অষ্টম পর্ব
রবির জীবনে মৃত্যুশোক
স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
শিক্ষাবিদ ও আইনজীবী।
মৃত্যু : ২৫ মে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ।
আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তিক্ততার সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তাঁর ছিল অনেক বড় পরিবার। আর্থিক কারণে তিনি যুবা বয়সের আইন পেশাটিই পুনরায় গ্রহণ করেন ৬০ বছর বয়সে। সেই বয়সেই একা একাই পাটনা যান ডুমরাঁর মামলার সওয়াল করতে। সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং আত্মীয়-পরিজন বিবর্জিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ৫ মে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রাবন্ধিক দীনেশচন্দ্র সিংহ ‘বিশ্বকবি-বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদ : আশুতোষ পর্ব’ শিরোনামের প্রবন্ধে উল্লেখ করেন : আশুতোষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই কবির [রবীন্দ্রনাথ] সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ পর্বের সমাপ্তি। সে সময় কবি দেশের বাইরে, পথে প্রবাসে। দেশে ফিরে এসে কবি এই মহান শিক্ষাগুরুর মৃত্যুতে গভীর মর্মবেদনা প্রকাশ করে বলেন—‘কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সুযোগ-সুবিধা শান্তিনিকেতন স্কুল পাইয়াছিল, সে তাঁহারই জন্য; আজ কৃতজ্ঞচিত্তে কবি সে সব স্মরণ করিলেন।’ ‘বিশ্বভারতী কোয়ার্টারলি’ পত্রিকায় কবি আশুতোষের স্মৃতি তর্পণ করতে গিয়ে শান্তিনিকেতনের প্রতি আশুতোষের শুভাকাঙ্ক্ষার উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: “Asutosh heroically fought against heavy odds for wining freedom for our education. We, who in our own ways have been working for the same cause, who deserve to be treated as outlaws by the upholders of law and order in the realm of the dead, had the honour of receiving from him the extended hand of comradeship, for which we shall ever remember him. In fact he removed for us the ban of official untouchability and opened a breach in the barricade of distrust, establishing a path of communication between his institution and our own field of work, but never asking us to surrender in the least our independence.”
বিনয়িনী দেবী
রবীন্দ্রনাথ ছেলের বউ প্রতিমা দেবীর মা। রথীন্দ্রনাথের শাশুড়ি। গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় মেয়ে।
মৃত্যু : বৈশাখ ১৩৩১ বঙ্গাব্দ, মে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ।
রবীন্দ্রনাথের কাছে যখন বিনয়িনী দেবীর মৃত্যুসংবাদটি পৌঁছায়, তখন তিনি ছিলেন পিকিংয়ে। ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩১ বঙ্গাব্দ, ২০ মে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার লেখা রবীন্দ্রনাথ পুত্রবধূকে সান্ত্বনা দিয়ে লেখেন : ‘তোমার মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে মনে আঘাত পেয়েচি। সেদিন তোমার মা যখন শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন তখন তাঁর মধ্যে এমন একটি গভীরতা দেখেছিলুম, সাধনার এমন একটি সহজ সুন্দর রূপ তাঁর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছিল যে আমি আশ্চর্য্য হয়েছিলুম। মৃত্যুর পূর্ব্বে তাঁর এই যে ভাবটি দেখতে পেয়েছিলুম এই কথাটি মনে করে আমার ভারি ভাল লাগচে। এইবার এই দিক থেকে বিনয়িনী আমার হৃদয়ের খুব কাছে এসেছিলেন। এক একদিন আমার কাছে এসে তিনি যখন তাঁর প্রাণের গভীর কথাগুলি বলতেন আমার ভারি তৃপ্তি হত। অন্তরে তিনি এমন একটি মুক্তি পেয়েছিলেন যে, মৃত্যু তাঁর কাছে