সুর-অসুরের দ্বন্দ্ব ও গণসংগীত
শ্রম থেকে যে সংগীতের উৎপত্তি, সেটা ভাষাতত্ত্বে ব্যাখ্যা ছাড়াই বুঝতে পারি। ছাদ পিটানোর গান, করাত টানার গান, গাছ ঠেলার গান, ধানকাটার গান, ধান ভানার গান বা নৌকাবাইচের গান—এসব কষ্টশ্রমের সঙ্গে সংগীতের প্রসঙ্গ যুক্ত। চৈত্রসংক্রান্তির পাট চালনার সঙ্গে যে গান যুক্ত, তার সঙ্গে খিস্তিখেউরও থাকে। কঠিন শ্রমের সঙ্গে খিস্তিখেউর দিয়ে শ্রমজীবী মানুষ তাঁদের গানের ভাষাকে শক্তিশালী করতে চেয়েছে বেশ আগে থেকেই। তবে ভাষাতাত্ত্বিক নোয়েরের মতে, ভাষা তৈরির আগে থেকেই মানুষের কণ্ঠে সুর ছিল। দীর্ঘস্বর যুক্ত সে সুর ইঙ্গিতের মাধ্যমে ব্যবহৃত হতো। ভাষার জন্মের ইতিহাস পড়লে গানের জন্মকথাও স্পষ্ট হয়।
ভাষা উদ্ভবের প্রাক্কালে মানুষ প্রথমে কিছু শব্দ ব্যবহার করত, যা সুরের বাঁধনে বাঁধা। সংগীতের ইতিহাস সম্বন্ধে ড. বার্নিক লিখেছেন, ‘পৃথিবীতে মনুষ্য উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গেই কণ্ঠসংগীত সমুদ্ভব হয়েছে। ভাষা সৃষ্টির চেয়ে সুর সৃষ্টি আরো পুরোনো। মানুষ তার প্রয়োজনে বিভিন্ন সুরের বিনির্মাণের মাধ্যমে নিত্য কার্যাদি পরিচালনা করত। সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর কান্না তার ভাষা প্রকাশেরই নামান্তর। মনের ভাব প্রকাশে আদিকাল থেকেই এক প্রকার দীর্ঘস্বর ব্যবহৃত হতো।’ তাহলে আমরা বলতে পারি, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর পার্থক্য ঘটে সুর-অসুরের পার্থকের মধ্য দিয়ে।
মানুষ জন্ম থেকে বড় হয়, তার ভেতরে থেকে যায় জন্মের সুর, তার- কান্না। আবেগে-অনুভবের তীব্রতম জায়গায় ঘটে তার উপস্থিতি। মানুষের আনন্দ-বেদনার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটে তার জন্ম থেকে পাওয়া সুর-কান্নার মধ্য দিয়ে। সুর তাই মানুষের জীবনের এক অনঙ্গ উপাদান বলায় যায়। কিন্তু সমাজের কাঠামোগত বিন্যাসের পরিক্রমায় আমরা দেখি, পুঁজিনির্ভর ব্যবস্থার মধ্যে একটা মানুষ যতই প্রবেশ করে সে তার জন্মপ্রসূত সুরটি ক্রমশ হারাতে থাকে। সমাজের ভগ্নস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে ভাষা হারা হয়ে যায়। আবার কোনো মানুষ বেজে ওঠে নিজস্ব সত্তায় ভর করে, অনেকটা স্বাভাবিক নিয়মেও। সেইসব সুরেলার হাত ধরে সমাজ ও সময় তার বিকাশের কাজ করিয়ে নেয়।
