বানান বিতর্ক
‘ঈদ’ না ‘ইদ’?
‘ঈদ’, নাকি ‘ইদ’? প্রতিবছর ঈদের ‘বাজার’ নিয়ে আলোচনা হয়, এ বছর ঈদের ‘বানান’ নিয়ে শুরু হয়েছে হৈচৈ। এ বিষয়ে একজন ভাষাতাত্ত্বিকের কি কিছু বলার আছে? শব্দের উচ্চারণ যেমন আমাদের ভাষাবোধের অংশ, তেমনি শব্দের বানানও শিক্ষিত বাঙালির ভাষাবোধের অংশ। শব্দকোষে শব্দ সম্ভবত একা থাকে না, যেমন ‘ঈদ’ শব্দের সঙ্গে (আঙুরের থোকার মতো) জড়িয়ে থাকে ‘ঈদুল ফিতর’, ‘ঈদি’ বা ‘ঈদী’, ‘ঈদোত্তর’, ‘ঈদপূর্ব’ ইত্যাদি শব্দ। ‘ঈদ’ বানানটি আমাদের ভাষাবোধের অংশ। ‘ইদ’ লিখলে সেই ভাষাবোধ বা ভাষাব্যবহার-অভ্যাস কমবেশি ধাক্কা খায়। ধাক্কা লাগে ‘ঈদ’ থেকে গঠিত অন্য শব্দগুলোতেও।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই ধাক্কা অপরিহার্য কি না। ‘নেই কাজ তো খই ভাজ!’ একটি শব্দ অন্য ভাষায় প্রবেশ করতে হলে সেই ভাষার ধ্বনিতত্ত্বের নিয়ম মেনে শব্দটির খোলনলচে পাল্টে নিতে হয়। সুতরাং বাংলা শুধু নয়, কোনো ভাষায় কোনো বিদেশি শব্দ নেই, থাকতে পারে না। বাংলা ভাষায় কোনো আরবি বা ইংরেজি শব্দ নেই। আরবি বা ইংরেজি ভাষার শব্দ বাংলা শব্দে পরিণত হয়ে তারপর প্রবেশাধিকার পেয়েছে বাংলা শব্দকোষে। সুতরাং বিদেশি শব্দের উচ্চারণ বা বানানের জন্য আলাদা নিয়ম রাখার কোনোই প্রয়োজন নেই। ‘ঈদ’ সম্পূর্ণভাবে গ্রহণযোগ্য একটি বানান। কেউ যদি আঁতলামি করে ‘ইদ’ লিখতে চান, তিনি লিখতেই পারেন, সেটি তার ‘বানানিক’ অধিকার। কিন্তু যারা ‘ঈদ’ লিখবেন, তাঁদের যেন কোনোমতেই বাধা দেওয়া না হয়।
এটা ঠিক যে আরবি ভাষায় ‘ঈদ’ শব্দটি দীর্ঘ ‘ই’ দিয়ে লেখা হয়, উচ্চারিত হয়। যাঁরা ‘ঈদ’ বানান লিখেছিলেন অতীতে, তাঁরা আরবি ভাষায় ‘ঈদ’ শব্দের উচ্চারণে দীর্ঘ ‘ই’ আছে বলেই সেটা করেছিলেন। কিন্তু আরবিতে কোনো শব্দের কী উচ্চারণ বা বানান হয়, সেটা বাংলা বানান বা উচ্চারণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে না ভাবলেও চলবে, কারণ আরবি আর বাংলার ধ্বনিতত্ত্ব আলাদা। বানানের দুটি নিয়ামক : ধ্বনিতত্ত্ব ও ঐতিহ্য। উচ্চারণ অনুসারে বানান নির্ধারিত হয় আবার ঐতিহ্যগতভাবেও (একাধিক কারণে) বানান নির্ধারিত হতে পারে। ‘ঈদ’ বানানটি এরই মধ্যে আমাদের ভাষিক ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গিয়েছে বলে এই বানান ব্যবহার করলে কোনো ক্ষতি নেই। সংস্কৃত ব্যাকরণেও এ ধরনের প্রচলিত বানানকে গ্রহণযোগ্য করার প্রয়োজনে নিপাতনে সিদ্ধ, আর্ষ প্রয়োগ (বা গণপ্রয়োগ) ইত্যাদি নিয়ম ছিল।
