কুরোসাওয়া কথা
ছিঁচকাঁদুনে
ভূমিকা
জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া (২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘ড্রিমস’সহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, ‘কুরোসাওয়া কথা’ শিরোনামে, ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে এখানে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।
এই স্কুলটিতে যখন বদলি হয়ে আসি, তখন আমি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণির দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় সাময়িক পর্যায়ের ছাত্র। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, মোরিমুরা গাকুয়েনের স্কুলটির তুলনায় এখানকার সবকিছু একেবারেই আলাদা। স্কুলঘরটির রং সাদা নয় মোটেও, বরং একটি মেইজি-যুগীয় [১৮৬২-১৯১২] মিলিটারি ব্যারাকের স্টাইলে, কাঠে তৈরি একটি সাদামাটা ও নিচু বিল্ডিং। মোরিমুরায় সব শিক্ষার্থী ইউরোপিয়ান স্টাইলের স্মার্ট ইউনিফর্ম পরত—ভাঁজ দেওয়া; আর এখানে সবাই পরে হাকামাকা নামের চওড়া ট্রাউজার-সহকারে একেবারেই জাপানি পোশাক-আশাক। মোরিমুরায় সবাই ‘ল্যান্ডসেল’, মানে, জার্মান স্টাইলের চামড়ার থলে নিয়ে আসত বই রাখার জন্য; এখানে সবাই আনে কাপড়ের তৈরি বুকব্যাগ। মোরিমুরায় সবাই পায়ে পরত চামড়ার স্যু; আর এখানে পড়ে কাঠের খড়ম।
সবচেয়ে বড় কথা, দুই স্কুলের ছাত্রদের চেহারা-সুরত দুই রকমের। এমনটা হওয়ারই ছিল; কেননা, মোরিমুরার শিক্ষার্থীরা নিজেদের চুল বড় হতে দিতো; আর এখানকার সবার চুল ন্যাড়া করে রাখার মতো ছোট ছোট করে ছাটা। তবুও আমার ধারণা, কুরোদার শিক্ষার্থীদের দেখে আমি যতটা চমকেছি, সেই তুলনায় আমাকে দেখেই বরং তারা বেশি চমকে গিয়েছিল।
ভাবুন তো, আমার মতো কেউ একজন আচমকাই এমন একটি দলের মধ্যে গিয়ে পড়ল—যারা নিখুঁত জাপানি রেওয়াজ মতো জীবন কাটায় : আশ্রিত কোনো পুঁচকে ‘ভীতু’র মতো চুলের ছাঁট, শর্ট-প্যান্টের ওপর একটি বেল্টে আটকানো, ডবল-ব্রেস্টেড কোট পরা, লাল মোজা, এবং নিচু, বাকলের জুতো। আর কী কী দেখতে হবে— ভেবে চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল আমার; আর মুখ হয়ে গিয়েছিল মেয়েদের মুখের মতো সাদাটে। মুহূর্তেই আমি পরিণত হলাম হাসির খোরাকে।
তারা আমার লম্বা চুল ধরে টানে, আমার ব্যাগ ধরে খোঁচাতে থাকে, আমার জামাকাপড়ে এটা-সেটা ঘষতে থাকে, আর আমি চিৎকার করে কাঁদি। যদিও আমি বরাবরই ছিলাম ছিঁচকাঁদুনে বালক, তবে এই নতুন স্কুলে এসে, সহসাই নতুন একটা ডাকনাম হয়ে গেল আমার। তারা আমাকে ‘কনবেতো-সান’ [‘মিস্টার গামড্রপ’ বা ‘চকোলেট বাবু’] নামে ডাকত; এই নামটি এসেছিল জনপ্রিয় একটি গান থেকে : গানটির একটি চরণ ছিল এমন—
‘কোনবেতো-সান এসেছে আমাদের বাড়িতে,
খুবই ঝামেলার সে, কী যে ঝামেলার সে।
সারাক্ষণই কাঁদে, আর কাঁদে :
হাউমাউ-হাউমাউ-হাউমাউ-হাউমাউ।’
