নজরুলের পত্রাবলি
হৃদ্য ও অন্তঃপাতী মনের দীর্ঘশ্বাস
১৯২৮ সালের ১০ মার্চ কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘প্রিয় মোতিহার’কে লিখেছেন- ‘. . . কাল আমার চিঠি পোস্ট করার একটু পরেই তোমার চিঠি এসে পঁহুচল। আমার চিঠি বোধ হয়, আজ সন্ধ্যায় পেয়েছ। না? আচ্ছা, তোমরা কলকাতার চিঠি কখন পাও, সকালে না সন্ধ্যায়? মনে করে লিখো কিন্তু। তাহলে আমি চিঠি দিয়ে তার পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় বসে বসে ভাবব যে এতক্ষণ তুমি আমার চিঠি পড়ছ। আচ্ছা ভাই, আমার সব চিঠিই কি তোমার বোনকে দেখাও? বড্ডো জানতে ইচ্ছে করছে। চিঠিগুলো আবার ফিরিয়ে নাও তো?’ কলকাতা থেকে ঢাকার কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখা চিঠিতে উদ্দিষ্ট ‘মোতিহারে’র বোন হচ্ছেন ফজিলতুন্নেসা, কবির গোপন প্রণয়ের নায়িকা। কিন্তু লক্ষণীয়, এখানে প্রকাশ পেয়েছে নজরুলের যোগাযোগের গুরুত্ব ও তাৎপর্য, চিঠিকে কেন্দ্র করে তাঁর উৎকণ্ঠা, উৎসাহ, আকুতি সবই।
একইভাবে দুই ব্যক্তির এই পত্রালাপের সঙ্গে তৃতীয় ব্যক্তির সম্পৃক্ততা স্পষ্ট করা হয়েছে। সাধারণভাবে ‘পত্র’ বা ‘চিঠি’কে একজনের থেকে অপরের কাছে প্রেরিত কেবল লিখিত সংবাদ হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু অনেক আগেই যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে পত্রের ধরন পাল্টে গেছে। ঐতিহাসিকভাবে দুই ব্যক্তির মাঝে কাগজে লিখিত পত্রের আদান-প্রদান বিভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন। বর্তমান যুগে প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রগতিতে ‘পোস্টেড লেটার’ তার গুরুত্ব হারিয়েছে। ফ্যাক্স এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে ই-মেলে বার্তা প্রেরণ এর অন্যতম কারণ। প্রাচীন ভারত, মিসর, রোম, গ্রিস এবং চীনে পত্রের মাধ্যমে যোগাযোগের অনেক নিদর্শন পাওয়া যায়। পবিত্র বাইবেলের অনেক অংশ পত্রাবলি হিসেবে উপস্থাপিত। বর্তমান শতাব্দীতে অনেকের ব্যক্তিগত পত্রকে সৃজনশীল কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। আগেই বলা হয়েছে, হস্তাক্ষরের জায়গা যদিও দখল করেছে ই-মেইল তবু মানুষ পত্র লিখতে পছন্দ করেন। ব্যক্তিক-অনুভূতিমাখা পত্রে থাকে হৃদয়ের গভীর উপলব্ধি, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, আনন্দ-আকুলতা। হৃদয়ের উষ্ণতা মাখানো সেসবের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে পত্র লেখকের ইচ্ছা-অনিচ্ছার অগাধ অনুভূতি।
কম্পিউটার ও ই-মেইলের যুগেও হাতের লেখা পত্রকে মানুষকে ধন্যবাদ কিংবা সান্ত্বনা জানানোর শ্রেষ্ঠ উপায় ভাবা হয়। এজন্যই বলা হয়ে থাকে- "Good letter writing feels much like good conversation, and it has the same power to nourish a relationship." হাতের লেখা পত্রে যেহেতু সংশোধনের অবকাশ দেখা যায় না সেজন্য ব্যক্তির চিন্তার ছাপ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ পায়। মূলত পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া নয় বরং শক্তিশালী সম্পর্কের বুনিয়াদ হলো পত্র। পত্র লেখক ও পাঠক উভয়ের মধ্যে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে; যা যুগ ও ইতিহাসের অনিবার্য উপকরণে পরিণত হয়। পারস্পরিক ভাবনার আদান-প্রদান থেকে সৃষ্টি হয় সৌহার্দ্য, প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ। ব্যক্তির আশা-অকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-কল্পনা আত্মপ্রকাশ করে পত্রের মধ্য দিয়ে। খুব বেশি ব্যক্তিগত পত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এর অতি নিকটত্বতা। পত্র লেখা এক ধরনের আবিষ্কার, জীবনের অনেক গোপন প্রান্তের কথা উচ্চারিত হয় এতে।
কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যচর্চার দশকগুলোতে(১৯২০-৪২) কিংবা তারও আগে থেকেই বিখ্যাত কবিদের ব্যক্তিগত পত্রগুলো উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হিসেবে প্রকাশিত হতে শুরু করে। ইংরেজ কবি জন কিটসের পত্রাবলি প্রকৃতপক্ষে ছিল ব্যক্তিগত; কিন্তু বর্তমানে সেগুলো সাহিত্যতত্ত্বের অন্যতম নিদর্শন। প্রাচীনকাল থেকে পত্রের আঙ্গিকে সাহিত্যের নানা অনুষঙ্গ ব্যক্ত হওয়ার প্রধান দৃষ্টান্ত রয়েছে হোরেসের ‘আর্স পোয়েটিকা’য়। নজরুলের পত্রে বর্ণিত হয়েছে জীবনের নানা দিক। তিনি বিদ্রোহ ও প্রেমের কবি, সর্বহারা মানুষের কবিও। তাঁর বাল্যকাল, স্বকাল, বাংলাদেশ ও ভারতের ভূগোল সবই তাঁর পত্রের পরতে পরতে উচ্চকিত। তিনি পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন- ‘. . . চুরুলিয়ার লেটুর দলের গান লিখিয়ে ছোকরা নজরুলকে কে-ই বা এক কানাকড়ি দাম দিয়েছে। স্কুল-পালানো মাট্রিক পাশ-না করা পল্টন-ফেরত বাঙালি ছেলে কী নিয়েই-বা সমাজে প্রতিষ্ঠার আশা করবে। আমার একমাত্র ভরসা মানুষের হৃদয়।’(১৯২০)
মানুষের হৃদয়ের খুব কাছে ছিলেন নজরুল। কারণ তিনি মানুষের মঙ্গল, কল্যাণ ও সকল শুভ’র প্রতি ছিলেন নিবেদিত। তিনি ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে, অত্যাচারী দেশীয় শাসকদের প্রতিপক্ষে নিজেকে দাঁড় করিয়েছিলেন। তাঁর সাহিত্যে নির্ভীক কবি, অনলবর্ষী বাগ্মী ও প্রেমিক পুরুষের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত পত্রে তিনি লিখেছেন- ‘. . . তবু আমি মানুষকে শ্রদ্ধা করি—ভালোবাসি। স্ররষ্টাকে আমি দেখিনি, কিন্তু মানুষকে দেখেছি। এই ধূলিমাখা পাপলিপ্ত অসহায় দুঃখী মানুষই একদিন বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত করবে, চিররহস্যের অবগুণ্ঠন মোচন করবে, এই ধুলোর নিচে স্বর্গ টেনে আনবে, এ আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি।’
এই পত্রেই তিনি তৎকালীন মুসলমান সমাজ কর্তৃক তাঁকে কাফের আখ্যা দেওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে নিজের যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। একইসঙ্গে হিন্দু সমাজের ঈর্ষাপরায়ণ ব্যক্তি কর্তৃক তাঁর নামে কুৎসা রটনার কথা বলেছেন। মূলত তিনি দেশের সত্যিকার প্রাণ তরুণ সমাজের ওপর তাঁর নির্ভরশীলতার কথা ব্যক্ত করেছেন। কারণ তাঁর মতে, তরুণদের কোনো জাত নেই, তারা সকল জাতির। কবির অসাম্প্রদায়িক চেতনা তীব্র ছিল বলেই তিনি আলোচ্য পত্রে আরো লিখেছেন- ‘ইসলাম কেন, কোনো ধর্মেরই শাস্ত্র নিয়ে কাব্য লেখা চলে বলে বিশ্বাস করি না। ইসলামের সত্যকার প্রাণশক্তি; গণশক্তি, গণতন্ত্রবাদ, সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ব ও সমানাধিকারবাদ।’ অবশ্য তিনি ইসলামকে কেন্দ্র করে অনেক কবিতা-গান লিখেছেন কিন্তু সেগুলোতে কাব্যকে ছাপিয়ে ধর্ম বড় হয়ে ওঠেনি। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যেও তিনি কাব্য রচনা করেননি।
