গপ্পো তক্ক যুক্তি
আমার ছবিতে আসল বলতে কিছুই নেই : ক্লদ শ্যাব্রল
ক্লদ অঁরি জ্যঁ শ্যাব্রল। বিখ্যাত ফরাসি চিত্রপরিচালক। ১৯৩০ সালের ২৪ জুন তাঁর জন্ম, মৃত্যু ২০১০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। তিনি ছিলেন ‘কাইয়্যে দ্যু সিনেমা’ পত্রিকার অন্যতম সদস্য, বিখ্যাত ফরাসি নবতরঙ্গ চলচ্চিত্র আন্দোলনের সামনের সারির নেতা। তাঁর সমসাময়িক নির্মাতারা হলেন জ্যঁ লুক গদার, এরিক রোমার, ফ্রাসোঁয়া ত্রুফো, লুই মাল, জাক রিভেত, অ্যাগনেস ভার্দার মতো নির্মাতারা। পরিচালক হিসেবে তাঁর কাজ সব মিলিয়ে ৭৩টি। এর মধ্যে ‘দ্য বুচার’, ‘দি আনফেইথফুল ওয়াইফ’, ‘দ্য বিস্ট মাস্ট ডাই’, ‘জাস্ট বিফোর নাইটফল’, ‘দ্য কাজিনস’, ‘ভায়োলেট’-এর মতো বিখ্যাত সব ছবি রয়েছে। ‘দ্য টকস’-এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি ২০০৯ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবের সময় নেওয়া হয়েছিল।
মিস্টার শ্যাব্রল, সিনেমা বানানোর ক্ষেত্রে আপনি কোন বিষয়টার দিকে বিশেষ নজর রাখেন?
আমার কাছে বিষয়টা হলো স্ক্রিপ্ট। আমি সব সময়েই কাউকে না কাউকে সঙ্গে নিয়ে লিখি। আর আমি সব সময়েই একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে কাজ করি—এমন একটা নোটবুকে লিখি, যেখানে প্রতি পাতায় এক মিনিটের শটের বিবরণ লেখার প্রয়োজনীয় জায়গা থাকে। আমি যখন সিনেমা লিখি, তখন আমি ঠিকঠাক জানি যে এটা ঠিক কতক্ষণের হবে। এমনকি পুরো বিষয়টার একদম পরিষ্কার ইমেজও আমি মনে মনে দেখতে পাই।
কোন দিকটা সবচেয়ে পছন্দের?
সিনেমা বানাতে আমার দারুণ আনন্দ লাগে, খুবই মজা পাই। এর মধ্যে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে সেটে থাকতে। সেসব দুর্ভাগা ৫০ জন লোককে ধন্যবাদ, যারা সব সময় আমার সঙ্গে কাজ করে, তারাই আমাকে এ আনন্দটা দেয়। যখন আমি শুটিং শুরু করি, তখন এই দক্ষ লোকজন আর শিল্পীরা আমার চারপাশ ঘিরে রাখে। ওরা আমাকে সুখী করে তোলে আর আমার স্বপ্নটা ছড়িয়ে দেয়। এর চেয়ে বেশি আর কী-ই বা চাইতে পারি!
শুনে মনে হচ্ছে, আপনি একা কাজ করতে ভালোবাসেন না!
সিনেমা বানানোর সবচেয়ে দারুণ বিষয়টাই হচ্ছে সবাই একসঙ্গে কাজ করা। আর ডিরেক্টরের মূল কাজ হচ্ছে এই ব্যাপারটা নিশ্চিত করা। এমন দক্ষ ৫০ জন লোক পাওয়া আনন্দের ব্যাপার, ভাগ্যেরও। তারা রীতিমতো হাড়ভাঙা খাটুনি করে তাদের ডিরেক্টরের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য ছোটাছুটি করে। অন্য কোনো পেশায় এমন সৃষ্টিশীল ব্যাকআপ থাকে না—কেবল একজন অর্কেস্ট্রা কন্ডাক্টর বাদে, যার কি না দারুণ একটা মিউজিশিয়ানের দল থাকে, যারা তার সুরটা বাজায়। তবে হ্যাঁ, পরিচালকের অবশ্যই একটা স্বপ্ন থাকতে হবে। নইলে পুরো ব্যাপারটাই বৃথা।
ছবির কাজ করতে গিয়ে আপনি কি হতাশ হন?
কখনো একেবারে ক্ষেপে যাই না। ভুল দেখলে আমি হাসি। আসলে কিছু ভুল হতেই পারে, এ জন্য ক্ষেপে ওঠাটা একদম অনর্থক। আপনি আর কী-ই বা করতে পারেন? কেউ কোনো ভুল করলে আপনি এর জন্য বড়জোর একটু হাসতে পারেন, এই তো!
ভাবনাহীন কি আসলে থাকতে পারেন? আর সেটা পারলেও কতক্ষণ পর্যন্ত?
মানুষ কী করবে, সেটা বলে দেওয়া সব সময় ঠিক নয়। আমি আমার কাজ করি, কাউকে কাজে নেওয়ার আগে একটু গবেষণা করি। আর এ বিষয়টি নিশ্চিত করি যে, আমার বাছাই করা লোকটা কাজ ঠিকমতো করতে পারবে। এ জন্যই আমি অভিনেতাদের নিজেদের মতো ছেড়ে দিই। তারা যেন নিজেরাই বুঝে নিতে পারে যে তাদের যে চরিত্রে নেওয়া হয়েছে, সেটার জন্য তারা কীভাবে কাজ করবে।
এটা কি সব সময় কাজে দেয়?