ধারণাটি ছিল— ছিঁচকাঁদুনে শিশুর চোখের জল গামড্রপের মতো বড় বড়। এমনকি আজকের দিনে এসেও, ‘কোনবেতো-সান’ নামটি শুনলেই আমার মনে অপমানিত হওয়ার একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে।
আমি যখন কুরোদা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হলাম, আমার ভাইয়াও এখানে চলে আসেন। তিনি তার মেধার শক্তিতে সোজা-সাপ্টা সবকিছু জয় করে নেন, এবং আমার মনে কোনো দ্বিধা নেই যে, এই ‘কোনবেতো-সান’ আরো বেশি কাঁদতে শুরু করে দেয়, কেননা, তার ভাই তাকে সাহস জোগানোর জন্য নিজের মর্যাদা ধার দেননি! নিজের স্বস্তির একটা জায়গা খুঁজে পাওয়ার জন্য পুরো একটা বছর ব্যয় করতে হয়েছে আমাকে। সেই বছরটির শেষে, কারো সামনে আর কাঁদিনি আমি; আমাকেও কেউ ‘কোনবেতো-সান’ নামে ডাকেনি আর। এ বেলা ‘কুরোচান’ হিসেবে আমার নাম বেশ মর্যাদার সঙ্গে উচ্চারিত হতে থাকে। এই এক বছরের মধ্যে এমনতর পার্থক্য ঘটে গিয়েছিল মূলত স্বাভাবিক নিয়মেই। আমার বুদ্ধিমত্তা কুঁড়ি মেলতে ও ফুল ফোটাতে শুরু করেছিল; আর তা এমন দ্রুততার সঙ্গে বেড়ে উঠছিল যে, আমি নিজের সমবয়সীদের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছিলাম। আমার এই অগ্রগতির পাগলা ঘোড়াটির নেপথ্যে কাজ করেছে তিনটি গোপন শক্তি।
এই গোপন শক্তিগুলোর একটি ছিলেন আমার ভাইয়া। কোইশিকাওয়া অঞ্চলের কেন্দ্রবিন্দু—উমাগারির কাছাকাছি ছিল আমাদের বসবাস; আর প্রতিদিন সকালে আমি ভাইয়ার সঙ্গে এদোগাওয়া নদীর তীর ধরে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতাম। আমি যখন নিচু ক্লাসের ছাত্র, তখন আমার স্কুল ছুটি হয়ে যেত আগে আগে; ফলে দুপুরবেলা আমাকে একা হেঁটে বাড়ি ফিরতে হতো। তবে প্রতি সকালে আমি ভাইয়ার পাশে পাশেই হাঁটতাম। প্রতি সকালে ভাইয়া আমাকে অবিরাম উপহাস করতেন। আমাকে অপদস্থ করার জন্য প্রতিবার ভিন্ন ভিন্ন মুখভঙ্গি দিতেন তিনি—যা কিনা স্বয়ং ছিল আজব ধরনের। তিনি উচ্চকণ্ঠে কিংবা কুচক্রীর ভঙ্গিমায় কিছু বলতেন না; বরং এতটাই নরম গলায় বলতেন যে, কথাগুলো আমার কানে ঠিকঠাক পৌঁছাত না। ফলে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া অন্য কেউ শুনতে পেত না এসব কথা। তিনি যদি জোরে বলতেন, তাহলে হয়তো আমিও চিৎকার দিয়ে জবাব দিতে পারতাম, কিংবা পারতাম কাঁদতে কাঁদতে ভেগে যেতে, কিংবা হাত দিয়ে নিজের কান চাপা দিতে পারতাম। কিন্তু তিনি এমনই আস্তে আস্তে, বিনম্রভাবে বলতেন যে, তার এমন নিরন্তর অপদস্থ করার কোনো জবাব দেওয়ার কথা আমার মাথায়ও আসত না।
ভাইয়া যে আমার সঙ্গে এমন আচরণ করেন, এ নিয়ে আম্মু ও আপুদের কাছে নালিশ করার কথা ভেবেছিলাম আমি; কিন্তু তা করতে পারিনি। স্কুলের কাছাকাছি আমরা পৌঁছুতেই ভাইয়া বলতে শুরু করতেন—‘আমি জানি তুমি একটা নোংরা পুঁচকে পচা কাপুরুষ; তাই আমি জানি তুমি আম্মু আর আপুদের কাছে গিয়ে সোজা গিয়ে নালিশ দেবে। আচ্ছা, চেষ্টা করে দেখো। আমি তোমাকে আরো বেশি অবজ্ঞা করব।’ ফলে আমার প্রতি তার এ রকম অবিরাম খারাপ আচরণের দিকে আঙুল তোলার সাহস পাইনি আমি।
