গল্প
হত্যার ছাড়পত্র

খবরটি ছোট। সাধারণত টেলিভিশনের সংবাদে এসব ছোটখাটো দুর্ঘটনার সংবাদ আসে না। টিভি চ্যানেলগুলো ব্যস্ত থাকে বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনা নিয়ে। প্রতিদিনের অনেক সড়ক দুর্ঘটনার বড় দুর্ঘটনা যেগুলোতে ১০-২০, ৫০-১০০ বা তারও বেশি মানুষ মারা যায়, সেসবের সংবাদ প্রচার করা হয় ফলাও করে। এর মধ্যে বাস চাপা পড়ে একজন কলেজছাত্রীর মৃত্যু অতি ছোট সংবাদ, পত্রিকার ষষ্ঠ বা একাদশ পাতার কোনো এক কোনায় থাকার মতো।
মুহাম্মদ আলী সাহেব মনোযোগ দিয়ে রাজনৈতিক খবর দেখছিলেন। এরপর কলেজছাত্রীর বাসের চাপায় পড়ে মৃত্যুর সংবাদ এলো। পাঠিকা ভাবলেশহীন মুখে বলে যাচ্ছিলেন, সাথে দশ-বারো সেকেন্ডের ভিডিও, একটি সাদা কাপড় দেখানো হলো। মুহাম্মদ আলী লক্ষ করলেন নিহত মেয়েটির চেহারা দেখানো হলো না। সম্ভবত মেয়েটির ওড়না দিয়ে মুখমণ্ডলটি ঢাকা। কয়েকজন ধরাধরি করে তার রক্তস্নাত লাশ গাড়িতে তুলছে। দৃশ্যটির প্রতি আলী সাহেবের মেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সে এ সময় কী খুঁজতে যেন ঘরে ঢুকেছে।
ইশ, মা দেখ, কীভাবে মেয়েটাকে বাসটা চাপা দিল।
আলী সাহেবের স্ত্রী রাতের খাবার আয়োজনে ব্যস্ত। তিনি এলেন না। তবে রান্নাঘর থেকেই গলা বাড়িয়ে জানতে চাইলেন, কোথায় দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। তুলি টিভি পর্দা থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, মালিবাগের মোড়ে, দেখে যাও না।
তিনি এলেন না কিন্তু গলা উঁচিয়ে বললেন, এইসব ড্রাইভারের শয়তানি, দিনেদুপুরে অন্ধের মতো গাড়ি চালায়।
তাঁর কথা আলী সাহেব ও তুলির কানে যাওয়ার সাথে সাথে সংবাদ পঠিকা বললেন, বাসের ড্রাইভার পলাতক রয়েছে। তবে গাড়িটি আটক করে স্থানীয় থানায় নেওয়া হয়েছে।
পাঠিকা অন্য সংবাদে গেলে তুলি এ ঘর থেকে চলে গেল। আলী সাহেব শুনলেন, তাঁর স্ত্রী আপন মনে বলে যাচ্ছেন, পালাবেই তো। কিছুদিন পরে আবার এই ড্রাইভার গাড়ি চালাবে। আরেক মার বুক খালি করবে।
আলী সাহেব স্ত্রীর কথায় কান দিলেন না। সিরিয়ায় আত্মঘাতী হামলায় খবরটি আগ্রহ করে দেখতে লাগলেন।
সুখী মানুষদের সাধারণত ঘুম ভালো হয়। আলী সাহেব নিজেকে একজন সুখী মানুষ মনে করেন এবং রাত সাড়ে এগারোটার দিকে একগ্লাস গরম দুধ খেয়ে ঘুমুতে যান। প্রায় দিনই তাঁর ভোর অব্দি টানা ঘুম হয়। কিন্তু আজ ব্যতিক্রম হচ্ছে। রাত একটার দিকে ঘুম ভেঙে গেছে। কোনো কারণ ছাড়াই তিনি আর ঘুমুতে পারছে না। তাঁর ঘরের ভেতর পায়চারি, দরজা খুলে ব্যালকনিতে যাওয়া, গ্লাসে পানি ঢালার শব্দ, এসব খুটখাট শব্দে তাঁর স্ত্রীরও ঘুম ভাঙিয়ে দিল। তিনি ঘুম ঘুম চোখে খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
তুমি ঘুমাও। আমার এমনিতেই ঘুম আসছে না।
ঘুম আসছে না কেন? আলসারের ব্যথা হচ্ছে?
