চলচ্চিত্রে যৌন নির্যাতন
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/07/17/photo-1437114561.jpg)
পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালের টিএসসি অঞ্চলে বর্ষবরণ উৎসবে যোগ দিতে আসা নারীদের ওপর যৌন-নির্যাতনের ঘটনায় উত্তাল দেশ। নারীর ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা এই প্রথম নয়। বাংলাদেশ তো বটেই, সমগ্র বিশ্বে কালে কালে নারী নানাভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে এসেছে। প্রতিনিয়ত হচ্ছে। আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বেশির ভাগ সময়ই অপরাধীর সঠিক বিচার হয়নি। কোনো না কোনো ফাঁকফোঁকর তৈরি করে ঠিকই অপরাধীকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। অপরাধী সমাজে দাপটের সঙ্গে চলাচল করে আর উল্টো নির্যাতনের শিকার নারী লজ্জায় অপমানে গৃহবন্দী হয়। সামাজিক অপরাধের এই এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে অপরাধী আসামি নয়, অপরাধের শিকারই বিবেচিত হয় আসামি হিসেবে। তবে এই অপরাধের উপযুক্ত ট্রিটমেন্ট আমরা সবসময় লক্ষ করেছি সব ধরনের শিল্পমাধ্যমে।
যেকোনো ধরনের নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার বিশ্বের সব শিল্পমাধ্যম। তবে তুলনামূলকভাবে সাহিত্য এবং চলচ্চিত্র মাধ্যমে নারীর অধিকারের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচনা করা হয়েছে। নানা মাত্রায় উপস্থাপিত হয়েছে নারীজীবনের নানা সংকটের কথা। এ ক্ষেত্রে নারীর ওপর পুরুষের যে অস্বাভাবিক এবং অনৈতিক যৌন আচরণ, যেমন- রেপ, সেক্সুয়াল হ্যারাজমেন্ট, সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট, সেক্সুয়াল অ্যাবইউজমেন্ট, মলেস্টেশন প্রভৃতি বিষয়াদি গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। স্বল্পপরিসরে চলচ্চিত্রে নারীর যৌননির্যাতনের বিষয়টি কীভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তার বিশদ বয়ান সম্ভব নয়। আমরা নির্দিষ্ট কয়েকটি মুভি ধরে আলোচনা করে তার স্বরূপটা উন্মোচন করতে পারি মাত্র। আমি সেই কাজটিই করছি বর্তমান গদ্যে।
মাত্রুভূমি
ছবিটি শুরু হয় আৎকে ওঠার মতো একটি দৃশ্য দিয়ে-একটি শিশুর জন্ম হচ্ছে ভারতের বিহারের ছোট্ট এক গাঁয়ে। বাড়িজুড়ে মানুষ। উঠোনে নাদাভর্তি গরুর দুধ। জন্মানোর পর পরই শিশুটিকে সেই সেই দুধে গোসল করানোর কথা। সবাই অপেক্ষা করছে শুভ সংবাদ শোনার জন্য। ঘোষণা এলো শিশুর জন্ম হয়েছে; তবে ছেলে নয়, মেয়ে শিশু। বিধি বাম! সঙ্গে সঙ্গে উঠোনভর্তি মানুষ নিমিষেই নেই হয়ে গেল। শিশুপিতা শিশুকে তুলে এনে দুধের নাদায় ডুবিয়ে ধরে থাকল কিছুক্ষণ। ৩০ সেকেন্ডে সবশেষ। শিশুটি জন্মানো মাত্রই মৃত। পৃথিবীতে আসা মাত্রই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার নির্মম বলি হলো সে। এই সিনেমার শিশুহত্যার দৃশ্যটি চলচ্চিত্র ইতিহাসের সবচেয়ে নারকীয় দৃশ্য হিসেবে আমি দেখতে চাই।
এমন একটি অমানবিক দৃশ্যের ভেতর দিয়ে শুরু হয় ভারতীয় পরিচালক প্রকাশ ঝার ছবি মাতৃভূমি, যার ইংরেজি সাবটাইটেল, ‘এ নেশন উইদাওট উইমেন’। ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড স্বরে বলা হয়- ‘প্রতিদিন ভারতে হাজার হাজার ভ্রুণ ও শিশুহত্যা করা হয়। এসব শিশুর অপরাধ তারা কন্যাশিশু। কারণ, একটা মোটা অঙ্কের যৌতুক ছাড়া বিয়ে হয় না তাদের, ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে চায় না কেউ। এই অপরাধ আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে?’