কিছুই নয়। ভিতরে ভিতরে তিনি সংসার পার হয়ে গিয়েছিলেন। ... তিনি যে একান্ত উপলব্ধির মধ্যে নিয়ত নিমগ্ন হয়েছিলেন তাই দেখে আমার নিজের মনের মধ্যে ভারি শান্তি বোধ হত। আমার কেমন মনে হয় যে, জীবন বন্ধনের শেষ সূত্রগুলি ছিন্ন করবার জন্যেই এবার তিনি শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন, সংসারের দায়িত্ব থেকে নিজেকে কিছুকালের জন্যেও বিচ্ছিন্ন করে যেন তিনি শেষ বিচ্ছেদের ভূমিকা রচনা করেছিলেন। অন্তরের মধ্যে গভীর শান্তি লাভ করে তবে তিনি যে সুখ দুঃখের পারে চলে গেলেন এ কম সৌভাগ্যের কথা নয়।’
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথের বড় দাদা।
মৃত্যু : ৪ মাঘ ১৩৩২ বঙ্গাব্দ, ১৯ জানুয়ারি ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার, ভোররাতে।
দ্বিজেন্দ্রনাথের মৃত্যুর সময় রবীন্দ্রনাথ লখনৌতে অবস্থান করছিলেন একটা কাজে। দাদার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তিনি সেখানকার কাজ অসমাপ্ত রেখেই ফিরে আসেন শান্তিনিকেতনে। এ প্রসঙ্গে তিনি সুকুমার হালদারকে লেখা এক চিঠিতে উল্লেখ করেছেন :
‘বড়দাদাও গেলেন, এখন আমিই শীতের গাছে শেষ পাতাটার মত উত্তরে হাওয়ায় কাঁপছি, ঝরে পড়লেই হয়, বোঁটাও আলগা হয়েচে।’
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী উৎসব পালিত হয়। সেই উৎসবে রবীন্দ্রনাথ অভিভাষণ পাঠ করেন। সেই ভাষণে প্রকাশ পায় রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুবিষয়ক চিন্তা। তিনি বলেন, ‘আমি আজ নিজের কথাই জানাই। এই তো দেখছি জরা ক্রমশই আমার চারদিকে তার ফাঁসগুলি আঁট করে দিচ্ছে। সৃষ্টিগতিস্রোতের সঙ্গে আমার যে-সব ইন্দ্রিয়বোধ-শক্তির সহচারিতা এত দীর্ঘকাল চলে এসেছে আজ তাদের মাঝখানে ক্রমশই নানা বেড়া উঠছে স্থূল হয়ে। সেই ব্যবধানে প্রতিহত হয়ে জীবনলীলা চিরকালের জন্য অবরুদ্ধ হয়ে যাবে এমন কথা সহজে মনে আসতে পারে। কেননা এই ব্যবধানের অতীত পথে যে অস্তিত্ব-স্রোত তাকে আমরা দেখতে পাই নে।... বিনাশ যদি কোনোখানেই সৃষ্টির প্রতিকূলে সত্যরূপে থাকত তাহলে সেই রন্ধ্র দিয়ে বহিঃসৃত হয়ে সৃষ্টি কোনকালে যেত অতলে তলিয়ে।... সব কিছু একাকার হয়ে যেত অবৈচিত্র্যে, সব চলা হয়ে যেত স্তব্ধ। কিন্তু ক্লান্তিবিহীন মৃত্যু দূর করে দেয় সঞ্চরমান কালের ক্লান্তি। জীর্ণতাকে সে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ফেলে দিয়ে নূতন রচনার তোরণ নির্মাণ করছে সেই উপকরণে। প্রথমকে সে বারেবারে ফিরিয়ে আনছে শেষকে অতিক্রম করে।’
চিত্তরঞ্জন দাশ
সমাজসংস্কারক। ‘দেশবন্ধু’ নামে খ্যাত। রবীন্দ্রনাথের বন্ধু।
মৃত্যু : ২ আষাঢ় ১৩৩২ বঙ্গাব্দে, ১৬ জুন ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার।
প্রশান্তকুমার পাল তাঁর ‘রবিজীবনী’ বইটিতে লিখেছেন : ‘দেশনেতা চিত্তরঞ্জন দাশ স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য দার্জিলিঙে গিয়েছিলেন, কিন্তু উক্ত [২ আষাঢ় ১৩৩২ বঙ্গাব্দ, ১৬ জুন ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার] তারিখেই সেখানে তাঁর জীবনাবসান হয়। তরুণ চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ও তা অক্ষুণ্ণ ছিল... এর পরে কী কারণে উভয়ের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে তিক্ততায় পর্যবসিত হল তা বলা শক্ত। ... কিন্তু চিত্তরঞ্জনের অকালমৃত্যু রবীন্দ্রনাথকে এক ধরনের সামাজিক সংকটে নিক্ষেপ করল।’
