গপ্পো তক্ক যুক্তি
আমি কখনোই মেধাবী ছিলাম না : আলেক্সান্ডার পেন
আলেক্সান্ডার পেনের জন্ম ১৯৬১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। একাধারে তিনি একজন পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং প্রযোজক। ১৯৯৬ সালে সিটিজেন রুথ ছবির মাধ্যমে পেনের চলচ্চিত্র যাত্রা শুরু। ইলেকশন (১৯৯৯), অ্যাবাউট শ্মিত (২০০২), সাইডওয়েজ (২০০৪), দ্য ডিসেনডেন্টস (২০১১), নেব্রাস্কা (২০১৩) তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবি। ডার্ক হিউমার এবং ব্যঙ্গধর্মী কাজ তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। চিত্রনাট্য রচনায় দেখিয়েছেন তিনি আলাদা মুন্সিয়ানা, বিশেষ করে সাহিত্য থেকে চিত্রনাট্য নির্মাণে। সাহিত্য অবলম্বনে সেরা চিত্রনাট্য রচনার জন্য দুবার জিতেছেন অস্কার। এ ছাড়া সেরা পরিচালকের জন্য তিনবার অস্কার মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি। তাঁর এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে দ্য টকস থেকে।
প্রশ্ন : মিস্টার পেন, হলে বসে একটা খারাপ ছবি দেখার পর কি আপনি হতাশ হন?
উত্তর : আমি খারাপ ছবি দেখতে যাই না (হাসি)। মনে আছে, কয়েক বছর আগে ‘কন এয়ার’ ছবিটা দেখে হতাশ হয়েছিলাম। এটা সম্পূর্ণভাবে একটা অনৈতিক ছবি।
প্রশ্ন : সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করার জন্য সিনেমার একটা অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতা আছে। এই ক্ষমতার যখন অপব্যবহার হয় তখন কি আপনি বিরক্ত হন?
উত্তর : হ্যাঁ, হই। মানুষকে প্রভাবিত করার একটা বিশাল ক্ষমতা সিনেমার রয়েছে। মানুষ এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। কিন্তু যখন দেখি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করা হচ্ছে তখন আতঙ্কিত হই। অযথাই নির্দয় সহিংসতা দেখানো বা ১০ ডলারের বিনিময়ে সিনেমা হলে রোমান সার্কাস দেখানোটাকে আমি সমর্থন করি না।
প্রশ্ন : আপনি কি এটাকে পরিচালকদের দায়িত্ব মনে করেন?
উত্তর : না, আমি বলতে চাইছি যার যা খুশি তা করতে পারে। কিন্তু এটা তো একটা ক্ষমতা। যেমনটা লেনি রিফেন্সাথাল (জার্মান চলচ্চিত্র পরিচালক) অসাধারণভাবে করে দেখিয়েছেন। এটা কোনো কিছু বদলানোর ক্ষমতা, সমাজের আয়না হিসেবে ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, মনুষ্যত্ববোধটা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা এবং মানুষকে হাসানোর ক্ষমতা। চ্যাপলিনই প্রথম বিশ্বের সবাইকে একসাথে হাসাতে পেরেছিলেন, তাও নীরবে, কোনো শব্দ উচ্চারণ না করে। নীরবতাই আসলে পুরো বিশ্বের ভাষা। অন্য অনেক জিনিসের মতোই আমার মনে হয় এটা সুন্দরের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, অসুন্দরের অস্ত্র নয়। সেই সাথে এটা নিজের পরিবর্ধনের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। সিনেমা দিয়ে আমরা নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পারছি।
প্রশ্ন : আপনি কি সব সময় পরিচালক হতে চেয়েছিলেন, নাকি অন্য কিছু?
উত্তর : আমার যদ্দূর মনে পড়ে, আমি সব সময়ই সত্যিকার অর্থে একজন ফিল্ম বাফ ছিলাম। চার বা পাঁচ বছর বয়স থেকেই আমি সিনেমা বলতে পাগল ছিলাম। এর পর যখন স্ট্যানফোর্ডে পড়তে গেলাম তখন ভাবলাম, গ্র্যাজুয়েশনের পর এই বিদ্যা কোথায় কাজে লাগাব, তখন মনের অজান্তেই মনে হয়েছিল, ‘আমার পরিচালনার কাজ করা উচিত।’ আমি ভাবছিলাম, আমার ফিল্ম স্কুলে যাওয়া উচিত। আমি আসলে বুঝতে চেয়েছিলাম যে সিনেমা জিনিসটা আসলে কী? একটা চান্স নিতে চেয়েছিলাম যে সিনেমা দেখার এই নেশাটাকে সিনেমা বানানোর নেশায় পাল্টে ফেলা যায় কি না।
প্রশ্ন : সেটা তো ভালোভাবেই পাল্টেছে...
