সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন

যতখোন নিজেগো উঠানভরা গেরামের মানুষজোন আছিলো, ততখোন জুলেখার মায় তার মাইয়ারে কোনো কথা কয়ও নাই; কী কোনো প্রকারে কিছু জয়-জিজ্ঞাসও করে নাই।
থাউক! লোকের সামোনে আবার বেবুঝ মাইয়ায় কী কইতে কী কইয়া ফালাইবো! হেশে শরমের তলে পড়তে হইবো! এই মোনে নিয়া মায়ে তখন মাইয়ারে জাবড়াইয়া ধইরা বইয়া আছিলো তো আছিলোই।
তার বাদে তো ইমাম হুজুরের কথা মান্যি কইরা গেরামের সগলতেই জুলেখাগো বাড়ির তেনে সোন্দর মোতোন বিদায় নিছে। একটা ঝটকার মধ্যে বাড়ি একেবারে নিরালা নিরাছাড়া হইয়া গেছে ! অখন তো জুলেখার সামোনে দূরের অড়শি-পড়শি কেউই নাই! মায়ে বুইজ্জা পায় না, তাও ক্যান তার মাইয়ায় এমুন থোম-ধরা! এক্কেবারে থোম ধরা। লড়ে না চড়ে না, হেলে না; এট্টু বেঁকে না তরি তার মাইয়ায়! ক্যান!
ঠাকুরবাড়ির ঘাটলায় তারে পাওনের পর থেইক্কা নিজে গো বাড়ির উঠানে আইন্না বহানো পর্যন্ত একটা টুঁ আওয়াজ তরি করে নাই সেয়! বহানের পরেও তো কতোক্ষণ গেলো গা! কোনোরকম আওয়াজ নাই তার গলায়! কোনো একটা কথা নাইক্কা তার মোখে!
ক্যান! কথা কয় না ক্যান উয়ে!
সেই যে ঘাটলায় খালি কোনোমতে একবার কইছে, ‘মা, আমি আইছি!’
মাইয়ার মোখে কথা বলতে আইছে খালি অইট্টুকই! আর কোনো একটা কথা না! একটা ডাক-খোঁজ কিচ্ছু না! পুরা তবদা লাগা; পুরা য্যান নিঃসাড় কাঠের পুতলাটা, উঠানে পড়া!
এইটা কিমুন বিত্তান্ত!
এই নিরালা বাড়িতে, মায়ের লগে বওয়া দিয়াও ক্যান মাইয়ায় ঝুম মাইরা থাকে!
সেই ঠাকুরবাড়ির ঘাটলায় যেমনে সেয় বওয়া আছিলো, সেইনে যেমুন তার মোখ মাটির দিগে নামাইন্না আছিলো, বাড়িতে আইয়াও সেই একই রকমে বওয়া দিয়া আছে জুলেখায়!
বাড়ির তেনে তো অন্য মাইনষেরা কুনসুম গেছে গা! ভিটি পুরা খালি হইয়া যাওনের পরেও তার মোখ সেই নামাইন্নাই থাকে ক্যান!
জুলেখায় এমুন ঝিমায় ক্যান!
মাটিতে লেট দিয়া বহা মাইয়ায়, কিন্তু তারে লাগে য্যান সেয় জাগনা নাই!
অবস্থাখান মায়ের চক্ষে ভালা ঠেকে না। এইটা কেমুন দশা লইয়া ফিরতি আইছে তার জুলেখায়! অর কী হইছে!
মায়ের কইলজাটা ডরে কাঁপানি দিতে থাকে থাইক্কা থাইক্কা। আবার তার অন্তর দেখো কিমুন জানি ছ্যাতছ্যাতাইতেও থাকে!
জুলেখায় নি কিছু নিয়া বেজার হইছে এইর মইধ্যে! বেজার হইয়া এমুন করতাছে! গোস্বা হইছে জুলিয়ে? ক্যান গোস্বা হইবো! ইমাম হুজুর গো বাইত দেইখ্যা গোস্বা করছে নি মানিকে!
