রবীন্দ্রনাথের বিশ্বদৃষ্টি
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/05/08/photo-1494212254.jpg)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শাসকদের এড়িয়ে চেষ্টা করেছেন মানুষের আত্মশক্তির মহৎ দিককে জাগ্রত করতে, জনগণের নৈতিক শক্তির ও সংহতিবোধের বিকাশ ঘটাতে, মানুষকে ভেতর থেকে জাগিয়ে তুলতে।
আত্মশক্তির জাগরণের কথা অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বারবার রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু তাঁর এসব মত আজ ভারতের কিংবা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের এবং জনসাধারণের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। পৃথিবীর দেশে দেশে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা যদি আজ এ বিষয়টি উপলব্ধি করার সামর্থ্য অর্জন করতেন এবং রাবীন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়—বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে মানুষের নৈতিক সত্তার তথা আত্মশক্তির মহৎ দিকের পরিচয় উদঘাটনে সচেষ্টা হতেন, তাহলে তা প্রত্যেক জাতির ও গোটা মানবজাতির জন্য মঙ্গলকর হতো।
সমস্ত কিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে রবীন্দ্রনাথের জীবন সাধনের সকল পর্যায়ে বারবার নতুন নতুন ভাষায় ও ভঙ্গিতে প্রকাশ পেয়েছে তা হলো তাঁর মর্ত্যপ্রীতি, মানুষের প্রতি বিশ্বাস ও ভক্তি, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মধুর সম্পর্ক এবং সকল ব্যাপারে সদর্থক বা পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি। এই বিশ্বজগৎকে তিনি ভালোবেসেছেন; পৃথিবীর ধূলিমাটি , গাছপালা,পশুপাখি, আলো-বাতাস ও মানুষকে তিনি পরম মূল্য দিয়েছেন। নিসর্গের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের মধুর সম্পর্ক সর্বোচ্চ মূল্য পেয়েছে তাঁর গানে, কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে ও প্রবন্ধে। যৌবনে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই।
মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি লিখেছেন :
এ দ্যুলোক মধুময়,মধুময় পৃথিবীর ধুলি—
অন্তরে নিয়েছে আমি তুলি,
এই মহামন্ত্রখানি
চরিতার্থ জীবনের বাণী।
রবীন্দ্রসাহিত্যের বিধৃত এই মর্ত্যপ্রীতি ও আশাবাদ বাঙালি পাঠকের মনে জীবনযাপন ব্যাপারে আশা ও সাহসের সঞ্চার করে। বাঙালি পাঠক তাঁর কাছ থেকে লাভ করেন আত্মশক্তির মহত্ত্বকে অবলম্বন করে স্বাভাবিক, সুস্থ, বলিষ্ঠ, আনন্দময় জীবনযাপনের নব নব প্রত্যয়। মনে হয়, যত দিন রবীন্দ্রনাথের ভাষা পুরোনো হয়ে দুর্বোধ্য হয়ে যাবে না , তত দিনই বাঙালি পাঠক এ বিষয়ে তাঁর থেকে প্রেরণা পাবে ও সময়ে সময়ে নতুন করে দীক্ষা নেবে।
রবীন্দ্রনাথ বহু দেশে ভ্রমণ করেছিলেন। তাঁর কালে এত বেশি এত বেশি দেশভ্রমণের সুযোগ হয়তো পৃথিবীর খুব কম লোকই লাভ করেছিলেন। ভ্রমণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পথের সঞ্চয় গ্রন্থের ‘যাত্রার পূর্বপত্র’ প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন : “আমি সোড়াতেই বলিয়া রাখিতেছি কেবলমাত্র বাহির হইয়া পড়াই আমার উদ্দেশ্য। ভাগ্যক্রমে পৃথিবীতে আসিয়াছি, পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় যথাসম্ভব সম্পূর্ণ করিয়া যাইব, ইহাই আমার পক্ষে যথেষ্ট। দুইটা চক্ষু পাইয়াছি, সেই দুটা চক্ষু বিরাটকে যত বিচিত্র করিয়া দেখিবে ততই সার্থক হইবে।”
এই সহজ সরল উক্তিটির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের জীবন জগৎদৃষ্টি সুন্দর প্রকাশ আছে। ‘শুধু অকারণ পুলকে’র জন্যই অনন্তকাল পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চেয়েছেন তিনি—মৃত্যু নিয়ে দুর্ভাবনা করেছেন—অমরত্ব আকাঙ্ক্ষা করেছেন।
