রবীন্দ্র ভাবনায় বিশ্ববিদ্যালয়
ভারতীয় উপমহাদেশে বেসরকারি তথা নিজস্ব উদ্যোগে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চিন্তা ও সেই চিন্তাকে বাস্তবে রূপদান করার সকল কৃতিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। যেহেতু তিনি নিজেই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান এজন্য তাঁর হাতে গড়া ‘বিশ্বভারতী’ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ছিল অপরিসীম আস্থা। তবে একদিনে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠেনি; ‘শান্তিনিকেতন’ আশ্রম থেকে তার যাত্রা শুরু। কবি নিজে তাঁর জীবদ্দশায় ‘বিশ্বভারতী’র আদর্শকে সমুন্নত রেখে এর পরিধিকে বৃদ্ধি করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে গেছেন। অর্থসংকট আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিন্ন আদর্শের বিপরীতে কিংবা ব্রিটিশরাজের শিক্ষানীতির অন্যথা করে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে অনেকটা সময় সাহিত্য সৃষ্টি থেকে বিরত থাকতে হয়েছে কবিকে।
রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম এবং স্বতন্ত্র একটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণের প্রয়াসকে বুঝতে হলে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় ভাবনাকে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করতে হবে। তবে কেবল বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ভাবনা নয় রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনার সঙ্গে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে কবির চিন্তাকে মূল্যায়ন করা দরকার। অন্যদিকে মুক্তবুদ্ধি চর্চার দিগন্তকে আরো বেশি উন্মুক্ত করার জন্য রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনার গুরুত্ব উপলব্ধি ও বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। বিশেষত বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রাধান্য নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক উপস্থাপন করা হচ্ছে। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংস্কৃতি চর্চা হচ্ছে না বলেও অভিযোগ সামনে এসেছে। অর্থাৎ ‘সহশিক্ষা কার্যক্রম নির্ভর’ শিক্ষাদান পদ্ধতি ব্যাপকভাবে চালু হওয়া দরকার বলে মনে করছেন অনেকেই। আর বিচিত্র সব তর্ক-বিতর্কের মধ্যে একজন সংবেদনশীল কবি বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিষ্ঠান নিয়ে কী করেছিলেন, কী ভেবেছিলেন তার পর্যালোচনা গুরুত্ব পাচ্ছে। যদিও ‘বিশ্বভারতী’ থেকে ডিগ্রিধারীদের বর্তমান চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হচ্ছে অর্জিত আদর্শের সঙ্গে বাস্তব জীবনের ব্যাপক পার্থক্যকে স্বীকার করে নিয়েই। তবু সমাজের প্রচলিত মুখস্থবিদ্যার বিপরীতে তাদের জীবনাদর্শ ও নৈতিক চেতনা ভিন্ন যার নির্মাতা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
১.
১৯০১ সালের ডিসেম্বরে (৭ পৌষ ১৩০৮ বঙ্গাব্দ) বোলপুরের নিকটস্থ শান্তিনিকেতন আশ্রমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এই বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ছিল প্রচলিত বৃত্তিমুখী অপূর্ণাঙ্গ শিক্ষার পরিবর্তে ব্যবহারিক শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের পূর্ণাঙ্গ মনোবিকাশের সুযোগ দান। রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ভারতের তপোবন কেন্দ্রিক বিদ্যানিকেতন থেকে এই বিদ্যালয়ের আদর্শটি গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, “আমার একান্ত ইচ্ছা ছিল যে, এখানকার এই প্রভাতের আলো, শ্যামল প্রান্তর, গাছপালা যেন শিশুদের চিত্ত স্পর্শ করতে পারে। কারণ প্রকৃতি সাহচর্যে তরুণ চিত্তে আনন্দ সঞ্চারের দরকার আছে। এই উদ্দেশ্যে আমি আকাশ আলোর অন্তশায়ী উদার প্রান্তরে এই শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেছিলুম “শান্তিনিকেতন”।