না না, ওষুধ খাচ্ছি তো, ওসব কিছু না।
তাহলে ঘুমাও, সকালে অফিস যাবে না?
তিনি কিছু না বলে শুয়ে পড়লেন, কিন্তু তাঁর অজানা অস্থিরতাটা যাচ্ছে না। এর মধ্যে কয়েকবার খবরে দেখা রাস্তায় বাসে চাপা পড়া মেয়েটির কথা মনে পড়ল। বিশেষ করে তার কাপড়ে ঢাকা রক্তস্নাত মুখ। মুখটি দেখার জন্য একধরনের কৌতূহল তিনি বোধ করছেন। তিনি হঠাৎ বিছানা থেকে উঠে ঘরের বাইরে এলেন। পাশের ঘরে বাতি জ্বালানো, তুলি পড়ছে। একটু ইতস্তত করে তিনি ঘরে ঢুকলেন। তুলি বাবাকে দেখে খুবই অবাক হলো। বাবা এত রাতে কখনো তার খোঁজখবর নিতে আসেন না। আলী সাহেব মেয়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর মনে হলো তিনি বাসে চাপা পড়া মেয়েটির মুখ তুলির মুখে দেখতে চাইছেন।
তুলিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ‘তুই পড় মা’ জাতীয় কথা বলে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। সে রাতটা তাঁর আধো ঘুম আধো জাগরণে কাটল।
আলী সাহেব সড়ক পরিবহন সংস্থায় চাকরি করেন। অফিসের দায়িত্ববান, একনিষ্ঠ, পরিশ্রমী কর্মকর্তা। রোজকার মতো আজও অফিসে ঢুকে আরাম করে চেয়ারে বসলেন তিনি। তাঁর পিয়ন তাঁর জন্য লেবু চা নিয়ে এলো । তাঁর সামনে গতকালের ফাইলগুলো এগিয়ে দিল। তিনি তাঁকে তাঁর সহকর্মী ইদ্রিস সাহেবকে খবর দিতে বললেন।
ইদ্রিস সাহেব গতকাল মালিবাগ মোড়ের অ্যাক্সিডেন্টের খবরটা টিভিতে দেখেছেন?
না তো স্যার। ১০টার খবর? ও তখন আমার ছেলেমেয়েরা স্টার প্লাসের নাটক দেখছিল। আমাকে খবর দেখতে দেয় নাই।
ও, যে গাড়িটা মেয়েটাকে ধাক্কা দিল, সেটা বেশ পুরোনো মনে হচ্ছিল। গাড়িটা আমি বোধহয় চিনি। আমাদের এখানে কিছুদিন আগে ফিটনেসের জন্য আসছিল।
পুরোনো হতেই পারে। ঢাকা শহরে নতুন বাস আর কয়টা। রং করে তাঁর সামনে-পেছনে স্টিকার লাগিয়ে ইমপোর্টেড বলে চালায়।
গাড়িটার কাগজপত্রের কপি খুঁজে বার করতে পারবেন?
কী করে পারব? আপনি কি রেজিস্ট্রেশন নম্বর জানেন?
না, জানি না, তবে জানা যাবে স্যার।
তিনি যে থানায় বাসটি আটক করা হয়েছে, সেখানে ফোন করলেন। নিজের পরিচয় জানিয়ে থানার সাব-ইন্সপেক্টরের কাছ থেকে গাড়ির প্লেটে লাগানো নম্বরটি জেনে নিলেন। তারপর ইদ্রিস সাহেবকে বললেন, রেজিস্টার বই ঘেঁটে গাড়ির ফিটনেসের কাগজপত্র বের করতে। ইদ্রিস সাহেব তাঁর কৌতূহলে অবাক হলেন।
কিন্তু স্যার এ রকম অ্যাক্সিডেন্ট তো প্রায়ই হয়। ফিটনেস সার্টিফিকেটে হয়তো দেখা যাবে গাড়ির সবকিছু ঠিক আছে।
ফিটনেস তো বছরে একবার হয়।
তাই তো নিয়ম।
এক বছরের মাঝে গাড়ির কোনো অংশ খারাপ হতে পারে না?
