বানান বিতর্ক
সংগততর ‘ইদ’ বনাম প্রচলিত ‘ঈদ’
বাংলা একাডেমির ‘আধুনিক বাংলা অভিধানে’ ‘ঈদ’ শব্দটির ভুক্তি রয়েছে দুটি। এর মধ্যে একটি লেখা হয়েছে ‘ঈ’ ব্যবহার করে, অন্যটি ‘ই’ ব্যবহার করে। এর মধ্যে ‘ঈদ’কে প্রচলিত ও অসংগত বানান এবং ‘ইদ’কে সংগততর ও অপ্রচলিত বানান বলছে বাংলা একাডেমি। বাংলা শব্দের বানানের ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়মে লেখা এবং বিধি অনুসৃত বানান পদ্ধতি বলে দুটি বিধি রয়েছে। এত দিন ‘ঈদ’ বানানটি প্রচলিত নিয়ম মেনে লেখা হতো, এখন থেকে সেটা বাংলা একাডেমির বিধি অনুযায়ী অনুসৃত পদ্ধতি মেনে অভিধানে সংশোধনী আনা হয়েছে।
বাংলা একাডেমি এমন একটা সময় ‘ইদ’ নামের সংগততর বানানের কথা বলল, যখন তার বয়স বাষট্টি বছর। একটা প্রতিষ্ঠান, যাদের কাজই ভাষা নিয়ে গবেষণা করা, সেই তারা এতটা বছর ধরে একটা ভুল বানানের বোঝা বয়ে বেড়াল কীভাবে? এখন কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আমরা কোথায় পাব যে বলব, প্রিয় কবি আপনি অসংগত বানানে ঈদের গান লিখেছিলেন।
বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘ইদ’ শব্দটির ভুক্তিতে বলা হয়েছে, ‘ইদ/ইদ্/[আ.]বি. ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব; (ইদুল ফিতর বা ইদুল আজহা); খুশি, উৎসব; ঈদ-এর সংগততর ও অপ্রচলিত বানান। ইদ মোবারক /ইদ্ মোবারক্/বি. ইদের শুভেচ্ছা বিনিময়কালে উচ্চারিত অভিবাদন।’ অন্যদিকে, অভিধানের ‘ঈদ’ ভুক্তিতে বলা হয়েছে, ‘/ইদ/[আ.]বি. ইদ-এর প্রচলিত ও অসংগত বানান।’ আবার বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে ‘ইদ’ শব্দের ভুক্তিতে নির্দেশ করা হয়েছে ‘ঈদ’ শব্দকে।
এর মানে দাঁড়াল বাংলা একাডেমি ঈদ এবং ইদ—এই দুটি বানানই নিজেদের অভিধানে রেখে দিয়ে সংগততর-অসংগতর ও প্রচলিত-অপ্রচলিত শব্দ দ্বারা বিভাজিত করে রেখেছে।
বানানবিধিতে বলা আছে, বিদেশি শব্দ লিখতে ‘ঈ’ বা ‘ঈ’-কারের পরিবর্তে ‘ই’ বা ‘ই’-কার লিখতে হবে। আবার ঐ বিধিতে এও বলা আছে, ইতিহাস-ঐতিহ্যনির্ভর বানান পরিবর্তন করা যাবে না। যেমন—‘আওয়ামী লীগ’। এ বানানটি প্রমিত বানান হিসেবে দুটোই হ্রস্ব-ই-কার হওয়ার কথা, কিন্তু এ নিয়ম এখানে প্রযোজ্য নয়। কারণ হিসেবে বলা হয় এ নামটি ঐতিহ্যবাহী।
ভাষা গতিপ্রকৃতি নিয়ে যাঁরা ন্যূনতম খোঁজখবরও রাখেন, তাঁরা এখন বলছেন, ৬০-৭০ বছর বয়সী একটি বানান ‘আওয়ামী লীগ‘ যদি ইতিহাস-ঐতিহ্যনির্ভর হয়, তা হলে যেসব আরবি-ফারসি শব্দের বাংলায় প্রবেশ ঘটেছে, সেগুলো কি শত-সহস্র বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিনির্ভর নয়?
বাংলা একাডেমির বানান সংশোধন বোর্ড ছাড়া ঈদের পরিবর্তিত বানানটি কেউ মেনে নিতে পারেননি। এই ব্যাপারে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. শামসুজ্জামান খান গণমাধ্যমকে বলে দিয়েছেন, এই পরিবর্তনে এত মাতামাতি করার কিছু নেই। তবে আমার মনে হচ্ছে, জামায়াত অথবা কোনো উগ্রবাদী মতাদর্শের লোকজনের বিষয়টি নিয়ে বেশ মাথাব্যথা শুরু হয়েছে।’
কথা হলো, দেশের আপামর জনগোষ্ঠী ‘ঈদ’ বিষয়ক বাংলা একাডেমির বানান সংশোধনীর গোয়ার্তুমি নিয়ে বেশ মাতামাতি করছেন, দ্বিমত পোষণ করছেন। ঈদের আগে গণমাধ্যমও বিষয়টি নিয়ে বেশ সরব। সোশ্যাল মিডিয়ায় কাউকে পাওয়া যাবে না, যিনি ‘ঈদ’কে ‘ইদ’ বলতে আগ্রহী। তাহলে মহাপরিচালকের কথানুযায়ী দেশের এই বিপুল জনসাধারণের সবাই কি উগ্রবাদী মতাদর্শী?