প্রাচীন ভারতীয় আশ্রমিক শিক্ষার ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ স্থাপন করেছিলেন শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়। প্রাচীন আশ্রমিক শিক্ষার সব বৈশিষ্ট্যই বর্তমান ছিল শান্তিনিকেতনে। তিনি পল্লির উদার প্রান্তরে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেন, তার ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন এভাবে- “ভারত এই একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখা গেছে, এখানকার সভ্যতার মূল প্রস্থান শহরে নয় বলে। ভারতবর্ষের সর্বপ্রথম আশ্চর্য বিকাশ যেখানে দেখতে পাই সেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষ অত্যন্ত ঘেঁষাঘেঁষি করে একেবারে পিণ্ড পাকিয়ে ওঠেনি। যেখানে গাছপালা নদী সরোবর মানুষের সঙ্গে মিলে থাকবার অবকাশ পেয়েছিল, সেখানে মানুষও ছিল ফাঁকাও ছিল। ঠেলাঠেলি ছিল না। অথচ ফাঁকায় ভারতবর্ষের চিত্তকে জড়প্রায় করে দেয়নি, বরঞ্চ তার চেতনাকে আরো উজ্জ্বল করে দিয়েছিল। এরকম ঘটনা জগতে আর কোথাও ঘটেছে বলে দেখা যায় না।’’ (শিক্ষা)
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাবীক্ষণের মূল কথা হলো ব্যক্তিত্ব বিকাশ এবং সামাজিক উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করা। এই প্রক্রিয়াই মানুষের সার্বিক মুক্তি অর্জন সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শান্তিনিকেতন। শান্তিনিকেতনে শিক্ষা পদ্ধতির প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ হলো : জাতি ধর্ম নির্বিশেষ সকল সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া ও এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, খেলাধুলা করা। আর উচ্চ চিন্তা এবং সরল জীবন-যাপন শান্তিনিকেতনের শিক্ষা পদ্ধতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শিক্ষার্থীরা নিজেদের কাজ নিজেরাই করে। সেখানে শ্রমের প্রতি মর্যাদা ও আত্মনির্ভরতা শেখানো হয়। শ্রেণীকক্ষে আবদ্ধ পরিবেশে শিক্ষাদানের পরিবর্তে এখানে মুক্ত প্রকৃতির মাঝে শিক্ষা দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের থাকার জায়গা নিজের বাড়ির মতো। শান্তিনিকেতনের শিক্ষা ব্যবস্থায় সহপাঠ্যক্রমিক কাজের প্রাধান্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ঋতু উৎসব, খেলাধুলা, অভিনয়, নৃত্য, সংগীত, সম্মিলন, ভ্রমণ, চিত্রাঙ্কন ইত্যাদির ব্যবস্থা আছে। শান্তিনিকেতনের শিক্ষাক্রমে রবীন্দ্রনাথ নিজে এইসব কাজে সক্রিয়ভাবে যোগ দিতেন, গান রচনা করতেন এবং অভিনয়ে অংশগ্রহণ করতেন। সেখানকার শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রছাত্রীদের ভারতীয় কৃষ্টি ও আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে শিক্ষা দান।
প্রাচীন ভারতের তপোবনের নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও আশ্রমিক শিক্ষাদর্শের প্রতিফলন শান্তিনিকেতনের শিক্ষা ব্যবস্থায় সুস্পষ্ট। রবীন্দ্রনাথ আশ্রম চালুর শুরু থেকেই মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদানের পক্ষে কথা বলেন ও লিখিত নির্দেশ দেন। তাঁর মতে, যথার্থ শিক্ষা কেবল মাতৃভাষার মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। উপরন্তু শিক্ষাক্রমে শিল্প কাজের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। এ বিদ্যালয়ে নানারূপ কুটির শিল্প, তাঁত শিল্প, দারু শিল্প, মৃৎ শিল্প, চামড়া শিল্প, কৃষি শিল্প ও উদ্যান পরিচর্যার কাজে শিক্ষা দেওয়া হয়। সেখানে সমাজসেবা ও পল্লি উন্নয়নের কাজ প্রত্যক্ষভাবে জানতে পারে শিক্ষার্থীরা।
মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রচলিত থাকলেও অন্যান্য ভাষা শিক্ষাকে রবীন্দ্রনাথ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন। হিন্দি, উর্দু, সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত, আরবি-ফারসি প্রভৃতি ভাষা শিক্ষার কথা বলেছেন। বৃহত্তর প্রাচ্য সংস্কৃতির সঙ্গে যোগস্থাপনের জন্য তিব্বতি এবং চীনা ভাষা শিক্ষার কথা তিনি বলেছেন, সর্বোপরি ইংরেজি ভাষা আয়ত্বের কথাও। তিনি লিখেছেন- ‘আমি বাঙালি বলে আমাদের সাহিত্য রসের চর্চা কেবল বাংলা সাহিত্যের মধ্যে পরিসমাপ্তি হবে? আমি কি বিশ্ব সংসারে জন্মাইনি? আমারই জন্য জগতে যত দার্শনিক, যত কবি, যত বৈজ্ঞানিক তপস্যা করেছেন। এর যথোপলব্ধির মধ্যে কি কম গৌরব আছে।’ (শিক্ষা) প্রকৃতপক্ষে শান্তিনিকেতনের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল ঔপনিবেশিক শাসক-প্রবর্তিত প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার বিপরীত।
২.