তাগো বাড়িতে অখন থাকার মধ্যে আছে ইসুফ মিয়ার মায়ে, ইমাম হুজুরে আর মংলার মায়। এই তিনজোনরে কি আর অখন বাইরের মানুষ হিসাবে ধরে জুলেখার মায়! হেরা অখন তার আপনার তেনে আপনা! রক্তের কুটুমের তেনে বেশি ভরসার মানুষ হেরা! হেরা যে আছে, সেইটা তো জুলেখার মায়ের সাত কপালের ভাগ্যি!
কিন্তু অই তিনজোনে যে অখন এইনে বইয়া রইছে, সেইটা নিয়া নি মাইয়াটার অশান্তি হইতাছে! হেইর লেইগা নি উয়ে এমুন মাথা নিচা কইরা থুইছে!
নাকি মাইয়ারে যে লগে লগে ঘরের ভিতরে নেয় নাই মায়ে, সেইটা নিয়া অন্তরে দুক্ষু হইছে অর!
কিন্তুক, কেমনে মায়ে নাওয়ানি-ধোয়ানি না দিয়া মাইয়ারে ঘরে তোলে! সেইটা নি কোনো প্রকারেই করোনের কোনো রাস্তা আছে! কোনো রাস্তা নাই।
সগল কিছুর একটা নিয়ম-রীতি আছে তো! সেইটা না মানলে অমোঙ্গল আইবো যে! বালা-মুসিবতরে কি আরো ডাক পাইড়া বাড়িতে আনবো মায়ে!
অইছে তো! অনেক হইছে। আর কতো! আর কতো!
ভিতরে এই পদের নানজাতের জ্বালা-যাতনা হইতে থাকে মায়ের, কিন্তু বাইরে সেইটা সেয় কেউইরে বোঝতে দিবো না বইল্লা মন স্থির করে। ‘দেহি! দয়ালে নসিবে আরো কতো কষ্ট দিয়া থুইছে!’ নিজেরে এই বুজ দিয়া সেয় মাইয়ার লগে কথা কওয়া ধরে।
‘জুলেখা! মাগো, তুমি মোখ তুইল্লা চাও!’ মায়ে মাইয়ারে ডাক দেয়। কিন্তু মাইয়ার কানে য্যান সেই ডাক পৌঁছেই না। ‘ও জুলি! কথা হোন!’ মায় আবার ডাকে; মাইয়ার কোনো সাড়া নাই। সাড়া নাই ক্যান! মায়ে তরাস চক্ষে মাইয়ার দিগে চায়।
অম্মা! কেমনে সাড়া দিবো মাইয়ায়! সেয় তো আউল্লা-পাথাইল্লা ঝুমাইতাছে! উয়ে হুঁশে আছে নি যে, হুমুইর দিবো!
মায়ের অন্তরে কিমুন য্যান সন্দো লাগে! জুলেখায় হুঁশে নাই কে কয়! হুঁশ আছে অর।
তয়, মায়রে সাজা দেওনের লেইগা এমুন কুয়ারা করতে ছাড়তাছে না জুলেখায়!
মাইয়ায়, মোনে অয়, ইচ্ছা কইরাই এই বিটলামি করতাছে! ভাবে দেহাইতাছে যে, হুঁশ নাই। কিন্তুক ভিতরে আসলে হুঁশ আছে। এমুন করতাছে উয়ে বাড়িতে এত্তা মানুষ দেইক্ষা।
দেহো আলা মাইয়ার না-বুঝপনা! এমুন করলে চলে দুনিয়ায়! বাড়িতে যে হেরা আইছে, এইটা কি হাউস কইরা আইছে তারা?
না না! তারা আইছে জুলেখার মায়রে বিপদ তেনে বাঁচানি দিতে!
দেখো সেয় তো এমনে বইয়া রইছে মাইয়ারে নিয়া!
অদিগে, তার হাতের লাঠি মংলার মায়ে কতো কী কইরা থুইতাছে!
মংলার মায় না থাকলে একলা জুলেখার মায়ে কেমনে কী করতো!
