গল্প পড়ার গল্প
প্রচলিত মিথ বারবার ভেঙেছেন বিমল কর
বিমল করের জন্ম ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯২১, প্রয়াণ ২৬ আগস্ট ২০০৩ সালে। বাংলা ছোট গল্পে বিমল কর একটি সময়, একটি যুগ। শুধু তাঁর গল্পের আধুনিকতাই নয়, তিনি আজীবন বাংলা সাহিত্যের তরুণ লেখকদের সঙ্গ দিয়েছেন, তাঁদের নিয়ে গল্পের নতুন নতুন রীতির কথা ভেবেছেন। শেষজীবন অবধি বিমলদা তাঁর সন্তানপ্রতিম তরুণ লেখকদের নিয়ে ছোটগল্পের পত্রিকা গল্পপত্র সম্পাদনা করে গেছেন। বিমলদার মুখেই শুনেছি গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকের শেষের দিকে তরুণ লেখকদের নিয়ে ছোটগল্পে নতুন রীতি—এই শিরোনামে গল্পের আঙ্গিক আর লিখন রীতি পরিবর্তনের সেই আন্দোলনের কথা, অফুরাণ সাহিত্যের আড্ডার কথা। আমরাও পেয়েছি তাঁর দুর্লভ সঙ্গ। এখন যাঁরা পঞ্চাশের উপর বা তার কাছাকাছি, তাঁদের অনেকেই পেয়েছেন বিমল করের স্নিগ্ধ সঙ্গ, বিমল করের গল্পে ছিল কঠিন সত্য উচ্চারণ। ছিল মনের গহনে বিচরণ। মনে করুন ‘জননী’, ‘সোপান’, ‘আমরা তিন প্রেমিক’ ও ‘ভুবন’, ‘আঙুরলতা’, ‘আত্মজা’, ‘কাচঘর’, ‘নিষাদ’-এর কথা। মনে করুন খ্রিস্টীয় রীতিতে আত্মোন্মোচনের কথা। পাপ স্বীকার করার কথা। বিমল কর যেন নিজের কাছে নিজেকে উন্মোচন করেছেন সমস্ত জীবন ধরে।
জননী , নিষাদ, সোপান... পরপর গল্পগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। তিনি ট্র্যাডিশনের বাইরে গিয়ে লিখেছেন অতি আধুনিক এক মনন নিয়ে। প্রচলিত মিথ বারবার ভেঙেছেন। অস্বীকার করেছেন যা প্রবহমান তার অনেকটাই। বিমল করের লেখার ভিতরে এক নির্মোহতা ছিল। জননী গল্পটির কথা মনে করুন। জননী চলে গেছেন, তাঁকে স্মরণ করছে পুত্ররা। জননী সম্পর্কে অতি কথন, মিথ ভেঙে যাচ্ছে। মানুষ কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থ নিয়ে বেঁচে থাকে, কত অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে। কত সামান্য কারণে নিষ্ঠুরতা প্রকাশ করে। মা জননী এর বাইরে ছিলেন না। বরং তার সম্পর্কে যা জানে সকলে, তিনি তাঁর বিপরীতই ছিলেন। এ যেন এক প্রাসাদ ভেঙে পড়ার গল্প। বিমল করের ‘ভুবনেশ্বরী’ উপন্যাসেও ছিল এই মিথ ভেঙে ফেলে সত্যকে উচ্চারণের স্পর্ধা। আর এই উচ্চারণ যেন উন্মোচন। নিজেকে এবং পরিপার্শ্বকে। নিষাদ গল্পটিকে স্মরণ করি এখানে।
‘you begin by killing a cat and you end by killing a man.’ ‘নিষাদে’র কথা আরম্ভ হয় এই ভাবে। তারপর আর একটি বাক্য, ছেলেটা মরবে; লাইনে কাটা পড়বে একদিন। আজ... কিংবা কাল...। এই গল্প একটি বালক আর একটি রেললাইনের। জায়গাটি রুক্ষ নিষ্করুণ পশ্চিমা প্রকৃতি। বিমল করের নানা গল্পে এই প্রকৃতি ছিল বিস্তৃত। ধুধু প্রান্তর, কোথাও কোনো ছায়া নেই, একা মাঠ আর একা মানুষ পোড়ে। এই গল্পের জলকু বছর দশের বালক। বাড়িতে তার শয্যাশায়ী বাবা, রুগ্ন মা আর বছর কুড়ি বাইশের ঢ্যাঙা রোগাটে গড়নের পিসি। রং মাজা মাজা, সাপের মতো লম্বা একটি বেণী তার পিঠের উপর দুলত। তাদের টালির চালের বাড়িরই একটি ঘরে ভাড়া থাকে এক বছর তিরিশের পুরুষ। সে এই গল্পের কথক। জলকু শুধু উধাও হয় প্রায় প্রতিদিন, আর তার পিসি তাকে খুঁজতে অবধারিত ভাবে এসে যায় এই যুবকটির দরজায়। জলকু যেখানেই যাক তাকে ধরে আনতে পারে ওই যুবক। সে জানে এখন জলকু রেললাইনে, লাইন থেকে পাথর তুলে লাইনের গায়ে ছুঁড়ে মারছে। ছেলেবেলায় এই খেলা কে না খেলে, হাতের টিপটা কেমন তা দেখতে। কিন্তু