সেলফি
ঘুম ভেঙে গেলে বোকার মতো এদিক ওদিক তাকায় মুহিত। ঘরে সামান্য আলো। জানালা বন্ধ, দরজাটা ভেজানো। ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না ঠিক কটা বাজে। তার মনে হচ্ছে ঘুমের মধ্যে দিন রাত ওলট-পালট হয়ে গেছে। মোবাইলটা চালু করে দ্রুত, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। ভুরু কুচকে ভাবতে চেষ্টা করে সে, হ্যা, অফিস থেকে ফিরে জুতাটা কোনো রকমে খুলেই শুয়ে পড়েছিল, ফোপাতে ফোপাতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না সে। ধীরে ধীরে সব মনে পড়ে তার। বাসায় ফেরার পথে জ্যামে বসে মোবাইলে হঠাৎ ফেসবুকটা চালু করেছিল, প্রায় দুই মাস পর কী মনে করে এমন করল কে জানে? আচমকা কয়েকটি ছবি দেখে স্থির হয়ে গেল তার চোখ। হার্টবিট বেড়ে গেল, শরীর বেয়ে ঠান্ডা বয়ে গেল, গলায় দলা পাকানো কান্না।
মধু চন্দ্রিমায় স্বামীর সঙ্গে সুরভি, সমুদ্র সৈকতে তাদের হাস্যোজ্জ্বল সেলফি। একজন চোস্ত সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে সাগরের পানিতে বা বালুকারাশিতে বসে সৌন্দর্যে মেতে ওঠা সুরভির সেলফিগুলো দেখে মুহিতের বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে, আশ্চর্য সে জানতেও পারল না বিয়ের কথাটা, অবশ্য এর জন্য সে কাউকে দোষও দিতে পারবে না। অনেকদিন থেকেই সে সব ধরনের যোগাযোগ থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে সুরভির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে তার। তারপর দুজনেই আলাদাভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজেদের জীবন গোছাতে।
চাকরির প্রস্তুতি, থাকার বন্দোবস্ত করা সব মিলিয়ে মুহিতের জেরবার হওয়ার অবস্থা, তখনো সুরভির সঙ্গে মাঝেমধ্যে যোগাযোগ হতো তার। বাসা থেকে বিয়ের জন্য ছেলে দেখা ছেলের কোয়ালিফিকেশনস তার ফ্যামিলি, ঢাকায় বাড়ি আছে কি না- এসব সুরভিই জানাত তাকে, কিন্তু মুহিত যদি কোনো মেয়েকে নিয়ে কথা তুলত তাহলে শুধু রাগ নয় ফোনে তার কান্নাকাটির শব্দও ভেসে আসত কানে। এভাবে চলতে চলতে যেদিন সুরভির বিয়ের আভাস পায় মুহিত তখন থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নেয় সে। সেই সময়গুলো খুব খারাপ কেটেছে তার, কোনো চাওয়া নেই পাওয়া নেই, আবেগ অনুভতিহীন যন্ত্রচালিত মানবের মতো সময়ের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল মুহিত। তবে সেই দুঃসময়ে একমাত্র শক্তি হয়ে উঠেছে তার ভেতরের মানুষটা। নিজেকে ভালোবাসতে পারার অদ্ভুত ক্ষমতাই তাকে বলে দিয়েছে টিকে থাকতে হবে, তখন কষ্টটাও দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে তার কাছে।
তবে সিগারেটটা ভালোভাবে ধরেছিল তাকে। অথচ এক সময় সুরভির কড়া নিষেধে সেদিকে তাকায়নি পর্যন্ত। বছর চারেক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একদিন অভিমানী প্রেমিকার মতো চোখে চোখ রেখে সুরভি বলেছিল সিগারেট খাবি না, সেই দিন বুকে এক ধরনের সুখ সুখ অনুভুতি টের পেয়েছিল ঠিকই কিন্তু তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি, অবিশ্বাসী এক জোড়া আহত চোখ নিয়ে সেই ছলনাময়ীর দিকে তাকিয়েছিল মুহিত। আর ভাবছিল, কী নাম দেবে এই অপরিচিতার, প্রেমিকা না বন্ধু কোন চোখে তাকাবে তার দিকে?
