তাহমিমা আনাম ও গল্পটি নিয়ে কিছু কথা
সম্প্রতি ‘গার্মেন্টস’ ছোটগল্পের জন্য ও’হেনরি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বাংলাদেশি কথাসাহিত্যিক তাহমিমা আনাম। গত বৃহস্পতিবার বাংলা ট্রিবিউন ও শুক্রবার দৈনিক প্রথম আলোর সাহিত্য বিভাগে গল্পটির অনুবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর ফেসবুকে পুরস্কৃত গল্পের সঙ্গে সঙ্গে লেখক তাহমিমা আনামের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের লেখকবৃন্দ। এর আগে তাহমিমা আমান তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘আ গোল্ডেন এজ’ (A Golden Age, ২০০৭)-এর জন্য ২০০৮ সালে কমনওয়েলথ সেরা প্রথম বই পুরস্কার পেলে এবং দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য গুড মুসলিম’ (২০১১)-এর জন্য ‘ম্যান এশিয়ান লিটারেরি প্রাইজ’-এর জন্য প্রাথমিকভাবে মনোনীত হলে একই রকম সমালোচনা হয়েছিল।
এখন প্রশ্ন হলো, এই সমালোচনার পেছনে কারণটা কী? তাহমিমা আনামের সমস্যা কী—উনি স্বনামধন্য পিতার কন্যা, এটা? নাকি উনি মধ্যমানের লেখক হয়েও আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকৃষ্ট করতে পেরেছেন, এটা?
আমরা একটা বিষয় বোধ হয় গুলিয়ে ফেলছি—তাহমিমা আনাম বাংলায় লেখেন না। কাজেই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে উনি বাংলাদেশের লেখকদের প্রতিদ্বন্দ্বী নন। ইংরেজিতে আমাদের ভালো লেখকদের লেখা মানসম্মত অনুবাদ হয়ে আন্তর্জাতিক সাহিত্য বাজারে যাচ্ছে না; এটা আমাদের জাতীয় আফসোস। এর জন্য তাহমিমা আনাম দায়ী নন নিশ্চয়? কাজেই তাহমিমা না লিখলে বাংলাদেশ থেকে আরো যোগ্য কেউ তাঁর আসনে থাকতেন, সেটা বলা যাচ্ছে না। ওঁর কিছু লেখা আমি পড়েছি। নিশ্চিত করেই খুব আপ্লুত হওয়ার মতো কিছু পাইনি। আমার কাছে আলাদা করে চিহ্নিত করার মতো লেখক তিনি নন বলে মনে হয়েছে। কিন্তু সেটা তাঁকে নিয়ে সমালোচনার কারণ হতে পারে না। তাহমিমার চেয়ে অনেক বাজে লিখে এখানে মিডিয়ার বদৌলতে জনপ্রিয় লেখক বনে গেছেন, তাঁদের সংখ্যা কিন্তু একেবারে কম না! আমি নাম না বললেও আপনারা বুঝতে পারবেন।
এখন প্রশ্ন হলো, তাহমিমা আনাম তাঁর লেখায় বাংলাদেশকে ভুলভাবে উপস্থাপন করছেন কি না? উনি ইংরেজিতে লেখার কারণে উনার বক্তব্য যেহেতু বিশ্ববাসীর নজরে আসছে, কাজেই বাংলাদেশকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার অধিকার উনার নেই বলে আমরা মনে করি। দেখেছি নাইপল-রুশদির বিরুদ্ধেও তাঁদের পৈতৃক ভূমি ভারতকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার অভিযোগ উঠেছে। ডায়াসপোরা থেকে যাঁরা লেখেন, তাঁদের এইসব সমস্যার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এ ক্ষেত্রে তাঁদের কাছ থেকে স্বদেশি পাঠকরা আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রত্যাশা করেন। এটা তো ঠিক যে তাহমিমার মতো ইউরোপের বাইরে থেকে যাঁরা ইংরেজি মাধ্যমে লিখছেন, তাঁরা স্বদেশি পাঠকদের জন্য লেখেন না, লেখেন সেসব বিদেশি পাঠকের জন্য, যাঁরা তাঁকে পড়েন। ওরহান পামুক স্পষ্ট করে বলছেন, ‘আজকের বিশ্বের সাহিত্যিকরা তাঁদের স্বদেশি মেজরিটির জন্য কম লিখেছেন (যাঁরা তাঁদের পড়ে না)। তাঁরা লিখছেন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পাঠককুলের জন্য, যাঁরা তাঁদের পড়ে।’ [তুমি কার জন্য লেখ? তর্জমায় বর্তমান আলোচক]
এ ক্ষেত্রে তাহমিমা ধন্যবাদ পাবেন যে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখার চেষ্টা করেছেন। ভালো হলো কি না, সেটা ভিন্ন আলোচনা। শিল্পমানে তাঁর লেখা কতটা সমৃদ্ধ, সেটা নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা হতে পারে। কিন্তু সেটা কখনই খুব বেশি হয়নি। অন্তত আমার চোখে পড়েনি। যা হয়েছে সেটা হলো তাঁর পারিবারিক পরিচয় ধরে টানাটানি।
তাহমিমা আনাম হালে ও’হেনরির নামে প্রবর্তিত যে পুরস্কারটা পেয়েছেন, সেটা খুব উল্লেখযোগ্য কোনো পুরস্কার নয়। আমরা আলোচনা করছি আমাদের দেশের লেখক এটা পেয়েছেন বলে, না হলে আমরা এর নামই জানতাম না হয়তো। অথচ ১৯১৮ সাল থেকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। প্রতিবছর কানাডা-আমেরিকার সাময়িকীতে প্রকাশিত গল্প থেকে একটা নির্বাচিত গল্পের সংকলন বের হয়। সেই সংকলনে স্থান পায় এই পুরস্কৃত গল্পগুলো। এ বছর তাহমিমার সঙ্গে আরো কয়েকজন পেয়েছেন। তালিকায় রয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখক শ্রুতি স্বামী, ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন পরমাণু রেডিওলজিস্ট অমিত মজুমদার ও লেখক জয় চক্রবর্তী। আমি অন্যদের গল্প পড়েছি। গল্পগুলোর যে মান, তাতে তাহমিমার নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকে না। বাংলাদেশে সমালোচনা হচ্ছে তাহমিমা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার জন্য। আমি নিজেও মনে করি ‘গার্মেন্টস’ গল্পে দৃশ্যত কিছু অসংগতি আছে।
বর্তমান বাংলাদেশে আর পঞ্চায়েত প্রথা চালু আছে বলে আমি মনে করি না। বিদেশের পাঠকরা সেটা বুঝতে পারবেন না। গল্পে দেখানো হচ্ছে, ঘরভাড়া নেওয়ার জন্য তিনজন গার্মেন্টকর্মী নারী একজন পুরুষকে একসঙ্গে কাজি অফিসে বিয়ে করছে। ঢাকার প্রেক্ষাপটে খুবই অবাস্তব একটা ঘটনা। গার্মেন্টকর্মীদের জন্য মেসের ব্যবস্থা আছে। বিয়ে না করেই হাজার হাজার মেয়ে থাকছেন সেখানে। মালা ছাড়া বাকিদের নাম স্বাক্ষর করতে না পারার বিষয়টিও আরোপিত। বলা হচ্ছে, দুলাল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বড় দোকানে কাজ করে, তার স্ট্যাটাস গার্মেন্টকর্মীদের