আর্থার সি ক্লার্কের গল্প
দ্য স্টার
মহাশূন্যে ভ্যাটিকান সিটি থেকে তিন হাজার আলোকবর্ষ দূরে কোথাও।
আমি কখনো চিন্তাও করিনি, মহাশূন্যের এই অভিজ্ঞতা আমার বিশ্বাসে এমন প্রবলভাবে আঘাত করবে। একসময়ে ভাবতাম, স্রষ্টা মহাশূন্যকে সৃষ্টি করেছেন স্বর্গের মতো করেই, সমান যত্নে। কিন্তু এখন, এত কিছু দেখার পর আমার বিশ্বাসের প্রাচীরে ফাটল ধরেছে। আমি মার্ক VI কম্পিউটারের ডেকের উপরে রাখা ক্রুশটার দিকে তাকালাম। জীবনে প্রথমবারের মতো উপলব্ধি হচ্ছে, ওটা সামান্য একটা বস্তু ছাড়া কিছু নয়।
কাউকে বলিনি ব্যাপারটা। কিন্তু এ এমনই এক সত্য- যা লুকিয়ে রাখার উপায় নেই। অসংখ্য ম্যাগনেটিক টেপ আর ফটোগ্রাফে রেকর্ড করা বিপুল পরিমাণে তথ্য- যা আমরা বয়ে নিয়ে এখন চলেছি পৃথিবীর দিকে, অনুচ্চারে বলছে সত্যটা। আমিসহ যেকোনো বিজ্ঞানীই পারবেন সত্যটা বের করে নিতে। চাইলেও তাই আমি অস্বীকার করতে পারব না এটা, তার ওপর আমি এমন একটা বিশেষ শ্রেণির প্রতিনিধি, যাদের বিরুদ্ধে অতীতে সত্যকে বিকৃত করার অপচেষ্টার ভয়াবহ অভিযোগ আছে।
অভিযানের অন্য ক্রুরা এখন বিপর্যস্ত। জানি না ব্যাপারটা কীভাবে নেবে তারা। এদের মধ্যে ধর্মবিশ্বাস আছে খুব অল্পেরই। আমি জানি সুযোগ পেলেই আমার উপর এই অস্ত্রটা ব্যবহার করার সুযোগ ছাড়বে না তারা, তার ওপর তাদের পক্ষে যখন আছেন ড. চ্যান্ডলার (মেডিক্যালের এই মানুষগুলো এতো নাস্তিক হয় কেন?)।আমার মতো একজন খ্রিস্টান যাজকের এই মহাকাশযানের চিফ আস্ট্রোফিজিসিস্ট হওয়ার ব্যাপারটা মেনে নেওয়া বোধ হয় তার কাছে কষ্টকর মনে হয়। মাঝে মধ্যে তার সঙ্গে আমার দেখা হয় অবজার্ভেশন ডেকে। এই জায়গাটায় আলোর ঔজ্জ্বল্য সবসময়ে কম থাকে। নক্ষত্রের বিচিত্র মলিন আলোকপ্রভায় তাই এখানটা আলোকিত হয়ে থাকে। আমাদের মহাকাশযানটা ধীরে ধীরে ঘুরতে থাকে। হঠাৎ করে যেন একটা স্বর্গীয় পরিবেশ তৈরি হয় এখানে। আর ঠিক তখনই তিনি হাজির হন।
‘ঠিক আছে ফাদার’, তিনি শুরু করেন এইভাবে, ‘আমি জানি আমাদের এই তর্ক চলতেই থাকবে। আচ্ছা ঠিক আছে মানলাম না-হয় ‘কিছু একটা’ আছে যা আমাদের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আপনি কীভাবে ধরে নেন যে সেই ‘কিছু একটা’ আমাদের মতো এত ক্ষুদ্র সত্ত্বাকে নিয়ে মাথা ঘামায়? আমার মাথায় ঢোকে না।’ এইভাবে শুরু হয় কথাবার্তা। অবজারভেশন ডেকের বাইরের আকাশজোড়া নক্ষত্র আর নেবুলাগুলো আমাদের ঘিরে ঘুরতে থাকে। আর চলতে থাকে তর্ক।