এটা এমন একটা পদ্ধতি, যেটা দশবারের মধ্যে নয়বারই কাজ করে। শিল্পীরা নিজেরাই বোঝে যে তাদের কী করতে হবে। যেমন বলা যায়, লুদিভাই সেনিয়ারের জন্য ‘এ গার্ল কাট ইন টু’-তে কাজ করা ছিল ব্যতিক্রমীভাবে সহজ, কারণ আমরা তখন একই মাপে চলছিলাম।
এই একই মাপে থাকার বিষয়টায় বুঝি আপনি খুব গুরুত্ব দেন! এ জন্যই আপনার দলে আপনার পরিবারের এত মানুষজন কাজ করে?
হ্যাঁ, আমার মেজ ছেলে আমার ছবির জন্য মিউজিক লেখার কাজ করে চলেছে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে। আপনি দেখবেন, আমার ছবির ক্রেডিট লাইনে খালি শ্যাব্রল আর শ্যাব্রল! আর হ্যাঁ, আপনাকে হলফ করে বলতে পারি যে বেনামের ব্যাপারটাও আছে প্রচুর (হাসি)! যেমন ধরুন গিয়ে, সেসিল মায়েস্ত্রে—ও হচ্ছে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর, চিত্রনাট্যও লেখে; ও হলো আমার এক ছেলের বৌ! ওরা যা করে, বেশ ভালোভাবেই করে, আমারও ওদের সঙ্গ দারুণ লাগে।
আপনার কাজ বুর্জোয়াদের কঠিন সমালোচক? কেন?
আমার ছবিতে যেমন দেখাই, বুর্জোয়ারা তেমনই। তেমন ভালো বা মন্দ, কোনোটাই নয়। ওদের কাজ-কারবার দেখলে আমার হাসি পায়। সত্যি বলতে গেলে, কাজের দিক থেকে তারা কখনোই শতভাগ ভালো নয়। কারণ, জীবন, বেঁচে থাকা নিয়ে তারা ভীত। ওখান থেকেই তারা এমনটা হয়ে ওঠে। প্রকৃত জীবনকে তারা ভয় পায়, রীতিমতো আতঙ্ক কাজ করে তাদের মধ্যে। আর এ বিষয়টাই আমাকে হাসায়।
কিন্তু আপনার কাজ প্রায়ই মনে হয়, সরাসরি আপনার জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। এক অর্থে আপনার কাজ কি তাহলে আত্মজীবনীমূলক নয়?
আমি ঠিক ওভাবে লিখি না, আত্মজীবনীর ধাঁচে। আমার ছবির অ্যাপ্রোচ একটু ভিন্ন। আমার নিজের জীবন থেকে আমি গল্প নিয়ে থাকি, সে সঙ্গে আমার কাছের মানুষের গল্পগুলোও নিই, এমন কিছু একটা বানানোর জন্য নিই, যেটা হবে আত্মকাহিনীর ঠিক উল্টো। সব মানুষের জীবনে যা আছে, সেটাকে দেখানোর জন্যই এভাবে কাজ করি। যে বা যারা আত্মজীবনী পছন্দ করে, তারা সবাই নিজের স্বরূপ দেখাতে আগ্রহী থাকে। আমার জন্য বিষয়টি একেবারেই উল্টো। আমার ছবিতে আসল বলতে কিছুই নেই, সব বানানো। সবাই যা বলতে পারে, নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করতে পারে, সেগুলোই আমার ছবিতে থাকে।
ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের কালে আপনি চলচ্চিত্র নির্মাণে নতুন ঢং আবিষ্কার করেছেন। আজকালকার সিনেমায় কি আপনি আঁভা-গার্দের চেতনা দেখতে পান?
ভাগ্য ভালো যে ‘সিনেমা বানানোর সিনেমা’ ন্যুভেল ভাগের (ফরাসি নবতরঙ্গ) সঙ্গে সঙ্গে খতম হয়ে যায়নি! অবশ্যই এখনকার অনেক নবীন পরিচালককে আঁভা-গার্দের কাজ হচ্ছে। আমি মনে করি, দুনিয়াজোড়া ফিল্মমেকারদের মধ্যে দুটো ভাগ রয়েছে—একদল হলো যাদের ছবি বানানোর জন্য ভেতর থেকে এক ধরনের তাড়না কাজ করে; আরেক দল হলো যাদের নেহাত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে থাকা দরকার! এই দ্বিতীয় ক্যাটাগরির নির্মাতাদের বিষয়ে আমার আদতে কোনো আগ্রহ নেই। অন্যদিকে প্রথম দলটি আমার কাছে সব সময়েই খুব আকর্ষণীয়। বলতে গেলে, বছরে আমি প্রচুর ছবি দেখি। ওগুলোর মধ্যে দু-তিনটে খুব ভালো হয়, তবে বাকিগুলো আপনার ভুলে যাওয়াই ভালো!
এই অনুপাতটা কি আগে আরো বেশি ছিল?
না, ব্যাপারটা সব সময়ই এ রকম। অনুপাতটা এখন যেমন, আগেও তেমনই ছিল। পার্থক্য একটাই, এখন ছবিগুলো পৃথিবীর সব জায়গা, ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে আসছে। এই ছবিগুলো ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতা, ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল থেকে আসছে। অনেক লম্বা একটা সময় ধরে আমরা দেখেছি যে এশিয়া থেকে কোনো ছবি আসছে না, কিন্তু এখন তো অনেক আসছে। তবে ওই ভালো-মন্দের অনুপাতটা সব সময়ই এক। সব সময়েই আপনি হাতেগোনা ভালো কয়েকটা কাজ পাবেন, বাকি যা পাবেন তার সবই বাজে। ভালো ছবি পেতে হলে আপনাকে হন্যে হয়ে ঘুরতে হবে, তবে এই ঘোরাঘুরি করাটা আমার কাছে ভালোই লাগে!