প্রমিত বাংলায় দীর্ঘ স্বরধ্বনি নেই—এই অজুহাতে কি আমরা তথাকথিত কৃতঋণ শব্দ থেকে দীর্ঘ ঈ বা দীর্ঘ ই-কার তুলে দেবো? বাংলায় দীর্ঘ স্বরধ্বনি নেই, কথাটা ঠিক নয়। প্রমিত বাংলায় দীর্ঘ স্বরধ্বনি অবশ্যই আছে, কিন্তু স্বরধ্বনির দৈর্ঘ্য ফোনেমিক নয়, অর্থাৎ স্বরধ্বনির দৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে দুই শব্দের মধ্যে অর্থগত পার্থক্য সৃষ্টি হয় না। আরবি বা চট্টগ্রামিতে স্বরধ্বনির দৈর্ঘ ফোনেমিক। উদাহরণ : ‘খাই’ (আমি খাই) এবং ‘খাআই’ (আমি খেয়েছি)। ‘গ্রীক’, ‘চীন’ ইত্যাদি শব্দ দীর্ঘ ই-কার দিয়ে লেখা যেতেই পারে ঐতিহ্যের অজুহাতে। এই শব্দগুলোতে ই-উচ্চারণ দীর্ঘ নয়—এই অজুহাতে যদি কেউ শব্দগুলোকে হ্রস্ব ই-কার দিয়ে ‘গ্রিক’, ‘চিন’ লেখে তাতেও অবশ্য কোনো ক্ষতি নেই। প্রথম ধরনের বানানের নিয়ামক ঐতিহ্য, দ্বিতীয় ধরনের বানানের নিয়ামক ফনোলজি। দুটি বানানই থাক না। কালের প্রবাহে যেকোনো একটি টিকে যাবে, ‘বউ’, ‘বৌ’, ‘বাংলা’, ‘বাঙলা’ বা ‘বাঙ্গালা’র ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছে।
‘ঈদ’, ‘ইতিপূর্বে’, ‘ফলশ্রুতি’, ‘লক্ষ্য’, ‘উপরোক্ত’ ইত্যাদি বানানকে যারা ইতিপূর্বে ভুল বলেছেন বা এখনো বলেন, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তাদের কারোই আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি নেই। বাংলা একাডেমিতে যাঁরা বানানের নিয়ম নির্ধারণ করেন, তাঁদের একজনেরও এই ডিগ্রি নেই। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা বানানের নিয়ম নির্ধারণ করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়... ভাষাবিজ্ঞানে প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে তাঁরা ‘সঠিক’ বানান-নির্ধারণে একাধিক ভুল করেছেন (এবং পরে সেই সব ভুল স্বীকারও করেছেন)। উত্তসূরিরা সেই ভুলগুলো সশ্রদ্ধচিত্তে বয়ে বেড়াচ্ছেন, গুরুদের ভুলস্বীকারকে আমলে নিচ্ছেন না।
মেডিকেল সায়েন্সে স্নাতক ডিগ্রি নেই, এমন কারো কাছে যদি আপনি চিকিৎসার জন্য যান, তবে চিকিৎসা-বিভ্রাট তো ঘটতেই পারে। ‘ঈদ/ইদ’ বানানবিভ্রাটের অন্যতম কারণ যে ভাষাবিজ্ঞানে উপযুক্ত প্রশিক্ষণহীনতা, এতে অন্তত আমার কোনো সন্দেহ নেই। বানান হচ্ছে, গরিবের বউ, সবার ভাবী। সবাই বানান নিয়ে কথা বলতে চায়, যোগ্যতা থাক বা না থাক। ঈদে বাড়ি ফেরার হাজারো ঝামেলার ‘বোঝার ওপর’ সঙ্গে এই নতুন একটি ঝামেলার ‘শাকের আঁটি’ যোগ না করলে কি চলতই না?
লেখক : ভাষাবিদ। ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি (২০০৭) করেছেন কানাডার মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্যারিসের সর্বোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাবিজ্ঞানে এমফিল (১৯৯৫) ও এমএ (১৯৯৪) এবং ইন্ডোলজিতে এমএ (১৯৮৮) করেছেন।