শান্তিনিকেতনের অভিজ্ঞতার ধারায় রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনার নতুন প্রয়োগ ক্ষেত্র হলো ‘বিশ্বভারতী’। প্রাচ্য ও প্রতীচ্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক উজ্জ্বল সমন্বয় কেন্দ্র হিসেবে তিনি নির্মাণ করেন বিশ্বভারতীকে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় দুটি প্রাঙ্গনে অবস্থিত- শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন।
‘বিশ্বভারতী’র উদ্বোধনী ভাষণে রবীন্দ্রনাথের কথার সূত্র ধরে বলা যায়, বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মানুষ কীভাবে পরস্পর সহযোগিতা করে বাঁচতে পারে এই প্রতিষ্ঠান সেই কাজে নিয়োজিত। বিশ্বভারতীর জন্য যে সংবিধান তৈরি করা হয়েছে- সেখানেই পাওয়া যায় রাবীন্দ্রিক বিশ্বাত্মবোধের পরিচয়- প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সমন্বয়ই যার মূল কথা। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন বিশ্বভারতীতে পৃথিবীর সকল জ্ঞানের সমন্বয় ঘটবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা এখানে এসে লেখাপড়া করবে- বিশ্বাত্মবোধে একাত্ম হয়ে সম্মিলনী সভ্যতার মহাঅক্ষরে তারা অবগাহন করবে। বিশ্বভারতীতে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার চর্চা হয়। শিশুদের নার্সারি থেকে আন্তর্জাতিক স্তরের নানাবিধ বিষয় পঠন-পাঠন হয়ে থাকে। বিশ্বভারতীর অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম থেকেই বুঝা যাবে এ বিদ্যায়তনের জ্ঞান চর্চার বিশালতা: ক) শিশু ভবন (নার্সারি স্কুল), খ) পাঠভবন (মাধ্যমিক বিদ্যালয়), গ) শিক্ষা ভবন (উচ্চ মাধ্যমিক), ঘ) বিদ্যাভবন (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর), ঙ) বিনয়ভবন (শিক্ষক-প্রশিক্ষণ), চ) কলাভবন- (শিক্ষা ও চারুকলা), ছ) সংগীত ভবন - (সঙ্গীত ও নৃত্য), জ) শ্রীনিকেতন (পল্লি উন্নয়ন), ঝ) শিক্ষা মন্ত্র (গ্রাম-বিদ্যালয়), ঞ) শিক্ষা সদন (শিক্ষা শিক্ষণ), ট) চীনা ভবন- (চীনা, তিব্বতি, ইত্যাদি ভাষা-শিক্ষণ প্রতিষ্ঠান)। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এইসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রূপায়িত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের যুগান্তকারী শিক্ষা দর্শন।
ভারতের শিক্ষা ও কৃষির সঙ্গে পাশ্চাত্যের শিক্ষা ও বিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটিয়ে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর শিক্ষাতত্ত্ব। তিনি দেশীয় শিক্ষারীতিকে সমকালের উপযোগী করে নিয়েছেন। তেমনি নিজের ভাবনার কাছাকাছি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিদদের ভাবনাকেও শিক্ষা ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছেন। তবে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন তাঁর জীবনদর্শন দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। ‘যদিও তিনি শিক্ষাতাত্ত্বিক নন, তবু তাঁর চিন্তাধারায় মৌলিকতা রয়েছে।’(হুমায়ুন আজাদ, রবীন্দ্রপ্রবন্ধ : রাষ্ট্র ও সমাজ, পৃ ১৩৪)
পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যেকার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন হিসেবে গড়ে ওঠা ‘বিশ্বভারতী’তে গবেষক ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি, উচ্চশিক্ষা এবং বিভিন্ন গবেষণার ব্যবস্থা রয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়টির উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, প্রথম থেকেই এখানে মেয়েদের ভর্তি এবং নারীশিক্ষার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, এবং এখনও সেই ঐতিহ্য বজায় রাখা হয়েছে। ‘বিশ্বভারতী’ থেকে পিএইচডি করা জনৈক গবেষক ও সংগীত শিল্পীর মতে, ‘বিশ্বভারতীর আঙিনায় এখনো সকাল ৭টা থেকে ক্লাস শুরু হয়, চলে ধাপে ধাপে দুপুর ১ টা পর্যন্ত। এই পুরো সময়টা চারদিক থেকে ভেসে আসে গান। সেখানকার প্রকৃতি এবং পড়ালেখা, গান শেখা সব একসঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। গান শেখা বা তালিমের জন্যে প্রকৃতির সঙ্গে এমন পরিবেশ আর হয় না।’
