প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির প্রবাদপুরুষ ভিত্তোরিও ডি সিকা
চার্লস থমাস স্যামুয়েলসকে ১৯৭১ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ডি সিকা বলেছিলেন, ‘আমার জীবনে অর্থই অনর্থ। আমার যত ভালো ছবি, যেগুলোর পেছনে আমি টাকা ঢেলেছি, কিচ্ছু করতে পারিনি। অথচ আমার বাজে ছবিগুলোই অনেক আয় করেছে’। স্যামুয়েলসের বিখ্যাত বই ‘এনকাউন্টারিং ডিরেক্টরস’-এ রয়েছে এই বিখ্যাত সাক্ষাৎকার।
নিজের জীবনের সারমর্ম ভিত্তোরিও ডি সিকা এভাবেই টেনেছেন। ভালো ছবি, মন্দ ছবি- এই দুয়ের মিশেলেই ভিত্তোরিও ডি সিকা। ইতালিয়ান নিওরিয়ালিস্ট ঘরানার , তথা চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম সেরা পরিচালক তিনি। সত্যজিৎ রায় নিজেই নাকি ‘বাইসাইকেল থিফ’ দেখেছিলেন প্রায় ২০০ বার। অথচ এ ছবিগুলোর সাথে তাঁর অন্যান্য বা পরবর্তী ছবিগুলোকে মেলানো কঠিন। সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব পরে আসুক, সমাজ বা যাপিত জীবনের মুখে প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া ‘বাইসাইকেল থিফ’ (১৯৪৮)-এর সাথে কোনো অবস্থাতেই ‘উওমেন টাইমস সেভেন’ (১৯৬৭), ‘আ প্লেস ফর লাভার্স’ (১৯৬৮) কি ঠিক মেলে? অথবা সোফিয়া লোরেন-রিচার্ড বার্টন জুড়িরে ‘দ্য ভয়াজ’ (১৯৭৪)?
ডি সিকার ক্যারিয়ার বিচিত্র। সাফল্যের সাথে সাথে তিনি পেয়েছেন বিস্ময়কর ব্যর্থতা। বাইসাইকেল থিফের কথা হিসেবের বাইরে থাকাই ভালো। তাঁর অন্য ছবিগুলো নিয়ে কিছু কথা হতে পারে। বেশ কিছু ছবিতে ডি সিকা যে সাফল্য পেয়েছেন, তা নিয়ে তিনি তেমন উচ্ছসিত ছিলেন না (এমনকি তাঁর নাকি বিশেষ আশাবাদও ছিল না এগুলো নিয়ে!) কখনোই। এ ছবিগুলো নিয়ে তেমন কথাও তিনি বলেননি। এগুলোর মধ্যে দ্য গোল্ড অব নেপলস (১৯৫৪), টু উওমেন (১৯৬১), ফিলুমেনা মারতুরানো’র (১৯৬৪) প্রসঙ্গ আসতে পারে। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে বলা যেতে পারে টু উওম্যানের কথা। আলবার্দো মোরাভিয়ার বিখ্যাত উপন্যাস থেকে নির্মিত এই ছবি অস্কার পর্যন্ত জিতে নিয়েছিল। অথচ তাঁর নিজের পছন্দের ছবি বা ‘ভালো ছবি’র কথা বললে ‘উমবার্তো ডি’ (১৯৫২) ছিল একদমই ব্যর্থ, একদমই ফ্লপ ছিল ছবিটি।
দ্য গোল্ড অব নেপলসের কয়েক বছর পর নিজের বিনিয়োগে দুটো ছবি বানিয়েছিলেন ডি সিকা। দ্য রুফ (১৯৫৬), আনা অব ব্রুকলিন (১৯৫৮)। ছবিগুলো ডি সিকার পছন্দের এবং অনেক ভালোবাসার হলেও সেগুলো ব্যবসায়িক সাফল্য পায়নি। সত্যি বলতে ‘টু উওমেন’ না হলে নিজরূপে ফিরতে মুশকিল ছিল তাঁর!
‘ফিলুমেনা মারতুরানো’ (১৯৬৪) নিয়ে যখন ডি সিকা এলেন, তত দিনে ইতালিয়ান চলচ্চিত্রে নব্য-বাস্তববাদের ধারা মোটামুটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। এমন সময় সেই ডি সিকা বাজালেন পুরনো সুর। হয়তো ব্যর্থই হতেন, কিন্তু হতে দেননি মার্চেল্লো মাস্ত্রোয়ানি-সোফিয়া লোরেন জুটির অসামান্য অভিনয়। ডি সিকার জন্য ‘অপ্রত্যাশিত’ হলেও দারুণ সফল এই ছবি।
‘বাইসাইকেল থিফ’ এর প্রসঙ্গ আনা যেতে পারে এখন। সাফল্য-ব্যর্থতার হিসেব যেমনই হোক, ডি সিকা কখনোই আরেকটি বাইসাইকেল থিফ তৈরি করতে চাননি। নিও রিয়ালিস্ট তত্ত্বের ওপর ভর করে থাকেননি আজীবন। একইসাথে, শিল্পের জন্য কখনো সামান্যতম সমঝোতা করেননি। কিংবা কপটতাও ছিল না তাঁর। সোজাসাপ্টা স্বীকারোক্তি করেছেন নিজের ছবি নিয়ে। যাচাই করেছেন নিজের বিখ্যাত সব ছবিকে ‘সামান্য’ হিসেবে। আবার যে ছবিগুলোকে নিয়ে কোনো কথাই হয় না, সেগুলোকে নিজের ‘সেরা কাজ’ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। যুদ্ধ-পরবর্তী ইতালির অসহায় মানুষদের দুর্দশা দেখতে তিনি সরাসরি ঘুরে বেরিয়েছেন পথে পথে। সিনেমা নির্মাণে তাঁর বোধ-অনুভূতি হয়তো অনেকাংশে, ফিল্ম-টেকনিকের চেয়েও ঢেরগুণে কার্যকরী হাতিয়ার ছিল।
ভিত্তোরিও ডি সিকা ১৯০১ সালের আজকের দিনেই, ৭ জুলাই জন্ম নিয়েছিলেন ইতালিতে। পরিচালনা করেছেন ৩৫টি ছবি। অভিনেতা হিসেবে তাঁর কাজের সংখ্যা ১৫৮। ১৯৭৪ সালের ১৩ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন তিনি।