যালেন্ডারের অকিঞ্চিৎকর ছবি দেখেই মুগ্ধ, প্রবীণ মানুষটিকে জিজ্ঞেস করে কত কথা। তাকে এ বাড়ির আর সকলে অবহেলা করছে, সে বিষয়ে তার কোনো বোধ নেই। প্রবীণ মানুষ, গল্প কথক স্নানে যাবেন, গন্ধ তেল মাথায় দিচ্ছেন। এক ফোটা তেল নিয়ে হাতটি মেয়েটির মাথায় ঘষে দিলেন। কী রকম গন্ধ?
চমৎকার, কাকাবাবু!
গন্ধ তেল মেখেই সে ভারি খুশি, বলে, বেলা হয়েচে, আসি তাহলে কাকাবাবু!
কতটুকু আর তেল দিয়েছেন তিনি ওর মাথায়। তাতে সে কত খুশি! আর সেই আনন্দ মানুষটির ভেতরে সঞ্চারিত হলো। এই সৌন্দযর্ময় অনুভূতির গল্পই তুচ্ছ। আপাতত যা তুচ্ছ, তাই-ই কত বিপুল, নীল আকাশের মতো তার বিস্তার।
‘নদীর ধারে বাড়ি’ গল্পটির কথা বলি। এই গল্প এক গৃহবধূ শ্যামলীকে নিয়ে। কলকাতার এক কানা গলির ভেতরে সাত ভাড়াটের বাড়িতে নয়টি বছর সে রয়েছে। তার দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। বয়স তিরিশের ওপর। স্বামী এক সওদাগরি অফিসের কেরানি। সামান্য বেতন তার। মনের গহনে সে লুকিয়ে রেখেছে অসামান্য এক সৌন্দর্য। প্রতিবেশী ভাড়াটেদের নোংরামি, ঈর্ষা, কলহ ইত্যাদির ভেতরে বাস করতে করতেও শ্যামলী সকলের থেকে আলাদা। এখানে সমস্ত দিন কেউ না কেউ কারোর না কারোর সঙ্গে কলহ বাঁধিয়েই রেখেছে। সে চুপ করে ভাবে কবে এই ঘৃণ্য পরিবেশ ছেড়ে উঠে যাবে। যেমন মানুষ সব, তেমন এই বাসা। রান্নাঘরের সামনে খোলা ড্রেনে তরকারির খোসা, ফেন, শাকের ডাঁটা, চিংড়ি মাছের খোসা জমে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এরই ভেতর এক প্রতিবেশী ধার চেয়ে না পেয়ে শ্যামলীর রান্নাঘরের সামনে সকালবেলায় তার দুই বাচ্চাকে ড্রেনের ধারে বসিয়ে দেয় প্রাতঃকৃত্যে। যদুনাথ তার স্বামী। সেও জানে কোন পরিবেশে আছে। সে বের হতে চায় এখান থেকে, কিন্তু উপায় নেই। সামান্য বেতনের কেরানি। তাই শ্যামলীকে অভয়া, শশীবাবুর বউ, বিশ্বেস গিন্নি, মতির মায়েদের ভেতরে থেকেও কোনোক্রমে নিজেকে আলাদা করে রাখতে হয়, এই ঘৃণ্য পরিবেশ থেকে কবে যে উঠে যেতে পারবে?
একদিন তার স্বামী যদুনাথ এক খবর আনে, রাণাঘাট থেকে যেতে হয়, এগার মাইল উত্তরে বল্লভপুর নামে একটি গ্রামে কলকাতার এক বড়লোকের কাছারি বিক্রি হচ্ছে। ওপরে নিচে পাঁচখানা ঘর, বারান্দা, রান্নাঘর, নাইবার ঘর। দশ বিঘে জমির ওপর সেই বাড়ি, তাতে আম-কাঁঠালের গাছ আছে, বাড়ির গা দিয়ে একটা ছোট নদী বয়ে যাচ্ছে। সেই নদীতে একটি ঘাটলা করে দিয়েছে জমিদার তার বাড়ির মেয়েদের স্নানের সুবিধার জন্য। প্রভিডেন্ট ফান্ডের সব টাকা তুলে নিয়ে আরো কিছু সংগ্রহ করে যদুনাথ সেই বাড়ি কিনবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কলকাতার এই খিন্ন জীবনে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। যে করে হোক ওই পাড়াগাঁয়ে বাড়ি কিনেও কলকাতার এই কানাগলি ছেড়ে যাবে।