৩.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ’ শীর্ষক প্রবন্ধে প্রাচীন ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আন্তর্জাতিক চারিত্র্য তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্বানের আসন চিরপ্রসিদ্ধ।... সমস্ত সভ্যদেশ আপন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে জ্ঞানের অবারিত আতিথ্য করে থাকে।’ তাঁর মতে, ‘বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশেষ সাধনার ক্ষেত্র। সাধারণভাবে বলা চলে সে সাধনা বিদ্যার সাধনা।’ অর্থাৎ স্বদেশ-বিদেশের সকল পণ্ডিত অভ্যাগতের জন্য দ্বার উন্মুক্ত থাকে বিদ্যা সাধনার এই প্রতিষ্ঠানে। সেই লক্ষে ১৯২১ সালে তিনি ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতা থেকে দূরে বোলপুরের সেই পরিবেশ ছিল নাগরিক জীবন থেকে ভিন্ন কিন্তু আঞ্চলিকতা মুক্ত। এজন্য ক্রমান্বয়ে দেশবিদেশ থেকে প্রচুর ছাত্রছাত্রী ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে আসেন। বিশ্বভারতীর স্বনামধন্য প্রাক্তনীদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, অস্কারবিজয়ী চিত্র-পরিচালক সত্যজিৎ রায়, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রমুখ। আগেই বলা হয়েছে, বিভিন্ন ভাষা ও বিচিত্র জাতি এবং নানা বিষয় অধ্যয়ন এবং জ্ঞান জগতের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য সেখানে স্থাপিত হয়েছে চীনা ভবন, হিন্দী ভবন, কৃষি অর্থনৈতিক গবেষণা কেন্দ্র, পল্লি শিক্ষা ভবন প্রভৃতি। বিদেশী একাধিক পণ্ডিত ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে সেখানে দীর্ঘ দিন শিক্ষকতা করেছেন। আত্মীয়করণ, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদির ঊর্দ্ধে বিশ্বভারতী ‘সমস্ত দেশের একই চিত্ত তার বিদ্যাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সৃষ্টি করে তুলেছে।’
প্রকৃতপক্ষে ১৯১৮ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠার চিন্তা বিকশিত হতে থাকে। শান্তিনিকেতনে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের বিদ্যার্থীরা শিক্ষালাভের জন্য আসতে থাকলে কবি তাদের নিয়ে উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। তিনি এসময় এন্ডরুজ ও পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লেখেন, ‘শান্তিনিকেতনকে ভারতীয়দের শিক্ষাকেন্দ্র করিয়া তুলিতে হইবে; এখানে ভারতের নানা প্রদেশের ছাত্র আসিবে এবং যথার্থ ভারতীয় শিক্ষা তাহারা গ্রহণ করিবে; বিভিন্ন প্রদেশের ছাত্ররা নিজ নিজ আচার ব্যবহার নিজেরা পালন করিতে পারিবে, একত্র শিশুকাল হইতে বাস করিয়া ছাত্ররা একটি জাতীয় আদর্শ চর্চা করিতে সক্ষম হইবে। বোলপুরের বিদ্যালয় প্রাদেশিক থাকিবে না- সাম্প্রদায়িক হইবে না।’ (প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবনী, ২য় খণ্ড, পৃ ৬১৯) তারও আগে ১৯১৬ সালে শিকাগো থেকে পুত্রকে লেখেন, শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগের সূত্র করে তুলতে হবে- ঐখানে সার্বজাতিক মনুষ্যত্ব চর্চার কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে- স্বজাতিক সংকীর্ণতার যুগ শেষ হয়ে আসছে- ভবিষ্যতের জন্যে যে বিশ্বজাতিক মহামিলন যজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে তার প্রথম আয়োজন ঐ বোলপুরের প্রান্তরেই হবে।’(তদেব) অর্থাৎ সর্বজাতি, সর্বধর্মের, সর্বভাষীদের জ্ঞানালোচনার কেন্দ্র হবে প্রতিষ্ঠানটি।
১৯১৮ সালে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ নিজগৃহে গুজরাটি ব্যবয়াসীদের একটি প্রতিনিধি দলের কাছে বিশ্বভারতীর পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে ১৯১৯ সালে কলকাতায় তিনি ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়ে বক্তৃতায় বলেছিলেন, ভারতবর্ষ একসময় নিজের মানসশক্তি দিয়ে বিশ্বসমস্যা গভীরভাবে চিন্তা করেছে এবং নিজের বুদ্ধিতে তার সমাধানের চেষ্টা পেয়েছে। সেই সময় থেকে ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থার যা কিছু নিজস্ব তাকে অবলম্বন করার কথা বারবার বলা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘মানুষের অভ্যন্তরের মানুষটিকে পরিচর্যা করে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টাই শিক্ষা।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘শিক্ষা হল, বাইরের প্রকৃতি ও অন্তঃপ্রকৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধন।’ এক কথায় পরিপূর্ণ মানবসত্তাকে লালন করে দেহ, মন ও আত্মার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে নিজেকে জাতির উপযোগী, যোগ্য, দক্ষ, সার্থক ও কল্যাণকামী সদস্য হিসেবে গড়ে তোলার নামই শিক্ষা। শিক্ষা মানব জীবনের এক মূল্যবান সম্পদ। এ সম্পদ কখনই খোয়া যায় না বা বিলুপ্ত হয় না। বেঁচে থাকার জন্য নিজেকে অভিযোজিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা অপরিহার্য। শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনার জগতটা অনেক বড়। এজন্য এখানে কেবল বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তাঁর ভাবনার কয়েকটি দিক তুলে ধরা হলো।
৪.