কখনো কখনো নিজেকে নিয়ে বড্ড অভিমান হতো তার, আর দশজনের মতোই তো হতে পারত তার জীবনটা! তা না দিনের পর দিন নিজের অজান্তেই এক গোলকধাঁধার মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে সে। যেদিন হুট করে সুরভি তাকে বলল যে,তাদের বন্ধুত্বটা কখনো প্রেমে গড়ানো চলবে না তখন হাসি পেয়েছিল মুহিতের। সুরভিকে তার একটা বাচ্চা মেয়ে ছাড়া অন্য কিছু মনে হয়নি। কিন্তু আজ যখন সে ভাবে সেদিনের কথাটা তো পাল্টায়নি তখন সত্যিই অবাক লাগে তার। অবশ্য সুরভিকে পাওয়ার কোনো চেষ্টা মুহিত করেনি, অথবা সব বাধা বিপত্তি কাটিয়ে দুজনে এক সঙ্গে জীবন গড়ার কোনো সিদ্ধান্তও তারা নেয়নি, কারণ মুহিত সবসময় সুরভির চাওয়াটাকেই মূল্য দিয়েছে। এমনকি সুরভিকে কখনো প্রশ্নও করেনি কেন এমন সিদ্ধান্ত? আসলে প্রয়োজনই মনে করেনি মুহিত।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোনোর পর যেবার তারা বন্ধুরা মিলে শহরের অদূরে পিকনিকে গেল সেবারও সুরভিকে কিছু বলেনি মুহিত। তখন হয়তো সে বুঝতেই পারেনি এত কাছে আসা আসলে অনেক দূরে চলে যাওয়ার জন্যই। সারাদিন হৈ হুল্লোর, খাওয়া দাওয়া, সেলফি সবকিছুর মধ্যেও সেদিন সুরভিকে যেন অচেনা লাগছিল তার। তারপর ঘন অরণ্যের মাঝখানে মুহিতকে একাকী ডেকে আনতে সুরভির ছলনা যেন দূরে দুর্বোধ্য করে তুলেছিল তাকে। পড়ন্ত বিকেলের আবছা অন্ধকারে অরণ্যের সুউচ্চ দেবদারু গাছগুলো দুটি মানুষকে আড়াল করে দিয়েছিল পুরো পৃথিবী থেকে। সেদিন অনেকক্ষণ মুখে কোনো কথা বলেনি তারা। আলো অন্ধকারে ফিরোজা রঙের শাড়ি পরা সুরভির খোলা পিঠের দিকে হঠাৎ তাকিয়েছিল মুহিত, সামান্য আলোতেও মুহিত দেখেছিল জোছনার মতো চকচকে সাদা পিঠ ছাড়িয়ে গেছে বেলি ফুলে জড়ানো তার কালো ঝলমলে চুলের বিনুনি। এমন অপূর্ব দৃশ্য বুকে নিয়ে কি সারাটা জীবন পার করে দেওয়া যায়?
এমনটা ভাবছিল বলে সে বুঝতে পারেনি সুরভি তাকে জড়িয়ে ধরেছে, বুকে মাথা রেখে কাঁদছে বোধহয়, মুহিতও দুই হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে সুরভিকে, সুরভির চুলে মুখ গুজে দেয়, চুমু খায়। এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর মুহিতের মনে হয় তার আর কোনো কষ্ট নেই, অপ্রাপ্তি নেই। সে অনেক পেয়েছে , তার এই প্রিয় মানুষটির অনেক কিছুই জেনেছে, এমনকি তার চুলের গন্ধ পর্যন্ত।
মুহিত এক মগ কফি নিয়ে জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। স্বচ্ছ কাচের মধ্য দিয়ে বৃষ্টি দেখতে ভালো লাগছে তার। এবার তার মনে হয়, অন্য একটি জীবন হলে কেমন হতো? একটি ছোট শহরের প্রাণকেন্দ্রে দ্বিতল বাড়ির ঝুল বারান্দায় বসে যদি এই বৃষ্টি দেখা যেত, পানির অবিরত ধারায় সতেজ চারপাশের সবুজ প্রকৃতি ধরে হাঁটতে হাঁটতে কলেজে গেলেও ছাত্রদের বায়না রাখতে শোনাতে হতো কোনো কিংবদন্তির গল্প, যেখানে নেই রেসে সামনে যাওয়ার রুদ্ধশ্বাস আতঙ্ক,কিন্তু সেখানেও কি থাকবে না ক্ষমতার শাসানি, উদ্ধত চোখ, কালো হাত? দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মুহিত, কী সব নেগেটিভ ভাবনা ভাবছে সে,তার চেয়ে বরং কাজ করে যাওয়া যাক, তাতেই মুক্তি! নিজের ডেস্কে এসে বসে সে, কিছুদিন হলো সে এই ফোন কোম্পানিতে আইটি বিভাগে জয়েন করেছে, স্যালারি ভালোই, তারপরও ছাত্রজীবনের কিছু কিছু অভ্যাস এখনো বদলায়নি, বাসে চড়ে অফিসে যাতায়াত করা, বোনের বাসায় ছোট্ট একটা কামরায় রাতটা পার করা মোকোমতো , অথবা দুপুরের সাদামাটা লাঞ্চ। আসলে আগের জীবনটাতেই পড়ে রয়েছে সে ।
