নিবেদিত প্রাণ এক সাহিত্যিকের কথা
কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক মোস্তফা কামালের আজ (৩০ মে) জন্মদিন। তিনি প্রায় শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা। সাংবাদিকতা পেশার ব্যস্ততার মধ্যে যাঁরা সৃষ্টিশীল কাজের ধারা বজায় রাখতে পেরেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মোস্তফা কামাল। প্রতিবছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তাঁর একাধিক বই প্রকাশিত হয়। তিনি দুই দশক ধরে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, সায়েন্স ফিকশন, টিভি নাটক এবং শিশু-কিশোর উপযোগী রচনার নিয়মিত লেখক। কলামিস্ট হিসেবেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে তাঁর।
চলতি বছর (২০১৭) বইমেলায় প্রকাশিত তাঁর ‘অগ্নিকন্যা’ একটি নতুন ধরনের উপন্যাস। নানা ধরনের কিশোর উপন্যাস লিখে মোস্তফা কামাল এরইমধ্যে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছেন। এ ধরনের একটি গ্রন্থ ‘ডাকাতের কবলে ফটকুমামা’। মোস্তফা কামালের রঙ্গব্যঙ্গ সিরিজ বেশ জনপ্রিয়। এ বছর প্রকাশিত হয়েছে ‘পাগলছাগল ও গাধাসমগ্র-১১’। আর সায়েন্স ফিকশন ‘বিমান রহস্য’ এবং ‘হাসির চার উপন্যাস’ সংকলন দুটিও দৃষ্টিনন্দন। এ ছাড়া কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে ৬টি সায়েন্স ফিকশন ও ৫টি গোয়েন্দা উপন্যাসের সংকলন নিয়ে মোস্তফা কামালের আরো দুটি গ্রন্থ।
২.
এ বছর(২০১৭) প্রকাশিত ‘অগ্নিকন্যা’ ব্যতিক্রমী সৃষ্টি। নামকরণ দেখে মনে হতে পারে উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন নারী। কিন্তু ঔপন্যাসিক এখানে ১৯৪৭ থেকে ছেষট্টি সালের রাজনৈতিক ইতিহাসের সময়কে তুলে ধরেছেন। যে কালকে তিনি ‘অগ্নিকন্যা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। যে সময় রাজনীতি পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তাদের দমন-পীড়ন সত্ত্বেও বাঙালির প্রতিবাদ থেমে থাকেনি। এই প্রতিবাদ রূপায়ণ করার জন্য লেখক ইতিহাসের নায়কদের হাজির করেছেন আখ্যানের ভেতর। আবার সেই ইতিহাসের নায়কদের সামাজিক মানুষ করে তোলার কৃতিত্বও তাঁর।
‘অগ্নিকন্যা’য় উপস্থাপিত ঘটনাবলি ইতিহাসের উপকরণ। অবশ্য ইতিহাসের ঘটনার সত্যের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে এ উপন্যাস। মহৎ লেখকরা তাঁদের রচনায় ইতিহাসকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণ করেন। মূলত ঐতিহাসিক সময়ের মানুষকে তাঁদের যুগোপযোগী চিন্তাচেতনায় অভিষিক্ত করে সৃষ্টি হয় ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’। ঐতিহাসিক সময়কালকে উপন্যাসের ঘটনার কাল হিসেবে বিবেচনা করে কাহিনী বুননে পরিশ্রম ও মেধার পরিচয় দেন কেউ কেউ। বঙ্গবন্ধুর মতো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের ঘটনাক্রমকে অনুপুঙ্খ ধরেছেন এই ঔপন্যাসিক। এসব ক্ষেত্রে জাতির পিতার সঙ্গে অন্যান্য ঐতিহাসিক চরিত্রকে পূর্ণাঙ্গভাবে রূপায়ণের প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়।
