গল্প পড়ার গল্প
সুবোধ ঘোষের সৃষ্টি পুরোনো হবে না
সুবোধ ঘোষ জন্মেছিলেন ১৯০৯ সালের বিহারের হাজারিবাগে। তাঁদের আদি নিবাস ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে। মৃত্যু ১০ মার্চ, ১৯৮০। আমাদের গল্প লিখতে শেখা সুবোধ ঘোষের গল্প পড়েও। কম বয়সে যখন খুঁজে খুঁজে বাংলা গল্প পড়ছি, সুবোধ ঘোষ পড়ে শিহরিত হয়েছি। কী ঐশ্বযর্ময় বাংলা ছোটগল্প তা সুবোধ ঘোষ পড়লে ধরা যায়। সেই গোত্রান্তর, অযান্ত্রিক, পরশুরামের কুঠার, ফসিল, সুন্দরম কত গল্পের কথা বলব।
সুবোধ ঘোষ কম বয়সে অনেক রকম জীবিকায় জড়িয়েছেন। তাঁর গল্পে অনেক বিচিত্র জীবনের খোঁজ পাওয়া যায়। পাওয়া যায় জীবনের অনেক নিষ্ঠুর চিত্র। নিষ্ঠুর কিন্তু তা ছিল অবধারিত। গোত্রান্তর, পরশুরামের কুঠার, ফসিল, সুন্দরম এই সব গল্প পড়লে টের পাওয়া যায় সুবোধ ঘোষ কত বিচিত্র জীবনের সাক্ষী। আবার কত গভীর উপলব্ধি অযান্ত্রিক গল্পে। যন্ত্র (সেই বুড়ো মোটরগাড়ির ইঞ্জিন) আর মানুষের সম্পর্কের কথা সুবোধ ঘোষ যখন লিখেছিলেন, তখন এই বিষয়টির কথা ভাবাও যেত না। এখন তা অতি সত্য। লেখক কত এগিয়ে ভাবতে পারেন।
সুবোধ ঘোষের গল্প ব্যতীত তাঁর একটি গ্রন্থ আমার খুব জরুরি মনে হয়, কিংবদন্তির দেশে। গ্রাম-গ্রামান্তরে ছড়িয়ে থাকা কিংবদন্তি সংগ্রহ করেছিলেন সুবোধ ঘোষ। যখন আমি মফস্বল মেদিনীপুরে চাকরি করতে যাই, সুবোধ ঘোষের ওই বই আমার সঙ্গী ছিল। আমাদের দেশটিকে চিনতে ওই বই খুব সাহায্য করেছিল। সুবোধ ঘোষের গল্প নিশ্চয় হারাবে না। তা হারালে আমাদের অনেক বড় কিছু হারাবে মনে হয়। ভারত প্রেম কথার সুবোধ ঘোষ ফসিল গোত্রান্তরের লেখক হয়ে বেঁচে থাকুন। আমি ফসিল গল্পটির কথা বলি। স্বাধীনতার আগের এক নেটিভ স্টেট, দেশীয় করদ রাজ্য অঞ্জনগড়ের কাহিনী নিয়ে এই গল্প। অঞ্জনগড়ের অধিপতি, মহারাজ শুধু বিলাস ব্যসনে, ঠাঁট-বাট রক্ষা করে করেই দিন কাটিয়ে দেন। যেমন হতেন কোনো সামন্ত অধিপতি। লেখকের বর্ণনা থেকে ধরা যায় অঞ্জনগড় ভীল আর কুরমি-মাহাতোদের দেশ। সাড়ে আটষট্টি বর্গমাইল এর আয়তন। রুক্ষ কাঁকুরে মাটি, ঘোড়ানিম আর ফণী মনসার গাছে ভরা অঞ্জনগড়ে বেঁচে থাকাই কঠিন, কিন্তু রাজার মহিমা প্রকাশে কোনো ঘাটতি ছিল না। ফৌজ, ফৌজদার, সেরেস্তা, নেজারত সব আছে। আছে রাজার এক কুড়ির মতো উপাধি। এখন স্টেটের শ্রী লুপ্ত। বিলাস-ব্যসন রক্ষার্থে সিন্দুকের সোনায় টান।