তা পারে। তবে অ্যাক্সিডেন্টে ড্রাইভারের দোষও থাকতে পারে। কাঁচা হাতে চালালে দুর্ঘটনা হতেই পারে।
ভালো কথা মনে করেছেন। বাসটার রেজিস্ট্রেশন ফাইল থেকে গাড়ির মালিকের ঠিকানায় খোঁজ নেন যে ড্রাইভার কে ছিল। তাঁর নাম জেনে ড্রাইভিং লাইসেন্সের কাগজপত্রও বের করেন।
কিন্তু এসব কেন চাচ্ছেন? ওপর থেকে কোনো নির্দেশ আছে?
না, সে রকম কিছু না, এমনিতেই আমি জানতে চাই। আপনি যান, তাড়াতাড়ি কাগজপত্রগুলো নিয়ে আসেন।
ড্রাইভারের ড্রাইভিং লাইসেন্সের কপি, গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট এসব দ্রুত বের করা সহজ নয়, তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো, ইদ্রিস সাহেব ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কাগজগুলো নিয়ে এলেন। আলী সাহেব সার্টিফিকেটগুলো কয়েকবার দেখলেন এবং হঠাৎ করেই অস্বস্তিবোধ করতে লাগলেন।
কী ব্যাপার স্যার? ঠিক আছে তো এগুলো।
হুম, ইদ্রিস সাহেব।
জি স্যার।
লাইসেন্সে ড্রাইভারের প্রশিক্ষণের মান সন্তোষজনক পত্রে আমার সই আছে।
সেটাই তো স্বাভাবিক। আপনি তো সব ড্রাইভিং লাইসেন্সের কাগজপত্রে ফাইনালি সই করেন।
কিন্তু গাড়ির ফিটনেসে সার্টিফিকেটেও আমার সই।
তাই নাকি। তাহলে আপনি বোধ হয় তখন এই সেকশনের অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন।
হুম।
স্যার, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? আপনি ঘামছেন কেন?
না ও কিছু না, ইদ্রিস সাহেব গাড়িটার কথা আমার মনে পড়ছে, মাস দুয়েক আগের চেক করা। ব্রেকে সমস্যা ছিল, মাঝেমধ্যে অটোগিয়ার কাজ করত না, এতে হঠাৎ ব্রেক ফেইল করার আশঙ্কা থাকে।
ইদ্রিস সাহেব হাসার চেষ্টা করে বললেন, কোনো একটা গাড়ি আপনি ১০০% ওকে পাবেন স্যার বলেন? এইসব একটু-আকটু প্রবলেম তো থাকে। তা ছাড়া এত খুঁটিনাটি দেখলে দুদিন লাগবে একটি গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করতে।
ওরা বলেছিল, প্রবলেমটা ঠিক করে নেবে।
বাদ দেন স্যার, এই ত্রুটির জন্য অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে তা তো না।
হুম, তা হয় তো না।
স্যার আপনি বরং বাসায় যান আজ, বিশ্রাম করেন। আপনাকে ক্লান্ত লাগছে।
আলী সাহেবের ভেতরে ভেতরে অদ্ভুত এক অস্থিরতা বোধ করছেন। আজ গরম খুব একটা পড়েনি, তবু তিনি দরদর করে ঘামছেন এসির রুমে বসে। সামনে পড়ে থাকা গোটা তিরিশেক ফাইল আর বাইরে অপেক্ষমাণ দশ-বারোজন দর্শনার্থী। কিন্তু তিনি কোনো কাজই শুরু করতে পারলেন না। বেলা সাড়ে ১০টার দিকে তিনি অফিস থেকে বের হয়ে এলেন।
সবাই আলী সাহেবকে বাসায় যেতে বললেও তিনি বাসায় গেলেন না। অফিস থেকে বের হয়ে সোজা চলে এলেন থানায়, যেখানে গতকালকে দুর্ঘটনার বাসটি রাখা হয়েছে। তিনি বাসটি ভালো করে দেখলেন। ইঞ্জিন, গিয়ার, কন্ট্রোল প্যানেল, সামনে-পেছনের চাকা সব দেখলেন। সকালে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া ব্রেক-গিয়ারের যে ত্রুটি মনে পড়েছিল, তিনি দেখলেন সেটি সে রকমই আছে। বাসের মালিক সেটি সারায়নি।