উত্তর : হ্যাঁ। সেটা পাল্টেছে। কিন্তু তার জন্য আমাকে যথেষ্ট ধৈর্য ধরতে হয়েছে। একটা ছবি না বানানো পর্যন্ত আপনি বুঝতে পারবেন না জিনিসটা বানাতে নিজেকে কীভাবে উজাড় করে দিতে হয়, কী পরিমাণ সময় যে এর পেছনে দিতে হয়। কাজ করতে গিয়ে সেটা আমি বুঝেছি এবং বিষয়টা আমার ভালো লেগেছে। আমার সমসাময়িক পরিচালকদের থেকে মেধায় আমি অনেক পিছিয়ে। তবে একটা সিনেমা বানানোর মতো সামর্থ্যটুকুই শুধু আছে।
প্রশ্ন : ৩৫ বছর বয়সে আপনি প্রথম ছবি বানিয়েছিলেন। পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্য এতটা সময় কি আপনার আসলেই দরকার ছিল?
উত্তর : সবার জন্য হয়তো দরকার পড়ে না, কিন্তু আমার দরকার ছিল। প্রথম ছবি বানানোর সময় আমার বয়স ছিল ৩৫, আমার মনে হয় প্রথম ছবি বানানোর জন্য সেটা একদম সঠিক সময়। কুরোসওয়া তাঁর প্রথম ছবি বানিয়েছিলেন ৩২ কি ৩৩ বছর বয়সে।
প্রশ্ন : কিন্তু তার পর থেকে তো সবাই অল্প বয়সেই সিনেমা বানানো শুরু করল।
উত্তর : হ্যাঁ, হ্যাঁ, অনেকেই অল্প বয়সে বানিয়েছে। কিন্তু বুন্যুয়েল প্রথম ছবি বানিয়েছিল ৪৮ বছর বয়সে।
প্রশ্ন : আচ্ছা, আপনি মনে হয় বিরক্ত হচ্ছেন। অন্যভাবে জিজ্ঞেস করি, ২৫ বছর বয়সী এক ছোকরা কি দুই কোটি ডলারের বাজেট সামলে রাখতে পারবে?
উত্তর : এখন কিন্তু ছবি করতে দুই কোটি ডলার লাগে না। আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি যেখানে কোনো অজুহাত খাটে না। এর মানে হচ্ছে এখন সিনেমা বানাতে চাইলে হাতের কাছেই সবকিছু পাওয়া যাচ্ছে। আপনার হাতে থাকা ফোনটা দিয়েও কিন্তু আপনি ছবি বানাতে পারেন (নিজের হাতে থাকা আইফোন-৪ দেখিয়ে)। আমরা খুব ভালো একটা সময়ে বাস করছি। পকেটে একটা মুভি ক্যামেরা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সবাই, সাথে সিংক-সাউন্ডও আছে। এটা অবিশ্বাস্য। দারুণ কোনো কিছু ঘটলে ফোন দিয়েই সেটা তুলে রাখতে পারবেন আপনি। ২০ বছর আগে জেমস বন্ডের ছবিতে যেসব প্রযুক্তি দেখে আপনার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতো, এখন সেটাই বাস্তব। বয়সের হিসাবে সিনেমাকে মাপা যায় কি না জানি না। স্টিভেন সডারবার্গ (মার্কিন চিত্রপরিচালক এবং প্রযোজক) তাড়াতাড়ি শুরু করেছিলেন। রেইনার ভের্নার ফাসবিন্ডার (জার্মান পরিচালক এবং অভিনেতা) ৩৮ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন কিন্তু এর মধ্যেই ৬০০ ছবি বানিয়ে ফেলেছিলেন।
প্রশ্ন : ওর ব্যাপারটা আলাদা ছিল...
উত্তর : হ্যাঁ, কোকেনের গুণ বলতে পারেন।
প্রশ্ন : পরিচালনার জন্য কোন জিনিসটা আপনাকে সবচেয়ে ভালোভাবে তৈরি করেছে?
উত্তর : আমি বলব, পুরো জীবন ধরে সিনেমা দেখাটাই সবচেয়ে ভালো প্রস্তুতি। ফিল্ম স্কুলে গেলে সেটা কিছুটা সাহায্য করে, নিজের মতো লোকজনের সাথে চলাফেরা করা উচিত। যারা অন্তত পাঁচ বছর ধরে ফিল্ম দেখে খায়, ঘুমায়, আড্ডা মারে, শ্বাস নেয় তাদের সাথে থাকলে সিনেমা বানানোর প্রস্তুতিটা ভালো হয়।
প্রশ্ন : আপনি স্নাতক করেছেন ইতিহাস এবং সাহিত্য নিয়ে। দ্য লাইভস অব আদার্স ছবির পরিচালক ফ্লোরিয়ান হেনকেল ভন ডনার্সমার্কও অন্য বিষয়ে লেখাপড়া করে পরে ফিল্ম বানিয়েছেন।
উত্তর : আপনি কার কথা বলছেন? যে লোকটা ‘দ্য ট্যুরিস্ট’ ছবিটা বানিয়েছেন? (হাসি)
প্রশ্ন : হ্যাঁ। একদম ঠিক ধরেছেন (হাসি)। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আপনার একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড কি সিনেমা বানানোর কোনো কাজে লেগেছে?