এরপর সিনেমার গল্প এগোতে থাকে । আমরা উপস্থিতি হই ভবিষ্যতের এক গ্রামে। খুন হতে হতে নারীশূন্য হয়ে পড়েছে গ্রামটি। এরপর হাস্যরসের ভেতর দিয়ে স্যাটায়ার করা নারীশূন্য জেনারেশনের যৌন কর্মকাণ্ডকে।
বিপত্নীক রামসারানের পাঁচ ছেলের মধ্যে বড় ছেলের জন্য বিয়ের পাত্রী খোঁজা হচ্ছে। এরপর একদিন পাশেই মাঠে এক বাবা তার কুমারী মেয়েকে গ্রাম থেকে বাঁচিয়ে গোপনে বসবাস করার খবর আসে রামসারানের কাছে। রামসারান তার বড় ছেলের জন্য যায় ওই বাবার কাছে। বাবা প্রথমে রাজি না হলে চাষের জমি, নগদ টাকা আর হালের গরু দিয়ে রাজি করানো হয়। আসবার সময় রামসারান বলে- আমাদের সময় মেয়ের বিয়েতে ছেলেকে এসব (টাকা-জমি) দিতে হতো, আর এখন মেয়ের বাপকে দিতে হচ্ছে! কালকি নামের ওই মেয়েকে ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বাড়ি তোলে রামসারান। কালকি চরিত্রে অভিনয় করেছেন টিউলিপ জোশি।
সবচেয়ে ছোটছেলের সঙ্গে কালকিকে বিয়ে দিয়ে ঘরে তুললেও আসলে তাকে আনা হয় পুরো পরিবার এমনকি গ্রামের অন্যসব পুরুষদের জন্যও! এখানে উপহাস হলো- কালকির বাবা কালকি ছোটো বলে রামসারানের বড় ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে আপত্তি তোলে। এরপর সে ছোট ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিলেও তার অজান্তেই সে মেয়ের বিয়ে দেয় একগ্রাম পুরুষের সঙ্গে! কালকিকে বাড়ি তুলেই কে কতরাত কালকির সঙ্গে থাকবে সেই ভাগাভাগিতে বসে রামসারানের পাঁচ ছেলে। রামসারান নিজের নামও প্রস্তাব করে সেই ভাগাভাগিতে। বস্তুত, বাবা হিসেবে ছেলের বিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে সে-ই প্রথম রাত্রিযাপন করে। এরপর শুরু হয় কালকিকে পালাক্রমে ধর্ষণ। প্রায় গ্রামসুদ্ধ মানুষ একটা অল্পবয়সী মেয়েকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করে চলে। কালকিকে ভালোবাসার অপরাধে রামসারানের এক ছেলেকে হত্যা করে অন্য ছেলেরা। কালকি অন্তঃসত্ত্বা হলেও তাকে ধর্ষণ চালিয়ে যাওয়া হয়। পরে অন্তঃসত্ত্বার খবর প্রকাশ পেলে পিতৃত্বের দাবি তোলে প্রায় সবাই। শেষ পর্যন্ত বাবা রামসারানের দাবির কাছে চুপ মেরে যায় ছেলেরা। পিতৃত্বের দাবি নিয়ে দুই মহল্লার বিবাদ বাধে। বিবাদ থেকে হানাহানি-খুনোখুনি। এরইমাঝে কালকি সন্তান প্রসব করে- বলাই বাহুল্য কন্যসন্তান। ভাগ্যের কি পরিহাস- যে সন্তানের জন্য একদিন সবাই মুখ ফিরিয়ে নিত আজ সেই সন্তানের পিতৃত্বের দাবিতে সবাই খুনোখুনি করছে। এরই ফাঁকে, মেয়েকে নিয়ে সটকে পড়ে কালকি।
এমনই এক সাহসী চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন পরিচালক মনিষ ঝা। মুক্তি পায় ২০০৩ সালে, বাংলাসহ পাঁচটি ভাষায় ডাবিং করে। কেন্দ্রীয় চরিত্রে টিউলিপ জোশি ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুশান্ত সিং, আদিত্য শিবাস্তব ও পীযূষ মিশ্র।