থানা থেকে বের হয়ে আলী সাহেব বাস মালিকের অফিসে গেলেন। বাসের চালকের খোঁজখবর চাইলে বাসের মালিক তাঁকে খাতির যত্ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি সড়ক পরিবহনের অফিস থেকে এসেছেন বললেও মালিক স্বস্তি পেলেন না। মালিকের কাছ থেকে পলাতক ড্রাইভারের বর্ণনা শুনে বোঝা গেল, এই ড্রাইভার খুব বেশিদিন ধরে বাস চালায় না। একসময় বাসের হেলপার ছিল, মাঝে মাঝে খালি রাস্তায় চালিয়ে গাড়ি চালাতে শেখে। পড়াশোনাও তেমন নাই। হালকা-পাতলা গড়নের কালো করে ছেলেটিকে আলী সাহেব চিনতে পারলেন। গাড়ি চালানোর পরীক্ষা দেওয়ার সময় কয়েকবার ভুল করেছিল। তা ছাড়া তার কী একটা শারীরিক সমস্যাও ছিল। তবে তাকে সামনাসামনি দেখতে পারলে তিনি তার অদক্ষতা আরো ভালো করে বুঝতে পারতেন।
বাস মালিকের অফিস থেকে বের হয়ে আলী সাহেব ঠিক করলেন বাসায় চলে যাবেন। দুপুরের খাড়া রোদ মাথার ওপর গনগন করছে। বাসায় যাওয়ার মাঝপথে এসে তিনি রিকশাওয়ালাকে বললেন মালিবাগের মোড়ে যেতে।
যে জায়গায় মেয়েটির গতকাল পড়ে ছিল, সেটি খুঁজে পেতে সমস্যা হলো না। দু-তিনটি ইট রাখা হয়েছে কালো পিচের রাস্তায়। আশপাশে পড়ে থাকা চাকচাক রক্তগুলো কালো, শক্ত হয়ে পিচের সাথে মিশে গেছে। হয়তো কাল পর্যন্ত এই রক্তের দাগ আর থাকবে না। এখানে চলাচলকারীরা কয়েকদিন পর ভুলেও যাবে যে এখানে আঠারো-উনিশ বছরের এক তরুণী গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়েছিল। আলী সাহেব দীর্ঘ সময় ধরে পড়ে থাকা ইট আর জমাট কালো রক্তের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর শার্ট ঘামে ভিজে গেছে। রোদের তেজে শরীরে জ্বলুনি হচ্ছে। মাথা টনটন করছে। তিনি এসব তোয়াক্কা না করে দাঁড়িয়ে আছেন। ঘটনার দৃশ্যটি তাঁর চোখের সামনে যেন স্পষ্ট ভাসছে। মেয়েটি ডান-বাম দেখে নিয়ে জেব্রা ক্রসিংয়ের প্রথম দাগে পা দিল, তার দ্বিতীয় দাগ, তৃতীয় দাগ, বাসটি এগিয়ে আসছে, থেমে যাবে। পথচারী পারাপারে থামতে হয়, তাই নিয়ম, মেয়েটি আরেকটু এগুলো, বাসটি এগিয়ে আসছে। মেয়েটি নিশ্চিত বাসটি থামবে। কিন্তু একি থামছে না কেন... এগিয়ে আসছে তার দিকে, দ্রুতগতিতে যেন তার পার হওয়ার আগেই সে জেব্রা ক্রসিং পার হবে। তার সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। মেয়েটি অনিশ্চিত, কী করবে, ফিরে যাবে নাকি বাকি রাস্তা পার হবে? ভাবার মতো সময় নেই। যেকোনো একদিকে পা ফেলতে হবে এখুনি নিজেকে বাঁচাতে হবে... বাঁচাতে হবে... মা... মাগো...।
আলী সাহেব ফুটপাতের ওপর বসে পড়লেন। তাঁর সারা শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে, তিনি যেন ওই দানব বাস। মেয়েটির ওপর দিয়ে উঠে তাকে, ভেঙেচুরে পিষ্ট করে চলে গেছেন। মেয়েটি মৃত্যুর আগ মুহূর্তে মাকেও ঠিকমতো ডাকতে পারল না।
দু-তিনজন পথচারী আলী সাহেবকে ধরাধরি করে রিকশায় তুলে দিল। তিনি বাসায় ফিরে প্রথমেই তাঁর মেয়ে তুলির খোঁজ করলেন। কলেজ থেকে একটু আগে ফিরেছে জেনে তিনি ক্ষণিকের জন্য যেন দুশ্চিন্তামুক্ত হলেন। তাঁর স্ত্রী তাঁকে ফ্যানের নিচে বসিয়ে বেলের শরবত বানাতে গেলেন। আলী সাহেব তুলিকে ডাকলেন।
কী ব্যাপার বাবা, তুমি এ সময় অফিস থেকে চলে এলে যে, শরীর খারাপ করেছে?
