মুক্তগদ্য
সত্যান্বেষী মৃণাল ও রবীন্দ্রনাথ

মানুষটার সঙ্গে বলতে গেলে রোজ আমার দেখা হয়। আগে মানুষটাকে দেখলে আমার মনের ভেতরটা কেমন যেন ছ্যাৎ করে উঠত। ধন্দে পড়ে যেতাম। মনে হতো, এ আমি কাকে দেখছি! মানুষটার চেহারার সঙ্গে আমি যার চেহারার মিল খুঁজে পাই তিনি তো এই পৃথিবী ছেড়েছেন আরো সাত দশক আগে। দুজন মানুষের চেহারায় কীভাবে এতখানি মিল হয়?
একদিন আর না পেরে নিজেই যেচে পড়ে তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, ‘আপনি কি জানেন আপনার চেহারার সঙ্গে একজন মহান মানুষের অসম্ভব মিল?’
তিনি যেন আগে থেকেই জানতেন একদিন আমি তাঁকে এই প্রশ্ন করতে আসব। আমার দিকে সকৌতুকে তাকিয়ে বলেন, ‘জানব না কেন? খুব জানি!’
আমি বললাম, ‘বলুন তো কে সে?’
তিনি হেসে বললেন, ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’
তার পর থেকে মানুষটার সঙ্গে আমার সখ্য। তার নাম মৃণাল কান্তি নিশি। পেশায় মুচি। আপনারা ইচ্ছা করলেই তাঁকে দেখতে পাবেন। শ্যামলী তিন নম্বর রোডের মুখেই যন্ত্রপাতি নিয়ে সকাল ৭টায় রুটি-রুজির তাগিদে বসে যান। সব সময় তাঁর মুখের কোনে একটা হাসি লেগেই আছে। দেখা হলেই এক গাল হেঁসে জিজ্ঞাসা করবেন, ‘কিরে মা, কই যাস?’ কয়েকদিন দেখা না হওয়ার পর আবার দেখা হলে চিন্তিত কণ্ঠে হয়তো জানতে চাইবেন, ‘কিরে মা, এই কদিন তোকে দেখলাম না যে? অসুখ করেছিল নাকি?’ আর টাকা ভাংতি না থাকলে তো আমার একমাত্র সহায় হচ্ছেন এই মৃণাল কাকা।
একদিন কথা প্রসঙ্গে জানলাম, তার বাড়ি খুলনায়। ক্লাস ফোর পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন। আগে খুলনা ডিসি অফিসে কাজ করতেন। ২০০৮ সাল থেকে শ্যামলী তিন নম্বর রোডের মুখে মুচির কাজ করেন।
তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘দৈনিক কত আয় হয় আপনার?’
-এই ধর যে ২০০-২৫০-এর মতো রোজগার হয়।
-এই যে রাস্তার পাশে বসেন কেউ আপনাকে উঠিয়ে দেয় না?
-নাহ কেউ উঠিয়ে দেয় না। এখানে সবাই আমাকে ভালোবাসে।
একটু সময় তার সঙ্গে কাটানোর পর দেখলাম আসলেই এই মানুষটার সঙ্গে আশপাশের সবার বেশ আন্তরিক সম্পর্ক। মাঝেমধ্যেই পাশে বসা আরেক বৃদ্ধ আম বিক্রেতা নজরুল চাচার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠছেন।
মৃণাল কাকার একটা বিষয় খুব অদ্ভুত লাগে। তিনি হাসতে হাসতেই মাঝে মাঝে কেমন গম্ভীর হয়ে যান। অদ্ভুত সব প্রশ্ন করা শুরু করেন! একদিন আমার কাছে জানতে চাইলেন, ‘বল তো দেখি কোন ধর্ম সত্য?’
আমি পালটা তাঁর কাছে প্রশ্নটা ছুড়ে দিলাম, ‘কোন ধর্ম আপনিই বলেন।’
উত্তর দিতে গিয়ে তাঁর দৃষ্টিটা কেমন ঘোলাটে হয়ে গেল। বললেন, ‘হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্ট, বৌদ্ধ সব ধর্মই সত্য। সব ধর্মই ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছে। সব ধর্মই মানবতার কথা বলে। ধর্ম কোনোটাই মিথ্যা না। আমরা মানুষরা আজকাল লোভে পড়ে ধর্মটাকে মিথ্যা বানাই। সবাই ধর্মকে নিজ স্বার্থে কাজে লাগায়!’
তার কথাগুলো শুনে আমার আবার কেমন গা ছমছম করে ওঠে। এই একই রকম কথা তো রবিঠাকুরও ১৯৪০ সালে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার সময় বলেছিলেন তাঁর পাচক গেদু মিয়াকে। বলেছিলেন, ‘গেদু খুব সাবধানে চলবে। ধর্মান্ধ সব বর্বরের দল কী সব করছে, যে কোনো সময় রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে যেতে পারে। আমি বুঝি না, এরা কি ধর্মগ্রন্থ ভালো করে পড়েনি! তোমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরান শরিফ আমি বাংলায় পড়েছি। বেদ-বাইবেল থেকে শুরু করে পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থ পড়েছি। সেখানে মানুষের ভালোবাসার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার কথাই বড় করে দেখানো হয়েছে। এরা ধর্ম বোঝে না। ধর্মকে ব্যবহার করে স্বার্থ লুটতে চায়।’
আমি মৃণাল কাকার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। আমার মনে হলো, হয়তো লোকটার মনের ভেতরে কোথাও না কোথাও রবিঠাকুর ভর করেছেন। তা না হলে দুজনার কথা কী করে এতটা মিলে যায়?
আবার জিজ্ঞেস করলাম, আবার বলুন কাকা আপনি কোন ধর্মের উপাসক?
তিনি বললেন, ‘আমি সত্য ধর্মের উপাসক।’
-আপনার কোনো ইচ্ছা আছে কাকা?
- হ্যাঁ আছে। আমি দেশের প্রধানমন্ত্রী আর বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে দেখা করে কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে চাই।
-কী প্রশ্ন?
-কি প্রশ্ন সেটা এখন বলব না।
আমি সেদিনের মতো মৃণাল কাকার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। এই বৃদ্ধের সঙ্গে যতই কথা বলি, আমার ভেতরে প্রতিদিন সন্দেহ জাগে, আসলে আমি কার সঙ্গে কথা বলছি? আসলেই একি মৃণাল কান্তি নিশি নাকি তাঁর ভেতরে অন্য কেউ বাস করে? স্পষ্ট করে বলতে আমি তাঁর মাঝে রবিঠাকুরের সন্ধান করি। কেনই বা খুঁজব না, তাঁরা দুজনেই তো সত্য খুঁজে বেড়িয়েছেন, সত্যকে আঁকড়ে ধরেছেন। আমার ভেতরেও হঠাৎ কবিগুরুর কথাগুলো বেজে উঠল- ‘সত্য যে কঠিন
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম-
সে কখনো করে না বঞ্চনা’।