মহাকাশযানের অন্য ক্রুদের কাছে সম্ভবত আমার পদমর্যাদা একটা কৌতুকের বিষয়। আমি প্রায়ই ব্যর্থভাবে চেষ্টা করি তাদেরকে বুঝাতে। আমি একজন পাদ্রী হতে পারি। কিন্তু Astrophysical Journal-এ তিনটা ও Monthly Notices of the Royal Astronomical Society-তে আমার পাঁচটা পেপার ছাপা হয়েছে। তা ছাড়া বিজ্ঞানের জগতে ইদানীং আমাদের অবদানও কিন্তু কম নয়।
অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই আমরা জোতির্বিদ্যা আর ভূগোলের ওপর কাজ করে যাচ্ছি। হয়তো আমরা সংখ্যায় খুব বেশি নই, কিন্তু সেই অনুপাতে আমাদের অবদান যথেষ্ট বেশি।
ফিনিক্স নেবুলার ওপর আমার রিপোর্ট কি হাজার বছরের ইতিহাস বদলে দেবে? সম্ভবত।
নেবুলাটার নামকরণ কে করেছিল জানি না। আর যাই হোক, নামকরণটা মোটেও যথার্থ হয়নি। ভবিষ্যতে, অন্তত কয়েক বিলিয়ন বছরেও মনে হয় না হবে। এমনকি নেবুলা নামটাই কেমন যেন ভুল অর্থ বহন করে। এটা আসলে খুবই ক্ষুদ্র একটা জিনিস- মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি জুড়ে ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে থাকা নক্ষত্রের ধ্বংসাবশেষের মেঘের তুলনায় তো বটেই। কসমিক স্কেলে ফিনিক্স নেবুলা আসলে এটা নক্ষত্রকে ঘিরে থাকা গ্যাসের ক্ষুদ্র একটা বলয় বিশেষ।
কিংবা বিলীন হয়ে যাওয়া কোনো নক্ষত্রের শেষ স্মৃতিচিহ্ন…
স্পেকট্রোফটোমিটারের ট্রেসিংয়ের উপরে ঝোলানো রুবেনে খচিত সেইন্ট লয়োলার [যাজক সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা-অনুবাদক] ছবিটা আমাকে যেন প্রতিনিয়ত আমাকে উপহাস করে চলে। ফাদার, তোমার ছোট্ট দুনিয়ার বাইরের এই বিশাল জগৎটার কথা তুমি জানতে? তোমার চিরন্তন আস্থা আর বিশ্বাস কি এখনো টিকে আছে, নাকি চুরমার হয়ে গেছে?
তোমার দৃষ্টিসীমার যত দূর যেতে পারে, তার চেয়েও বেশি দূরত্ব আমরা পাড়ি দিয়েছি। আর কোনো মহাকাশযান পারেনি এত দূর আসতে। আমরা ফিনিক্স নেবুলার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলাম। সেই যাত্রা শেষ করে এখন আবার ফিরে চলেছি পৃথিবীর দিকে। সঙ্গে নিয়ে নিয়েছি অজস্র-অগণিত তথ্য আর জ্ঞান। ভাবতে পেরেছিলে, এই জ্ঞানই শেষ পর্যন্ত তোমার কাছে অসহনীয় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে?
এই মুহূর্তে তুমি হাতে ধরে আছো যে বইটি তার ওপর উৎকীর্ণ আছে AD MAIOREM DEI GLORIAM (স্রষ্টার অপার মহিমার তরে) এ কথা কি তুমি এখনো বিশ্বাস করো? যা তুমি দেখেছ, তার পরও কি বিশ্বাস রাখা সম্ভব?