অই যে আরেক জোন—জুলেখার মায়ের মাথার উপরের ছেমা—অই যে ইসুফ মিয়ার মায়—অখন যেয় জুলেখার মায়ের ধরম-বইন! সেয় যুদি এমনে নানামতে আগলানি দিতে না আইতো; জুলেখার মায়ে অখন, এই আঁতকা ফিরতি আওয়া মাইয়াটারে লইয়া কী করতো! কেমনে যে কী করতো, সেইটা খোদাতাল্লায় জানে!
আর, সগল বালা-মুসিবতে যেয় নিদানের পথ বাতলাইয়া দেয়, পোথ বাতলাইন্না অই মানুষটায়—এই ইমাম হুজুরে—এমনে বওয়া দিয়া না থাকলে জুলেখার মায়ে আন্ধা-ধোন্ধা কিয়ের তেনে কী করতো—এই মাইয়ারে নিয়া?
একলা হাতে সেয় কোনদিগ সামলাইতো! একলা হাত-রথ দিয়া কোন কর্মখান হইতো জুলেখার মায়ের! এই যে অখন সেয় মাইয়ারে জাবড়ানি দিয়া বইয়া রইছে, ওদিগে দেখো ইসুফ মিয়ার মায়ে সিজিল মোতন জুলেখারে ঘরে তোলোনের নানান বয়-বন্দোবস্ত করতাছে!
এইটা কি জুলেখায় বোজতাছে না? তাইলে মাইয়ায় ক্যান বেজার! ক্যান সেয় এমুন ঝিমান্তিতে থাকোনের ভং করতাছে!
নাকি হাছা হাছাই মাইয়ায় আধা বেহুঁশ! অ খোদা! হাছা হাছাই তার মাইয়ায় তাইলে কেমুন জানি অইয়া গেছে! কী গরদিশ নামলো আবার নয়া কইরা—এই ভিটায় ! মাবুদ!
‘এমুন ঝিমায় ক্যান উয়ে! ও বুজি! আইয়া এট্টু দেখতেন যুদি!’ মাইয়ার ভালা-বুরার নানান চিন্তায় বেদিশা হইতে হইতে শেষে জুলেখার মায়ে বোঝে যে, তার পরান আর একলা একলা অই সগল ভাবনা নিয়া থাকতে পারতাছে না! পারতাছে না।
না পাইরা সেয় তখন ইসুফ মিয়ার মায়রে ডাক দেয়।
শত হইলেও তো ইসুফ মিয়ার মায় মুরুব্বি মানুষ! দুনিয়াদারি তো সেয় কম দেখে নাই! কম চিনেও নাই! তাইলে অখন সেয় একবার আইয়া ভালা কইরা দেখুক, জুলেখায় যে এমুন করতাছে—এইটা কিয়ের লক্ষণ!
রান্ধন ঘরে ইসুফ মিয়ার মায়ে হেন-তেন শত কাম জোড়াইয়া না দিয়া পারে নাই। এই সকল কামে জুলেখার মায়রে ডাকতে তার অন্তর সায় দেয় নাই। আহহারে! দুক্ষিণী আবাগী এতো দিনে ফিরা পাইছে তার কইলজার টুকরারে! থাকুক উয়ে আঞ্চলের নিধিরে উরে লইয়া! থাকুক! সেয় মংলার মায়রে লইয়াই সোন্দর হালে নিয়ম-রীতির জয়-জিনিস জোগাড়-পাতি করতে পারবো।
এই মোনে নিয়াই না ইসুফ মিয়ার মায়ে রান্ধন ঘরে আইয়া নানান কামে হাত দিছে! সগলতের আগে মাইয়াটারে দিতে হইবো গোছল। যতো তরাতরি পারা যায়, সেই গোছলের কর্মখান সারোন লাগবো। যতো দেরি হইবো, বালা-মুসিবত না ততো শইল্লে গাড়াইয়া যাইতে থাকবো!
