করুণাময় গোস্বামী : গানের মানুষ, প্রাণের মানুষ
করুণাময় গোস্বামী। চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। তবু তাঁর উপস্থিতি ফুরোতে চায় না। গানের ভুবনটা যে তিনি কীভাবে দখল করেছিলেন, সেটা অনুমান করে বলা যাবে না। গানের এমন কোনো খুঁটিনাটি থেকে বৃহৎ বিষয় নেই, যা তিনি জানতেন না। কখনো কোনো বিষয় জানতে চাইলে একদম চলন্ত অভিধানের মতো বলে দিতেন। যেমন স্মরণশক্তি ছিল, তেমনি ছিল তাঁর পাণ্ডিত্য। দুইয়ের সম্মিলন তাঁকে সাধারণ থেকে অসাধারণে পরিণত করেছিল।
আমি তাঁকে জানতাম। উদীচী করার সূত্রে তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল আরেক গুণী মাহমুদ সেলিমের মাধ্যমে। তারপর পত্রিকায় লেখার কারণে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল একটা সময় পর্যন্ত। একজন তরুণের সঙ্গেও আড্ডা জমাতে তাঁর সময় লাগত না। ছিলেন প্রাণের মানুষ, গানের মানুষ; সংগীতে ছিলেন আজীবন সমর্পিত। খুব রাশভারি মানুষ ছিলেন। তবে এক ধরনের বাউলিয়ানাও ছিল তাঁর মধ্যে। জাগতিক লাভ-ক্ষতির বিচার তিনি কখনো করেননি। গানের ভেতর দিয়ে ভুবন দেখার শক্তি ও আনন্দ ছিল তাঁর মধ্যে, এই আনন্দরস সবার মাঝে বিতরণে তিনি খুঁজেছেন জীবনের সার্থকতা।
ভারতবর্ষীয় সংগীতের যে বৈচিত্র্য এবং তা যে সংগীত-সমুদ্রের সমান, তা করুণাময় গোস্বামী বুঝেছিলেন। রস আস্বাদন করেছিলেন। সংগীতের সুধারসে ডুবেই থাকতেন তিনি। চারপাশের জীবন, জগৎ, প্রকৃতি সম্বন্ধেও ছিলেন সমান আগ্রহী। জগৎ, জীবন, সংগীতের সঙ্গে তিনি এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন যে গানের চর্চার মধ্যেও তিনি ছিলেন উৎসের শিকড়সন্ধানী। সাধনার এমন স্তরে তিনি নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন যে সাধকের দৃষ্টি দিয়ে দেখতেন বিশ্বকে। প্রাচীন ভারতের সাধকদের দ্বারা ভীষণভাবে তাড়িত ছিলেন তিনি। সাধকের সে স্তর থেকেই জগৎ-জীবনকে দেখতেন তিনি। বহুমাত্রিক এক সাধকের বিশাল ব্যাপ্তিতে জীবন অবলোকনের তাগিদ অনুভব করতেন করুণাময় গোস্বামী। তাঁর ভাবনা-রসে ডুবে থাকার বিষয়টি ছিল প্রাত্যহিক। কথার মধ্যেও তিনি হারিয়ে যেতেন। জনারণ্যেও থাকতেন একা। তাঁর এই সাধকসুলভ জীবনাচরণ অনেকেই ভুল বুঝতেন। ভাবতেন তিনি অহংকারী। আসলে চলার পথে ভাবনা-রসে এতটাই ডুবে থাকতেন যে সহসা অনেক কিছুই এড়িয়ে যেত।
গানের বইয়ের পিছে ছুটতেন যেখানেই যেতেন। তাঁর সংগ্রহ ছিল বিশাল। সংগীতজ্ঞানী হিসেবে তাঁর রচনাদি ও বক্তৃতা-আলোচনা সবকিছুতে জুগিয়েছে অনন্য বৈশিষ্ট্য এবং সাহিত্যিক হিসেবে এমন একমাত্রায় তাঁকে উন্নীত করেছিলেন নিজেকে, যার তুলনা বাংলায় তো বটেই, এমনকি উপমহাদেশীয় সাহিত্যেও বিশেষ নেই। ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশভাগের পর ও তার পূর্বাপর ঘটনা তাঁকে খুব যন্ত্রণা দিত। তাঁর বিশ্বাস ছিল, দেশভাগ না হলে বাংলাদেশ হতো গানের দেশ। দেশ ভাগের কারণে আমরা হারিয়েছি অজস্র সংগীতজ্ঞকে। উপমহাদেশজুড়ে সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি তথা জীবনের সর্বক্ষেত্রে যে দীনতা, শূন্যতা, বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে তার হদিস এখনো আমরা পুরোপুরি করে উঠতে পারিনি। তবে সংগীতে সমর্পিত হতে হলে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার যে জরুরি প্রয়োজন, তার প্রমাণ ছিলেন তিনি নিজেই।