‘নার্গিস’ নজরুলের সাহিত্য ও সংগীত জীবনের অনেকটা স্থান দখল করে আছেন। কিন্তু নার্গিস আসার খানম যাঁর প্রকৃত নাম সৈয়দ খাতুন তাঁকে নজরুল একটি মাত্র পত্র লিখেছিলেন। ১৩২৮-এর ৩ আষাঢ় নজরুলের সঙ্গে এই নারীর আকদ সম্পন্ন হয়। কিন্তু সেই বিয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। নার্গিসকে লেখা পত্রের আগেই নজরুলের এই বিয়ের প্রসঙ্গ পাওয়া যায় ১৯২১ সালের ২৩ জুনে নার্গিসের মামা আলী আকবর খানকে লেখা এক পত্রে। কুমিল্লার দৌলতপুরের অধিবাসী আলী আকবর খানের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় কলকাতায়। ঢাকায় ‘ভারতী লাইব্রেরি’ নামে তাঁর একটি প্রকাশনা সংস্থা ছিল। নার্গিসের এই মামার উদ্যোগে নজরুলের সঙ্গে বিবাহের বন্দোবস্ত হয়। নার্গিসের পিতৃগৃহ ছেড়ে কুমিল্লায় এসে এই মামা শ্বশুরকে ‘বাবা শ্বশুর’ বলে সম্বোধন করে কবি লেখেন- ‘আমি সাধ করে পথের ভিখারি সেজেছি বলে লোকের পদাঘাত সইবার মতন ‘ক্ষুদ্র-আত্মা’ অমানুষ হয়ে যাইনি। আপনজনের কাছ হতে পাওয়া অপ্রত্যাশিত এত হীন ঘৃণা, অবহেলা আমার বুক ভেঙে দিয়েছে। বাবা! আমি মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি।’ নজরুলের আত্মমর্যাদায় আঘাত করা মানুষকে তিনি ক্ষমা করেছেন কিন্তু আলী আকবর খানের ছাপানো বিবাহ সংক্রান্ত নিমন্ত্রণ পত্রকে কেন্দ্র করে বন্ধু ও কলকাতার সুধী সমাজে আলোড়নের জবাবও দিয়েছেন কবি সাপ্তাহিক ‘বিজলী’র ২২ জুলাই ১৯২১ সংখ্যায় ‘কবিবরের প্রতিবাদ’ শিরোনামের পত্রে।
কবি কয়েক ঘণ্টার জন্য ‘বর’ সেজেছিলেন; সে উপলক্ষে নিমন্ত্রণ পত্র ছাপিয়ে পাঠানো হয়েছিল কবি বন্ধুদের কাছে। অথচ বিষয়টির সঙ্গে কবির সংশ্লিষ্টতা ছিল না। কবির আত্মপক্ষ সমর্থনে এই পত্র প্রকাশিত হলে অনেকেরই বিষয়টি পরিষ্কার হয়। ১৯২৪-এর ২৪ এপ্রিল নজরুল প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করেন। অন্যদিকে বিচ্ছেদের ১৫ বছর পর নার্গিস নজরুলকে নানা অভিযোগ এবং এমনকি ঢাকায় নজরুল মানুষের হাতে লাঞ্চিত হতে পারেন, এ ভয়ে সেখানে যেতে পারেন না প্রভৃতি আপত্তিকর কথা উল্লেখ করে একটি চিঠি লিখলে তার উত্তরে পহেলা জুলাই ১৯৩৭ সালে তাঁকে কবি তাঁর প্রথম ও শেষ চিঠিটি লেখেন। এই পত্রের সূচনায় কবি সেই ১৫ বছর আগের স্মৃতি স্মরণ করেছেন। নার্গিসের চিঠি পেয়ে সেদিনের প্রকৃতির পেলবতা, ধারাপাত, বর্ষণসিক্ত মুহূর্তগুলো আবেগায়িত করেছে তাঁকে। নার্গিসের জন্য কবির হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল; অসীম বেদনা বহন করে কাটাতে হয়েছে দিনের পর দিন। বেদনার আগুনে তিনি নিজে দগ্ধ হয়েছেন। সেই দাহ নার্গিসকে স্পর্শ করতে দেননি। নার্গিসের মতো রূপবতী, বিত্তশালিনী, গুণবতীর পাণিপ্রার্থী অনেকেই হবে স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি কবিকে সময়ের প্রবহমানতায় মুক্তি দিয়েছে তাঁর অধিকার থেকে। তবু ১৫ বছর আগেকার করুণ মিনতি, আর কিশোরী নার্গিসের জন্য প্রাণের আকুতি পত্রটির বস্তুনিষ্ঠ তথ্যাবলিকে অতিক্রম করে কাব্য মাধুর্যে পরিপ্লুত হয়েছে। সূচনাংশটি স্মরণীয়- ‘তোমার পত্র পেয়েছি—সেদিন নববর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে। মেঘ-মেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝরছিল। ১৫ বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি বারিধারার প্লাবন নেমেছিল—তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পার। আষাঢ়ের নব মেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার। এই মেঘদূত বিরহী যক্ষের বাণী বহন করে নিয়ে গিয়েছিলো কালিদাসের যুগে, রেবা নদীর তীরে, মালবিকার দেশে তাঁর প্রিয়ার কাছে। এই মেঘপুঞ্জের আশীর্বাণী আমার জীবনে এসে দেয় চরম বেদনার সঞ্চয়। এই আষাঢ় আমার কল্পনার স্বর্গলোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্তস্রোতে। যাক, তোমার অনুযোগের অভিযোগের উত্তর দিই।’