শনির দিষ্টি কাটানির লেইগা কি গুঁটি-বসন্ত ভালা হইয়া যাওনের পরে শীতলা মায়ের আছর ছুটানের লেইগা দেওভোগ গেরামের মাইনষে কী করে! নিমপাতা আর কাঁচা হলদি বাটা দিয়া বিমারিরে গোছল দেয়। দুষী শইল্লেরে শোধন দেওনেরও অইই বিধি।
জুলেখায় বিমারি না। কিন্তুক উয়ে তো আঁতকা নাই হইয়া গেছিলো! অমুন নাই-হইয়া যাওয়া একজোনরে শোধন না দিয়া ঘরে কি নেওন যায়? যায় না। ইমাম হুজুরেও সেই একই মত দেয়। আগে মাইয়াটারে শোধন দেওন, তার বাদে ঝাড়-ফুঁক যা দেওনের দেওন যাইবো নে।
মংলার মায়ে ইমাম হুজুরের ফরমাইশ মাফিক তরাতরি কাঁচা হলুদ আর নিমপাতা বাটতে বইছে। আর অদিগে ইসুফ মিয়ার মায়ে চুলা ধরাইয়া নিমপাতা দিয়া এক পাতিলা পানি জ্বাল দিতাছে। অই কাম করতাছে বইল্লা কিন্তু সেয় নিজের হাত বন্ধ রাখে নাই! সেয় করতাছে কী, ধুইচ্চা কতাটি রসুনও কুইট্টা লইতাছে।
জুলেখারে কোনো প্রকার বান-বাতাসের দোষে পাউক নাইলে না পাউক, আগে অরে সাতবার নিমপাতা-কাঁচা হলদি বাটা শইল্লে মাখাইয়া দোষ-কাটানি গোছল দিতে হইবোই। তার বাদে নিমপাতা সেদ্ধ পানি দিয়া শইল শুদ্ধ করোনের কথা কইছে ইমাম হুজুরে।
হেইটা তো করাইবোই ইসুফ মিয়ার মায়ে। তার লগে সেয় আরো একটা কামও করাইবো। সোনা-রুপা ভিজাইন্না পানি দিয়াও সেয় জুলেখারে শোধন দিবো। সেইটার পরে কাঁচা দুধ মিশাইন্না পানিও সেয় সাত লোটা জুলেখার মাথায় দেওনের নিয়ত করছে।
অতো পদের গোছল শেষ না কইরা, করতে হইবো অন্য গুরুতর কয়টা কাম।
গোছলের পরে বড়ো ঘরের দুয়ারের বাইরে মাইয়াটারে খাড়া করুন্তির কাম আছে। অরে খাড়া করাইয়া এই কাঁচা রসুনটি মোখে দিতে হইবো। সেই রসুনরে ভালারকমে চাবানি দিয়া গিলাইতে হইবো জুলেখারে। ভালা মতোন, পুরা ল্যাতা ল্যাতা কইরা চাবাইয়া, তয় গিলোন! নাইলে মাইয়াটার ভিতরটা ঠায়-ঠিক হালে শোধানি পাইবো না।
তার বাদেও কাম কী একটা-দুইটা থাকবো! থাকবো দুনিয়ার কাম।
জুলেখার ভিজা চুলের আগা কাটুন্তির কাম আছে! আর আছে – অই যে ছিঁড়া তেনা তেনা পিন্ধনের কাপড়খান- এইটারে বাড়ির উত্তরের নামায় নিয়া দবদবাইন্না আগুন দিয়া পুইড়া ছাই করোন।
সেই কামখান নাইলে মংলার মায়ের লগে হাত লাগাইয়া ইসুফ মিয়াগো কামলাটিয়ে কইরা নিবো নে! কিন্তু অন্য তামানটি কাম তো করতে হইবো তারে, আর জুলেখার মায়রেই!
কোন প্রকার শোধন দেওনে কারপিন্নি করলে যে চলবো না—এই কথাটা ক্যান জানি খালি খোনে খোনে তার মোনে আইতাছে! ক্যান জানি ঢোক্কে ঢোক্কে তার অন্তরে কইতাছে যে, বিষয়খানরে হালকা কইরা নেওনের উপায় নাই! বিষয়খান গুরুতর!
