শেষ আখ্যান
রুদ্র, হাতে মিলিয়ে যাওয়া হাওয়াই মিঠাই
(আজ ২১ জুন, কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯১ সালের এই দিনে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তিনি মারা যান। সত্তরের দশকের এই কবি পরিচিত তারুণ্য ও দ্রোহের প্রতীক হিসেবে। তাঁর প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই সাক্ষাৎকারভিত্তিক রচনা।)
ছোটবেলায় প্রথমবারের মতো বাজার থেকে হাওয়াই মিঠাই কিনেছিল এক দুরন্ত বালক। শৈশবের অপার বিস্ময় আর আনন্দ নিয়ে উপভোগ করতে চেয়েছিল রঙিন-সুদৃশ্য বস্তুটিকে। খুশিতে দৌড়েছিল অনেকটা পথ। তার পর বাড়িতে এসে যখন মুঠো খুলল তখন দেখল, সে মিঠাই হাওয়াতেই মিলিয়ে গেছে। হাতে শুধু কিছু রং লেগে আছে।
বালকটিকে আমরা চিনি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ নামে। দুনিয়ার দাবি না মিটিয়ে অকালে চলে যাওয়া এই কবির আজ মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯১ সালে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে অন্যলোকে পাড়ি জমিয়েছিলেন সদা বিদ্রোহী এই কবি।
মৃত্যুর মাত্র একদিন আগে হাওয়াই মিঠাইয়ের গল্পটা রুদ্র নিজেই শুনিয়েছিলেন তাঁর বড় আপাকে। আক্ষেপ করেছিলেন। প্রায় পুরো জীবন ধরে করে আসা প্রচুর অনিয়ম, শরীরের প্রতি যত্ন না নেওয়ার জন্য দুষেছিলেন নিজেকে। পণ করেছিলেন নিয়মবদ্ধ হওয়ার। কিন্তু মৃত্যুর নির্মমতা থেকে রেহাই মেলেনি বাংলাদেশের ট্র্যাজিক এই বিপ্লবী কবির।
ছোটবেলায় যে বাজার থেকে হাওয়াই মিঠাই কিনে নিতে চেয়েছিলেন অপার আনন্দের স্বাদ, মংলার সেই মিঠেখালি বাজারের পাশে নিজ পৈতৃক বাড়িতে রুদ্র কাটিয়েছিলেন জীবনের শেষ কয়েকটি বছর। অনেক কিছু নতুন করে গড়তে চেয়েছিলেন। দিনবদলের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন নতুন করে। ‘ভালো আছি ভালো থেকো’র মতো জনপ্রিয় কিছু গান ও অনেক কবিতা রচেছিলেন শেষ জীবনের দিনগুলোতে। সম্প্রতি রুদ্রর মংলার বাড়িতে বসে সেসব গল্প তাঁর সর্বকনিষ্ঠ ভাই সুমেল সারাফাতের কাছ থেকে শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল লেখকের। সেই বিবরণের ওপর ভিত্তি করেই লেখা হয়েছে রুদ্রর শেষ জীবনের আখ্যানগুলো।
সোনালী খামার
নন্দিত-নিন্দিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর ১৯৮৭ সালের শেষের দিকে অবসাদগ্রস্ত রুদ্র চলে আসেন মংলায়। এসে দেখেন ‘উপদ্রুত উপকূলে’র মানুষরা দিন কাটাচ্ছে চরম ভোগান্তিতে। নিজের জমি থেকেও নেই। নামমাত্র কিছু টাকা দিয়ে বা না দিয়ে সেই জমি গায়ের জোরে দখল করে রেখেছে ক্ষমতাশালীরা। স্বভাবজাত রুদ্র স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবাদ করলেন এবং জমির ওপর কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই চালালেন।