রবীন্দ্রনাথের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যার উদ্ভাবনা চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য কাজ বিদ্যার উৎপাদন, তার গৌণ কাজ সেই বিদ্যাকে দান করা। বিদ্যার ক্ষেত্রে সেসব মনীষীদের আহ্বান করতে হবে যাঁরা নিজের শক্তি ও সাধনা দিয়ে অনুসন্ধান, আবিষ্কার ও সৃষ্টির কাজে নিবিষ্ট আছেন। মনীষীদের একক কিংবা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জ্ঞানের উৎস উৎসারিত হবে। রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার সঙ্গে দেশের সর্বাঙ্গীণ জীবনযাত্রার যোগ চেয়েছেন। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্যই অর্থশাস্ত্র, কৃষিতত্ত্ব, স্বাস্থ্যবিদ্যা, সমস্ত ব্যবহারিক বিজ্ঞানকে নিজের প্রতিষ্ঠাস্থানের চারিদিকের পল্লির মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে; কাপড় বুনবে এবং নিজের আর্থিক সম্বললাভের জন্য সমবায় প্রণালি অবলম্বন করে ছাত্র শিক্ষক ও চারিদিকের অধিবাসীদের সঙ্গে জীবিকার যোগে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হবে। আর এরকম আদর্শ বিদ্যানিকেতনকে তিনি ১৯১৯ সালে ‘বিশ্বভারতী’ নাম দেবার প্রস্তাব করেন।
রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক ‘বিশ্বভারতী’র মহৎ আদর্শ প্রচারিত হওয়ার পর দেশ-বিদেশের পণ্ডিত ও নানা শ্রেণির লোক শান্তিনিকেতনে উপস্থিত হতে থাকেন। কবির স্বপ্ন সফল করার জন্য নিজেদের শ্রম ও মেধা দিতে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ‘বিশ্বভারতী’র হৃদস্পন্দন কম্পিত হতে থাকে ইংরেজ যুবক কৃষিবিশেষজ্ঞ লেনার্ড এলমহার্স্ট, এনড্রুজ, পিয়ার্সন এবং ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে সস্ত্রীক যোগদান করেন সিলভা লেভি। তিনি প্রাচীন ভারতের ইতিহাসকে আধুনিক মানুষের কাছে তুলে ধরেন এবং চীনা ও তিব্বতী ভাষা শিক্ষাদানের ক্লাশ খোলেন। মাদাম লেভি ফরাসি ভাষা শিক্ষা দিতে শুরু করেন। প্রাচ্যজ্ঞান জগতে সুপরিচিতদের আগমন বিশ্বভারতীকে আন্তর্জাতিক চারিত্র্য প্রদান করে। রবীন্দ্র জীবনীকার লিখেছেন, ‘শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের বিশ বৎসর এইবার পূর্ণ হইল। এই দীর্ঘকাল বিদ্যাতনের ব্যয়ের মূলাংশ কবি একাই বহন করিয়া আসিতেছিলেন, কিন্তু বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পর হইতে তাঁহার একার পক্ষে এ ভার বহন করা আর সম্ভব নহে। বিশ্বভারতীতে নানা বিষয় অধ্যয়ন-অধ্যাপনার পরিকল্পনা রহিয়াছে, বিদেশ হইতে গুণী-জ্ঞানীদের আসিবার সম্ভাবনা। কবির মনে তাঁহার ‘মিশন’ সম্বন্ধে কোনো দ্বিধা নাই; তাঁহার অন্তরের বিশ্বাস আন্তর্জাতিকতার মনোশিক্ষা না পাইলে ভাবীকালের সভ্যতা টিকিবে না।’ (প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবনী ৩য় খ-)
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় আরো জানিয়েছেন, ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে শান্তিনিকেতনের নতুন যুগের সূচনা হয়। নতুন যুগের সেই অতিথিশালায় মানুষের সঙ্গে মানুষের হার্দিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনকি শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে অধ্যাপক বিধুশেখর ভট্টাচার্য সংস্কৃত শিক্ষার প্রসারের জন্য গ্রামে ফিরে গিয়ে টোল প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হলে রবীন্দ্রনাথ পুনরায় তাঁকে ফিরিয়ে আনেন। দেশ-বিদেশের পণ্ডিতদের সম্মিলন কেন্দ্র হয়ে ওঠে ‘বিশ্বভারতী’। এক পর্যায়ে এই বিশ্বভারতী ভারতবর্ষের জিনিস হলেও সমস্ত মানবের তপস্যার ক্ষেত্র করে তোলা হয়। শিক্ষা এবং জীবনের সমবায়ে সার্বিক শিক্ষা তথা জীবনদর্শনের সূত্র রচনা করে প্রতিষ্ঠানটি। ১৯২২-২৩ সালেই ‘বিশ্বভারতী’ নানাভাবে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। বিদেশী অধ্যাপকদের বিচরণ ক্ষেত্র হয়ে ওঠে এটি।
সিলভা লেভির পর সেখানে আসেন জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও প্রাচ্যসংস্কৃতির অধ্যাপক হিনটারনিটস এবং তাঁর ছাত্র অধ্যাপক লেসনি। ইংরেজ তরুণী ও আর্ট বিশেষজ্ঞ স্টেলা ক্রামরিশ, বহুভাষাবিদ ইহুদী নারী শ্লোমিও ফ্লাউম আশ্রম বিদ্যালয়ের শিশুবিভাগের কাজে যোগদান করেন। এছাড়া ছিলেন সুইস-ফরাসি বেনোয়া, ফার্সি ও ইসলামের ইতিহাসের রুশদেশীয় পণ্ডিত বগদানফ, ভাষাতত্ত্ববিদ মার্ক কলিন্স ও রেভারেন্ড স্ট্যানলি জোনস। বিদেশী অধ্যাপক এবং গুণীদের সমাবেশ বিশ্বভারতীকে প্রথম থেকেই কর্মমুখর করে তোলে। বিবিধ ভাষা, বিচিত্র বিষয় অধ্যাপনার আয়োজনে বিকশিত হয় প্রতিষ্ঠানটি। ফ্রান্স, জার্মান, চীন থেকে অসংখ্য গ্রন্থ, পত্রিকা আসে; বিশ্বভারতী গ্রন্থাগার পূর্ণ হয়। বিচিত্র প্রায়োগিক কাজের মধ্য দিয়ে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথ যখন বিশ্বভারতীর কাজ শুরু করেন তার আগে স্থাপিত হয় মৈসুর (১৯১৬), বারাণসী হিন্দু (১৯১৬), পাটনা (১৯১৭) এবং ওসমানিয়া (১৯১৮) বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। মৈসুর বিশ্ববিদ্যালয় দেখে এসে কবির মনে হয়েছিল ঘুরে ফিরে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার বেলাতেও প্রণালি বদল করার কথা মনে আসে না, নতুনের ঢালাই করা হচ্ছে পুরানোর ছাঁচে। বিশ্ববিদ্যালয় হবে বিদ্যা সমবায়ের একটি বড় ক্ষেত্র, যেখানে বিদ্যার আদানপ্রদান ও তুলনা হবে, যেখানে ভারতীয় বিদ্যাকে মানবের সকল বিদ্যার ক্রমবিকাশের মধ্যে রেখে বিচার করতে হবে। আবার রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, সমস্ত পৃথিবীকে বাদ দিয়ে যারা ভারতকে একান্ত করে দেখে তারা ভারতকে সত্য করে দেখে না। এজন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈদিক, পৌরাণিক, বৌদ্ধ, জৈন, মুসলমান ও পার্সি বিদ্যার সমবেত চর্চার সঙ্গে সঙ্গে আনুষঙ্গিকভাবে ইউরোপীয় বিদ্যাকে স্থান দিয়েছেন। তিনি শান্তিনিকেতনে জ্ঞানের সঙ্গে রসের চর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন। বিশ্বভারতীতে জ্ঞানানুশীলনের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কলাবিদ্যাচর্চার ব্যবস্থা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করেছিলেন, ‘বিশ্বভারতী যদি প্রতিষ্ঠিত হয় তবে ভারতীয় সংগীত ও চিত্রকলা শিক্ষা তার প্রধান অঙ্গ হবে এই আমাদের সংকল্প হোক।’ শুরু থেকেই সেখানে ছাপাখানা স্থাপিত হয়। সংগীত, নৃত্যকলা ও চিত্রকলার বৃহৎ আসর বসে। কেবল রসের আঙিনা নয় জীবিকার প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেয়ায় গড়ে ওঠে কৃষি ও পল্লি উন্নয়ন সম্পৃক্ত নানা গবেষণা কেন্দ্র। ‘বিশ্বভারতী’র মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববিদ্যালয় ভাবনা বাস্তব হয়ে উঠেছিল। সেখান থেকে শতবর্ষের কাছে দাঁড়িয়ে আজ আমরা বিশ্বকবির নামে বাংলাদেশে ‘রবীন্দ্র-বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপন করতে যাচ্ছি। এজন্য আমাদের দায়-দায়িত্ব অনেক; বিদ্যায় বুদ্ধিতে জ্ঞানে দেশের যাঁরা সুধীশ্রেষ্ঠ তাঁদের দিকনির্দেশনাও গুরুত্ববহ।
৫.
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপদ্ধতি যে স্কুল-কলেজের মতো নয় সেই ধারণা রবীন্দ্রনাথ অর্জন করেছিলেন প্রাচীন ভারতের ‘নালন্দা’র মতো বিদ্যাপীঠ এবং ইউরোপ-আমেরিকার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ চক্ষে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে। এজন্য ‘বিশ্বভারতী’র মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত সাংস্কৃতিক বাতাবরণ যেমন প্রত্যাশা করেছেন তেমনি জ্ঞানচর্চার নতুন নতুন দিগন্ত নিয়ে গবেষণায় শিক্ষকদের উৎসাহ যুগিয়েছিলেন। তিনি বিদ্যার ফসল শুধু জমানো নয়, বিদ্যার ফসল ফলানোর কথা বলেছেন। একইভাবে বার্ট্রান্ড রাসেল ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ নামক প্রবন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষককে গবেষণাকার্যে নিযুক্ত থাকার কথা বলেছেন। অধ্যাপনার বিষয়ে অন্যান্য সকল দেশে কী কী গবেষণা হচ্ছে এবং কোথায় কোনো নতুন তথ্য বা জ্ঞাতব্য বিষয়ের উপর নতুন আলোকপাত হচ্ছে কিনা তা অধ্যয়ন করার যথেষ্ট অবসর থাকতে হবে।’ (বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা, পৃ ১৭) তাঁর মতে, নতুন জ্ঞান অবলম্বন করেই ক্রমোন্নতির ধারা চলছে। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত এডওয়ার্ড শিলসের ‘দি কলিং অব এডুকেশন’ গ্রন্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি সত্যসন্ধানী জ্ঞানানুরাগী শিক্ষক ও গবেষণা পৃথক ও যৌথভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে সৃজনশীলতায় সমৃদ্ধ করে বলে মন্তব্য প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, উদারপন্থী গণতান্ত্রিক সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়কে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হলে তার স্বায়ত্তশাসন একটি আবশ্যকীয় শর্ত। (তদেব, পৃ ৫৪) তিনিও গবেষণার গুরুত্বকে স্বীকার করে লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মৌল কাজ হলো জ্ঞানের চর্চা এবং জ্ঞানকে নতুনভাবে উপলব্ধি করা, বিচার করা, পরিচর্যা করা। গবেষণা তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের জন্য অবশ্যকরণীয় কাজ। হুমায়ুন আজাদ ‘স্বাধীনতা ও বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েও এক স্বতন্ত্র রাষ্ট্র।’ (নির্বাচিত প্রবন্ধ, পৃ ২৮৩) শুধু জীবিকা উপার্জনের শিক্ষা দেয়াই লক্ষ্য নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের। সংস্কারহীন, জ্ঞানচর্চা, তার সম্প্রচার ও বিচারবিবেচনার স্থান বিশ্ববিদ্যালয়।