অর্থাৎ মোস্তফা কামাল ইতিহাসের একটি সময়কালকে পটভূমি হিসেবে বেছে নিয়ে সেই সময়ের মানুষকে চিত্রিত করেছেন। অনেকেই ইতিহাসের পটভূমিতে নির্মিত গল্প-কাঠামোর মানুষের ভেতর দিয়ে বর্তমানের আকাঙ্ক্ষা ও মননকে চিত্রিত করেন। ঐতিহাসিক সময় ইতিহাসের পুঙ্খানুপুঙ্খতা ভেঙে বেড়িয়ে আসে। বাংলা সাহিত্যে লিখিত ইতিহাসের অবিকৃত সময়কে নিয়েও উপন্যাস রচনার প্রচেষ্টা রয়েছে। মূলত ইতিহাসের ঘটনা আশ্রয় করে ‘অগ্নিকন্যা’ উপন্যাস রচিত হওয়ায় একটি কালের সামগ্রিক পরিচয় পাওয়া যায়। আবার সেখানে রাজনীতি সম্পৃক্ততায় নেতা এবং জনগণ উপস্থাপিত হয়েছে। তা ছাড়া ইতিহাসের সংস্রব উপন্যাসে একটা বিশেষ রস সঞ্চার করে, ইতিহাসের সেই রসটুকুর প্রতি ঔপন্যাসিকের অনুরাগ থাকে, সেই সত্যের প্রতি তাঁর কোনো খাতির নেই। কেউ যদি উপন্যাসের সেই বিশেষ গন্ধটুকু এবং স্বাদটুকুতে সন্তুষ্ট না হয়ে তা থেকে অখণ্ড ইতিহাস উদ্ধারে প্রবৃত্ত হন তবে তিনি ব্যর্থ হতে পারেন। তবে মোস্তফা কামাল একটি কালপর্বের অনেক কিছু তুলে ধরেছেন যার ভেতর নতুনত্ব আছে।
বিশেষত মোস্তফা কামাল বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে উপকরণ নিয়ে ঘটনা সাজিয়েছেন কিন্তু সেখানে শেখ মুজিবকে আমরা নতুন করে খুঁজে পাই। দেখতে পাই পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র আর বাঙালি নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের ভেতর তিনি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হচ্ছেন নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমে, তৃণমূল সংলগ্নতায়। অন্যদিকে এ উপন্যাসের সূচনায় মতিয়া চৌধুরীর বাল্যকাল দিয়ে শুরু হয়েছে এবং ১৯৬৬ সালে যখন কাহিনীর গতি পরিণতির দিকে ধাবিত তখন তাকে আমরা রাজপথের সক্রিয় কর্মী হিসেবে দেখতে পাচ্ছি। এই চরিত্রটিকে সামাজিক করে তোলার পুরো কৃতিত্ব মোস্তফা কামালের। কারণ পুলিশ অফিসারের কন্যা মতিয়া বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে সক্রিয় হওয়ায় পাকিস্তানি শাসকরা উদ্বিগ্ন হয়। সংকট তৈরি হয় মহিউদ্দিন-নূরজাহান বেগমের সংসারে। কিন্তু হঠাৎ সাংবাদিক বজলুর রহমানকে বিয়ে করে চমকে দেন মতিয়া। প্রকৃত অভিভাবক স্বামী হওয়ায় দমে যায় শাসকগোষ্ঠী। অর্থাৎ নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করে কাহিনীর ভিন্ন ভিন্ন গতিমুখ নির্দেশ করেছেন ঔপন্যাসিক।
‘অগ্নিকন্যা’ উপন্যাসে ইতিহাসের প্রসঙ্গ বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। ইতিহাসকে উপজীব্য করায় উপন্যাসে সেই সময়ের উল্লেখযোগ্য সব নেতাকে কাহিনীর ভেতর সক্রিয় থাকতে দেখা যায়। শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, বঙ্গবন্ধু যেমন তেমনি জিন্নাহ থেকে শুরু করে বাঙালির শত্রু সকল পাকিস্তানি চরিত্র আখ্যানে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে মিডিয়ার যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তারও বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে এই উপন্যাসে। আবার ইতিহাসের কাহিনী ও চরিত্রকে অবলম্বন করা হয়েছে বলেই অতীতচারী কল্পনা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্তর্লোকে উঁকি দিয়ে একটি বিশেষ যুগ বিশেষত দেশভাগের পর থেকে উত্তাল ঘটনার দিকে মনোযোগী হয়েছেন ঔপন্যাসিক। মুখ্য চরিত্রগুলোকে কেন্দ্র করে অন্য ব্যক্তিত্বের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, আশা-নিরাশার প্রতিফলন ঘটেছে লেখকের নিজের অভিব্যক্তিতে। অবশ্য লেখক অতীতের রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার-সংস্কার, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি সব বিষয়ে সচেতন ছিলেন। আবার তাঁকে ঐতিহাসিক বাস্তবতা প্রকাশে নির্লিপ্ত থাকতে হয়েছে।