ছবিটি বিশ্বব্যাপী সাধুবাদের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়। প্রদর্শিত হতে থাকে একের পর এক চলচ্চিত্র উৎসবে। ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কৃতও হয়। ছবিটি সম্পর্কে পরিচালক প্রকাশ জানান, তিনি একদিন গুজরাটের নারীশূন্য হতে যাওয়া এক গ্রামের খবর পত্রিকায় পড়েন। এর পরই তাঁর মাথায় এই ছবির আইডিয়াটা আসে।
গুলাব গ্যাং
২০১৪ সালে বলিউড সিনেমার অন্যতম আকর্ষণ ছিল গুলাব গ্যাং ছবিটি। এই আকর্ষণের কারণ বলিউডের অতি জনপ্রিয় অভিনেত্রী মাধুরী দীক্ষিত ও জুহি চাওলা অনেকদিন পর অভিনয় করেন। বলিউডে এই প্রথম কেন্দ্রীয় চরিত্র এবং খলনায়কের ভূমিকায় দুই নারীকে দেখা যায়। ছবিটি মুক্তি পায় ওই বছর নারী দিবসের ঠিক আগের দিন, অর্থাৎ ৭ মার্চ। নারী দিবস উদযাপন করার উপযুক্ত কাহিনি নিয়েই হাজির হয় গুলাব গ্যাং। ছবির গল্পে দেখা যায়, ভারতের উত্তর প্রদেশের এক গ্রামে একটি নারী গ্যাং গড়ে ওঠে যারা সমাজে নারীদের ওপর যেকোনো ধরনের নির্যাতনের সশস্ত্র মোকাবিলা করে। এই দলের নারীরা অত্যাচারী স্বামীর হাত থেকে স্ত্রীকে রক্ষা করে। প্রয়োজনে স্বামীকে শারীরিকভাবে আঘাত করে উচিত শিক্ষা দেয়। ধর্ষক পুরুষের অঙ্গহানি ঘটায়।
দ্য হ্যান্ডমেড’স টেল
‘দ্য হ্যান্ডমেড’স টেল’ চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয় ১৯৯০ সালে কানাডিয়ো কবি ও কথাসাহিত্যিক মার্গারেট আটুডের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে। ছবিটি পরিচালনা করেন ভলকার স্কলনডোর্ফ এবং চিত্রনাট্য লেখক নোবেলজয়ী নাট্যকার হারল্ড পিন্টার।
ছবির গল্পে দেখা যায়- কল্পিত রাজ্য রিপাবলিক অব গিলেডে যুদ্ধ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এবং দূষণে সেখানকার ৯৯ শতাংশ মানুষ সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয়ে পড়ে। ছবির প্রটাগনিস্ট কেট তার স্বামী ও কন্যাশিশুকে নিয়ে প্রতিবেশী দেশ কানাডায় পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। স্বামীকে মেরে ফেলা হয়, অপহরণ করা হয় মেয়েকে। কেটকে তুলে এনে পরীক্ষা করা হয় সে সন্তান ধারণে সক্ষম কি না। পরীক্ষায় পজিটিভ ফল এলে তাকে ‘হ্যান্ডমেড’ বা রক্ষিতা হিসেবে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রণে আছে এমন পুরুষের নিকট পাঠানো হয়, যার স্ত্রী বন্ধ্যা। কেটকে পাঠানো হয় কমান্ডো ও তার রুক্ষ স্বভাবের স্ত্রী সেরেনা জয়ের বাড়িতে। সেখানে তার নতুন নাম পড়ানো হয় ‘অফফ্রেড’(অফফ্রেড মানে ফ্রেডের সম্মত্তি; ফ্রেড কমান্ডারের নাম। কেটকে সেরেনা জয়ের হাঁটুর মাঝে রেখে ধর্ষণ করে কমান্ডার- বাইবেলের উক্তি টেনে বলা