প্রতি বছর খাজনা আদায়ের সময় ভীল আর মাহাতোদের সঙ্গে আদায়কারী তহশিল বিভাগের সংঘর্ষ লাগেই। অঞ্জনগড়ে প্রজা শায়েস্তা করতে লাঠি, প্রজা হিতৈষণায় লাঠি, প্রজার উল্লাস আর রাজার জয়ধ্বনিতেও লাঠি। এই স্টেটে রাজদরবারের ইংরেজি আইননবিশ উপদেষ্টা হয়ে এলো এক বাঙালি, মুখার্জি। ল-এজেন্ট। বুদ্ধিমান, আদর্শবাদী, ডেমোক্রেসির স্বপ্ন দেখা মুখার্জি অচিরেই মহারাজের বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠল। অঞ্জনগড়ের উন্নতি কীভাবে করা যায় তা নিয়ে ভাবতে লাগল। তার নির্দেশে বন্ধ হলো লাঠিবাজি। প্রজারা তাকে ভয় করে যেমন, ভক্তিও করে। তার কাছে সুবিচার পায় তারা। এই মুখার্জিই একদিন আবিষ্কার করল অঞ্জনগড়ের মাটির নিচের সম্পদ। কলকাতা থেকে জিওলজিস্ট আনিয়ে সার্ভে করিয়ে জানা গেল মাটির নিচে অভ্র। এর পরে কলকাতা থেকে মারচেন্ট ডেকে এনে কাঁকুরে ডাঙাগুলি ইজারা দিয়ে স্টেটের হাল ফিরিয়ে দিল মুখার্জি। অঞ্জনগড়ে বক্সাইট আকরিক নিষ্কাশনের খনিতে মাহাতো, ভীলেরা কাজে লেগে গেল।
এই সময় মরিশাসের চিনি কল থেকে অঞ্জনগড়ে ফিরে এসেছিল দুলাল মাহাতো। সে হয়ে উঠল অঞ্জনগড়ের নিবোর্ধ প্রজাদের পরামর্শদাতা। তার কথাতেই মাহাতোরা তাদের অধিকার বুঝে নিতে চাইছিল। তারা হাতে হাতে মজুরি, কুলি পিছু কয়লা, কেরোসিন ফ্রি আদায় করে নিল কোম্পানি থেকে। মহারাজার প্রজারা সব কুলি হয়ে নগদ উপার্জন করছে, তারা আর রাজার বাগানে কিংবা পোলো গ্রাউন্ডে বেগার দিতে এলো না। এদিকে মুখার্জি পরিকল্পনা করেছিল দশটি ক্যানেল কেটে সেচের ব্যবস্থা করে অঞ্জনগড়ের অবস্থা বদলে দেবে। চাষবাস হবে ভালো। প্রজা কল্যাণ হবে। কিন্তু এর বিরোধী খনির সায়েবরা। তারা জানে খাল কাটার কাজ আরম্ভ হলে খনির মজুরে টান পড়ে যাবে। রাজার প্রস্তাব ছিল, খনিতে কাজে লাগানোর আগে রাজার কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া হোক। রাজা আর আগের মতো প্রজাদের বেগার শ্রম পাচ্ছেন না। প্রজারা বদলে যাচ্ছে। বদলে তো যাচ্ছেই। মরিশাস ফেরত দুলাল মাহাতো মিটিং করে প্রজাদের নিয়ে, তাদের হক পাওনা বুঝিয়ে দেয়। রাজার অহঙে ঘা লাগে। রাজ্যের আর্থিক অবস্থা ফিরেছে কিন্তু প্রজারা আনুগত্যহীন হয়ে পড়ছে। এর জন্য দায়ী মুখার্জি।
বক্সাইট কোম্পানি ৯৯ বছরের লিজ নিয়েছে অঞ্জনগড়ের জমি। তারা তাদের মতো করে প্রশাসন চালাবে। কৃষি শ্রমিক খনির মজুর হয়ে আর রাজ-আনুগত্য যে রাখবে না তা কোম্পানি বুঝতে পারছিল। সুবোধ ঘোষের এই গল্পে সামন্ত প্রভু ও নব্য-বণিকের দ্বন্দ্ব আছে। খনির মালিক দুলাল মাহাতোকে দিয়ে চিঠি লেখায় ব্রিটিশ সরকারের কাছে, অঞ্জনগড়ের অনেক অনিয়ম করছে রাজা। সামন্ত প্রভু নিজের রোষে প্রজাদের কোনো দাবিই মানেন না। যে ছাড় দিয়েছিল