করুণাময় গোস্বামীর সাংগীতিক পাণ্ডিত্য ছিল অগাধ। এর কারণ ছিল তাঁর পারিপার্শ্বিকতা। করুণাময় গোস্বামী জন্মেছিলেন ময়মনসিংহ জেলার গোঁসাই চান্দুরা গ্রামে। তাঁদের বাড়িটি ছিল একটি সংগীতাশ্রমের মতো। তাঁর জ্যাঠামশাই কবি, গায়ক ও পণ্ডিত ছিলেন। বাবা গাইতেন না, অভিনয়পাগল ছিলেন, নাট্য সংগঠনে তাঁর খুব আগ্রহ ছিল। গ্রামে স্থায়ী নাট্যমঞ্চ, মণ্ডপ ছিল। সেখানে বসে মানুষ নাটক দেখত। গোঁসাই চান্দুরা সাংস্কৃতিক গ্রাম ছিল। সারা বছর ধরে প্রতিদিন, প্রতি রাতে কোনো না কোনো বাড়িতে, বিশেষত আমাদের বাড়িতে যাত্রা, নাটক, পদাবলি কীর্তন, নামকীর্তন, নগরসংকীর্তন হতো। বাবার মা, মানে তাঁর পিতামহী ইন্দ্রমণি দেবী কবি, গায়িকা ছিলেন। গান, নাটক, যাত্রায় অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন। শুধু ছেলেদেরই নয়, মেয়ে, বয়স্কদেরও জড়ো করে তিনি এগুলো আয়োজনের ব্যবস্থা করতেন।
পুরো ময়মনসিংহ জেলার কবি সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁর খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। সে কারণে বাবা, জ্যাঠামশাই নরেন্দ্রনাথ গোস্বামীর সঙ্গেও তাঁদের পরিচয় ছিল। প্রতিবছর বৈশাখ মাসের ২ তারিখে তাঁদের বাড়িতে কবিগান হওয়ার পর গোঁসাই চান্দুরা গ্রামে কবিগান শুরু হতো। গ্রামে হরিগান, মেটে হরিগানের মতো বাংলার লোকসংগীত, আধা-লোকসংগীত, রাগসংগীতের মাঝামাঝি ফর্মগুলো হতো। তখন হিন্দুস্তানি গানের ওস্তাদরা ময়মনসিংহের গৌরীপুর, কালীপুর, রামগোপালপুর, কৃঞ্চপুর, আঠোরো বাড়িসহ বিভিন্ন গ্রামে এসে থাকতেন। এ গ্রামগুলো তাঁদের বাড়ি থেকে কাছেই ছিল। ফলে হিন্দুস্তানি দরবারি গানের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল শৈশব থেকেই। ভারত থেকে আসা দরবারি ঘরানার ওস্তাদদের কাছ থেকে গোঁসাই চান্দুরা গ্রামের সংগীত উৎসাহীরা কিছু না কিছু শিখে, শুনে আসতেন। সেটির প্রভাব গ্রামের সংগীত, নাট্যচর্চায় পড়ত। অতি শৈশবে জমিদার বাড়ি থেকে সেতারি, বেহালাবাদক, নর্তক-নর্তকীদের গ্রামে আসতেন সেসব স্মৃতি তিনি ভোলেননি কখনো। তাঁরা নানা পরিবেশনা করতেন। শৈশব থেকেই তিনিও খুব ভালো গান করতেন। ফলে সবার কাছে খুব সমাদর পেতেন।
মামা পবিত্রকুমার গোস্বামীর কাছে গান শিখতেন সেই শৈশবে। স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই গান-বাজনার ভেতরে বড় হতে শুরু করেন করুণাময় গোস্বামী। তাঁর সমস্ত পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় বলা যায়। এমন পরিবেশ থেকে একজন করুণাময় গোস্বামী কেন কয়েক ডজন গুণী মানুষ বের হতে পারত। কিন্তু দেশভাগের কারণে যে আমাদের সমাজ-সামাজিকতা বঞ্চিত হয়েছি, সে কথাই তিনি দেশভাগের আলোচনায় বলতেন। তাঁর শিক্ষাজীবনের দিকে তাকালে দেখি, কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ থেকে সোজা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৬৪ সালে ইংরেজিতে এমএ পাস করেছি। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯৮৭ সালে ‘বাংলা কাব্যের গীতিধারায় কাজী নজরুল ইসলামের স্থান’ বিষয়ে পিএইচডি করেছি। কিন্তু তাঁর জ্ঞানের পরিধি ছিল বিশাল। যে কারণে তাঁর জীবনাচরণে এক বিশাল বৈচিত্র্য ছিল। গানের মানুষ ছিলেন। পড়েছেন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে, আর পিএইচডি করেছেন নজরুল সংগীত বিষয়ে। তারপর প্রবেশ করেন শিক্ষকতা পেশায়।