হয়, এভাবে কেট গর্ভবতী হলে সেই সন্তান হবে সেরেনার। কেট সবসময় তার আগের জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রার্থনা করে। সে বুঝতে পারে, মেয়েদের মতো বেশিরভাগ পুরুষই বন্ধ্যা হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারে কমান্ডার নিজেও বন্ধ্যা। কিন্তু গিলার্ডের মানুষ বিশ্বাস করে পুরুষ কখনো বন্ধ্যা হয় না। কাজেই এখন সন্তান না হওয়ার কারণে আগের রক্ষিতাদের মতো কেটকে মেরে ফেলা হবে অথবা কলোনিতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
দ্য হ্যান্ডমেড’স টেল চলচ্চিত্রে একটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দেখানো হয়েছে। যেখানে নির্মমতার চূড়ান্ত বলি হয় নারীরা। পদ্ধতির মধ্যে এনে সুবিধাভোগী নারীদের শত্রু হিসেবে গড়ে তোলা হয় সুবিধাবঞ্চিত নারীদের কাছে। সমাজে অবস্থানগতভাবে নারীদের কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। যারা রক্ষিতার কাজে থাকে তাদের কানে সবসময় তুলে দেওয়া হয়, ‘তারা ঈশ্বর-সেবা করছে’। কেউ এসব নিয়মের প্রতিবাদ করলে ‘টেচারি’ যৌনপাপ বলে তাদের ঝুলিয়ে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ধর্ষণের জন্য দায়ী করা নারীকেই। এভাবেই ধর্ম ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নারীর জন্য নরকতুল্য এক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় গিলেগে।
প্রিসিয়াস
প্রিসিয়াস ছবিটি মুক্তির পর পরই তুমুল আলোচনায় আসে। ছবিটির বিষয়বস্তু রেসিজম, সেক্সিজম, বর্ণবৈষম্য, যৌননিপীড়ন, নারীনির্যাতন, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স, অলটারনেটিভ রিলেশন বা সমকাম, এইডস এমন আরো অনেককিছুই। সম্প্রতি চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক ছবিতে এতগুলো বিষয় উঠে আসার কোনো নজির দেখা যায়নি।
ছবিতে আতঙ্কিত হওয়ার মতো অনেক দৃশ্যই আছে। যেমন, মায়ের বয়ফ্রেন্ডের হাতে প্রিসিয়াসের ধর্ষিত হওয়ার দৃশ্যটি। এই দৃশ্য দেখার পর পরই যেকোনো সুস্থ মানুষের আর সুস্থ থাকা সম্ভব নয়। কেমন যেন একটা নওসিয়া ভাব চলে আসে। মা যখন দেখেন তার অল্পবয়সী মেয়েকে তার বয়ফ্রেন্ড ধর্ষণ করছে তখন সে সেটা না দেখার ভান করে চলে যায়। পরে আবার নিরপরাধ প্রিসিয়াসের ওপর সে সসস্ত্র হামলা চালান। তার ক্ষোভ প্রিসিয়াস তার কাছ থেকে তার বয়ফ্রেন্ডকে ছিনিয়ে নিচ্ছে। এমন অনেক দৃশ্য আছে যা আমরা সভ্য মানুষ হিসেবে অরুচিকর বলেই হয়তো উড়িয়ে দিতে চাইব।
