বই আলোচনা
চেনা মানুষকে নতুন করে জানা
কার্ল মার্কসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় হাইগেট সেমিট্রিতে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ১১ জন মানুষ। ১৮৮৩ সালের ১৭ মার্চ। সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে ফ্রেডরিক এঙ্গেলস উপস্থিত এই নগণ্য সংখ্যক মানুষের সামনে ছোট্ট শোকবক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘মার্কসের নাম এবং কার্যাবলি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে উজ্জ্বীবিত করবে।’ বইটির প্রথমেই কার্ল মার্কস সম্পর্কে দীর্ঘ বর্ণনা এভাবেই শুরু করেন লেখক।
হয়েছেও তাই এঙ্গেলস এর ভবিষ্যদ্বানী বিন্দুমাত্র মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি।
মার্কসের মৃত্যুদিন থেকে আজ অবধি সারা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ তাঁর দর্শনকে হৃদয়ে ধারণ করে মানব মুক্তির লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গল্পকার লেখক জাকির তালুকদার অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে রচনা করেছেন ‘কার্ল মার্কস : মানুষটি কেমন ছিলেন’। কেমন ছিলেন মার্কস? প্রুশিয়ার একজন গুপ্তচর ছদ্ম পরিচয়ে মার্কসের বাড়িতে গিয়েছিলেন। তিনি রিপোর্ট করছেন, ‘সত্যিকারের বোহেমিয়ান বুদ্ধিজীবীর জীবন-যাপন করেন তিনি। মনে হয় তার জামা-কাপড় ধোয়া, ইস্ত্রি করা কিংবা বদলানোর সুযোগ ঘটে খুবই কম। তিনি মদ খেয়ে মাতাল হতে খুবই পছন্দ করেন। সারা দিন তিনি অলসভাবে কাটিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু যখন কাজ করতে শুরু করেন তখন দিনরাত একাকার হয়ে যায়। তার ঘুমাতে যাওয়ার কিংবা ঘুম থেকে ওঠার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। প্রায়শই তিনি সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেন। আবার সকালে পোশাক না ছেড়েই সোফার ওপর ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুমান সন্ধ্যা পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে কে এলো বা কে গেল,তাতে তাঁর ঘুমের কোনো ব্যাঘাত ঘটে না।’
এই রকম জীবনযাপন একজনকে অবশ্যই খিটখিটে করে তুলতেই পারে। কিন্তু মার্কসের বাড়িতে যাঁরা নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন, তাঁরা বলেছেন, যে এত দুঃখ-কষ্ট ভোগ তার মানবিক গুণাবলিকে ক্ষুণ্ণ করতে পারেনি। তার পরিবারে অভাব-অনটন ছিল, কিন্তু অশিষ্ট আচরণের প্রমাণ কেউ কখনো দিতে পারেনি।
মার্কসের শত্রুরা অবিরাম দুনিয়াজুড়ে এই কথা রটিয়ে চলেছে যে- তিনি ছিলেন খিটখিটে, গোমড়ামুখো, কটুস্বভাব, অনমনীয় এবং অমিশুক ধরনের লোক। মার্কসের সর্বকনিষ্ঠা কন্যা এলিয়েনর বলেছেন, ‘এর চেয়ে মিথ্যাভাষণ আর হয় না। যার মতো হাসিখুশি, আমুদে মানুষ দুনিয়ায় খুব কমই আছেন। রসিকতা আর খোশমেজাজে ভরপুর যে মানুষটির প্রাণখোলা হাসি ছিল, সংক্রামক ও অপ্রতিরোধ্য, সঙ্গী হিসেবে যিনি ছিলেন সবচেয়ে সহৃদয়, শান্তশিষ্ট ও সহানুভূতিশীল, তাঁর ওই পূর্বোক্ত ধরনের চরিত্রচিত্রণ তাঁর পরিচিত ব্যক্তিদের কাছে আজও একটা তাজ্জব ব্যাপার, একটা হাসির খোরাক হয়ে আছে।’
মার্কসকে নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। তাঁর বিরুদ্ধে নাস্তিকতা প্রচারের অভিযোগ ছিল। অথচ মার্কস নাস্তিক হলেও নাস্তিকতা প্রচারকে তিনি নিজের কাজ বলে মনে করতেন না। ধর্ম প্রসঙ্গে মার্কস অত্যন্ত পরিষ্কার। মার্কসের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম একদিকে যেমন মানুষকে দমিয়ে রাখার হাতিয়ার, অন্যদিকে তা তেমনই নির্যাতনকারীকে প্রত্যাখ্যানেরও একটি মাধ্যম। নির্যাতিত মানুষের কাছে ধর্ম হচ্ছে দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন পৃথিবীতে হৃদয়ের সন্ধান; এবং আত্মাহীন পৃথিবীতে আত্মার সন্ধান, ধর্ম হচ্ছে জনগণের আফিম। তিনি কখনোই ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেননি। মার্কসের লড়াই ছিল মূলত পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে। যে কারণে এই পুঁজিপতিরা তখন থেকে এখন পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের পরে, এটাকে শয়তানের ওপর ঈশ্বরের আপাত বিজয় ধরে নিয়ে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার তথাকথিত ‘পুঁজিবাদই ইতিহাসের শেষ কথা’ বাণীটির সঙ্গে গলা মিলিয়েছিল ‘প্রতিবন্ধী’ বুদ্ধিজীবীর দল। তারা বলতে শুরু করল যে, মার্কসবাদের সঙ্গে সঙ্গে মার্কসেরও মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু মার্কসের তো মৃত্যু ঘটেনি! ঘটছে না! কেন?