বস্তুত ইতিহাসাশ্রিত চরিত্রগুলোকে প্রাণবন্ত ও জীবন্ত করার জন্য ‘অগ্নিকন্যা’য় একটি জীবনভাবনা বা বার্তা প্রদান করেছেন মোস্তফা কামাল। বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও লড়াই কেবল পাকিস্তানিদের সঙ্গে ছিল না, তা ছিল নিজেদের ভেতরও। এ কারণে লেখককে ইতিহাসের বিশাল পটভূমিতে আবর্তিত বিভিন্ন চরিত্রের জীবনের উত্থান ও পতন ব্যক্ত করার জন্য সামাজিক-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং আবেগ-আলোড়ন তুলে ধরতে হয়েছে। কাহিনী ও চরিত্রকে মানবিক করে তোলার জন্য যা অবশ্যস্বীকার্য একটি বিষয়। এ উপন্যাসে বঙ্গবন্ধু ব্যক্তি চরিত্রের আবরণ খুলে মহাকালের অঙ্গীভূত হয়ে উঠেছেন। স্থান ও কালের সীমা অতিক্রম করে বিশ্বজনীন ব্যঞ্জনায় এর উপসংহার উপস্থাপিত। ভাষার ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিক যথেষ্ট মনোযোগী। কাব্যিক, গম্ভীর, সাবলিল গদ্যশৈলীর অনুসরণ রয়েছে এ উপন্যাসে। ভাষার মধ্য দিয়েই বিশেষ দেশকাল পরিপ্রেক্ষিত ছাড়িয়ে কল্পনার আবিশ্ব স্পন্দিত বিস্তার ঘটেছে ‘অগ্নিকন্যা’র।
৩.
মোস্তফা কামালের ‘জননী’ উপন্যাসটি ইতিমধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ২০১১ সালের তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘জনক জননীর গল্প’ প্রকাশিত হয়। এসব গ্রন্থের আগেও তিনি ‘সিরিয়াস’ ধারার উপন্যাস রচনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ‘বারুদ পোড়া সন্ধ্যা’(২০০৫), ‘হ্যালো কর্নেল’(২০১০) তার মধ্যে পাঠকের মনোযোগ আকৃষ্ট করেছে। এরপর তিনি লিখেছেন ‘জিনাত সুন্দরী ও মন্ত্রী কাহিনী’(২০১২), ‘কবি ও একজন নর্তকী’(২০১৩) প্রভৃতি উপন্যাসের বাস্তবধর্মী কাহিনী। অন্যদিকে তাঁর সংকলনগ্রন্থ ‘সায়েন্স ফিকশন সমগ্র’, ‘চার জয়িতা’, ‘চার অপরূপা’ এবং গবেষণাগ্রন্থ ‘আসাদ থেকে গণঅভ্যুত্থান’(১৯৯৩) খ্যাতি অর্জন করেছে।
‘হ্যালো কর্নেল’(২০১০) তাঁর একটি ব্যতিক্রমী সৃষ্টি। বিশেষত এই উপন্যাসের কাহিনী বর্তমান পাকিস্তানের জঙ্গি তৎপরতা ও আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তালেবানদের আক্রমণ সব মিলিয়ে সমকালীন ও প্রাসঙ্গিক। ২০০৪ সালে মোস্তফা কামাল পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য পাকিস্তানের বেলুচিস্তান ছাড়া অন্য সব অঞ্চল প্রায় এক মাস চষে বেড়িয়েছিলেন। এরপর আরো দুই দফায় তিনি সেখানে যাওয়ার সুযোগ পান। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি দেখতে পান সেখানকার সমাজে কীভাবে জঙ্গিবাদ শিকড় গেড়ে বসেছে। সরকার, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন, রাজনৈতিক দল জঙ্গিবাদকে সহযোগিতা করছে। তখন থেকেই আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত এলাকা ও ওয়াজিরিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গি ঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্র বিমান এবং কখনো কখনো ড্রোন হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তানের অনুমতি না নিয়ে এই হামলা পরিচালনা করলেও তৎকালীন মোশাররফ সরকার নিন্দা জানাতে পারেনি। কারণ তার সরকার জঙ্গিবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্য নিয়ে উল্টো তালেবান জঙ্গিদের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করেছিল।