কিছুক্ষণ আগে অফিসে একটা পার্টি হয়ে গেল, তাদের এক সিনিয়র সহকর্মীর জন্মদিন উপলক্ষে কেক কাটা হয়েছিল, খুব হৈচৈ করছিল সবাই। মুহিত খাবারের প্লেটটা নিয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল, ওকে একা দেখেই মেয়েটি এগিয়ে আসে। মেয়েটির নাম আদৃতা। সে এখানে ব্র্যান্ড প্রমোশনে কাজ করে। কথা বলার একপর্যায়ে হঠাৎ করে সে বলে বসে মুহিতকে তার ভালো লাগে, চমকে যায় মুহিত, সে তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েটির দিকে তাকায়, তার মনে হয়, অনেকদিন ধরেই মেয়েটি তাকে ফলো করছে, তার অজান্তে, খানিকটা রোমাঞ্চিত হয় সে।
এখন অফিসে পা রাখলেই বুক ধড়ফড় করে মুহিতের। ভাগ্যিস আদৃতা আর সে দুজন আলাদা ফ্লোরে বসে, তা না হলে অফিসে কাজ করত কীভাবে সেটাই ভাবে সে। আদৃতা কখন কী করে বসে এই ভয়ে সারাক্ষণ কাঁটা হয়ে থাকে সে। এখন প্রায় প্রতিদিনই গুলশান লেক পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে আসে তারা। ওকে সিএনজিতে তুলে দেওয়ার পর নিজের গন্তব্যের দিকে এগোয় মুহিত। এই সময়টা হাঁটতে হাঁটতে যে কত কথা বলে দুজন! একে অপরের জীবনের কথা, এই সময়টাতে অন্য কোনো কিছু মাথায় থাকে না তাদের। যেন কথার ছলে নিজেকে জানাতে আর অপরকে জানতে চায় তারা। এই সেদিন অফিস শেষ করে সন্ধ্যার আগে আগে রাস্তায় নামে দুজন। কোনো প্রশ্ন করা যাবে না এই শর্তে মুহিতকে নিয়ে সিএনজিতে উঠে বসে আদৃতা। সোনারগাঁ পার হওয়ার সময় মুহিত বুঝতে পারে তারা আদৃতার বাসায় যাচ্ছে। পান্থপথের বাসায় ওর বাবা-মা আর ছোট দুই ভাইবোনের সঙ্গে সেটাই মুহিতের প্রথম সাক্ষাৎ।
আজ অন্য রকমভাবে দিনটা শুরু হলো মুহিতের। ছুটির দিন হলেও তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠে সে। হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা সেরে নিচে এসে দেখে আদৃতা দাঁড়িয়ে আছে, সে হাসছে। এতক্ষণ একা একা দাঁড়িয়ে থাকার পরও মেয়েটার মুখে হাসি দেখে খুব আনন্দ হয় মুহিতের। দুই মাস পর তাদের বিয়ে, বাসা খুঁজতে আজ ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে ঘুরবে তারা। দুপুরে একসাথে খাবে, মুভি দেখবে কেনাকাটা করবে- কত পরিকল্পনা তাদের! আজ প্রথমবারের মতো কোনো কিছুকে মুহিতের নিজের বলে মনে হচ্ছে। তার একটি ঘর হবে, কতবার এমন হয়েছে, অফিস থেকে বা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ফেরার সময় মাথার ওপর প্রবল বর্ষণ দেখে মনে হয়েছে বৃষ্টির ছাঁটে আহত পাখি যেমন ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে তার পরম নিরাপদ বাসস্থানটিতে আশ্রয় নেয় সেও যদি পারত!
অফিস শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে মুহিতের রাত হয়ে যায়। আদৃতা আগেই বেরিয়ে গেছে অফিস থেকে, পরে বাসায় ফেরার একটা আনন্দ জেনে ফেলেছে মুহিত, দরজা খুলে আদৃতা যখন হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকে তখন সব ক্লান্তি ধুয়ে মুছে যেন হারিয়ে যায়! হাতমুখ ধুয়ে বারান্দায় এসে বসে মুহিত, সামনে সাদা থালার মতো চাঁদ সঙ্গ দেয় তাকে। একটু পরে টোস্ট আর চায়ের কাপ নিয়ে পাশে এসে বসে আদৃতা, গল্প করে দুজন, মুহিত তার ল্যাপটপ চালু করে। ফেসবুকে নিজের প্রোফাইলে ঢুকে অবাক হয়ে যায় সে। তাদের মধুচন্দ্রিমার অনেক সেলফি ঝুলছে সেখানে। আদৃতা বোধহয় সেগুলো আপলোড করেছে। সেলফিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তারা, এখানে এমন ওখানে ওমন করলে আরো ভালো হতো আফসোসের সুরে আদৃতা বলে যায় আর মুহিত ভাবে, এক সময় তার মুখে কোনো মেয়ের কথা শুনে কেঁদে ফেলেছে সুরভি, আজ এই সেলফিগুলো দেখলে তার কি কিছু এসে যায়? নিশ্চয়ই না, কান্না তো অনেক দূরের ব্যাপার ...