সংক্ষেপে ছবির গল্পে দেখা যায়- ১৬ বছর বয়সী অক্ষরজ্ঞানহীন তরুণী প্রিসিয়াস জোনস হার্লেমের এক বস্তিতে বাস করে। সঙ্গে থাকে বেকার ও বিকারগ্রস্ত মা। প্রিসিয়াস তার বাবার হাতে ধর্ষিত হয়। ফলে দুবার অন্তঃসত্ত্বা হয়। জন্ম হয় মঙ্গো নামক এক সন্তানের। পরিবার মঙ্গোকে রেখে দেয় যাতে তারা সরকারের কাছে আরো রেশন দাবি করতে পারে। প্রিসিয়াস অন্তঃসত্ত্বা প্রকাশিত হলে স্কুল থেকে তাকে বিকল্প স্কুল বা পরিবার পরিকল্পনার অধীনে পাঠানো হয়। সেখানে প্রিসিয়াস তার অন্য একটা জীবন আবিষ্কার করে। সে জীবন ও তার সন্তানকে ভালোবাসতে শেখে। সে বাড়িতে ফিরে এলে, তার মা তাকে ইচ্ছে করেই আঘাত করে ও সন্তানকে ফেলে দেয়। প্রিসিয়াস সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিবাদ করে এবং বাড়ি থেকে সন্তানকে সঙ্গী করে বেরিয়ে আসে।
পরে প্রিসিয়াসের মা তাকে জানায় যে তার বাবা এইচআইভিতে মারা গেছে এবং পরীক্ষায় দেখা যায়, প্রিসিয়াস নিজেও এইসআইভি পজেটিভ। তবে সন্তানটি নয়। এই খবরেও দমে যায় না প্রিসিয়াস। সে স্বপ্ন দেখে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে ছেলের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার। পেসিমিজম দিয়ে শুরু হলেও অপটিমিজম শেষ পর্যন্ত ছবিটির মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এমন এক চরিত্রের নাম প্রিসিয়াস হওয়াটাকে আইরনি মনে হলেও শেষ পর্যন্ত মনে হয় মেয়েটি সত্যিই প্রিসিয়াস।
ছবিটির গল্প সাপায়ারের পুশ উপন্যাস থেকে নেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালে মার্কিন পরিচালক লি ডেনিয়েলস নির্মাণ করেন। অভিনয় করেন- গ্যাবোরি সিডিবি, মোনিক, পাওলা পাটন ও মারিয়া ক্যারি। আগেই বলেছি, ছবিটি মুক্তির পর পরই তুমুল আলোচনায় আসে। সে বছরই সেরা ছবিসহ ছয়টি বিভাগে মনোনয়ন পায়। সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী ও সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কার যায় এই ছবির ঝুড়িতে।
টেস
টেস অব ডি’আরবার ভিলেজ উপন্যাসটি লেখেন ব্রিটিশ কথাসাহিত্যিক টমাস হার্ডি ১৮৯১ সালে। আর সেটির গল্প অবলম্বনে টেস নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত ফরাসি পরিচালক রোমান পলোনস্কি, ১৯৭৯ সালে। ছবিটি দুটি বিভাগে অস্কার মনোনয়ন পেয়ে তিনটি বিভাগে জয়লাভ করে।
ছবির গল্প একা একজন নারীর সংগ্রামী জীবন নিয়ে। তার নাম টেস। অতি সাধারণ ঘরের মেয়ে সে, যদিও তার পরিবারের পদবি ডারবেফিল্ড শুনে এক গ্রাম্য পাদ্রী কাম ইতিহাসবিদ জানায়, যে তারা বিখ্যাত বংশ ডারবারভিলেসের বংশোদ্ভূত। এ কথা শুনে মাতাল কৃষক তার বড় মেয়ে টেসকে আত্মীয়তার সূত্র তৈরি করে এক ডি’আরবারভিলেস পরিবারে কাজের জন্য পাঠিয়ে দেয়। সেখানে এলেক ডি’আরবারভিলেস কর্তৃক ধর্ষিত হয় টেস। টেস অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসে। শিশুটি অসুস্থ অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে এবং মারাও যায়।