বোধের সুষমায় আর সুরের ইন্দ্রজালে তৈরি ওই সব মানুষ কোনো ব্যক্তির খোলসে আটকে থাকে না। হয়ে ওঠেন সামষ্টিক এক বোধের নাম—এক সম্মিলিত অক্ষর। তার সুরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব হয় অসুরের। সুর শ্রেণি চেনার উপায়, সুর অসুরকে চিহ্নিত করে দেয়। সুরের সঙ্গে অসুরের লড়াই চিরন্তন এবং তা ভাষা-সংস্কৃতি সবকিছুর বাইরে। যে কারণে নাইজেরিয়ার কৃষ্ণ কালো অবহেলিত ইবো সম্প্রদায়ের এক ছেলে পল রোবসন, ১৮৫৮-তে জন্ম নিলেও আজও সে সুরের কারণে বিশ্বে সব সুরের মানুষের বন্ধু। নিপীড়িত মানুষের সুর ধ্বনিত হয় তার কণ্ঠে। পিট সিগার, বব ডিলান, জোয়ান বায়েজ, বব মার্লি এঁদেরই গোত্রভুক্ত। বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের সুর এক। তাই ভিয়েতনাম সাম্রাজ্যবাদের নাপাম বোমার আগুনে দগ্ধ হলে আমাদের বুক ভেঙে যায়। আমার ভাই মতিউল কাদের সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করে ঢাকায় জীবন দেয়। খোদ আমেরিকায় গিটার হাতে ভিয়েতনামের মানুষের পক্ষে গান গেয়ে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামেন বব ডিলান।
১৯৭১ সালে আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি বর্বররা যে খাণ্ডব দাহন চালাচ্ছিল তার বিরুদ্ধে বিশ্বের জনমত গঠনে আমেরিকার মেসিডিন স্কয়ারে পণ্ডিত রবিশংকরের নেতৃত্বে ডিলান বায়েজরা ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নিয়ে দাঁড়ায়। বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের পক্ষে সমৃদ্ধ এই সম্মিলন যে করার যোগ্যতা ধারণ করার ক্ষমতা রাখে তার নাম গণসংগীত। মানে নিপীড়িত গণমানুষের গান। সুরও অসুরের মধ্যে যে চিরায়ত দ্বন্দ্ব তার মধ্য থেকেই গণসংগীতের জন্ম।
গণ’র গান, নিপীড়িত গণমানুষের শোষণ মুক্তি সংগীতই এককথায় গণসংগীত। অন্যন্য দেশের মতো আমাদের দেশের বিশুদ্ধ সংগীতজ্ঞরা গণসংগীতকে গান নয় বা ছোট লোকের চিৎকার বলেই অভিহিত করেন। গণসংগীতের সার্থকতা সেখানেই। ‘লুটেরা পুঁজি যখন বিশুদ্ধ সংগীত চর্চা শুরু করে, বিভিন্ন নামে উৎসব শুরু করে, তখন বুঝতেই হবে শরীরের সব রক্ত মুখে এসে জড়ো হয়েছে। সমাজকে স্বাস্থ্যবান ঘোষণার ব্যাখ্যাপত্র তৈরি করা হচ্ছে। তখনই বুঝতে হবে দিনকাল ভালো নয়। ওটা দুর্দিন। মরচে পড়া সমাজের ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার সময় তখনই। এখনই সময় গলা ছেড়ে গান গাওয়ার। এই গানের সুর শুনে শোষিত চাড়াল, মুণ্ডা, শবর—সবাই শাবল গাইতি হাতে ছুটে আসবে গানের মিছিলে। শোষকের ভিত নাড়িয়ে দিতে তাই গলায় বাধো শানিত গণসংগীত।’ (অন্ধ্রের গণশিল্পী গদর-এর সাক্ষাৎকার থেকে) ।