ওপরে। অথচ দেখা যাচ্ছে সে স্ত্রীদের কাছে পালা করে থাকে, খায় এবং স্ত্রীদের টাকায় নিজের অক্ষমতার চিকিৎসা করাবে বলে চিন্তা করছে। বাংলাদেশের সংগ্রামী গার্মেন্টকন্যাদের এত ঠ্যাকা পড়েনি যে ঘরভাড়া নেওয়ার জন্য অক্ষম এক পুরুষকে বিয়ে করে সারা রাত তার পিঠ চুলকে দিতে হবে! গার্মেন্টকর্মীরা এখন অনেক বেশি স্বাবলম্বী। এটা লেখকের মাথায় রাখা উচিত ছিল। গল্পে দেখানো হচ্ছে শীতকাল। অথচ জেসমিন নতুন ভাড়া বাড়িতে উঠে দেখে ফুটো চাল দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে মেঝেতে পানি জমে গেছে। এসব বিষয় হয়তো বিদেশি পাঠকের নজরে আসবে না, কিন্তু এ দেশের পাঠকের কাছে বিষয়টি ঠিকই চোখে পড়বে। এসব কারণে লেখক তাহমিমা আনামের লেখা নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা নিশ্চয় হবে, কিন্তু যা হচ্ছে তা ব্যক্তি তাহমিমা আনামকে নিয়ে, তাঁর পিতৃপরিচয় নিয়ে। ফেসবুকে এক সিনিয়র লেখক ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, ‘তাহমিমা আনাম আবার কে? আমি তো জানি তিনি মাহফুজ আনামের মেয়ে।’ অন্য একজন লিখেছেন, ‘She (তাহমিমা আনাম) is the daughter of Mr Mahfuz Anam. Is it not enough?’
কথা হলো, তাহমিমা লিখছেন ইংরেজিতে। বিশ্বে শিল্পের বিভিন্ন মান আছে—এ গ্রেড, বি গ্রেড, সি গ্রেড—এমন। সব গ্রেডের ভোক্তাও আছে। কাজেই মোটামুটি লিখতে পারলে কোনো না কোনো গ্রেডে সেটা প্রকাশিত হওয়ার কথা। এ কারণে ইউরোপে অসংখ্য বাজে বই প্রকাশিত হয়। পেঙ্গুইন থেকেও হয়। এখানে অনেকে মনে করেন, তাহমিমার বাবা বাংলাদেশে কিছুটা প্রভাবশালী বলে তাহমিমা ওসব সম্মাননা, প্রকাশনা সুবিধা পাচ্ছেন। অযৌক্তিক ধারণা। তাহমিমার বাবা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এমন কিছু হয়ে যাননি যে তাঁকে ইংল্যান্ড-আমেরিকা-কানাডা থেকে এত সুবিধা দেবে ওখানকার ব্যবসায়ী ও শিল্পগোষ্ঠী। তিনি যা পাচ্ছেন নিজের যোগ্যতার জন্যই পাচ্ছেন বলে আমি বিশ্বাস করি। কারণ, তাঁর মতো ইউরোপীয় নন, এমন মাঝারি মানের লেখকরা ইউরোপে এ ধরনের পুরস্কার-সম্মাননা পাচ্ছেন। বিদেশে পুরস্কার পেলেই যে বিরাট কিছু হয়ে গেল তাও না। এই যে আশরাফ শিশিরের ‘গাড়িওয়ালা’ সিনেমাটি ছয়টি মহাদেশের ২৬টি দেশের ৭৮টি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হলো এবং রেকর্ডসংখ্যক পুরস্কারও পেল। কিন্তু সেই তুলনায় সিনেমাটি কি আদৌ কিছু হয়েছে?
মোটের ওপর কথা হলো, তাহমিমার চেয়ে অনেক অনেক ভালো লেখক যেমন এখানে তরুণদের ভেতর আছে, তেমন তাঁর চেয়ে নিম্নমানের লেখকের সংখ্যাও একেবারে কম নেই। তাই সব মিলিয়ে আমার প্রস্তাবনাটি হলো, তাঁকে তাঁর পিতৃপরিচয়ে নয়, তাঁর লেখক-পরিচয়ের মূল্যায়ন এবং তাঁর সাহিত্যকর্মের গঠনমূলক সমালোচনা করা হোক।