বরং আপনি যখন বৃহৎ মানুষের মানসিকতা বা ইচ্ছার দাম না দিয়ে বিপরীত স্রোতে গা ভাসাবেন, সেটাই বরং হয় একগুঁয়েমি বা উগ্রবাদিতা।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, গবেষণা ও প্রচারের লক্ষ্যে আজ থেকে ৬২ বছর আগে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটটা ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও সংগঠনের চিন্তা প্রথম মাথায় আনেন বহুভাষাবিদ, বিশিষ্ট শিক্ষক ও দার্শনিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। যিনি পরে পূর্ব পাকিস্তানি ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকাশের সম্পাদক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে যোগ দেন। কিন্তু এই পণ্ডিত মানুষটিরও কখনো মনে হয়নি ঈদটাকে ‘ইদ’ করে দিতে হবে।
বাংলা ১৩৫৮ সালের ১ ফাল্গুন প্রকাশিত রাজশেখর বসু প্রণীত ‘চলন্তিকা’ আধুনিক বঙ্গভাষার অভিধানের ৬৬ পৃষ্ঠাতে মুসলমানের উৎসব হিসেবে ‘ঈদ’ বানানটি লেখা আছে। সংস্কৃত থেকে আসা তৎসম শব্দগুলো ছাড়া সবগুলোতেই ‘ই’ এবং ‘ই’-কার ব্যবহার করতে হবে, যা কলকাতা বানান রীতি এবং বাংলা একাডেমি বানান রীতিতেও আছে। এ বিষয়টি কি রাজশেখর বসু বা তাঁর সমসাময়িক পণ্ডিতরা জানতেন না?
বাংলা একাডেমির ঈদ বানান পরিবর্তন প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও সদ্য নিযুক্ত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিশ্বজিৎ ঘোষ গণমাধ্যমকে মোক্ষম জবাব দিয়েছেন, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম দীর্ঘ-ঈ ব্যবহার করতেন। তাহলে কেন ঈদ বানান হ্রস্ব-ই দিয়ে লেখার প্রস্তাব এলো? ঈদ শব্দটি বাংলার এবং বাঙালির উৎসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কোনো কোনো বানান থাকে, যার পরিবর্তন হলে চোখে লাগে। কখনো কখনো আবেগে লাগে, কখনো কখনো বিশ্বাসে লাগে। এর ফলে সমাজে বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। ফেসবুকে অনেকেই এর প্রতিবাদ করে লিখছে। আমার মনে হয় কিছু কিছু শব্দ ব্যতিক্রম বানান নিয়ে থাকতে পারে। যেমন ঈদ-এর বেলায় এমনটি হতে পারে। ঈদ বানান যেহেতু আমাদের অপটিকস সহ্য করে নিয়েছে, তাই আমার মনে হয় ঈদ বানান অপরিবর্তিত রাখলে অধিকাংশ বাঙালির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
তৎসম শব্দের ভেদ-অভেদ বোঝাটা আপামর জনসাধারণের কর্ম নয়। তারা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ঐতিহ্যবাহী ঈদের গানটিতে দশকের পর দশক ধরে ‘ঈ’ অক্ষরটিই দেখে এসেছে। এখন একজন বয়সী মানুষ নতুন করে বানান মুখস্থ করার পীড়ন বা দৃষ্টির চাপ সইতে যাবে কেন? ‘ঈদ’ বানান শিখে আসা শিশুটিকে পরিবর্তনের ভাষা বোঝাবে কে? কোটি কোটি ছাপা বই অথবা ইন্টারনেটে থাকা বিলিয়ন শব্দ পরিবর্তন করে দেওয়ার দায় নেবে কে?
বাংলা একাডেমি ‘ঈদ’-এর মতো স্পর্শকাতর ও ধর্মীয় ভাবাবেগ সম্পন্ন ট্র্যাডিশনাল একটি শব্দকে হুট করে বদলে দেওয়ার দায়িত্ব দিল মাত্র গুটিকয়েক বোর্ড সদস্যকে।
অথচ তাদের উচিত ছিল দেশের প্রাজ্ঞ ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্যবিশারদদের মতামত নেওয়া। যুগটা সোশ্যাল মিডিয়ার। বাংলা একাডেমির নিজস্ব ফেসবুক পেজে পাবলিক ওপিনিয়নটাও জানতে চাইতে পারত তারা। এসবের কোনো কিছুই না করে বিস্ময়করভাবে মানুষের আবেগের মর্মে আঘাত করে ‘ঈদ’টাকে ‘ইদ’ করে দেওয়া হলো!
ইদানীং কিছু একটা করতে হবে, তাই অহেতুক শব্দ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা বাংলা একাডেমি নিজেদের নামের ওপর চেপে বসা ইংরেজি ভূতটাও কিন্তু এখনো সরাতে পারেনি।
হয়তো একাডেমি শব্দের বাংলা অর্থ তাদের নজরে কেউ আনেনি। অভিধান মতে, একাডেমি শব্দের অর্থ হলো শিক্ষায়তন, সংস্কৃতি পরিষৎ বা পণ্ডিতসভা। প্রবলভাবে প্রচলিত ‘ঈদে’র জায়গায় ‘ঈদ’ রেখে দিয়ে বাঙালি মনশীলতার প্রতীক বাংলা একাডেমি তাদের নাম থেকে একাডেমি শব্দটি ফেলে দিয়ে ‘পণ্ডিতসভা’ করতে পারে!
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।
২২ জুন ২০১৭।