উত্তর : ইতিহাস, সাহিত্য এবং মানুষের ইতিহাস নিয়ে পড়াটা আমার কাজে লেগেছে। মানুষ কী করে এবং তারা কী করতে চায় এবং কেন করে সেটা ন্যারেটিভের সেন্স তৈরি করে দেয়। ইতিহাস হচ্ছে কাহিনী, সাহিত্য তো অবশ্যই কাহিনী। চরিত্রগুলোকে উপস্থাপন করা, তাদের জীবনের উল্লেখযোগ্য অংশ বাছাই করা এবং সেখান থেকে প্রেরণা নেওয়া। এ সবকিছুই আমি একাডেমিক লেখাপড়া থেকে পেয়েছি। সেরা ইতিহাসবিদরা সেরা সাহিত্যিকদের মতোই গুরুত্ব এবং মমতা দিয়ে ইতিহাস লেখেন। ইতিহাসবিদরাও আসলে এক ধরনের সাহিত্যিক।
প্রশ্ন : আপনি কি সাহিত্য অবলম্বনে চিত্রনাট্য করতে বেশি পছন্দ করেন নাকি মৌলিক গল্পের চিত্রনাট্য?
উত্তর : মৌলিক গল্প ভালো, যদি আপনার মাথায় ঠিক গল্প আর ঠিক চরিত্রগুলো থাকে। উপন্যাস থেকে ধার করাটা ভালো কারণ এটা আপনাকে এমন এক জগতে নিয়ে যাবে, যেটা আপনি বা আমি লাখ লাখ বছর ধরে চিন্তা করেও বের করতে পারতাম না। ‘দ্য ডিসেনডেন্টস’-এর কথাই ধরুন। আমি জীবনেও এই রকমের গল্প ভাবতে পারতাম না, এর ধারে কাছে ভাবাও আমার পক্ষে সম্ভব না।
প্রশ্ন : এটা কীভাবে ঠিক করেন? একটা সামান্য ছোটগল্প বা উপন্যাস দিয়ে পুরো একটা সিনেমা কীভাবে বানান?
উত্তর : আপনি কি আমার ‘ইলেকশন’ ছবিটা দেখেছেন? একটা হাইস্কুলের গল্প, যেখানে ম্যাথিউ ব্রডেরিক অভিনয় করেছিল। আমি পুরো ছবিটা বানিয়েছিলাম দুটি কারণে। প্রথমত, গল্পটা আলাদা চারজনের ভয়েস ওভারে বলা হয়েছে। এই ব্যাপারটা আমার কাছে খুব চ্যালেঞ্জিং মনে হয়েছিল, একটা গল্প চারজন মিলে বলছে এবং দ্বিতীয় হচ্ছে, ছবিতে একটা শট ছিল। ওই শটটা নেওয়ার জন্যই ছবিটা করতে চেয়েছিলাম। মাথা খারাপ হওয়ার মতো ব্যাপার ছিল সেটা।
প্রশ্ন : কোন শটটা?
উত্তর : সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ! ওই দৃশ্যে অবৈধ সম্পর্কের টানে একটি লোক সস্তা এক হোটেলে ওঠে। আর এই কাজটি সে করে সবকিছু ঠিক করার জন্য। তো এই দৃশ্যে দেখা যায়, লোকটি শ্যাম্পেন বের করে সিংকে রাখে, সাথে কিছু বরফ দেয়। রাসেল স্টোভার চকলেট বের করে রাখে এবং তারপরই সেই শট- সে বাথটাবে বসে বিশেষ অঙ্গ ধুতে থাকে। বাথটাবে উবু হয়ে সে ভালোমতো ঘষামাজা করতেই থাকে। পুরো ছবিটাই আসলে ওই একটা শট নেওয়ার জন্যই করেছিলাম।
প্রশ্ন : আমি আসলে ঠিক বুঝতে পারছি না, আমি প্রশ্নটা আপনাকে ঠিকভাবে করতে পেরেছি কি না। কিন্তু আমি খুশি এই কারণে যে আপনি উত্তরগুলো নিজের মতো করে দিয়েছেন।
উত্তর : আমি কিন্তু অন্যদের নিজের ছবি দেখতে বলি না কখনো। কিন্তু ‘ইলেকশন’ ছবিটার কথা বললাম এই কারণে যে ওই ছবিটার জন্যই আমি সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পেয়েছি। আপনারও ছবিটা দেখা উচিত।