মুখার্জি, তা তুলে নিতে লাগলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল প্রজার এই আনুগত্যহীনতার জন্য দায়ী মুখার্জি। বেনিয়ার জোর বেশি না রাজার। বেনিয়াদের এনে সব্বোনাশ হয়ে গেছে। এই সময়েই খনিতে দুর্ঘটনা ঘটে। ধস নামে অসাবধানতায়। একশ শ্রমিক চাপা পড়েছে খনির ভিতরে। আর একই দিনে কিছু প্রজা বনে গিয়েছিল বিনা পারমিটে লকড়ি কাটতে। বনের পাহারাদারদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। ফরেস্ট গার্ড গুলি চালায়। বাইশ জনের মতো মরেছে। এখন কী হবে? জানাজানি হলে প্রজা বিদ্রোহ হবে। কী ভাবে এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসবে রাজ্য ? ব্রিটিশ সরকার তো ইতিমধ্যেই জানতে চেয়েছে কিছু অনিয়মের কথা। মুখার্জি বলুক তার বুদ্ধিতে, কী করতে হবে এখন। মুখার্জি বলে, দুলাল মাহাতোকে আটক করতে। দুলাল ছাড়া থাকলে সব্বোনাশ হয়ে যাবে রাজ্যের। খনিতে তো কুলিরা ধস নামা পিটের দিকে ছুটছে। খবর রটছে। খনির গিবসন সায়েব রেজিস্টার গায়েব করে খনির ভিতরে কারা নেমেছিল সেদিন তা লুকোতে চাইছে। না লুকোলে উপায় নেই।
মুখার্জির সঠিক সিদ্ধান্তে খনি এবং রাজ্য বেঁচে গেল। দুলাল মাহাতোই ছিল বিপদের কারণ। সে প্রজা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিত। সেদিন রাতে বেনিয়া আর সামন্ত প্রভু স্বার্থের কারণে মিলেছিল। রাজার প্যালেসে তারা নিশ্চিন্ত উল্লাস করছিল। সেদিন রাত দুপুরে ঘোড়ানিমের জঙ্গল থেকে বাইশটা লাশ এবং দুলাল মাহাতোর লাশ খনি গর্ভে চালান হয়ে গিয়েছিল। কোনো প্রমাণই আর থাকল না অতগুলি মানুষের মৃত্যুর। মুখার্জি ছিল ডেমোক্রেসির স্বপ্ন দেখা মানুষ। তার বুদ্ধিতেই রেহাই পায় অঞ্জনগড়ের রাজা এবং বেনিয়া। দুলাল মাহাতোকে না আটক করলে অবস্থা ভয়ানক হয়ে উঠত। সুবোধ ঘোষের এই গল্প এবং গোত্রান্তর গল্পে শিক্ষিত বাবু ক্লাশের মানুষের আসল চেহারাটি উন্মোচন হয়েছে ভয়ঙ্কর ভাবে। এই গল্প পড়লে ধরা যায়, মানুষের অনেক সংগ্রাম কেন বার বার ব্যর্থ হয়ে যায়। আর গল্প তো এই কাহিনীতে শেষ হয় না। মুখার্জি কল্পনা করছে লক্ষ বছর পরের এক পৃথিবীর। কোনো জাদুঘরে জ্ঞানবৃদ্ধ পণ্ডিতের দল কতগুলো ফসিল পরীক্ষা করে বুঝতে চাইছে কিছু। হয়তো প্রাচীন পৃথিবীর একদল হতভাগ্য মানুষ আকস্মিক ভূ-বিপর্যয়ে কোয়ার্টস আর গ্রানিটের গহ্বরে সমাধিস্ত হয়েছিল। সেই ফসিল। আসলে ফসিল হয়েই বেঁচে আছে এই সভ্যতাই বুঝি। ইতিহাস এবং সভ্যতাকে এই ভাবে পরিমাপ করেছেন লেখক।
সুবোধ ঘোষ তাঁর সব গল্পেই এই পথেই যান। তাঁকে প্রণাম।