গণসংগীত হলো মুক্তির অমেয় সুধা। লক্ষ্য সামনে রেখে যে যেমন পারো গাও। আমাদের জানা আছে, সুরে বিনির্মাণ হয় অঞ্চলভেদে, ভৌগোলিক কারণে। শ্রমজীবী মানুষ ভাষা ও সুরের নির্মাতা। ভাষার সুরের মধ্য দিয়ে আমরা অঞ্চলভেদে মানুষকে চিনতে পারি। বরিশালের মেহনতি মানুষ কাজ করে নদীতে। নদী থেকে নদীতে কথা বলতে যে সুরের জন্ম হয়, সে সুরে কথা বলে বরিশালের মানুষ। উত্তরবঙ্গের বিরানভূমির কৃষকের সুর সেখানের মেহনতি মানুষের সুর। ময়মনসিংহ অঞ্চলে পাহাড় সমতলে কাজ করে আরেক সুর। সিলেট চট্টগ্রামে ভূ-প্রকৃতির যুক্ত হয়েছে অবস্থানগত বাস্তবতা। বহুজাতিক মানুষের আগমন, পার্শ্ববর্তী দেশের ভাষার প্রভাব সমুদ্র নদী পাহাড়ের আবহ সব মিলে সে অঞ্চলের সুর।
গণসংগীত যেকোনো সুরে আঞ্চলিকতা সহকারে গাওয়া যায়। যে কারণে গণসংগীতের গণমুখীনতা সবার চেয়ে ভিন্ন। আমাদের লোকসংগীতের ধারার সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে গণসংগীত। এ ক্ষেত্রে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের একটি ব্যাখ্যা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘গণসংগ্রামের চেতনায় উদ্বুদ্ধ লোকসংগীতের ধারাটি গণসংগীতেরই অন্তর্গত, কিন্তু গণসংগীত মাত্রই লোকসংগীত নয়। গণসংগীত কথাটা অনেক বেশি ব্যাপক।... লোকসংগীত সুরে ভঙ্গিতে ও বাক্য বিন্যাসে আঞ্চলিকতার বৈশিষ্ট্যে সীমাবদ্ধ।’ (লোকসংগীত—সমীক্ষা : বাংলা ও আসাম-হেমাঙ্গ বিশ্বাস) সংগীতের আগে ‘গণ’ যুক্ত হয়ে ‘গণসংগীত’ শব্দটি নিঃসন্দেহে আমাদের সামনে নতুন একটি সাংস্কৃতিক নিশানাকে চিহ্নিত করার দাবি নিয়ে হাজির হয়েছিল। যে ব্যাপারে আরো খোলসা করে হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেন, ‘গণসংগীত মানুষের সচেতন জীবন সংগ্রামের ফসল। বলা যেতে পারে জাতীয় চেতনার ধারা যেখানে আন্তর্জাতিক, মেহনতি মানুষের আন্দোলনের সমুদ্রে মিশেছে, সেই সাগর সঙ্গমে গণসংগীতের উৎপত্তি।’
এ কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলা যায়। লোক বা কোনো কৃষকের স্বভাবগত সংস্কৃতির উত্তরাধিকারকে সঙ্গে করে স্বদেশি ধারার গানকে গণসংগীত বিকাশের ক্ষেত্রে পা রেখেছিলে যে দর্শন, তার নাম কমিউনিজম। এই দার্শনিক চেতনার বিচ্ছুরণ গণসংগীতকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি। সমাজের খোলনলচে বদলে দেওয়ার ভাষা পেল গণসংগীত। অতুল প্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্তসহ কবিদের দ্রোহের কবিতাকে গানের সুর করে গাওয়া রেখে শুরু হলো নিজেদের লেখা।