তা ছাড়া আমার এই হীন ও জঘন্য ভাইটিকেই অবসরের সময় যখনই প্রয়োজন, নিজের পাশে পেয়েছি। যখনই কোনো বালক আমাকে উত্ত্যক্ত করত, তিনি যেন কোত্থেকে কেমন করে হাজির হয়ে যেতেন : জানি না, কী করে আমাকে এতটা চোখে চোখে রাখতেন তিনি। পুরো স্কুলের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল তার অবস্থান; এবং আমাকে উত্ত্যক্তের চেষ্টাকারীরা ছিল বয়সে তার চেয়ে ছোট; ফলে দৃশ্যপটে তিনি হাজির হওয়ামাত্রই তারা কিছু না বলে সটকে যেত দূরে। তাদের দিকে না তাকিয়েই তিনি নির্দেশ দিয়ে বসতেন, ‘আকিরা, একটু এদিকে আসো তো!’ স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে, হাসিমুখে তার কাছে ছুটে যেতাম আমি, ‘কী হয়েছে?’ তিনি শুধু একটা জবাবই দিতেন, ‘কিছু না,’ তারপর ঝটপট চলে যেতেন।
এ ধরনের ঘটনা বারবার, কতবার যে ঘটেছে। আমার কুয়াশাচ্ছন্ন মস্তিষ্ক তখন অল্প অল্প ভাবতে শুরু করে দেয় : স্কুলে আসার পর ভাইয়ার যে ব্যবহার, সেটির সঙ্গে স্কুলে আসার পথের ব্যবহারের কোনো মিল নেই। স্কুলে আসার পথে আমার প্রতি তার অবজ্ঞা ধীরে ধীরে কমতে থাকে; এবং নিঃশব্দ মূল্যায়নের শব্দ শুনতে শুরু করি আমি। সে দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকালে এখন আমার মনে হয়, এভাবেই শিশুতোষ বুদ্ধিমত্তা থেকে একজন স্বাভাবিক স্কুল-বালক-বয়সী শিশুর চিন্তা-ক্ষমতার সক্ষমতা অর্জনের পথে বিকাশ ঘটতে শুরু হয়েছিল আমার।
আমার ভাইয়ার প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনাকে সম্পৃক্ত করতে চাই এখানে। তখনো আমার ‘কোনবেতো-সান’ পিরিয়ড শেষ হয়নি, বাবা একদিন হুট করেই সিদ্ধান্ত নিলেন, আমাদের সবাইকে সুইফুরিউ প্র্যাকটিস পুলে নিয়ে যাবেন। সেটি নির্মিত হয়েছিল আকারাওয়া নদীতে। সেদিন ভাইয়ার পরনে আগে থেকেই ছিল কালো ত্রিভূজী নকশা কাটা একটি সাদা বাথিং-ক্যাপ; এবং প্র্যাকটিস পুলে ওভার-আর্ম ক্রাউল স্ট্রোকে তার অবস্থান ছিল শীর্ষস্থানীয়। সুইফুরিউর শিক্ষক ছিলেন আমার বাবার বন্ধুর মতো; তার হাতে সঁপে দেওয়া হলো আমাকে।
আমি যেহেতু পরিবারের সবচেয়ে ছোট শিশু, বাবা আমাকে পাত্তা দিলেন না। তবে আমাকে এক বাচ্চা-মেয়ের মতো সাঁতার কাটতে, প্যাটি-কেক নিয়ে খেলতে, আর আপুদের সঙ্গে জলকেলি করতে দেখে বাবা নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত হয়েছিলেন। তিনি বললেন, সাঁতার যদি শিখতেই হয়, তাহলে আমাকে রোদে পুড়তে হবে; এমনকি আমি যদি সাঁতার না শিখেও নিজের চামড়া রোদে পোড়াতে পারি, তাহলে পুরস্কার দেবেন। কিন্তু পানি দেখলেই আমার ভয় লাগত; প্র্যাকটিস পুলে কোনোদিনই নামিনি আমি। দিনের পর দিন তিরস্কার করেও আমার সাঁতারের শিক্ষক আমাকে নাভি পর্যন্ত জলেও নামাতে পারেননি।
আমরা যখন পুলে যেতাম, ভাইয়াও আমাদের সঙ্গে থাকতেন; কিন্তু পুলে পৌঁছানোর পরপরই আমাকে ত্যাগ করতেন তিনি। সোজা সাঁতার দিয়ে জলাধারের গভীরতর অংশ অবধি চলে যেতেন; এবং আমাদের বাড়ি ফেরার সময় হওয়ার আগপর্যন্ত পাড়ে ফিরতেনই না। একা একা আতঙ্ক নিয়ে কতগুলো যে দিন কাটাতে হয়েছে আমাকে!