উল্লেখ্য, একসময় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তালেবান জঙ্গি সংগঠনের জন্ম হয়। মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা তালেবান সংগঠন আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সর্বত্র ঢুকে গেছে। বাংলাদেশ তাদের টার্গেট ছিল তখন থেকেই। অর্থাৎ পাকিস্তান যেমন ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা পেয়েছে তেমনি বাংলাদেশকে ধর্মীয় উন্মাদনা দিয়ে অস্থির করে তোলার চেষ্টা হয়েছে অনেক আগে থেকেই। জঙ্গিবাদের এই বাস্তবতা নিয়ে মোস্তফা কামালের ‘হ্যালো কর্নেল’-এ যুদ্ধ ও প্রেম একীভূত। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের অভিজ্ঞতা উপন্যাসের কাহিনীর ফ্রেমে ধারণ করেছেন তিনি। মোস্তফা কামাল দেখিয়েছেন এক জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতা রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলে।
তালেবান, আল-কায়েদার সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্পর্ক, যুক্তরাষ্ট্রের চাপে জঙ্গি দমনে নাটক মঞ্চস্থ করা, তালেবান নেতাদের ভয়ে ভীত পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা, মানুষ অপহরণ করে অর্থ সংগ্রহের তালেবানি কৌশল, বাংলাদেশে জঙ্গি প্রেরণের জন্য ট্রেনিং প্রদান প্রভৃতি প্রসঙ্গ এবং সামাজিক-পারিবারিক জীবনের অনেক অজানা তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে এ উপন্যাসে। পাকিস্তানের সেনাকর্তা কর্নেল মইনুদ্দিন, বাংলাদেশি যুবক সাকিব, তার পাকিস্তানি প্রেমিকা মাহাভেস, যুবক আফ্রিদি ও তার মমতাময়ী মা উপন্যাসের মূল চরিত্র। সাকিবের জবানিতে উপন্যাসের কাহিনীর সূচনা এবং ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়েছে পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী ভূখণ্ডের চিত্রাবলি।
‘হ্যালো কর্নেল’ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত। এর কাহিনী নাটকীয় কৌশলে বিবৃত হয়েছে। দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে জঙ্গি অভিযান নাটকের সময় প্রথমে একজন সেনা কর্মকর্তা এবং আফ্রিদির বাড়ি থেকে একাকী বের হয়ে সাকিব তালেবানদের দ্বারা অপহৃত হয়। অপহৃত সাকিবকে উদ্ধারের জন্য মাহাভেসের প্রচেষ্টা, এই বাংলাদেশি যুবকের জন্য তার হৃদয়ের আকুতি কাহিনীকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। যুদ্ধ, হত্যা, আতঙ্ক সব কিছুকে ছাপিয়ে এই দুই ভিনদেশি নর-নারীর প্রেমের পুনর্মিলনে উপন্যাসটি শেষ হয়েছে। মূলত মোস্তফা কামাল সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে একাধিক উপন্যাস রচনা করেছেন। তার মধ্যে স্থান-কালের বিন্যাসে বৈচিত্র্যময় আখ্যানের শৈল্পিক উপস্থাপনা হচ্ছে ‘হ্যালো কর্নেল’। উপন্যাসটি দেশ এবং বিশ্বের বর্তমান জঙ্গিবিরোধী-পরিস্থিতিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সৃষ্টিকর্ম।
৪.