উল্লেখ্য, নজরুলের স্ত্রী প্রমীলা দেবীকে লেখা কোনো পত্র ‘নজরুল-রচনাবলি’ কিংবা পত্রের সংকলনে অনুপস্থিত। অর্থাৎ স্ত্রীকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিগত অনুভূতি, প্রকৃতির বাঙ্ময় রূপ আর অনাবিল আত্ম-উন্মোচনের প্রকাশ ঘটনাতে দেখা যায়নি তাঁকে। আবার সরাসরি কোনো নারীকে কেন্দ্র বা উপলক্ষ করে প্রেম ও প্রকৃতিময় পত্র দুর্লভ। যদিও প্রকৃতির মহিমা অনেক পত্রের বিভিন্ন জায়গায় উন্মোচিত হয়েছে। তবে নজরুল-বন্ধু প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও বিজ্ঞানী কাজী মোতাহার হোসেনকে লিখিত পত্রে মিস ফজিলতুন্নেসার প্রতি বিবাহিত নজরুলের অনুরাগ ও আসক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। ফজিলতুন্নেসা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অঙ্কশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান পাওয়া প্রথম মুসলিম নারী। তিনি স্কলারশিপ নিয়ে বিলাতেও গমন করেন। তাঁর বিলাত গমন উপলক্ষে ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সংবর্ধনা দেন। সে সংবর্ধনা সভায় নজরুল স্বরচিত গান গেয়ে শোনান। ‘শিখা’ গোষ্ঠীর ও মুক্তবুদ্ধি আন্দোলনের অন্যতম সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যানের অধ্যক্ষ কাজী মোতাহারকে নজরুল ‘মোতিহার’, ‘বন্ধু’ সম্বোধন করে একাধিক পত্র লিখেছেন।
১৯২৮ থেকে ১৯২৯ সালে রচিত ও প্রেরিত পত্রে নজরুল নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। কবির গোপন প্রেমের সাক্ষ্য এই পত্রগুলো নজরুলের জীবনী লেখকদের জন্য অসামান্য উপকরণ। গোপন প্রেমে অস্থির নজরুলের পত্রের একটি অংশ- ‘আমার কোনো কিছু ভালো লাগে না আর। এত আড্ডা গান—কিছুতেই মনকে ডুবাতে পারছিনে। এ কোথায় শেষ—কে জানে? কেবলি বিস্বাদ ঠেকছে—আলো বাতাস, হাসি-গান। সব, কী যে হবে কী যে করব—আমি জানিনে।’
কাজী নজরুল ইসলাম ডায়েরি কিংবা দিনপঞ্জি রচনা করেননি। কিন্তু তাঁর পত্রগুলোই সেই অভাব পূরণ করেছে। তিনি তাঁর দুঃখ বেদনার কথা অকপটে বলেছেন নিকটতম বন্ধুকে, আর সেসব কবি-সাহিত্যিককে যাঁরা তাঁর আপনজন ছিলেন। যদিও তিনি তাঁর ব্যক্তিগত দুঃখ বেদনা, যন্ত্রণার কথা কবিতা-সংগীতে প্রকাশ করতে পছন্দ করতেন তবু হৃদ্য ও অন্তঃপাতী মনের দীর্ঘশ্বাস এবং পরিপূর্ণ আলোক ছটার দীপ্তি দেখা যায় পত্রাবলিতে। ১৯২৬ সালে কবির প্রতি শ্রদ্ধান্বিত এবং তাঁর স্নেহধন্যা বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদকে লেখা একটি দীর্ঘ পত্র ‘বুলবুল’ পত্রিকায় ১৩৪৩ সালে ‘চিঠি’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। সেখানে কবি লিখেছিলেন- ‘আমার জীবনের ছোট-খাট কথা জানতে চেয়েছ। বড় মুশকিল কথা ভাই। আমার জীবনের যে বেদনা, যে রং তা আমার লেখায় পাবে। অবশ্য লেখার ঘটনাগুলো আমার জীবনের নয়, লেখার রহস্যটুকু আমার, ওর বেদনাটুকু আমার। ঐখানেই তো আমার সত্যিকার জীবনী লেখা রয়ে গেল। জীবনের ঘটনা দিয়ে কৌতুক অনুভব করতে পারো। কিন্তু তা দিয়ে আমাকে চিনতে পারবে না।’ কবির এই মন্তব্যকে আমরা তাঁর পত্রাবলি পাঠের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করতে পারি। কারণ তাঁর জীবনের রহস্যময়তা, বেদনা ও গোপন ঘটনার অনেক কিছুই পত্রাবলিতে প্রকাশিত হয়েছে।