সংগীতের গর্ভে তখন জন্ম নেওয়া এক দুরন্ত সন্তান গণসংগীত। যে সংগীত মুষ্টিমেয় কিছু মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে আটকে থাকেনি। বেরিয়ে এসেছে নিপীড়িত মানুষের সংগ্রামে সহযোদ্ধা হয়ে। ব্রিটিশ বিদায়ের পর এটা আরো চূড়ান্ত রূপে প্রকাশ হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সর্বহারা বা প্রলেতারিয়েতের মুক্তির প্রশ্নটি। সেই মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যাত্রা শুরু করে গণসংগীত। যার আভাস আমরা বিদ্রোহী কবি নজরুলের লেখা ‘কৃষকের গান’, ‘শ্রমিকের গান’ বা বলশেভিক বিপ্লবের প্রতি তার উষ্ণ অভিনন্দন। ‘ঐ নতুনের কেতন উড়ায় কালবোশেখীর ঝড়/ তোরা সব জয়ধ্বরি কর’। এসব কারণে নজরুলকে সবাই বাংলা ভাষায় প্রথম সফল গণসংগীতকার হিসেবে মনে করেন। তবে কোনটি যে প্রথম গণসংগীত বা উপলক্ষ করে গণসংগীত কবে শুরু হয়েছিল, তা আজও স্পষ্ট নয়। তবে প্যারিকমিউনের যোদ্ধা ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ইউজিন পাতিয়েরের লেখা, সুর করেন পিয়ের দেগতার, কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল নামে পরিচিত এ গান (জাগো সর্বহারা অনশন বন্দি ক্রীতদাস, এর সফল অনুবাদ করেছিলেন মোহিত বন্দ্যোপাধ্যায়) এ গানটিকে কেউ কেউ প্রথম গণসংগীত হিসেবেও আখ্যা দেয়। কিন্তু বাস্তবের দিকে তাকালে আমরা দেখি চর্যাপদের চর্যার ভেতরেও ক্ষুধা, পীড়িতের আহাজারি। শোষিত-নিপীড়িত মানুষের সুর সেখানে ধ্বনিত হয়। সেগুলো গণসংগীত হিসেবে গীত হতো কি-না জানি না। কিন্তু সেটি কবিতায় এক দুঃখী কবি তার সংসারের অভাবের ছবি এত মর্মস্পর্শী করে এঁকেছেন যে পড়তে পড়তে শিউরে উঠতে হয়। কবির ভাষা তুলে দিচ্ছি :
‘টালতে মোর ঘর নাহি পড়বেষী।
হাড়ীতে ভাত নাহি নিতি আবেশী।
বেঙ্গ সংসার বডহিল জাঅ।
দুহিল দুধ কি বেন্টে ষামায়।
(চর্যাগীতি। কবি টেণ্টণপাদ। ৩৩, রাগ পটমঞ্জরী)।
কবির এ কবিতা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়—টিলার উপরে আমার ঘর, আমার কোনো প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতে আমার ভাত নেই, আমি প্রতিদিন উপোস থাকি। ব্যাঙের মতো প্রতিদিন সংসার আমার বেড়ে চলছে, যে-দুধ দোহান হয়েছে তা আবার ফিরে যাচ্ছে গাভীর বাঁটে।
এমন অনেক বেদনার কথা আছে চর্যাপদে, আছে সমাজের তথাকথিত উঁচুশ্রেণির লোকের অত্যাচারের ছবি। তাই কবিরা সুযোগ পেলেই উপহাস করেছেন ওইসব লোকের। চর্যাপদের মধ্যে শ্রেণিচেতনার যে আভাস পাওয়া যা তার সময়কাল ১৮০০ সালেরও আগে। তাহলে এগুলো গণসংগীত না তা বলি কিভাবে?