তা সামান্য সময়ের। আর জলকু খেলছে না, পাথর মারছে ভয়ানক এক আক্রোশে, সেই সকাল থেকে বেলা দুপুর, যত সময় না তাকে ধরে আনা হবে। কী বিপজ্জনক! সে মরবে। লাইনে কাটা পড়ে মরবে। পিসি তরুলতার সঙ্গে যুবকটির মেলামেশা নেই, কিন্তু রাতে যখন তার ঘরে গ্রামোফোন বাজে, তরু এসে দাঁড়ায় ঘরের বাইরে বারান্দায়। মুখোমুখি হলে বলত, কালকের ঐ গানটা আজ একবার দেবেন। তার কাছ থেকে ডাকে আসা মাসিক পত্রিকাও চেয়ে নিয়ে যেত তরু। আর জলকুর খোঁজে তার দরজায় আসা তো হতোই। সমস্তঁটাই যেন ছকেবাঁধা।
পড়তে পড়তে সেই পুরাতন প্রেমের কথা মনে পড়ে যায়। অমন দিনে অমন হতো। পিসি খুঁজবে জলকুকে, যুবক প্রথমে গা না করেও বেরোবে বৈশাখের খর রোদ, আগুনে হাওয়ার ভিতর। টিলায় উঠে ঝাঁঝাঁ রোদের ভিতর দেখতে পাবে নীচে রেললাইনের শ্লিপারের উপর জলকু। পাথর ছুঁড়ছে লাইনের গায়ে, লাইনের ধারাল হিংস্রতার গায়ে। বারবার আঘাত করছে। জলকুকে সে ফিরিয়ে আনবে জোর করে। জলকুকে নিষেধ করবে রেললাইনে যেতে। কিন্তু সে জানে, জলকু যাবে। কী সব্বোনেশে খেলায় পেয়েছে ওকে। ও মরবে...। আদুল গা, ছোট একটু ইজের, উদোম পা, লাইনের শ্লিপারের উপর দাঁড়িয়ে জলকু পাথর ছুঁড়েই যাবে। এই বৈশাখে সমস্তদিকে এক অবয়বহীন অতি হিংস্রতা। তাকে আঘাত করতে করতে জলকু শেষ পর্যন্ত কাটা পড়ল। মরণকে এড়াতে পারল না।
সেই রাতে পাশের ঘরে বিনবিনে কান্না। কান্নাও থামল এক সময়। জেগে আছে যুবক। ঘুটঘুটে অন্ধকারে সে যেন লুকিয়ে পড়তে চাইছে। অস্থির হয়ে সে বাইরে এল। তখনো চাঁদ ওঠেনি। পা বাড়াতে গিয়ে ফুলের টবে পা আটকাল। সেই ফুল ছেঁড়া ডাল চিবোন ডালিয়ার গাছ। জলকুর ছাগল মানিকের অপরাধের স্মৃতি। তরু জানত যুবক ফুল আর গান ভালবাসে। তরু জানত তাকেও ভালবাসতে শুরু করেছে সে। একদিন আঁধার হয়ে আসা ঘন মেঘের দুপুরে অসাড় পায়ে তরু তার ঘরে গিয়েছিল। ঝড়ে আসা ধুলোর ভয়ে জানালা বন্ধ ছিল। দুজনে যখন অতি নিকটে, সেই সময় ছুটে জলকু এসে ঘরে ঢুকল। জলকু তার মানিককে খুঁজছে। সেই ছিল জলকু আর তার মানিকের অপরাধ। মানিক মরেছিল। সেই শোকে জলকু জ্বরে পড়েছিল। জলকুর সোহাগের ছাগলছানা যুবকের টবের দুটি ডালিয়ার গোড়া অবধি চিবিয়ে খেয়েছিল। একদিন রাগের মাথায় ছাগলটার দিকে গ্রামোফোনের দম দেওয়া হাতলটা ছুঁড়ে মেরেছিল। মানিক মরে গেল। মারতে চায়নি, তবু মরে গেল জলকুর ছাগলছানা মানিক। তারপর সমস্তদিন আর প্রায় সারারাত লুকিয়ে রাখা মানিককে চটে জড়িয়ে রেললাইনে ফেলে দিয়ে এসেছিল সে। যেন লাইনে কাটা পড়েছিল মানিক।
সেই আক্রোশে পাথর ছুঁড়তে ছুঁড়তে জলকুও মরে গেল লাইনে কাটা পড়ে। বিমল কর তাঁর গল্পে যেন খ্রীষ্টিয় রীতিতে আত্ম উন্মোচন করেন। এই গল্পের নিষাদ তার হত্যাকান্ডের কথা বলে গেল ধীরে ধীরে। এই নিষাদ তার পাপের জন্য দায়ী নয় হয় তো। সে তো মারার জন্য মানিকের দিকে ছুঁড়ে মারেনি দম দেওয়ার হ্যান্ডেলটি। কিন্তু মরেই গেল জীবটি। জলকু জানল রেললাইন খেয়েছে তাকে। রেললাইনের উপর আক্রোশ দেখাতে দেখাতে মরল জলকু। মানিক না মরলে সে মরত না। আর মানিক তো অপরাধীই ছিল। তরু আর তার নিবিড় মুহূর্তে মানিককে খুঁজতে জলকু ঢুকে পড়েছিল তাদের ঘরে। রাগ তো ছিলই। কী আশ্চর্য এক গল্প ‘নিষাদ’। আর ‘জননী’। ‘সোপান’। তাঁর কত গল্প। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন গল্প বলা। তিনি শিখিয়েছেন কীভাবে আত্মোন্মোচন করতে হয়। কিন্তু তা ছিল তাঁরই কথা সব। আমরা তত আধুনিক কি হয়েছি এখনো?