মোস্তফা কামাল তাঁর কথাসাহিত্যে ম্যাজিক রিয়ালিটি সৃজনে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ‘চাঁদের আলোয় রাগিব আলী এবং সে’ উপন্যাসে ম্যাজিক রিয়ালিজম এসেছে বাস্তব থেকে স্বপ্ন এবং স্বপ্ন থেকে বাস্তবের আখ্যানের মধ্য দিয়ে। স্বপ্ন অনেক ক্ষেত্রে সত্য ঘটনা হয়ে উঠেছে। কারণ ম্যাজিক রিয়ালিজম আসলে বাস্তবকে দেখার এক বহুমাত্রিক এবং সামগ্রিক পদ্ধতি। সেই কাজটিই করেছেন মোস্তফা কামাল। তিনি রোজকার জীবনে চমক তৈরি করেছেন; রাগিব আলীর কাহিনীতে মানুষের বিস্ময়কে তুলে ধরেছেন। রাগিব আলী একজন সত্যবাদী মানুষ। আর এ কারণেই তাঁর পদে পদে বিপদ। একবার একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেখে ফেলায় মহাবিপদে পড়েন রাগিব আলী।
খুনের ঘটনা ফাঁস হলে তাঁকেও খুন করা হবে বলে হুমকি দেয় সন্ত্রাসীরা। আবার রাতে ঘুমের ঘোরে তাঁকে তাড়া করে সেই মৃত ব্যক্তির প্রেতাত্মা। রাগিব আলীর সংকট তৈরি হয়। তিনি সত্য প্রকাশ করবেন; নাকি অপরাধীদের হাতে জীবন দেবেন? এমনি এক পরিস্থিতিতে তাঁর পাশে দাঁড়ায় ডাক্তার শাওলী। শেষ পর্যন্ত একটি ইতিবাচক পরিণতি সম্পন্ন হয় আখ্যানে। মাঘ মাসের হাড়কাঁপানো শীতে এর কাহিনী উন্মোচিত হয়েছে। ৪৫ বছর বয়সের রাগিব আলী শিক্ষিত বেকার। পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। কিন্তু তার প্রকৃতিতে রয়েছে পরোপকারী প্রবৃত্তি। নাবিলার মতো অনাথ শিশুর প্রতি কাতর হওয়া থেকে শুরু করে পাড়ার কলেজ ছাত্রকে বিনা কারণে পুলিশ কর্তৃক শাস্তি পেতে দেখে ঝাঁপিয়ে পড়া তার স্বভাব। এমনি এক নিঃস্বার্থ ঘটনায় জনৈক মহিলার ব্যাগ ছিনতাই হওয়ার সময় সেটি রক্ষা করতে গিয়ে আহত হন ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে। তবে ঘটনাটি উপন্যাসের বাঁক ঘুরিয়ে দেয়।
ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ডাক্তার শাওলীর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ ঘটে তার। শাওলী তার মানসিক অস্থিরতা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়, হত্যার ঘটনা প্রকাশে এবং অপরাধীকে কাঠগড়ায় দাঁড়ানোতে সাহস জাগ্রত করে। তবে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পিস্তল আসলাম ভারতে পালাতে গিয়ে সীমান্তরক্ষীদের দ্বারা ধৃত হয়; রাগিব আলী বিপদ-মুক্ত হন। মূলত মোস্তফা কামাল বাস্তবের ভেতর অলৌকিক সব ঘটনা অনুপ্রবিষ্ট করিয়ে ম্যাজিক রিয়ালিজমের অন্যতম চরিত্র হিসেবে রাগিব আলীকে নির্মাণ করেছেন। উপন্যাসটি পাঠককে রহস্যের জগতে নিয়ে যাবে।
৫.
মোস্তফা কামালের অনেক গ্রন্থের মধ্যে ‘রুবীর কালো চশমা’ ২০১৫-এর বইমেলার গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা। সত্য ঘটনা অবলম্বনে পারিবারিক ক্রাইসিসকে কেন্দ্র করে এর আখ্যান বিন্যস্ত হয়েছে। বর্তমান সময়ের একটি সামাজিক সংকট হলো সেপারেটেড ফ্যামিলি; মা-বাবার বিচ্ছিন্নতা। আর এই দাম্পত্য জীবনের সংকট সন্তান কিংবা পরবর্তী প্রজন্মের ওপর প্রভাব ফেলে। সন্তান বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক বিপর্যয় সূচিত হয়। এমনকি এ ধরনের সংকট-দীর্ণ পরিবারের ছেলে-মেয়েদের অন্যরা এড়িয়ে চলে। নর-নারী সম্পর্কের ভেতর মহিমান্বিত সংযোগ হিসেবে প্রেম ও বিবাহের পথে কাঁটা বিছানো থাকে। ‘রুবীর কালো চশমা’ উপন্যাসে এসবই ব্যক্ত হয়েছে। এর