গত শতাব্দীর চারের দশকে স্বল্পসময়ের ব্যবধানে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে রাজনৈতিক-সামাজিক-ঐতিহাসিক বিচারে যাদের গুরুত্ব অপরিসীম। ঘটনাগুলো হলো : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, মহামারী, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশ বিভাগ এবং ঠিক তার অব্যবহিত পূর্বে তেভাগা আন্দোলন। এ সময়ে যেসব গান তৈরি হয় সেগুলো মাইলফলক। সর্বহারা জনতার সংগ্রাম আদর্শিক, সংঘবদ্ধ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও অন্যায় প্রতিরোধের। শিল্পী সংগ্রামীরা গণসংগীতকে এ দেশে আন্দোলন-সংগ্রামে প্রয়োগ করেছিলেন সময়োপযোগী সাংস্কৃতিক মাধ্যম হিসেবে। আদর্শিক রাজনৈতিক সংগ্রামকে বেগবান করতে যে সংস্কৃতির প্রয়োজন চল্লিশের দশকে সে সংস্কৃতি যাত্রা শুরু করেছিল। তাই ব্যাপক আকারে সংগ্রামরত মানুষ-কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষ মাত্রেই আদর্শিক সংগ্রামের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। গণমানুষের লড়াই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঘৃণার বিস্ফোরণ, মনুষ্যসৃষ্ট ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে (১৩৭৬ অর্থাৎ ১৯৪৩ সাল) জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল গণসংগীত। গণসংগীত যে বড় হাতিয়ার, সেটা প্রতিষ্ঠিত করেছিল গণসাংস্কৃতিক সংগঠন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের শিল্পীরা। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ মাঠে ময়দানে নেমে পড়েছিল দুর্গত বিপন্ন মানুষকে ছেচল্লিশের ভাতৃঘাতি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ‘গ্রেট কলিকাতা কিলিং’ প্রতিরোধ করতে।
গণনাট্য ভারতব্যাপী ‘ভুখা হ্যায় বাঙাল রে সাথী, ভুখা হ্যায় বাঙাল’ গান গেয়ে, নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করে সংগ্রহ করেছিল অর্থ। ভারতের গননাট্যসংঘ প্রথম বোঝাতে পেরেছিলো গণসংস্কৃতি কী ও কেন। দেশভাগের পরে আমাদের দেশেও আন্দোলন সংগ্রামের মুখ্য ভূমিকায় উঠে আসে সুর-অসুরের দ্বন্দ্ব। প্রাণ পায় গণসংগীত। বিজন ভট্টাচার্য, দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্র মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সাধন দাশগুপ্ত, হরিপদ কুশারী, কানু ঘোষ, প্রেম ধর, প্রেম ধাওয়ান, মখদুম মহিউদ্দীন, নিবারণ পণ্ডিত, পারভেজ শাহেদি, সজল চট্টোপাধ্যায়, ভূপেন হাজারিকা, নির্মলেন্দু চৌধুরী, অমর শেখ, প্রতুল মুখোপাধ্যায়, হলরাজী, মোহিনী চৌধুরী, দিলীপ সেনগুপ্ত, অজিত পাণ্ডে, শুভ্যেন্দু মাইতিসহ একদল মেধাবী শিল্পী-সুরকার সংগঠককে (অনেকের নাম স্থান সংকুলানের জন্যে দেওয়া গেল না বলে দুঃখিত), দেশভাগের পরও, আমাদের দেশে উদীচী, ক্রান্তি, ছায়ানট তাঁদের চর্চা করেছে। এতে গণনাট্যের কার্যক্রমের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠতে দেখি আমরা।