ফিনিক্স নেবুলার সম্পর্কে আমরা অনেক কিছুই জানতাম। শুধু আমাদের গ্যালাক্সিতেই প্রতি বছর একশর উপর নক্ষত্র বিস্ফোরিত হয়। তখন তারা স্বাভাবিকের তুলনায় লক্ষগুণ উজ্জ্বলতায় জ্বলতে থাকে। ঘণ্টাখানেকের মাঝে জ্বলে জ্বলে নিঃশেষ হয়ে গিয়ে তারা নিঃসঙ্গ আঁধারে হারিয়ে যায়। এদেরকে বলা যায় সাধারণ শ্রেণির নোভা, লুনার অবজারভেটরিতে কাজ করার সময়ে এ রকম ডজন খানেক নোভার স্পেকট্রাম আমি রেকর্ড করেছি।
কিন্তু প্রতি তিন কি চার হাজার বছরে এমন কিছু মহাজাগতিক ঘটনা ঘটে যার কাছে নোভার উজ্জ্বলতাও ম্লান হয়ে যাবে।
যখন কোনো নক্ষত্র সুপারনোভায় পরিণত হয়, এর ঔজ্জ্বল্যের কাছে গ্যালাক্সির সব নক্ষত্রের সম্মিলিত উজ্বলতাও হার মানে। ১০৫৪ সালে চীনা জোতির্বিদরা এ রকম ঘটনার বিবরণ লিখে গেছেন, যদিও তাঁরা জানতেন না আসলে এটা কি। পাঁচ শতাব্দী পর্ব, ১৫৭২ সালে ক্যাসিওপিয়া নক্ষত্রপুঞ্জে আরেকটি সুপারনোভা বিস্ফোরিত হয়। এর উজ্জ্বলতা এত বেশি ছিল যে দিনের আলোতেও এটাকে পরিষ্কার দেখা যেত। গত হাজার বছরে এ রকম আরো তিনটা ঘটনার বিবরণ পাওয়া গেছে।
আমাদের মিশন ছিল এ রকম একটা সুপারনোভা বিস্ফোরণ সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ করা, বিস্ফোরণ কীভাবে হলো এবং কেন হলো তা খুঁজে বের করা।
ধীরে ধীরে আমরা কেন্দ্রীভূত গ্যাসীয় স্তরের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম যা বিস্ফোরিত হয়েছিল ছয় হাজার বছর আগে। এই গ্যাসের স্তরের পরিধি এখনও বাড়ছে। প্রচণ্ড উত্তপ্ত গ্যাসের মেঘ থেকে বিকিরিত হচ্ছে এক ধরনের তীব্র বেগুনি আলো।
যখন নক্ষত্রটি বিস্ফোরিত হয়েছিল, এর বাইরের স্তরটি এতো তীব্র বেগে উড়ে গিয়েছিল যে এর মহাকর্ষ বলও পারেনি তাকে ধরে রাখতে। আর এখন এটা বিরাট একটা গ্যাসের বলয় যার মধ্যে হাজারটা সৌরজগত এঁটে যাবে সহজেই। আর বলয়ের ঠিক কেন্দ্রে পৃথিবীর চেয়েও ছোট্ট বামন তারাটি-ই আসলে অতীতের আসল তারার ভূত- একটা হোয়াইট ডোয়ার্ফ। ছোট্ট হলেও তার ভর পৃথিবীর থেকে লক্ষগুণ বেশি।
আমরা এগিয়ে চলছিলাম একটা কসমিক বোম্বের দিকে যেটা ডেটোনেট হয়েছিল হাজার বছর আগে। আমরা যতই এগোচ্ছিলাম উজ্বল গ্যাসের মেঘ আমাদের আলিঙ্গন করে নিচ্ছিল। গ্যাস আর ধ্বংসাবশেষ চারদিকে একেবারে এমনভাবে ছেয়ে রেখেছে যে খালি চোখে এর বাইরে আর কিছুর দেখা পাওয়াই মুশকিল। আর এই গ্যাসের সমুদ্র আরো প্রসারিত হচ্ছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে সবদিকে।
আমাদের লক্ষ্যবস্তু নেবুলার দিকে আমরা ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলাম। একসময়ে এটি সূর্যের মতোই একটি নক্ষত্র ছিল। এর ভিতরে যে জ্বালানী ছিল তা ব্যবহার করে এটি আরো লক্ষ লক্ষ বছর টিকে থাকতে পারতো। কিন্তু ফিনিক্স তার অবশিষ্ট জ্বালানী শেষ করেছে করেছে মাত্র কয়েক ঘণ্টায়!