মধ্যে আছে প্রেম, আছে স্বামী-স্ত্রীর সাংসারিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত। সব মিলিয়ে উপন্যাসটি নাগরিক সংকটের কাহিনী। প্রেমের উপন্যাস লেখার সময় প্রেমের সঙ্গে সমাজের দ্বন্দ্ব-সংঘাতগুলোও মোস্তফা কামাল তুলে আনেন। সাংসারিক জীবন, পারিবারিক জীবনে চলার সময় যা কিছু থাকে সব মিলিয়ে নিতে চান তিনি। তাঁর মতে, প্রেমতো সব জায়গাতেই আছে। সেই প্রেম কেবল নিরেট নর-নারীর প্রেম নয়। তাকে সমাজ-সংসার যুক্ত করে দেখা দরকার। অর্থাৎ এই ঔপন্যাসিক প্রেম কাহিনী লিখতে পছন্দ করেন তবে তা সমাজজিজ্ঞাসা বিচ্যুত প্রেমকাহিনী নয়।
মোস্তফা কামাল আলোচ্য উপন্যাসে রুবীর ব্যক্তিমানুষের অতল গহীনে ডুব দিয়ে একজন নারীর যন্ত্রণা, কষ্ট, ভয়, হতাশা, সংশয়, সাহসিকতাকে পরিস্ফুট করেছেন অসামান্য আলোকসম্পাতে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো- নিয়াজ, নিগার সুলতানা, জামিল আহমেদ, রওশন আরা, রুবাইয়াত হাসান একদিকে যেমন নাগরিক রুচি এবং আবেগকে লালন করে তেমনি অন্যদিকে নাগরিক সভ্যতার নেতিবাচক অবদান- সংশয়, বিচ্ছিন্নতাবোধ, কপটদাম্ভিকতা, নিঃসঙ্গতা, আত্মানুসন্ধানের আত্মদহন প্রভৃতি মনোজগতের অতল গহ্বরের অন্ধকারের পুঞ্জীভূত উপাদানসমূহ তাদের মনের মধ্য থেকে উঠে আসে। ফলে নাগরিক পুঁজিতন্ত্রের অভিঘাতে যেখানে ব্যক্তির সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো অস্বীকৃত হয়েছে, অনিকেত সঞ্চারী করে তুলেছে তার দৈনন্দিন জীবন, সেখানে যন্ত্রণাদগ্ধ সেই ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের বিবরণ ও বিশ্লেষণ হয়ে উঠেছে প্রধান। নাগরিক সভ্যতাও যে পারিবারিক বিচ্ছিন্নতার আবেষ্টন থেকে ব্যক্তির যন্ত্রণা ও অবচেতনার কামনাকে অগ্রাহ্য করতে চায় এবং এরই ফলে ব্যক্তি মানুষ কীভাবে প্রতিবাদী সত্তায় জাগরিত হয় তারই শিল্পরূপ ‘রুবীর কালো চশমা’ উপন্যাসের গতিচঞ্চল প্রান্ত।
মূলত মোস্তফা কামাল নাগরিক জীবনের পারিবারিক সংকটকে ব্যক্তির বহুমাত্রিক চেতনার সংস্পর্শে দৃশ্যমান করেছেন। ব্যক্তি তো শুধু গণ্ডিবদ্ধ পরিবারের সংকটের চূড়ান্তসীমায় ক্ষয়ে গিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না। সচেতন শিক্ষিত নাগরিক জীবনযন্ত্রণার মূলে থাকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাস্রোত। মোস্তফা কামাল এসব প্রসঙ্গ সংবাদপত্রের কলামে উপস্থাপন করলেও এখানে সযত্নে তা থেকে দূরে থেকে মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের অবয়ব নির্মাণ করেছেন। তবে তিনি সংহত বিবরণ ও একঘেঁয়েমী কাহিনীসূত্র উপন্যস্ত না করে নাগরিক বৃত্তের জীবনদগ্ধ উপন্যাস উপহার দিতে পেরেছেন, যার মূল সুর ইতিবাচক। এই ইতিবাচক জীবনদৃষ্টি ও সাবলীল গদ্যে শিল্প সম্মত কাহিনী বর্ণনার কারণে ‘রুবীর কালো চশমা’ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে।
৬.
বস্তুত মোস্তফা কামাল একজন নিবেদিত প্রাণ সাহিত্যকর্মী। প্রতিদিন লেখাপড়ায় নিজেকে নিয়োজিত রেখে সাহিত্য সৃষ্টির শ্রমসাধ্য ধারা অক্ষুণ্ণ রাখা সত্যিই অভিনন্দনযোগ্য। তিনি নিরন্তর চেষ্টায় বাংলা সাহিত্যের সেবা করে যাচ্ছেন। জনপ্রিয় ধারার সফল কথাসাহিত্যিক হয়েও বৈচিত্র্যে তাঁর সৃজনকর্ম বহুমাত্রিক এবং জ্ঞানের সব দিগন্তকে স্পর্শ করেছে। তাঁর সৃজনকর্ম আমৃত্যু সক্রিয় থাকুক এই প্রত্যাশা আমাদের।