সকালে ইসুফ মিয়ার মায়ে আইয়া, উঠানে বহা জুলেখারে খালি এক নজর দেখছে; তার বাদেই তো সেয় আইয়া রান্ধন ঘরে নানা কামের ভেজালে পড়া। অই যে এক ঝলক দেখা, অইতেই ক্যান জানি তার ভিতরে কেমুন কু-ডাক ডাকতাছে! সেইটা ভাইঙ্গা কইয়া কেউইরে বুঝাইতে পারবো না ইসুফ মিয়ার মায়ে। খালি তার নিজের ভিতরে কেমুন জানি কাছুর-মাছুর হইতাছে!
সেই অশান্তিরে গোনায় না নিয়া ইসুফ মিয়ার মায়ে তার হাতে একটার পর একটা কইরা নানা কাম নিতে থাকে। সেয় নানা কাম সারতে থাকে, আর মংলার মায়রে একের পর এক ফরমাইশ দিতে থাকে।
এই যে বাটাবুটি, এট্টুক সাইরাই য্যান মংলার মায়ে লউর দেয় ইসুফ মিয়া গো বাড়ির দিগে। গিয়া য্যান ইসুফ মিয়ার ফুবুরে কয়, খামাখা কইরা ছোটো মাইট্টা কলসিটারে ভইরা য্যান এক কলসি কাঁচা দুধ দিয়া দেয় সেয় মংলার মায়ের হাতে। লগে একটা নয়া কাপোড়ও য্যান দিয়া দেয় সেয়—জুলেখারে পিন্ধানের লেইগা। আর, মংলার মায়ে য্যান তার লগে কইরা ইসুফ মিয়াগো একটা কামলারেও নিয়া আহে। এই বাড়িতে নানা কামে লাগবো কামলাগো একজোনরে! এই যে এতাটি কথা কইলো ইসুফ মিয়ার মায়, তার একটা কথাও য্যান মংলার মায় না ভোলে।
মংলার মায়ে পাটা-পুতা নিয়া বহা। সেয় আধা-থেঁতলা, পিছলা পিছলা নিমপাতাটিরে মিহিন করোনের লেইগা শক্ত বাটা দিতে দিতে ইসুফ মিয়ার মায়ের কথা অর্ধেক কানে নেয়, অর্ধেক কানে নেয় না। মোনে মোনে সেয় নিজেরে কইতে থাকে, আগে হাতের কাম তো শেষ হউক। তার বাদে যখন সেয় অই বাড়িতে মেলা দিবো, তহন ফিরা জিগাইয়া নিতে কতখোন!
রান্ধন ঘরের ভিতরে ইসুফ মিয়ার মায়ের অই-তাই নানান পদের হুকুম আধা-সাধা কানে তোলতে তোলতে মংলার মায়ে হোনে, অই ত্তো! জুলেখার মায় দেহি ডাক পাড়তাছে!
সেয় দেহি হাবুইট্টা ডাক পাড়তাছে ইসুফ মিয়ার মায়রে!
কী কী! বিত্তান্ত কী! তরাতরি কইরা ইসুফ মিয়ার মায়ে রান্ধনঘর তেনে বাইর হয়। মংলার মায়ে যে আর পাটাপুতা নিয়া থাকে, সেই মাতারিও সেই উপায়টা দেখে না! সেয়ও ধুছমুছাইয়া বাইর হয়।
ক্যান, ক্যান এমুন বেতালা গলায় ডাক দিলো জুলেখার মায়! কী হইছে! কী!
না, মাইয়ার ভঙ্গি-ছঙ্গি কেমুন জানি ডর ধরাইয়া দিতাছে বোলে জুলেখার মায়েরে!
এমুন ঝুমায় ক্যান তার জুলেখায়!