না রে মা, মনটা বড় অস্থির লাগছে।
কেন, কী হয়েছে?
তুই হেঁটে বা রিকশায় কখনো আসিস না।
কেন বাবা, মাঝেমধ্যে তো আমি রিকশায় যাই।
না, তুই গাড়িতে আসবি। গাড়ি না থাকলে সিএনজি নিবি। কখনো হেঁটে আসবি না। আর রাস্তা পাড়ের সময় খুব সাবধান।
আমি জানি বাবা, ছোট বাচ্চাদের মতো আমাকে জ্ঞান দিচ্ছো কেন?
সুমী মেয়েটাও তো ছোট ছিল না, তোর মতো বয়সী, কলেজে পড়ত।
সুমী কে বাবা?
কাল খবরে দেখলি না, বাস চাপা পড়ে...
ও, তুমি তাই আমার জন্য ভয় পাচ্ছ।
তিনি মেয়ের কথা শুনে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। হাতের গ্লাসভর্তি বেলের শরবতটি এই প্রচণ্ড গরমে বুক শীতল করার কথা, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি উষ্ণ বোধ করছেন।
সুমী মেয়েটা কেন মারা গেল, আমি জানি।
অ্যাক্সিডেন্টে মরেছে, আমরা সবাই জানি।
কিন্তু অ্যাক্সিডেন্ট কীভাবে হলো তা কেউ জানে না, শুধু আমি জানি।
বলো কী বাবা, তুমি কি তখন সেখানে ছিলে?
না ছিলাম না, তবে ওই গাড়ি আর গাড়ির চালককে মেয়েটিকে হত্যার অনুমতি আমি দিয়েছিলাম।
তুলি এবার বাবার প্রতি মনোযোগ দিল। বাবার কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? কী সব আবোলতাবোল বলছে। সে বিস্ময় ও জিজ্ঞাসু চোখে বাবার কাছে এসে বসল। তিনি একটু থেমে বললেন, গাড়িটার ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও আমি গাড়িটাকে ভালো, রাস্তায় চলাচল উপযোগীর সার্টিফিকেট দিয়েছিলাম। তা ছাড়া ড্রাইভারটা একটা হেলপার ছিল, কোনোরকমে স্টিয়ারিং ধরতে শিখেছে মাত্র, আর আমি তাকে দিলাম ড্রাইভিং লাইসেন্স। অদক্ষ ড্রাইভার খারাপ গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নেমে মেয়েটাকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলল। বল, তাহলে বল আমি কি এর জন্য দায়ী না? আমি কি সুমীকে হত্যার ছাড়পত্র দিইনি?
বাবা এটা তোমার কাজ, সব সময়ই করছ।
কিন্তু কাজটা আমি ঠিকমতো করি নাই।
তা ছাড়া এই দুটো কারণেই যে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, তুমি নিশ্চিত হচ্ছো কীভাবে। অন্য কত কারণ থাকতে পারে। ট্রাফিক সিগন্যাল হয়তো ঠিক ছিল না বা মেয়েটি হয়তো অন্যমনস্কভাবে রাস্তা পার হচ্ছিল।
তুলির মা পাশের ঘরে বাবা-মেয়ের কথাবার্তা শুনছিলেন। তিনি এসে বললেন, ড্রাইভারটা হয়তো মদ খেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল। এরা কি আর দিন-রাত বোঝে? মানুষের জীবনের মূল্য বোঝে?
