গল্প
নকশা বদল
গলাপানিতে দাঁড়িয়ে থাকলেও তাঁদের দেখা পাওয়া যাবে না স্বাভাবিক। তাঁরা একটা ভুল পরিচয় বহন করেন। জনপ্রতিনিধি নামটা একেকটা ভুল মানুষের সঙ্গে সেঁটে বসে আছে। তাঁরা কেন তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করতে যাবেন, যাঁদের কখনো তাঁদের কোনো প্রয়োজনেই লাগে নাই! অগত্যা তাঁদের সঙ্গে আছেন ওই বরাবরের চাকুরে সাংবাদিকগণ। তাঁদেরই কথায় দুর্গতের নমুনা হয়ে এক কোণে বসে থাকে পরান। তাঁরা ছবি তোলেন, একের পর এক না-না অ্যাঙ্গেল থেকে। আর পরানের চোখের সামনে শুধু কতগুলা নকশা ভাসে। যেসব শব্দ সে শুনতে পায়, কিন্তু দেখতে পায় না এমন সব শব্দ তার সামনে নকশা হয়ে ভাসে। উনাদের কথাগুলা হাঁড়িতে দেওয়া গরম মুড়ির মতো ফুটতে থাকে। চটফট চটফট শব্দে সাদা সাদা মুড়ি। পরান ভাবে, এই বুঝি একটা সুরাহা হবে তাঁদের।
শেষ পর্যন্ত তাঁরা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন। তাঁদের যাবতীয় আঙুল উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতিতে গিয়ে হেলে পড়ল। কারণ খুঁজে বের করতে পারায় তাঁদের চোখে-মুখে প্রশান্তি ফুটে উঠল।
পরানের চোখে ওই দুর্নীতি শব্দটার একটা নকশা ঘুরপাক খায়। দুর্নীতি শব্দটা তার কাছে একটা চক্রের মতো লাগে। একটার সঙ্গে একটা জুড়ে জুড়ে হওয়া চক্র। এবারেরটা বোধ হয় ছিল পাহাড়প্রমাণ। ছুড়ে দিলে চক্রাকারে ছোটে ব্যাস থেকে ব্যাসার্ধে। একেবারে বোধ হয় হিমালয়ে গিয়ে ঠেকেছিল। পাহাড় গড়িয়ে ধেয়ে আসা পানি চির ধরা বালির বাঁধ, ঠুনকো বেড়া ভাসিয়ে দিল। ধোঁয়া ওঠা গরম সাদা ফুরফুরে ভাত সঙ্গে ঝালে-ঝোলে হাওরের এক টুকরো মাছের স্বপ্ন সত্যিকার অর্থেই জলাঞ্জলি গেল।
খুব ভালো ধান হয়েছিল এবার। সময়মতো সার-কীটনাশক পেয়ে লকলক করে বেড়ে উঠেছিল গোছা গোছা ধান। কাঁচা সবুজ ধানে টিপ দিলে যেদিন দুধ-সাদা রস বের হয়ে এসেছিল, পরানের চোখ জলে ভরে উঠেছিল আনন্দে। এই দুধ জমে চাল আর তারপর—এই তো আর কয়েকটা মাত্র দিন, ঘরে এলো বলে। এই বর্ষায় ঘরের খড়ের চাল বদলে টিন দেবে সে। প্রতি সপ্তাহে সুদে আনা কিস্তির টাকার ধার শোধ দেওয়ার যন্ত্রণা অনেকটাই কমে এসেছিল। ফসল ঘরে তোলার তর সয় না ওদের, তার আগেই ধার শোধের নেশায় এসে দাঁড়ায় দরজায়। বর্গা জমির চাষ, নিড়ানি যাবতীয় তদারকি সেরে অন্যের বাড়ির মজদুরি..! না করে উপায় কি, ঋণের টাকা শোধ দিতে হবে যে!
হাড়ভাঙা খাটুনিতেও পরানকে কাবু করতে পারে না, কারণ তার চোখের সামনে ইদানীং ভাসে আরো অনেক অনেক নকশা। স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাইছে তার মেয়ে ময়না। একখানা নীল-সাদা পোশাকে হাতে বই-স্লেট, চুলের বিনুনিতে রঙিন ফিতে। আলতা পায়ে লাল ফুল ছাপ শাড়িতে রোদে ধান শুকোতে দিচ্ছে বৌ শাফিয়া, নাকে সদ্য গড়িয়ে দেওয়া সোনার নাকছাবিতে সূর্যের আলো পড়ে ঝিলিক মেরে ওঠে একবার। শাফিয়া যেন সোনার নাকছাবি পেয়ে স্বর্গ পেয়েছে হাতে! এমন কতশত নকশা ঘোরে, ঘুরে বেড়ায় সারাক্ষণ। মাঝেমধ্যে পরানের চোখে যেন জল এসে যায়।
পরান কখনো ভাবে নাই, নকশাগুলো এভাবে বদলে যেতে পারে! রাত-বিরেতে বলা নাই, কওয়া নাই ভেঙে গেল বাঁধ। রাক্ষুসী বানের জল ভাসিয়ে নিয়ে গেল হাওর-বাঁওড়। উজাড় হলো ধানক্ষেত। জলে জলে বিষ। গবাদি যা আছে দু-একটা, পোষ্য মুরগি-হাঁস সব নিঃশেষ, সব নিঃশেষ! শুধু তিনটে প্রাণ দিগন্ত বিস্তৃত জলের দিকে অবাক তাকিয়ে রয়। নকশা বদলে যায়।