‘বুজি! দেহেন কেমুন জানি করতাছে উয়ে!’ এইবার জুলেখার মায়ের চক্ষের পানিরা আর আটকাইন্না থাকতে রাজি হয় না। তারা ঝপঝপাইয়া পড়তে থাকে। কিছু পড়ে উঠানের মাটিতে, কিছু পড়ে জুলেখার কান্ধে-পিঠে।
কিন্তু কী আচানক কারবার! এই যে মায়ে এমুন কান্দতাছে, এই যে মংলার মায়ে আর ইসুফ মিয়ার মায়ে আইয়া তাগো মায়ে-ঝিয়েরে এমুন ঘিরা খাড়াইছে; সেই সবের কোনো কিচ্ছুর দিগে জুলেখার যুদি কোনো খেয়াল থাকে!
সেয় নিজের মতোন ঝিমানি দিতেই আছে; দিয়াই যাইতাছে।
দুনিয়ার কোনো কিছুর দিগে অর হুঁশ নাই! চোখও তার খোলা নাই।
এইটা কী বেপার!
সোন্দর বহা দিয়া আছে মাইয়ায়, কিন্তু সেয় য্যান জাগনা নাই।
এতখোন হইয়া গেলো সেই একই রকম বহা জুলেখায়! সেই একই রকম ঝিমান্তি দিতে থাকা সেয়! এইটা কেমুন বিষয়! এই ভেদের মীমাংসা করে সেই শক্তি নি ইসুফ মিয়ার মায়ের আছে!
ইসুফ মিয়ার মায়ে বাক্যিহারা হইয়া খাড়া দিয়া থাকে।
বিত্তান্ত দেইক্ষা মংলার মায়ের অন্তরাত্মা এমুন টাসকি খাইয়া যায় যে; পাটা-পুতা ,বাটা-বুটি- কোনো কিচ্ছুর কথাই তার আর স্মরণে আহে না।
জুলেখার মায়ের ফোঁপানির আওয়াজ ইমাম হুজুরের কানেও আহে। সেয় এট্টু ফারাকে বহা দিয়া আছে সেই কুনসোম তেনে। এট্টু আউইলে বইয়া আছে সেয় দুই কারোনে। এক হইল, বাড়িতে থাকার মিদে আছে খালি কয়টা মাতারি। তাগো চলা-চলতির সুবিধার লেইগা সেয় এট্টু ফারাকে গিয়া বইয়া রইছে। দুই হইল, জুলেখারে দেইক্ষা তার চিত্তি নাই-কারোনেই মোছড় দিয়া উঠছে!
বাড়ির মাতারিটি আলা কী বুঝতাছে কে জানে! কিন্তু ইমাম হুজুরের কাছে জুলেখার লক্ষণ ভালা ঠেকে নাই। ভাবে বুঝা যাইতাছে মাইয়ার শইল-স্বাস্থ্য ঠিকই আছে। কিন্তু তার য্যান চেতন নাই।
জুলেখায় জাগনা, কিন্তু মোটের উপরে য্যান হুঁশই নাই তার। এইটা কিমুন আলামত! এমুন কিসিমের কোনো আলামত সেয় তো তার এই এত্তা লাম্বা জিন্দিগীতে দেখে নাই! কোন প্রকারে বেক্ষান দিবো সেয়—এই বিষয়খানরে!
ফারাকে বইয়া এই নিয়াই নানামতে ভাবনা করতাছিলো এতখোন ইমাম হুজুরে। জুলেখার মায়ের কান্দন হুইন্না সেয়ও ধুছমুছ পাওয়ে আইয়া খাড়ায় জুলেখার মায়েগো মায়-ঝিয়ের সামোনে।
‘দেহো তো মাতারিটির কারবার!’ হুজুরে ভিতরে ভিতরে এট্টু বেজার হইয়া যায়, ‘কই কিনা তরাতরি মাইয়াটারে ঘরে তোলনের আঞ্জাম করব; সেইটা না কইরা কিনা হেরা খাড়াইয়া খাড়াইয়া দেখতাছে জুলেখার মায়ের কান্দন; আর হুদাকামে উতলা হইতাছে অই মাইয়ার ঝিমান্তি লইয়া!’
(চলবে)