দুই বছর অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর ১৯৮৯ সালের দিকে এসে রুদ্র দেখতে পান সফলতার মুখ। কৃষকদের নিয়ে গড়ে তোলেন একটি সমবায় সমিতি। যেখানে কৃষকরা যুক্ত থাকবেন শেয়ারের ভিত্তিতে। আগে যেখানে নিজের জমির ওপর কোনো অধিকারই ছিল না, সেখানে কৃষক এখন নিজের জমির পরিমাণে লভ্যাংশ পাওয়ার কথা চিন্তা করতে পারছে। রুদ্র তাঁর সহজাত কবি ভাব থেকে এই প্রয়াসের নাম দিয়েছিলেন ‘সোনালী খামার’।
মংলা ফিরে এসে রুদ্র শুরু করেছিলেন ঠিকাদারি দিয়ে। চূড়ান্ত সৎ থাকার লোকসান গুনতে হয়। পরে ঘুষ না দেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে টাকা তুলতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। এমনকি একপর্যায়ে সরকারি এক কর্মকর্তাকে মারধরও করেছিলেন রুদ্র। ঠিকাদারির এসব ঠ্যাকা সামলাতে সামলাতেই অবশ্য চালিয়ে যাচ্ছিলেন ‘সোনালী খামারের’ কাজ। সে সময় তিনি একটা গান লিখেছিলেন, ‘ঘেরে ঘেরে ঘেরাও হলো চারিদিক/ঘেরের ঘোড়া চলছে ছুটে দিগ্বিদিক’।
অন্তর বাজাও
রুদ্রর গানের কথা আসলে অবধারিতভাবে চলে আসে ‘ভালো আছি ভালো থেকো’ গানটির কথা। ‘আমার ভেতর-বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে’। এই অন্তর ছিল রুদ্রর গানের কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর কথা ছিল গান হবে অন্তর বাজিয়ে। তিনি একটা গানও লিখেছিলেন, ‘ঢোলক বাজাও দোতারা বাজাও, সুর মিলছে না/অন্তর বাজাও নইলে তাল মিলবে না’। আর তাঁর গানের দলের নাম ছিল ‘অন্তর বাজাও’।
মংলায় এসেই রুদ্র লিখেছিলেন ও সুর করেছিলেন তাঁর গানগুলো। ১৯৯৬ সালের দিকে গানগুলো নিয়ে একটি অ্যালবাম প্রকাশ করেছিলেন রুদ্রর ছোটভাই সুমেল সারাফাত।
বাংলার আবহমান চিরায়ত সংস্কৃতির হারিয়ে যেতে বসা জিনিসগুলো আবার ফিরিয়ে আনার প্রয়াস দেখিয়েছিলেন রুদ্র। প্রায়ই আয়োজন করতেন জারিগান, কবিগানের। প্রতি সপ্তাহে বাড়ির পাশের নদীতে বসত নৌকাবাইচের আসর। আমুদে রুদ্র প্রায় সব সময়ই হইহুল্লোড় করে মেতে থাকতেন কিছু না কিছু নিয়ে। আবার রাতে একলা হওয়ার পর লিখে যেতেন একের পর এক কবিতা। মৃত্যুর আগ দিয়ে প্রায় তিনটি পাণ্ডুলিপি তিনি একেবারে প্রস্তুত করে গিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় কবিতার বই ‘এক গ্লাস অন্ধকার’, ‘অন্তরঙ্গ নির্বাসন’ ও নাট্যকাব্য ‘বিষ বিরিক্ষের বীজ’। মিঠেখালিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন ‘অগ্রদূত ক্রীড়াচক্র’।
কিন্তু প্রতিভাবান ও উদ্যমী এই মানুষটা নিজের প্রতি খেয়াল খুব কমই রেখেছেন। ১৯৯১ সালের জুন মাসে আলসারের প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন রুদ্র। ভর্তি হন হাসপাতালে। কয়েক দিন সেখানে থেকে সুস্থও হয়ে গিয়েছিলেন প্রায়। বাড়িতেও ফিরে এসেছিলেন ২০ জুন। পরিবারের সবার সঙ্গে কাটিয়েছিলেন অনেক স্মৃতিকাতর সময়। কিন্তু সেই কলতান ছিল ক্ষণস্থায়ী। ২১ জুন সকাল ৭টায় হঠাৎ স্ট্রোক করে রুদ্র চলে যান না-ফেরার দেশে।
শেষ সময়টাতে রুদ্র নিজেই তাঁর বড় আপাকে শুনিয়েছিলেন হাতে মিলিয়ে যাওয়া হাওয়াই মিঠাইয়ের গল্পটি। রুদ্রর জীবনটাও কি সেই হাওয়াই মিঠাইয়ের মতোই নয়? তাঁর কিছু রং লেগে আছে আমাদের মাঝে। কিন্তু আমরা হাওয়াতেই হারিয়ে ফেলেছি মিঠাইটা।