১৯৬৪ সালের শেষের দিকে নারায়ণগঞ্জের উত্তরায়ণ কলেজে ইংরেজির প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন, একদম অপরিকল্পিতভাবে। এখান থেকে আর বেরোতে পারেননি । ১৩-১৪ বছর সেখানে কাজ করার পর কলেজটি সরকারি হয়ে গেল। ফলে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে পদোন্নতি হলো এবং নারায়ণগঞ্জ মহিলা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসরে গেলেন। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনোটিতে সংগীত, কোনোটিতে ইংরেজি বা কালচারাল হিস্ট্রি পড়িয়েছেন। ২০০৫ সালে ক্যামব্রিয়ান কলেজে প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগ দিয়েছি। কিন্তু গানের বাইরে যাননি কখনো।
ওয়েস্টার্ন মিউজিকের মুভমেন্ট, টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো খুব ভালোভাবে বুঝে নিয়েছিলেন একজন বিদেশির কাছে। পরে এই শিক্ষা খুব উপকারে লেগেছে। নজরুলের ওপর ইংরেজিতে বই লেখার সময় স্টাফ নোটেশনে তাঁর ১৭টি নতুন রাগের আরোহ, অবরোহ দিতে পেরেছিলেন। ওই বিদেশি বন্ধু পেরেইরা তাঁকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন। তাঁর এই আহরণ ক্ষুধা ছিল প্রাত্যহিক। কোথাও কোনো সংগীত অনুষঙ্গ আছে শুনলেই ছুটে যেতেন তিনি। এই সংগ্রহের মধ্যে একসময় তিনি মনে করেন, সংগীত বিষয়ে লেখার লোক কম, তাই এ কাজটা দ্রুত শুরু করা উচিত। সে চিন্তা থেকে ১৯৬৫ সাল থেকে দৈনিক সংবাদে রবীন্দ্রনাথের ওপর ধারাবাহিক লিখতে শুরু করেন। পাঠক পেলেন। লেখাও হলো গতিশীল। সঙ্গে সাহিত্যের অন্যান্য বিষয় নিয়েও কাজ শুরু করেন।
শুরুতে আগ্রহের বিষয় ছিল আফ্রিকার গল্প, কবিতা, লাতিন কবিতার অনুবাদ, আধুনিক লাতিন কবিতার ইতিহাস। অনেক কাজ করেছেন এ বিষয়ে। এ সময় থকেই ভাবনা আসে গানের জন্য নতুন কিছু করার। ইচ্ছে হলো সংগীতের অভিধান ‘সংগীতকোষ’ তৈরি করার। সেখানে ভারতবর্ষের সংগীত, বাংলা গানই শুধু নয়, সারা পৃথিবীর, বিশেষত ওয়েস্টার্ন ও কিছু আফ্রিকান ফর্ম নিয়েও কাজ করতে চাইলেন। ডিকশনারি অব ওয়ার্ল্ড মিউজিক তৈরির জন্য ১৯৬৫ সাল থেকে সারা বছরই এ বিষয়ে প্রতিদিন কিছু না কিছু পড়েছেন এবং লিখেছেন। সংগীত অভিধানের অতি সংক্ষিপ্ত শিশুতোষ রূপ প্রথমে বের হয়েছে। ২০০০ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত গ্রোভস ডিকশনারি অব মিউজিক অ্যান্ড মিউজিশিয়ানসের ৩০ খণ্ডের ভলিউম প্রকাশিত হয়। সেখানে বিশ্বের সব সংগীত ও সংগীতবিদদের জীবনী আছে। তাতে নয় হাজার শব্দের বাংলা গানের ইতিহাসটি করুণাময় গোস্বামীর লেখা। এর আগে ১৯৯৯ সালে গারল্যান্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অব ওয়ার্ল্ড মিউজিকে ‘দি সাউথ এশিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট’ ভলিউমে বাংলা গান নিয়ে ২৩ হাজার শব্দ লিখেছিলেন। পশ্চিম বাংলার অংশটুকুও তাঁর লেখা। এর মধ্য দিয়েই নজরুলের গানের খাতা উদ্ধার করেছিলেন তিনি। তাঁর অজস্র লেখায় ঋদ্ধ সব গানের ভুবন। বাংলাদেশে তাঁর যে সংগীতভাণ্ডার তিনি রেখে গেছেন, এটা আর কারো নেই। তাঁর এই অমূল্য ধন তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে বহুকাল। দেশের অন্যতম প্রধান এই সংগীত-গবেষক ও শিক্ষাবিদের শেষ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন সাংবাদিক ওমর শাহেদ। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, কিছুই তো করতে পারিনি, শুধু বই কিনি আর লিখি। এত বড় জ্ঞানভাণ্ডার রেখেও তিনি তৃপ্ত হননি। অতৃপ্তি নিয়ে চলে গেছেন নিরন্তরের পথে। এই গুণীর জীবন ও কর্মের প্রতি জানাই শ্রদ্ধার্ঘ্য।
তথ্যঋণ : করুণাময় গোস্বামীর শেষ সাক্ষাৎকার, নিয়েছেন ওমর শাহেদ, প্রকাশ : কালের কণ্ঠ, ৭ জুলাই, ২০১৭।