মানুষের স্খলন, পতন ও মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ বিচলিত হয়েছেন; কিন্তু তিনি ভেবেছেন—স্খলন, অস্তিত্বশীল থাকে এবং যত ধীরগতিতে ও যত বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়েই হোক, উন্নতির দিকে অগ্রসর হয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় :
চলছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর-পানে
ঝরঝঞ্ঝা-ব্জ্রপাতে জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে
অন্তরপ্রদীপখানি।
‘মানবযাত্রী’র এই যাত্রা পরমোৎকর্ষের দিকে। রবীন্দ্রনাথের ‘চিরকালের মানুষ’ কিংবা ‘মানবযাত্রী’র ধারণাকে আপাতদৃষ্টিতে রহস্যাচ্ছন্ন মনে হলেও আসলে তা হলো চিরবিকাশমান মনুষ্যত্ব বা মহত্ত্বর মানবিক গুণাবলি—যে গুণাবলির কারণে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মানুষের স্থান সব জৈবসত্তার ও জড়সত্তার ঊর্ধ্বে। মনুষ্যত্বের বা মহত্ত্বর মানবিক গুণাবলির উৎকর্ষ সাধনের প্রয়াসের মধ্য দিয়ে মানুষ অতি ধীরগতিতে যুগযুগান্তর ধরে পরোমৎকর্ষের দিকে ধাবিত হচ্ছে—এ বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের সুদৃঢ়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী কবিসুলভ তীব্র আবেগের সঙ্গে ইতিহাসের ধারায় ব্যক্তি মানুষের ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে করেছেন এবং তারই ভিত্তিতে গোটা মানবজাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চেয়েছেন।
সমস্যার সম্মুখে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসপ্রবণতা ছিল সর্বাবস্থায় সদর্থক বা পজিটিভ। নঞ্চর্থক বা নেগেটিভ কোনো সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি তাঁর কখনো সমর্থন ছিল না।
রবীন্দ্রনাথের নৈতিক চিন্তার ধারাকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে বিচার-বিশ্লেষণ করলে সামাজিক সমস্যা সমাধানের কিছু বিবেচনা যোগ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সন্ধান পাওয়া যাবে। ‘সুখে আছে যারা সুখে থাক তারা, দুঃখে আছে যারা সুখী হোক তারা’—এই ছিল মানুষে মানুষে ভেদাভেদের সমস্যার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। রবীন্দ্রনাথ সব সময়ই অহিংস পন্থায় শান্তিপূর্ণ বিবর্তনের পক্ষে ছিলেন, বিপ্লব সমর্থন করেননি।
জীবনসাধনায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মহাকাব্যের নায়কের মতো অবিচল, স্থিতধী, সুস্থ, সবল, স্বাভাবিক। বিশ্বাসে এবং নৈতিক সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন বলেই মানসিক স্থৈর্যে ব্যত্যয় ঘটেনি তাঁর। কবিসুলভ অস্থিরচিত্ততা , বাউণ্ডুলেপনা , স্বেচ্ছাচারিতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা তাঁর জীবনে কখনো ছিল না। তাঁর কাব্য সাধনার পথ অবশ্যই কঠিন ও কঠোর ছিল, নানা ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করতে হয়েছে তাঁকে। তবে ব্যবহারিক জীবনে মহাকাব্যের নায়কের মতো বিরাট বিরাট প্রতিকূলতার সম্মুখীন তাঁকে হতে হয়নি। জীবনে যেসব ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন তিনি হয়েছেন, সেগুলো প্রধানত মানসজগতের। তাঁর পাঠক ও সমালোচকদের মতে, তিনি তাঁর চিন্তা ও অনুভূতিকে প্রকাশ করেছেন সবচেয়ে সুন্দর ভাষায়—সুন্দরতম রূপের মাধ্যমে; কিন্তু নিজের উপলব্ধি ব্যক্ত করে তিনি বলেছেন যে, যা তিনি অনুভব করেছেন তাঁর অতি সামান্য অংশকেই মাত্র তিনি ভাষার মাধ্যমে ব্যক্ত করতে পেরেছেন। রোমান্টিক কবিদের মধ্যে এ ধরনের আকুতি সুলভ। রবীন্দ্রনাথ নিজেকে রোমান্টিক বলে পরিচর্যা দিয়েছেন—যদিও তাঁর বিরাট সৃষ্টির স্বরূপ এক একটি কথা দ্বারা সামান্যই বোঝা যায়।