এই বিষাক্ত পরিবেশ ছেড়ে যাবে। দিনরাত জল নিয়ে, স্নানঘর নিয়ে কলহ লেগে আছে। সবাই গায়ের জোর আর মুখের জোর দিয়ে সব কিছু করায়ত্ত করতে চায়। শ্যামলী যখন বলে, যদুনাথের চাকরি? যদুনাথ বলে, চাকরি সে ছেড়ে দেবে। একঘেয়ে হয়ে গেছে এই জীবন। স্বাস্থ্য যেতে বসেছে। একটু সাহস করে সে গ্রামে চলে যাবে ওই বাড়ি কিনে। বিভূতিভূষণ এই গল্পে যদুনাথের মুখ দিয়ে বলছেন, বিলেত থেকে লোক গিয়ে আমেরিকায় বাস করে আমেরিকা যুক্তরাজ্য স্থাপন করেছিল। অজানায় পাড়ি না দিলে মানুষ মানুষ হয়ে ওঠে না। যদুনাথ ওই গ্রামে গিয়ে চাষবাস করবে, নাইট ইস্কুল করবে, কত তার স্বপ্ন। আর তারা সত্যিই গেল। রাণাঘাট লাইনে গাংনাপুর স্টেশনে নেমে গরুর গাড়িতে রওনা হলো। সে কতদূর! মাঠ আর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে গরুর গাড়ি চলল। সে যেন এক অভিযাত্রা।
শ্যামলীর বুক দুরুদুরু করে ওঠে, এত আশা করে কেনা বাড়িটা কেমন হবে কে জানে? না দেখেই বাড়িটা কিনেছে যদুনাথ তার সর্বস্ব দিয়ে। অপরাহ্নবেলায় তারা পৌঁছল বল্লভপুর। দেখল আশাহত হওয়ার মতো নয়। এ যেন প্রাসাদ। বাড়ি দেখে আনন্দ ও বিস্ময়ে শ্যামলী বাক্যহারা। তেতলা এই বাড়ি তাদের নিজস্ব। গল্প এই। যেন সমুদ্র যাত্রা করে তারা এক সবুজ দ্বীপের সন্ধান পেয়েছে। বারান্দা, রান্নাঘর, কুয়োতলা, নাইবার ঘর, ছাদ, সমস্ত নিয়ে যে বাড়ি তাদের অপেক্ষায় ছিল, তা শ্যামলীকে বিহ্বল করল। মুক্তোর মা নামের এক কাজের লোক বাড়ি ঝাটপাট দিয়ে ধুয়ে রেখে দিয়েছিল। শ্যামলী কত দিন বাদে বুক ভরে শ্বাস নিল। বেলা শেষে ছোট নদীটির ঘাটে গেল গা ধুতে। নদীর পাড়ে একটি নাম না জানা গাছে সাদা ফুল ফুটেছে। কী সুবাস। শ্যামলী জলে নামল। আজ সে যেন রূপকথার রাজকন্যা। অন্ধকার নেমে গেছে। মাথার ওপর তারাভরা আকাশ। এই বাঁধাঘাট, প্রাচীন বনস্পতি, বনফুলের গন্ধ, সবই তাদের। তারা পয়সা দিয়ে কিনেছে। কলকাতার সেই পচা ড্রেন, কানাগলি, কলঘর, অভয়া, বিশ্বেস গিন্নি, সব অবাস্তব স্বপ্ন হয়ে গেছে একদিনেই। তাদের জন্য কষ্ট হলো শ্যামলীর। সত্যি কষ্ট! বেচারী শশীবাবুর বউ, মতির মা, ওদের একবার আনতে হবে এখানে। গল্প আর কিছু নেই। বাড়ির জানালা থেকে মেয়ে ডাকে, মা, তাড়াতাড়ি এসো, বাবা চা চাইছে...। শ্যামলী সেই মুক্তোর মাকে বলল, সাবান আনিনি, যাও তো, ছোট তোরঙ্গের ভেতর আছে, নিয়ে এসো তো।
গল্প এইটুকু। সুখের যে চিহ্ন এঁকেছেন বিভূতিবাবু, তা বিরল। আর শ্যামলীর সেই দুঃখ কলকাতার প্রতিবেশীদের ক্ষুদ্র জীবনের জন্য..., এও বিরল। বিভূতিবাবু আমাদের সাহিত্যে এক বিরলতম লেখক, যিনি নিজের পথে নিঃসঙ্গ অভিযাত্রী। তাঁর পথ, তাঁরই। এই পথে তিনি ছাড়া আর কেউ নেই বিশ্ব সাহিত্যে। প্রণাম।
পুনশ্চঃ আরণ্যকে জমি বন্দোবস্ত দিতে গিয়ে বনভূমির সর্বনাশ হয়ে গেল যে তা অনুভব করেছিল গল্প কথক, সেই জমিদারি নায়েব। বিভূতিবাবুর সেই দেশ নিয়ে আমি একটা গল্প লিখেছিলাম, ‘বিভূতিবাবুর দেশ’। ওড়িশার নিয়মগিরি পাহাড় আর কন্দ উপজাতি এবং সেই বিভূতিবাবুর দেশের ধনঝরি পাহাড় ও আদিবাসী রাজা, রাজকন্যা ভানুমতী মিলেছে একসঙ্গে। পাহাড় ভেঙে অরণ্য ধ্বংস করে লুটেরার দল, বহুজাতিক নেমে পড়েছে মুনাফা অর্জনে। মানুষ প্রতিরোধ করতে নেমেছে প্রকৃতি লুণ্ঠন। বিভূতিবাবুর পৃথিবী থাকবে না। সেই কথা জনে জনে জানানো প্রয়োজন। ভানুমতীরা ধর্ষিতা হচ্ছে, জেলে ঢুকছে। ছত্তিশগড়ের সোনি সোরি কি রাজকন্যা ভানুমতী নয়, যে ভালোবাসে ধনঝরি পাহাড় আর অরণ্যকে।