তোমরা যাই বলো, নিজেকে আমার অপরাধী মনে হচ্ছে। এমন ফুটফুটে একটা মেয়ে, আমার কারণে...
কী যে হলো তোমার, আজ অচেনা একটা মেয়ের জন্যে তোমার দরদ উথলে উঠছে কেন। তুমি তো এত নরম মানুষ ছিলে না।
আলী সাহেব স্ত্রীর দিকে করুণ মুখ করে তাকালেন। তাঁর অস্থিরতা, কষ্ট, বিবেকের তাড়না এরা বুঝতে পারছে না। তিনি উঠে দাঁড়ালেন, বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন।
এখন আবার যাও কই। খাওয়া-দাওয়া করে ঘুম দাও। রাতেও তো ঘুমাওনি।
আমি অফিসে যাব। কাজ আছে।
স্ত্রী-কন্যার অনুরোধ উপেক্ষা করে আলী সাহেব রওনা হলেন অফিসের পথে। অফিসের বড় কর্তার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে এলেও বড়কর্তাকে পাওয়া গেল না। তাঁর পিএস জানাল, তিনি মন্ত্রণালয়ে মিটিংয়ে গেছেন, অফিসে আজ নাও ফিরতে পারেন। আলী সাহেব অফিসে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে বিকেলের দিকে বড়কর্তার বাসায় গেলেন। চেয়ারম্যান সাহেব তখনো ফেরেননি। তিনি তাঁর বাড়িতে বসার ঘরে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
তিনি ফিরলেন রাত ৯টার দিকে। অফিসের লোক দেখে তিনি বিরক্ত হলেও তাঁর সাথে হাসিমুখে কথা বলতে এলেন। আলী সাহেব ভয়ে ভয়ে পুরো ব্যাপারটা তাঁকে বললেন। তাঁর সব কথা শুনে বড় কর্তার ভ্রুকুঞ্চিত হলো, তিনি বিরক্তি প্রকাশ না করে সহজ হতে চেষ্টা করলেন।
আপনি বলেছেন মেয়েটির মৃত্যুর জন্য মূলত আপনিই দায়ী?
জি স্যার, আমি লাইসেন্স আর ফিটনেস না দিলে হয়তো অ্যাক্সিডেন্টটা হতো না।
আপনি আসলে এখন চাচ্ছেন কী? বুঝলাম নাতো ।
আমি আমার ভুল স্বীকার করে কর্তৃপক্ষের কাছে আমার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বলব।
তিনি আলী সাহেবের কথায় সশব্দে হাসলেন। বিস্মিত হলেও তা গোপন করলেন। একটু পরে কিছু একটা ভেবে নিয়ে বললেন, আপনি এই ডিপার্টমেন্টে কত দিন আছেন?
তা স্যার প্রায় ১৪ বছর। এর মধ্যে দুবার ঢাকার বাইরে তিন বছর বদলিতে ছিলাম।
এত দিনে কত লাইসেন্স দিয়েছেন, ফিটনেস পরীক্ষা করেছেন?
তা তো স্যার নথিপত্র দেখে বলতে হবে।
ধরে নিলাম আপনি ১৪ বছরে ১৪ হাজার দিয়েছেন। এখন আপনার দেওয়া লাইসেন্স আর ফিটনেসের ফলে কতগুলা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, কত মানুষ মারা গেছে তার হিসাব কি আপনার কাছে আছে?
আলী সাহেব উত্তর দিলেন না।
দেখুন, দেশে বছরে নিয়মিত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে, পঙ্গু হচ্ছে, তার মানে কি এইসব অ্যাক্সিডেন্ট, ক্ষয়ক্ষতি, মৃত্যুর জন্য আপনি দায়ী? বলুন ঠিক কি না?