অবশেষে একদিন আমি সাঁতার শিখতে আসা নতুন শিশুদের সঙ্গে প্রথমবারের মতো শিখে গেলাম—কী করে পা দিয়ে কিক করতে হয় জলে; একটা লগ-ফ্লোটিং ধরে নেমে গেলাম নদীতে, আর তখনই সামনে এসে হাজির হলেন ভাইয়া। তিনি আমাকে ধরে একটা নৌকায় ওঠালেন; প্রস্তাব দিলেন নৌকায় ঘোরানোর। তীব্র আনন্দে আমি হাত মেলে দিলাম, নিজেকে সঁপে দিলাম তার হাতে—যেন তিনিই আমায় নৌকায় ওঠান। পাটাতনে উঠতেই, তিনি নৌকা ছোটাতে লাগলেন মাঝনদীর দিকে। পুলের পাশে থাকা পতাকা ও সঙ্কেতগুলো যখন একেবারেই ছোট হয়ে আসতে থাকল, হুট করেই আমাকে জলে ফেলে দিলেন তিনি!
নিজের সব শক্তি দিয়ে আমি স্রোতের ভেতর ভেসে থাকার এবং নৌকাটির কাছে পৌঁছার চেষ্টা করলাম—যেটির ওপরে ভাইয়া বসা। কিন্তু যখনই নৌকার কাছে আসি, ভাইয়া সেটিকে দূরে-দূরে সরিয়ে নিতে থাকলেন। বেশ কয়েকবার এ রকমটা করার পর, আমার সব শক্তি ফুরিয়ে এলো। যখন আমি নৌকাটি কিংবা ভাইয়াকে আর দেখতে পেলাম না, এবং আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছিলাম, তখন তিনি আমার লোইনক্লথ (লেঙটি) ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে, আমাকে তুলে আনলেন নৌকায়।
আতঙ্কিত ও বিস্মিত হয়ে খেয়াল করলাম, অল্প একটু পানি খেয়ে ফেলা ছাড়া, আমার আর কোনো ক্ষতিই হয়নি। নৌকায় বসে আমি যখন খাবি খাচ্ছি ও চোখ বড়-বড় করে ফেলেছি, ভাইয়া বললেন, ‘তার মানে, শেষ পর্যন্ত তুমি সাঁতার শিখেছ, আকিরা!’ নিশ্চিতভাবেই, এরপর আর কখনোই পানি দেখে ভয় পাইনি আমি। সাঁতার শিখেছি; শিখেছি সাঁতারকে ভালোবাসতে।
সেদিন বাড়ি ফেরার পথে ভাইয়া আমাকে এক ধরনের মজার আইসক্রিম কিনে দিলেন। আমরা যখন খাচ্ছিলাম, তিনি বললেন, ‘আকিরা, ডুবন্ত মানুষেরা হাসিমুখে মরে—এ কথা সত্য; তুমি তা-ই করছিলে।’ এ কথা শুনে আমার রাগ হলো খুব; কিন্তু আমার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি এমনই ঘটেছিল বলে মনে হলো। ডুবে যাওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে এক আজব ধরনের শান্তিময় সংবেদনশীলতা অনুভব করেছিলাম, মনে পড়ল।