এরপর টেস একটি ডেইরি ফার্মে মিল্কম্যানের কাজ জুটিয়ে বাড়ি ছাড়ে। এখানে সে তার সত্যিকারের প্রেমিক অ্যাঞ্জেল ক্লারের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও প্রণয় ঘটে। আঞ্জেল বড় পরিবারের সন্তান। কৃষি তার প্যাশন। টেস তার জীবনে ঘটে যাওয়া পূর্বের ঘটনাগুলো অ্যাঞ্জেলকে জানাবো জানাবো করে জানানোর সুযোগ পায় না। বিয়ের রাতে সে সুযোগ পেয়ে অ্যাঞ্জেলকে সব খুলে বলে। আঞ্জেল সব শুনে টেসকে প্রত্যাখ্যান করে।
প্রত্যাখ্যাত অ্যাঞ্জেল বাড়ি ফিরে আসে। ততদিনে তাদের পরিবারের অবস্থা আরো শোচনীয় অবস্থায় চলে এসেছে। বাবা মারা গেছে। মা ও ছোটভাই বোনদের চালানোর দায়িত্ব তখন টেসের ঘাড়ে। উপায়হীন টেস ফিরে যায় এলেকের কাছে। বাধ্য হয়ে তাকে বিয়েও করে।
এরই ভেতর স্বেচ্ছায় সন্ন্যাসজীবন থেকে ফিরে আসে অ্যাঞ্জেল। সে সন্ন্যাসজীবনে টেসের প্রতি যে অন্যায় করেছে, সেটা বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়। ফিরে আসে টেসের কাছে। ততদিনে সে অনেক দেরি করে ফেলেছে। টেসের সঙ্গে দেখা করে হতাশ হয়ে ফিরে যায় সে। অ্যাঞ্জেলের প্রত্যাবর্তনে টেস বুঝতে পারে, তাকে সুখী হতে হলে তার সত্যিকারের ভালোবাসা অ্যাঞ্জেলের কাছে ফিরে যেতে হবে। আর এজন্য প্রয়োজন পথের কাঁটা দূর করা। সে এলেককে খুন করে অ্যাঞ্জেলের কাছে পালিয়ে আসে। তারা দুজনে একপৌঢ় বাড়িতে আশ্রয় নেয়। দুদিন স্বামী-স্ত্রীর মতো বাস করে। তৃতীয় দিন পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায় টেসকে। টেসের ফাঁসি হয়ে যায়। টেসের কথা মতো তার ছোটবোনকে বিয়ে করে অ্যাঞ্জেল।
ছবি জুড়েই উপস্থাপিত হয়েছে টেসের সাফারিং। তার সাফারিংয়ের জন্য সে নিজে দায়ী নয়। এলেক তাকে ধর্ষণ করে। আর সেই অপরাধ গিয়ে পড়ে টেসের ওপর। যে-কারণে টেসকে ভুল বোঝে অ্যাঞ্জেল। অথচ অ্যাঞ্জেলের নিজের জীবনেও একজন নারী এসেছিল। অ্যাঞ্জেলের সেই জীবন টেস মেনে নিতে পারলেও টেসের জীবন মানতে পারেনি তার প্রেমিক কথিত পুরুষ। টেস বারবার সমাজ-সংসার থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। তবু সে দায়িত্বশীল থেকেছে তার সংসারের প্রতি। পরিবারের কথা ভেবে নিজেকে পুনরায় সপে দিয়েছে তার ধর্ষক পুরুষের কাছে। টেসকে ধর্ষণ করার জন্য এলেকের কোনো শাস্তি হয়নি। কিন্তু এলেকের হত্যার অপরাধে টেসের ফাঁসি হয়েছে।
যৌন নির্যাতনের বিষয়টি যেসব ছবিতে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে তার সংক্ষিপ্ত তালিকা :
সিক্রেট ইন দেয়ার আইজ, ৮ এমএম, অ্যান আমেরিকান হ্যান্টিং, আমেরিকান মি, এ টাইম টু কিল, দ্য বাটারফ্লাই ইফেক্ট, চায়না টাউন, দ্য কালার পার্পল, দ্য ক্যান্ট্রি টিচার, ফ্রি ওয়ে, গন বেবি গন, অ্যানিমাল হাউস, দ্য হিলস হ্যাভ আইজ, কিং অব থিবস, লিপস্টিক প্রভৃতি।