তবে বলতে হয় বিশ্বভারতীর সাবেক উপাচার্য নিমাই সাধন বসু ‘ভগ্ননীড় বিশ্বভারতী’ গ্রন্থে দুঃখ করে লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ যে আদর্শ নিয়ে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সে আদর্শ আজ সেখানে আর ততটা সজীব নয়। তিনি নানা বৃত্তিজীবী সৃষ্টির পরিবর্তে মানুষ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম সেখানে অধ্যয়নের সময় তাঁর সেই আদর্শকে মেনে চলছে না। এমনকি নিজের কাজ নিজে করার যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তারও ব্যত্যয় ঘটেছে। নিমাই সাধন বসু সেখানকার ছাত্রীদের একটি আচরণ উল্লেখ করে লিখেছেন, তাদের আবাসস্থলের পাচক অনুপস্থিত থাকায় তারা উপাচার্যকে ঘেরাও করলে তিনি তাদের অনুরোধ করেছিলেন, প্রতিষ্ঠানের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কষ্ট করে দু’একদিন নিজেদের রান্না নিজেরা করে নিতে। তারা জবাব দিয়েছিল, ‘তরকারি কুটার জন্য আমরা বিশ্বভারতীতে আসিনি।’ রবীন্দ্রনাথের উচ্চতর শিক্ষার আদর্শ আজ আর অনুসরণ করা হচ্ছে না। বর্তমান শিক্ষার্থীরা শিক্ষার ব্যবহারিক সুবিধার দিকে তাকিয়ে থাকে। আসলে বলতে হয় শিক্ষা শেষে বৈষয়িক জীবনে সফল হওয়া যাবে সেদিকে রবীন্দ্রনাথ মনোযোগী ছিলেন না।
রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববিদ্যালয় ভাবনাকে স্মরণ রেখেই বলতে হয়, প্রতিষ্ঠা-লগ্ন থেকেই এদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ ছিল জ্ঞান সৃষ্টি করা, জ্ঞান-জগতের অভিনব উদ্ভাবনের নতুন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও গবেষণায় শিক্ষার্থীদের নিয়ত নিয়োজিত রাখা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক একাধারে জ্ঞানদান করেন, নিজে জ্ঞান সৃষ্টির জন্য আত্মনিমগ্ন থাকেন, শিক্ষার্থীর সুপ্তজ্ঞান, অভীপ্সা জাগিয়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হন, সর্বোপরি মানব কল্যাণে জ্ঞানকে ব্যবহার করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানার্জনে মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও সত্য অনুসন্ধান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় সমাপ্তির পর একজন শিক্ষার্থী কেবল একটি সনদ উপার্জনের জন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন না। বরং সংস্কারমুক্ত ও যুক্তিশীল মননের অধিকারী একজন ব্যক্তি হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের অন্যতম পুরোধাও তিনি। একারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ ও গবেষণার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মার্কেট ভ্যালুর চেয়ে সোস্যাল ভ্যালু তৈরি করা জরুরি যা রবীন্দ্র ভাবনা থেকে আমরা শিখেছি।
রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববিদ্যালয় ভাবনার সূত্র ধরে আরো বলা যায়, ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ হবে মানসম্পন্ন শিক্ষা এবং জ্ঞান সৃষ্টি ও প্রসারের কেন্দ্রস্থল। আমাদের দেশে রাজনীতির নামে বিবদমান ছাত্র-গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ও রক্তপাতের কারণে সৃষ্ট নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমকে চরমভাবে বিঘ্নিত করেছে; যা অনভিপ্রেত। ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা করতে। দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করে তাদের মেধা, মনন বিকাশের দ্বার রুদ্ধ করা হয়েছে। দলীয় লেজুড়বৃত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত করে একদিকে যেমন ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা জীবন বিনষ্ট হচ্ছে, তেমনি সৎ, যোগ্য ও দক্ষ মানবসম্পদ এবং নেতৃত্ব গড়ে না উঠার ফলে দেশ ও জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে’ ছাত্র রাজনীতির নামে দলীয় লেজুড়বৃত্তি থাকবে না বলেই আমরা মনে করি।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হবে সবার জন্য উন্মুক্ত। সেখানে সকল দলের ও মতাদর্শের সমন্বয় সাধন হবে। স্বাধীনভাবে সকলের মতামত প্রকাশের অধিকার থাকবে। ছাত্র-ছাত্রীরা হবে যুক্তিবাদী। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীরাই নিরেট সত্য প্রতিষ্ঠা করবে— তবেই শিক্ষাঙ্গণ হয়ে উঠবে সঠিক জ্ঞান চর্চার কেন্দ্রস্থল। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে আধুনিক জ্ঞান অনুসন্ধান, জ্ঞানের চর্চা ও জ্ঞানের আদান-প্রদানের তীর্থস্থান। বিশ্ববিদ্যালয়ে একজনের মতাদর্শ আরেকজনের ওপর চাপিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। অযথা জোরপূর্বক কাউকে দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে অংশগ্রহণে বাধ্য করারও অবকাশ নেই।
৬.