এ কথার সত্যতা পাওয়া যায় রথীন্দ্রনাথকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠির মধ্য দিয়ে। ৪ আষাঢ় ১৩৩২ বঙ্গাব্দ, ১৮ জুন ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার লেখা সেই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেন : ‘চিত্তরঞ্জনের মৃত্যু উপলক্ষ্যে আমার কলকাতায় যাওয়া উচিত বলে আমার মনে একটা আন্দোলন চলচে। ...বিশেষত চিত্তর সঙ্গে বরাবরই আমার একটা বিরোধ ছিল, এ কথা যেন মনে না করে যে আমার মনে তার প্রতি একটুও প্রতিকূল ভাব আছে। আর কিছু নয় কলকাতায় গিয়ে ওদের বাড়িতে একবার দেখা করে আসা উচিত হবে বলে বোধ হচ্চে। নিতান্তই যদি সভা-সমিতিতে টানাটানি করে তাহলেও দুচার কথা বলতে হবে। এ চিঠি পেয়েই আমাকে ...তার যোগ্য তোদের পরামর্শ জানাস। প্রশান্তকেও এ সম্বন্ধে লিখছি। সেই দিনই প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে তিনি লেখেন : ‘শাস্ত্রী মশায়ের সঙ্গে আজ সকালে আলোচনা করে আমার মনে হচ্চে চিত্তরঞ্জনের মৃত্যু উপলক্ষ্যে এখনি আমার কলকাতায় যাওয়া উচিত। তার প্রতি আমার যেটুকু দেয় দেশের লোক তা আশা করে, শরীরের অস্বাস্থ্য ওজর খাটবে না। কিছু না, একবার ওদের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে অভিশোচন প্রকাশ করা। আর নিতান্তই যদি সভাসমিতিতে কিছু বলতে ধরে দু’চার কথা বলা। আমার প্রতি চিত্ত চিরদিন নিরন্তর অশ্রদ্ধা প্রকাশ করে এসেছিলেন বলেই আজ এই কর্ত্তব্য আমাকে টানচে, নইলে কলকাতায় যাবার ইচ্ছে ছিল না, এর পরে সভাপতিত্ব ইত্যাদি বালাই থেকে রক্ষা পাব। যেটা স্থির কর এই চিঠি পেয়েই জরুরি টেলিগ্রাম যোগে জানিয়ো।’
এ মানুষটির মৃত্যু উপলক্ষে ১ জুলাই ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে লেখা বাণী প্রচার করেন : ‘আপন দানের দ্বারাই মানুষ আপন আত্মাকে যথার্থভাবে প্রকাশ করে। চিত্তরঞ্জন তাঁহার যে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ দান দেশকে উৎসর্গ করিয়াছেন তাহা কোনও বিশেষ রাষ্ট্রিক বা সামাজিক কর্ত্তব্যপালনের আদর্শমাত্র নহে; তাহা সেই সৃষ্টিশক্তিশালী মহাতপস্যা যাহা তাঁহার ত্যাগসাধনের মধ্যে অমৃতরূপ ধারণ করিয়াছে।’ ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ চিত্তরঞ্জনের উদ্দেশে দুইটি পঙক্তি লিখে দেন, যা আর্ট কাগজে ছাপা প্রয়াত চিত্তরঞ্জনের ছবির নিচে রবীন্দ্র-হস্তাক্ষরে লিখিত কবিতা হিসেবে স্থান পায় :
‘এনেছিলে সাথে করি মৃত্যুহীন প্রাণ,
মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।’
যতীন দাস
শহীদ বিপ্লবী নেতা।
মৃত্যু : ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ।
রবীন্দ্রজীবনীকার তাঁর ‘রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য প্রবেশক’ গ্রন্থে বিপ্লবী নেতা যতীন দাসের মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথের মনে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল তা উল্লেখ করেছেন : ‘প্রেসিডেন্সি কলেজে ভাষণদানের অব্যবহিত পরে ‘তপতী’ অভিনয়ের ব্যবস্থা করিবার জন্য কবি শান্তিনিকেতনে ফিরিয়া আসিলেন। নাটকের মহড়া শুরু হইল, কবি স্বয়ং সাতষট্টি বৎসর বয়সে বিক্রমের ভূমিকা গ্রহণ করিলেন। মহড়া চলিতেছে দিনের পর দিন। এমন সময়ে একদিন সংবাদ আসিল লাহোর জেলে যতীন দাস নামে একজন বিপ্লবী যুবক অনশনে প্রাণ-ত্যাগ করিয়াছে; জেল কর্তৃপক্ষের অন্যায়ের প্রতিবাদে এই আত্মাহুতি। শান্তিদেব লিখিয়াছেন, ‘এই সংবাদ যেদিন আসিল, সেদিন তপতীর মহড়া জমিল না, কবিকে খুবই অন্যমনস্ক দেখা গেল। মনের এই অবস্থায় কবি লেখেন ‘সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ’ গানটি।’ গানটি ‘তপতী’র অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গানটি হলো :
সর্ব খর্বতারে দহে তবে ক্রোধদাহ,
হে ভৈরব, শক্তি দাও, ভক্তপানে চাহো।
দূর করো মহারুদ্র,
যাহা মুগ্ধ, যাহা ক্ষুদ্র,
মৃত্যুরে করিবে তুচ্ছ প্রাণের উৎসাহ।
দুঃখের মন্থনবেগে উঠিবে অমৃত
শঙ্কা হতে রক্ষা পাবে যারা মৃত্যুভীত।
তব দীপ্ত রৌদ্র তেজে
নির্ঝরিয়া গলিবে যে,
প্রস্তর-শৃঙ্খলোন্মুক্ত ত্যাগের প্রবাহ॥
(চলবে)