আলী সাহেব তবু চুপ করে রইলেন, তিনি মাথা নিচু করে কী যেন ভাবছেন। বড়কর্তা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। হালকাভাবে বললেন, আলী সাহেব, পাবলিক পরিবহনের অনেক গাড়িই রাস্তায় চলাচলের উপযোগী নয়। অযোগ্য চালকের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু আমাদের হাত-পা কোথায় বাঁধা, এটা আপনি আমি জানি। শুধু শুধু ইমোশনাল হয়ে এসব নিয়ে ঝামেলা করছেন কেন? কী দরকার আমাদের সিস্টেমের ক্ষতে খোঁচা দিয়ে ব্যথা বাড়াবার? এসব সিলি ম্যাটার নিয়ে মাথা ঘামিয়েন না।
স্যার একটি মানুষের জীবনের অকাল অপমৃত্যু সিলি ম্যাটার? না স্যার, আমি সহজভাবে নিতে পারছি না। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। আমার শাস্তি পাওয়া উচিত।
বড়কর্তা আলী সাহেবের কাঁধে হাত রাখলেন। মৃদুস্বরে বললেন, যান বাড়ি যান, বিশ্রাম নিন।
তিনি কোনোরকমে জি, আচ্ছা স্যার, স্লামালাইকুম, বলে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। পথে আসতে আসতে তাঁর মনে হলো বড়কর্তার কথাগুলোই ঠিক। সবকিছু যেমন চলছে চলুক না। তিনি একা এসব নিয়ে হৈ হৈ করে কী করবেন। কেউ তাঁর সাথে একমত হবে না। জেনেশুনে নিজেদের আইনের ঝামেলায় জড়াতে চাইবে না। অন্যায় করে শাস্তি এড়াতে সবাই চায়, নিজেকে শাস্তির জন্য মাথা পেতে দেয় না। তাঁর মতো বোকারাই হয়তো এমন করে।
বাড়িতে গিয়ে তুলির মায়াকাড়া মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আগের মত বদলালেন। বড়কর্তা বা অন্যরা যাই বলুক, তিনি তাঁর অপরাধের জন্য শাস্তি পেতে চান। প্রয়োজনে তিনি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত যাবেন। পুলিশের কাছে জবানবন্দি দেবেন। তাঁর চাকরি গেলে যাবে। তবু তিনি আর এসব অন্যায় করবেন না। জেনেশুনে নিরীহ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার ছাড়পত্র দেবেন না। এ সিদ্ধান্তের পর তাঁর মন ফুরফুরে লাগতে লাগল। তিনি খাওয়া-দাওয়ার পর আরাম করে ঘুমুতে গেলেন। তাঁর দ্রুত ঘুম এসে গেল, সুখী মানুষের ঘুম।
আলী সাহেব অফিসে তাঁর চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর সামনে আঠারো-বিশটি ফাইল। বাইরে এই সাত সকালেই চার-পাঁচজন লোক বসে আছে। এরা সবাই হয় গাড়ির মালিক বা ড্রাইভার। আলী সাহেবের অফিস সহকারী ঘরে ঢুকে চায়ের কাপ সামনে রেখে হাসিমুখে বলল, স্যার আজ কিন্তু ড্রাইভারগো পরীক্ষা, মনে করাইয়া দিলাম। একটু তাড়াতাড়ি করলে তিরিশ-পঁয়ত্রিশটা একদিনেই সারতে পারবেন। আমি দশজনের থেকে অ্যাডভান্স নিসি, বলসি চিন্তা নাই পাস করবা। ব্যাংকে টাকা জমা দিসি। বাকি টাকাগুলো কি স্যার এখন দেবো? নাকি পুরা কালেকশন কইরা?
তিনি কিছু বলার আগে ফোন বাজল। তাদের ডিপার্টমেন্টের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ফোন। তিনি জানালেন, তাঁর ছেলের বিদেশ যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। তাঁর কিছু টাকার প্রয়োজন। আলী সাহেব স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে বললেন, রাত্রে তাঁর বাসায় লোক যাবে। ফোন রেখে তাঁর মনে পড়ল আজ অফিসের এক ফাঁকে ইস্টার্ন প্লাজায় যেতে হবে। স্ত্রী-মেয়ের জন্য ১০ ভরি স্বর্ণের অলংকার বানাতে দিয়েছিলেন। সেটা তুলে আনতে হবে।
আলী সাহেব গা ঝেড়ে বসলেন, সামনের ফাইলগুলো একেক করে দেখতে লাগলেন। পিয়নকে বললেন, বাইরের লোকগুলো এক এক করে পাঠাতে। তিনি দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততায় ডুবে গেলেন। গতকাল রাতে নেওয়া সিদ্ধান্তের কথা তাঁর আর মনেই পড়ল না।