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “ওখান থেকে ডিজিজ তৈরি হয়, ডক্টর না। ওখান থেকে উৎপন্ন হয় বৈদ্য নয় ব্যাধি, যে যতো উচ্চ পদস্থ বৈদ্য সে ততো দুরারোগ্য ব্যাধি।” আহমদ ছফা ‘গাভী বিত্তান্ত’ নামক আখ্যানে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের উপাচার্যের জীবন বর্ণনা করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় নামক বিশেষ স্থানের কিছু অপ্রিয় সত্য আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। একইভাবে মুহাম্মদ জাফর ইকবালও লিখেছেন- ‘মহব্বত আলীর একদিন’ শিরোনামে অপর একটি কাহিনি। বর্তমানে ছাত্রছাত্রীদের মুখ্য উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন নয়, ডিগ্রি অর্জন। ভালো চাকরি অর্থাৎ বেশি বেতনের এবং ক্ষমতার চাকরি তাদের কাঙ্ক্ষিত, সেটা যে প্রতিষ্ঠানেই হোক না কেন। এখানে নৈতিকতার প্রশ্ন করা বাতুলতা মাত্র। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে প্রকৃত শিক্ষক তারা যারা জ্ঞানী, সৎ, দায়িত্বশীল এবং দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ। এরা গবেষণা করেন মানুষের জন্য, বই লিখেন মানুষের জন্য, এরা জাগতিক লোভের কাছে বিক্রি হয়ে যান না। শত ব্যস্ততা থাকলেও এরা ইচ্ছাকৃত ভাবে কখনো ক্লাস ফাঁকি দেন না। ছাত্র-ছাত্রীদের শুধু পড়াশুনাই তাদের লক্ষ নয়, তাদেরকে মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্যও তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। লোভকে অস্বীকার করে নীরবে নিভৃতে স্বেচ্ছাকৃত দারিদ্র্য নিয়ে এরা জীবন-যাপন করেন। অথচ বাংলাদেশে ১৯৭৩’ এর অধ্যাদেশ বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ঐশ্বরিক ক্ষমতা উপভোগ করেন। তারা শুধু আদেশ করেন। আর ছাত্রছাত্রীদের কর্তব্য হচ্ছে সেই আদেশ পালন করা, প্রশ্ন না করা, শিক্ষকের বাণী শুনে ধন্য হওয়া এবং ভয় করা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা যেখানে হবে জ্ঞানের আদান-প্রদানের মাধ্যমে সেখানে শিক্ষকেরা শুধু বিতরণ করতেই পছন্দ করেন। কোনো ছাত্র প্রশ্ন করলে কিংবা যোগ্যতাবলে জ্ঞানের স্রোতকে উল্টো দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করলে সে হয়ে যায় ‘বেয়াদব’। অথচ রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী থেকে সর্বগুণান্বিত ব্যক্তিকে চেয়েছিলেন। ‘সুষমাস্থাপক’ মানুষ সৃষ্টি করা তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল। এজন্য ১৯৩৬ সালে বিশ্বভারতী স্থাপনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে লিখেছেন, ‘I have felt that the civilization of the west to-day has its law and order, but no personality. It has come to the perfection of a mechanical order but what is there to humanize it? It is the person who is in the heart of all beings. (উদ্ধৃতি, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবনী ৪র্থ খণ্ড)
৭.
রবীন্দ্র-ভাবনা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের যাবতীয় জ্ঞান ভাণ্ডারের রক্ষক। কেবল রক্ষক নয় বরং সেই জ্ঞানকে সাধনার মাধ্যমে, বোধশক্তি ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে বৃদ্ধি করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে উপস্থিত করার দায়িত্বও বিশ্ববিদ্যালয়ের। সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা এবং তাদের মধ্যে সুস্থ মানসিকতা ও উচ্চ মানসম্পন্ন মনন সৃষ্টি করাও বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব। মুক্তচিন্তার চর্চা, নিরাসক্তভাবে সত্যের অনুসন্ধানের মাধ্যমে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলাও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তব্য। এসব লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে ‘রবীন্দ্র ভাবনার বিশ্ববিদ্যালয়’কে অনুসরণ করে প্রথম শ্রেণির বিদ্যাপীঠ সৃষ্টি করতে হবে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো সৃজনশীলতার সূতিকাগার। নতুন জ্ঞান সৃষ্টির প্রচেষ্টা, নতুন চিন্তা ও আবিষ্কার সমাজকে এগিয়ে নেয় এ ভাবনা আমাদের অস্থি-মজ্জায় লালন করা দরকার।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
রবীন্দ্রজীবনী ২য়, ৩য় ও ৪র্থ খণ্ড, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা, ১৩৪০
রবীন্দ্রনাথ, এই সময়ে, সম্পাদনা : আনিসুজ্জামান, প্রথমা, ২০১২
রবীন্দ্রপ্রবন্ধ : রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা, হুমায়ুন আজাদ, আগামী, ২০১২
বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা, সম্পাদনা : রতনতনু ঘোষ, অবসর, ২০১১
রবীন্দ্রনাথের ভাষা সাহিত্য ও শিক্ষা চিন্তা, ড. সফিউদ্দিন আহমদ, বিশ্ব সাহিত্য ভবন, ১৯৯৯
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-
ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ, (রচনাবলি, দ্বিতীয় খণ্ড, বিশ্বভারতী, ১৪১৫)
য়ুনিভার্সিটি বিল, (রচনাবলি, দ্বিতীয় খণ্ড, বিশ্বভারতী, ১৪১৫)
শিক্ষা (রচনাবলি, চতুর্দশ খণ্ড, বিশ্বভারতী, ১৪১৫)
আশ্রমের রূপ ও বিকাশ (রচনাবলি, ষষ্ঠ খণ্ড, বিশ্বভারতী, ১৪১৫)
বিশ্বভারতী (রচনাবলি, চতুর্দশ খণ্ড, বিশ্বভারতী, ১৪১৫)
শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম (রচনাবলি, চতুর্দশ খণ্ড, বিশ্বভারতী, ১৪১৫)