পৃথিবীর দেশে দেশে গরিব মানুষ আবার মার্কসবাদের নামে সমবেত হচ্ছে। যখন নিন্দুকরা বলছিল ফুরিয়ে গেছে মার্কস, তখন ‘নিউ ইয়র্কার’ পত্রিকা তাকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা করে। ‘টাইমস সাময়িকী’ তাঁকে আখ্যা দেয় সহস্রাব্দের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক বলে। ‘নিউ ইয়র্কা’র পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় একজন বিশ্বখ্যাত ব্যাংকার মন্তব্য করেন এভাব- ‘আমি যত বেশি সময় ওয়াল স্ট্রিটে কাটাই, তত বেশি অনুভব করি যে কার্ল মার্কস সঠিক।’
কার্ল মার্কস ছিলেন একাধারে লেখক, গবেষক, কলামিস্ট, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনৈতিক নেতা, সংগঠক, শিক্ষক, সর্বোপরি একজন মানবতাবাদী মানুষ। আজীবন তিনি কাজ করেছে মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে। কাল মার্কসকে নিয়ে তাবৎ দুনিয়ায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। পৃথিবীর নানা ভাষায় তাঁকে নিয়ে রচিত হয়েছে বই। বাংলা ভাষায় মার্কসকে নিয়ে অনেকে লিখেছেন, আরো লিখবেন। এসবের মাঝে এই বইটি ব্যতিক্রম। লেখক যে উদ্দেশ্য নিয়ে এটি রচনা করেছেন, তা বোধ করি অনেকটা সফল হয়েছে। কার্ল মাকর্স কে জানার জন্য শুধুমাত্র এই বইটি যথেষ্ট না হলেও কম কিছু নয়।
শুধু মাকর্স নয় তাঁর প্রিয়তম বন্ধু (যাঁর সঙ্গে তাঁর কখনোই বিরোধ হয়নি) সেই এঙ্গেলসকেও আমরা জানতে পারি এই বই থেকে। একই সঙ্গে দুই বন্ধুর বিরল বন্ধুত্বের ইতিহাস আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয়। মার্কসকে সাহায্য করার জন্য এঙ্গেলস তাঁর আজন্মলালিত সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে বাবার টেক্সটাইল ফার্মে কেরানির চাকরি নেন। নিয়মিত বন্ধুকে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। অসংখ্য প্রবন্ধ, বই তারা যৌথভাবে লিখেছেন।
এত সব আর্থিক, পারিবারিক এবং সামাজিক সুবিধা সত্ত্বেও এঙ্গেলস জানতেন যে দুজনের মধ্যে তিনি কখনোই প্রধান হতে পারবেন না। তিনি কখনোই কর্তৃত্বকারী নন। শুরু থেকেই তিনি মার্কসের আনুগত্য মেনে নিয়েছিলেন। বুঝে গিয়েছিলেন যে তাঁর ঐতিহাসিক দায়িত্ব হচ্ছে এই আর্থিকভাবে দরিদ্র মহাপ্রতিভাকে সহায়তা করা এবং সম্পূরক দায়িত্ব পালন করা।
দার্শনিক কার্ল মার্কস শুধু তত্ত্বীয় বিষয় নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন না, তিনি রাজনীতি নিয়েও ছিলেন সমধিক আগ্রহী। আমরা দেখতে পাই রাজনীতি ও সংগঠনের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহের কারণেই বিভিন্ন সংগঠনের রাজনৈতিক কার্যক্রমে ছিল তাঁর প্রবল অংশগ্রহণ। মার্কস জড়িত ছিলেন ব্রাসেলসের কমিউনিস্ট করেসপন্ডেন্স কমিটিতে। পরবর্তীকালে লিগ অব জাস্টে। এই লিগ অব জাস্টের কংগ্রেসে একটি খসড়া ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করেছিলেন এঙ্গেলস। পরে এই ঘোষণাপত্রটি মার্কসের হাতে পড়ে নতুনরূপে আবির্ভূত হয় কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো হিসেবে। বলা হয়ে থাকে এটি হচ্ছে মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি পঠিত রাজনৈতিক ইশতেহার।
হামবুর্গের দর্জি শ্রমিক ফ্রিডরিক নেসনারের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, ‘মার্কস ছিলেন জন্মগতভাবেই নেতা। তাঁর বক্তব্য ছিল সব সময়ই সংক্ষিপ্ত, নির্দেশনামূলক এবং যুক্তির অনুগামী। তিনি কখনোই কোনো ধোঁয়াশে শব্দ উচ্চারণ করতেন না। তাঁর প্রতিটি বাক্যই ছিল সুচিন্তিত। নিজেকে তিনি কখনোই রহস্যের আড়ালে রাখতেন না। আমি ভাইটলিংয়ের কমিউনিজমের সঙ্গে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর কমিউনিজমের পার্থক্য বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে এটাও বুঝতে পারি যে, মার্কস হচ্ছেন সমাজতান্ত্রিক মতবাদের মূর্ত প্রতীক।’
দার্শনিক কার্ল মার্কসের শৈশব, শিক্ষাজীবন, সংসার জীবন, তাঁর লেখালেখি, বিপ্লবী আন্দোলন সমস্ত বিষয় সম্পর্কে বিস্তর জানা যাবে বইটি পাঠে। লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন, লেখক, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে। এমন একখানা বই লেখার জন্য অগ্রজ লেখক জাকির তালুকদারকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাই।
কার্ল মার্কস মানুষটি কেমন ছিলেন
জাকির তালুকদার
প্রকাশক : ঐতিহ্য
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি-২০১৫ খ্রি.
মূল্য : ৩০০ টাকা।