এখানে কোন গ্রহ পাওয়ার আশা ছিল না। যদি থেকেও থাকতো তাহলেও তা সুপারনোভা বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই উত্তাপে বাষ্পে মিলিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে একটা গ্রহের দেখা মিলল। কেন্দ্র থেকে অনেক অনেক দূরে। অনেকটা আমাদের সৌরজগতের প্লুটোর মতো। এত দূরে থাকার কারণেই বোধহয় এটা টিকে গেছে।
আগুনের হল্কা গ্রহটির পাথুরে আবরণকে যেন গরম লোহার শিক দিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে গ্রহটির জমাটবাঁধা গ্যাসের স্তরকেও একেবারে জ্বালিয়ে দিয়েছে।
আমরা এখানে নামলাম এবং ভল্টটা পেয়ে গেলাম।
যারা এটা বানিয়েছিল তাঁরা নিশ্চয়ই চেয়েছে যেন কোনো ভবিষ্যৎ যাত্রীর এটা চোখে পড়ে।ঢোকার মুখে একটা পাথরের স্তম্ভ ছিল যেটা আগুনে পুড়ে ক্ষয়ে গেছে। আমরা বুঝতে পারলাম এখানে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল। একটু পরই বিস্তৃত এলাকাজুড়ে তেজস্ক্রিয়তার চিহ্ন ধরা পড়ল যা পাথরের গভীরে সমাহিত হয়ে আছে।
ভল্টের প্রবেশপথটা প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। তারপর যা অবশিষ্ট ছিল সেটাই যথেষ্ট । আর এই প্রবেশপথটা ছিল যেন এক আমন্ত্রণ মহাজাগতিক অতিথিদের প্রতি ।এই আমন্ত্রণই হয়তো সহস্র আলোকবর্ষ দূর থেকে এখানে টেনে নিয়ে এসেছিল আমাদেরকে।
প্রবেশপথের স্তম্ভটার উচ্চতা একসময় এক মাইলের মতো ছিল। এখন এটাকে দেখলে মনে হয় যেন কোন মোমবাতি গলতে গলতে সামান্য একটু অবশেষ বাকি আছে। পোড়া পাথরের বুকে ড্রিল করে ভেতরে পৌঁছাতে আমাদের এক সপ্তাহের মতো লেগে গেল, কারণ- আমাদের পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ছিল না। আমরা তো আর ভূতত্ত্ববিদ নই বরং মহাকাশচারী। কিন্তু কাজ করতে করতে একটা সময়ে আমরা তা ভুলে গিয়েছিলাম। একসময়ে উপলব্ধি করেছি, এই গ্রহের অধিবাসীরা বুঝতে পেরেছিল তাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। তাই বিলীন হয়ে যাবার আগ মুহূর্তে তারা শেষ চেষ্টা করেছে টিকে থাকার জন্য, অমরত্ব অর্জনের জন্য।
তারা যেসব নিদর্শন রেখে গেছে তা পরীক্ষা করে দেখতে দীর্ঘ সময়ে লেগে যাওয়ার কথা। ওরা অনেক সময় পেয়েছিল প্রস্তুত হওয়ার জন্য। ওদের সূর্য পুরোপুরি নিভে যাবারও অনেক আগে নিশ্চয় কোনো সতর্কবার্তা দিয়েছিল। তখন তারা তাদের সভ্যতার সবচেয়ে মূল্যবান, সবচেয়ে বড় নিদর্শনগুলো এখানে এনে জড়ো করেছিল। হয়তো ভেবেছিল দূর ভবিষ্যতে কেউ এই নিদর্শনগুলো দেখবে। হয়তো এভাবেই ওরা বেঁচে থাকবে, অনন্তকাল ওদের স্মৃতিচিহ্ন বয়ে বেড়াবে নতুন কোনো সভ্যতা।
যদি ওরা আরেকটু সময় পেত! তাহলে ওরা হয়তো অন্য কোথাও পাড়ি জমাতে পারত! দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের প্রযুক্তি আন্তনাক্ষত্রিক দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। তাছাড়া তাদের সবচেয়ে কাছের সৌরজগতটাও প্রায় একশ আলোকবর্ষ দূরে। এমনকি তারা ট্রান্সফাইনাইট ড্রাইভ দেওয়া শিখলেও লাভ হতো না, বড়জোর তাদের মধ্যে মাত্র কয়েক লক্ষ টিকতে পারত।