১৯৬৮ সালে সংস্কৃতিকে গণসংগ্রামের হাতিয়ার করতে ও গণমানুষের সংস্কৃতিকে ধারণ ও লালন করার ব্রত নিয়ে গড়ে ওঠে উদীচী। তারা যেভাবে শুরু করেছিল আজও সেই জায়গায়, সেই লক্ষ্যে স্থির-সংগ্রামরত। এভাবে গণসংগীত ছড়িয়ে পড়ে দেশের পথে-প্রান্তরে। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে গণসংগীত গাওয়া হলেও ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে এর প্রাতিষ্ঠানিকতা অনেকটা মেলে। আর সমস্ত আয়োজন গিয়ে ঠেকে ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে। যুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতারে গণসংগীত মুক্তিসেনাদের প্রাণ জোগাত। মানে সশস্ত্র এক যোদ্ধার কাছে প্রেরণার উৎস ছিল গণসংগীত। এরচেয়ে বড় ঘটনা আর কী হতে পারে? স্বাধীনতার পরে বহু সংগঠন গড়ে উঠেছে । কিন্তু গণসংগীতকে টিকিয়ে রাখতে উদীচীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। গণনাট্য সংঘের আদলে উদীচীর বিনির্মাণ হয়েছে। এই সাংস্কৃতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছি শিল্পী সংগ্রামী সংগঠক সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, মোস্তফা ওয়াহিদ খান, গোলাম মোহাম্মদ ইদু, কামাল লোহানী, কলিম শরাফী,ওয়াহিদুল ইসলাম, সনজীদা খাতুনসহ অনেক মহান ব্যক্তিত্বকে।
শিল্পী হিসেবে পেয়েছি শেখ লুৎফর রহমান, রমেশ শীল, ফনী বড়ুয়া, আবদুল লতিফ, সুখেন্দু চক্রবর্তী, অজিত রায়, আলতাফ মাহমুদের মতো মহান প্রতিভাকে (এখানে বহুনাম যুক্ত হওয়ার মতো রয়েছে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় দুঃখিত)। ১৯৭১ সালের গণবিপ্লবকে ’৭৫ সালে রুখে দেয় সাম্রাজ্যবাদের অনুগামী বিপথগামী একদল সেনা কর্মকর্তা। দেশকে পাকিস্তানি ধারায় নেওয়ার চক্রান্ত চলে। সে এক শুভ্র তিমির জুড়ে বসে দেশে। ওই সময়ে অনেক সংগঠন গণসংগীতের দাড়ি, কমা মুছে ফেললেও উদীচী তখনও তার সংগ্রামে অবিচল ছিল। তখন শিল্পী সংগ্রামী মাহমুদ সেলিমের লেখা ‘ইতিহাস কথা কও’-এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা স্থাপনের সংগ্রাম শুরু হয়। ওই দুর্দিনে বাঙালি সংস্কৃতির সব মাধ্যমের পরিবেশনার মাধ্যমে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা বাজানো হয়। আজও এই সাহসী পরিবেশনাটি মাইলফলক এক গীতি আলেখ্য, যার পরিবেশনা উদীচীর মতো সংগঠন ছাড়া আর কারো পক্ষে করা সম্ভব ছিল না।
গণসংগীত উদ্ভবের কারণে আমরা এমন মেধাবীদের সংস্কৃতি সংগ্রামে যুক্ত হতে দেখেছি, যা কল্পনাতীত। নিরক্ষর কৃষক মজদুর থেকে মধ্যবিত্ত সবার সম্মিলন ঘটেছে এক প্ল্যাটফর্মে। সব সুর যোদ্ধার সাংস্কৃতিক যূথবদ্ধতার মধ্য দিয়ে শানিত হয়েছে গণসংগীত। মুটে-মজদুর থেকে ক্ষেতের কিষাণ রিকশাচালকের মেধার স্ফুরণ ঘটেছে গণসংগীতের মধ্য দিয়ে। ’৮২ সালে সামরিক সরকারবিরোধী সংগ্রাম থেকে ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে আজ অবধি স্বৈরাচার, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও মানবতাবিরোধী সংগ্রামে গণসংগীত অপরিহার্য ভূমিকা রেখে চলেছে। গ্রামেগঞ্জে কুপির আলোর মতো টিকে আছে গণসংগীত। যেকোনো সময়ে তা অগ্নিমশাল হতে তৈরি। যে রাজনীতি সমাজব্যবস্থা পাল্টানোর জন্য উদ্যোগ নেয়, তাকে সহায়তা করার জন্য থাকে সাংস্কৃতিক তৎপরতা। এ ক্ষেত্রে গণসংগীতের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