তাদের মূর্তি দেখে মানুষের সঙ্গে তাদের আশ্চর্য সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছিলাম আমরা। সাদৃশ্য থাকুক বা নাই থাকুক, তাদের কর্মের স্বাক্ষর দেখে প্রশংসা না করে আমরা পারিনি। তারা অসংখ্য ভিজুয়াল রেকর্ড আর যন্ত্র রেখে গেছে আর সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাও দিয়ে গেছে কীভাবে এগুলো ব্যবহার করে তাদের চিত্রিত করা যাবে এবং তাদের ভাষা শেখা যাবে। আমরা সেগুলো পরীক্ষা করলাম এবং যখন চালনা করলাম, ছয় হাজার বছর পর অতীত এক সভ্যতা যেন আবার জীবন্ত হয়ে উঠল। আমরা হতবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, আমরা এমন এক সভ্যতার সংস্পর্শে এসেছি, যারা মানবজাতির চাইতে কোনো অংশেই পিছিয়ে ছিল না। তাদের শহর নির্মাণের প্রযুক্তি মানুষের সঙ্গে অনেকখানি মিলে যায়। আমরা তাদের কাজ-কর্ম, খেলাধূলা দেখলাম। শতাব্দীজুড়ে বিস্তৃত তাদের সংগীত উপভোগ করলাম।
একটা দৃশ্য এখনো আমার চোখে ভাসে। একদল শিশু তাদের সমুদ্রের নীল বালুকাবেলায় খেলছে, ঠিক পৃথিবীর শিশুদের মতোই। তীর ধরে অদ্ভুতদর্শন চাবুকের মতো দেখতে গাছের সারি। বিরাট দানবাকারের কিছু প্রাণী অল্প পানিতে চলাফেরা করছে। সেটা নিয়ে কারো মাথাব্যাথা আছে বলে মনে হয় না। আর দূরে ডুবতে থাকা সূর্যটাকে দেখে মনে হচ্ছে আরামদায়ক রকমের উষ্ণ, বন্ধুত্বপূর্ণ ও প্রাণের যোগানদাতা। কেউ কি ঘূণাক্ষরেও কল্পনা করেছিল যে এই সূর্যই একদিন বিশ্বাসঘাতক হয়ে উঠবে আর এই সরল সুখগুলোকে কেড়ে নেবে?
দীর্ঘদিন পৃথিবীর বাইরে থেকে আর নিঃসঙ্গতার কারণেই কি না কে জানে- এই অভিজ্ঞতা আমাদের ওপর ভালো মতো প্রভাব ফেলল। আমাদের অনেকেই প্রাচীন সভ্যতার অনেক ধ্বংসাবশেষ দেখেছে কিন্তু এতটা ধাক্কা খায়নি কখনো। পৃথিবীর ইতিহাসেও অনেক সভ্যতা এসেছে, আবার কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। কিন্তু একটা গ্রহের একটা আস্ত সভ্যতা, পুরোপুরি বিলীন হয়ে গেল, একটা প্রাণীও বেঁচে থাকতে পারলো না- এমনটা অন্তত আমাদের ক্ষেত্রে ঘটেনি। আর এত কিছু দেখার পর স্রষ্টার অপার মহিমায় কীভাবে আস্থা রাখা সম্ভব? আমি মিলাতে পারি না।
আমার সহকর্মীরাও আমাকে এই প্রশ্নটি করেছিল। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি উত্তর দেওয়ার। হয়তো আমার জায়গায় ফাদার লয়োলা থাকলে আরো ভালো বলতে পারতেন। উত্তরের খোঁজে আমি বারবার পড়ে দেখেছি Exercitia Spiritualia, কিন্তু কিছুই পাইনি। তারা তো খারাপ ছিল না। আমি জানি না তারা কোন স্রষ্টার আরাধনা করত, কিংবা আদৌ করত কি না, কিন্তু আমি যখন বহু প্রাচীন এই সভ্যতার দিকে ফিরে তাকাই তখন দেখতে পাই, কী মমতা নিয়েই না তারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করে গেছে। তাদের কাছ থেকে আমাদের শেখার ছিল অনেক কিছু। কেন ওরা নিঃশেষ হয়ে গেল? কেন? কেন?
আমি জানি পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে আমার সহকর্মীরা কী বলবে। তারা বলবে, মহাবিশ্ব আসলে আপন গতিতে চলছে। এর পিছনে কোনো পরিকল্পনা বা কোনো উদ্দেশ্য নেই। আমাদের গ্যালাক্সিতে প্রতিবছর শত শত নক্ষত্র বিস্ফোরিত হচ্ছে, সেই সঙ্গে বহু সভ্যতা হারিয়ে যাচ্ছে মহাকাশের কোনো অতল গভীরে। কে ভালো আর কে খারাপ তাতে আসলে কিছুই আসে যায় না। একটা পর্যায়ে সবাইকেই একই পরিণতি বরণ করতে হবে। ঐশ্বরিক দণ্ডবিধান বলে কিছু নেই, আর তাই নেই স্রষ্টার অস্তিত্বও।
তারপরও আমরা যা দেখেছি তাতে আসলে প্রমাণ হয় না কিছুই। কেউ যদি এটা নিয়ে তর্ক করতে চায়, তাহলে বুঝতে হবে সে আসলে আবেগ দিয়ে চালিত, যুক্তি দিয়ে নয়। স্রষ্টা কী করবেন, কী করবেন না সেটা একান্তই তাঁর নিজস্ব ব্যাপার, এখানে মানুষের হস্তক্ষেপ করার কোনো সুযোগই নেই। তিনি আপন ইচ্ছেয় মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন, আবার তিনি নিজের ইচ্ছামতো তা ধ্বংস করবেন। তাঁর কর্মকাণ্ড নির্ধারণ করাটা আমাদের জন্য একধরনের ধৃষ্টতা, ধর্মাবমাননার শামিল।
নেবুলাটির কাছে পৌঁছানোর আগে আমরা জানতাম না কত আগে তার বিস্ফোরণ ঘটেছিল। কিন্তু বিভিন্ন প্রমাণাদি আর উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এখন আমি নিখুঁতভাবে বলে দিতে পারি ঠিক কবে, কতদিন আগের ঘটনা ছিল এটা। আমি জানি সেই মহাজাগতিক অগ্নিকাণ্ডের আলোকচ্ছটা প্রথম কবে পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছিল। আমি জানি পৃথিবী অভিমুখে যাত্রারত আমাদের মহাকাশযানের পিছনে মলিন হয়ে আসা নক্ষত্রটির ধ্বংসাবশেষ একসময়ে কী রাজকীয় ভাবেই না আলো ছড়াতো!
আর এখন এটি প্রতিদিন আমাদের সূর্য ওঠার আগে পুব আকাশে ম্লান হয়ে ঝুলে থাকে, যেন কোনো সংকেত পাঠিয়ে যাচ্ছে অবিরাম।
এখন আর কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। অবশেষে বহু পুরোনো এক রহস্য উন্মোচিত হলো। কিন্তু হে পরম করুণাময়, আরো কত নক্ষত্রই না ছিল! কেন তুমি ফিনিক্সকেই বেছে নিলে? কেন অসহায় সত্তাগুলোর নিয়তিতে আগুনে মৃত্যু লিখে দিলে?
এই নির্মম নিয়তি ক্ষুদ্র আলোকবিন্দু হয়ে তোমার ওই বেথেলহেমের পবিত্র আকাশের বুকে খোদিত রবে অনন্তকাল।
লন্ডন, অক্টোবর ১৯৫৪
[মূল গল্প – The Star. The Nine Billion Names of God: The Best Short Stories of Arthur C. Clarke]