গণসংগীতের বাণী ও সুর মানুষের ব্যক্তিগত আবেগকে ছাপিয়ে ওঠে। ব্যক্তিগত আবেগকে অতিক্রম করে হৃদয়কে এমনভাবে স্পর্শ করে যে, ‘শ্রোতা একজন সামাজিক প্রাণী হিসাবে আর দশ জনের সঙ্গে একা অনুভব করেন। তিনি যদি সামাজিক ব্যবস্থায় অসন্তুষ্ট থাকেন, এই অসন্তুষ্টি তবে মধ্যবিত্তের শখের বেদনা-বিলাসের স্তর অতিক্রম করে সমাজব্যবস্থা উচ্ছেদের সঙ্কল্পে পরিণত করার জন্য তাকে ইন্ধন যোগাবে। গণসঙ্গীত মানুষকে বিষাদে আচ্ছন্ন করে না বা সুখে বিভোর করে তোলে না বরং জেগে ওঠে মানুষের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উৎসাহ দেয়।’ কথাগুলো আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের।
সমাজতান্ত্রিক চেতনায় ঋদ্ধ গণসংগীত যা বুর্জোয়া সমাজ কাঠামোতে তৈরি ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে থাকবে অগ্রগণ্য। শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভেতরে জন্ম নেওয়া আত্মকেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকের গণসংগীত আন্দোলন আঘাত হেনেছিল। সেই শুরু তারপরে সংগ্রামের আর শেষ হয়নি।
১৯২০-২১ থেকে ফ্যাসিবাদী বর্বরতা ইতালির মুসোলিনি, স্পেনের ফ্রাঙ্কো হয়ে ১৯৩৩ সালে হিটলারে জার্মানিতে চূড়ান্ত আকার ধারণ করে। ফ্যাসিবাদের উম্মত্ত তাণ্ডবে তখন ছিন্নভিন্ন বিশ্ব। ক্ষমতার দম্ভে অস্থির নাৎসি মন্ত্রী গোয়েরিং দৃঢ়কণ্ঠে ব্যক্ত করেছিলেন যে, সংস্কৃতি শব্দটাকে দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন করে ছাড়ব।’ সংস্কৃতি ধ্বংস হয়নি, কেউ করতে পারে না; বরং সংস্কৃতি ধ্বংস করতে যারা চেয়েছে, বিশ্ব থেকে তারা ধ্বংস হয়ে গেছে, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সুরের কাছে অসুর টিকতে পারে না। পারবে না। সুরের শক্তি এতোই যে ছেঁড়া পালে জোড়া লাগায়। সুর টিকে থাকে আঁতুড়ের জন্মে-কান্নায়-হাসি আনন্দে। অসুর নিপাত হয় তার সৃষ্ট পুঁজির পাহাড় ধসে।
সমাজে যতকাল শ্রেণি থাকবে, ততকাল শ্রেণিসংগ্রাম থাকবে, যতকাল সমাজে কায়েমি স্বার্থ থাকবে, তত দিন টিকে থাকবে গণমানুষের লড়াই-সংগ্রাম। এই সংগ্রামের নেতৃত্ব দেবে গণসংগীত। যুগে যুগে কালে কালে গণসংগীত বেঁচে থাকবে মেহনতি মানুষের সংগ্রামের প্রেরণা হয়ে। সারা বিশ্বের সংগ্রামরত সমমনা মুক্তিকামী নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে আমিও এ বিশ্বাস করি। জয় হোক মেহনতি মানুষের ।
তথ্যঋণ
উজান গাঙ বাইয়া, হেমাঙ্গ বিশ্বাস
চল্লিশের দশকের বাংলার গণসংগীত আন্দোলন, অনুরাধা রায়
জীবনের গান গাই, শেখ লুতফর রহমান
ফ্যাসিবাদবিরোধীতায় বাংলা গণসংগীত, অরুণ কুমার বসু
সমগীত : গণসংগীত আন্দোলন
history of language, B. noyeer