কুরোসাওয়া কথা
দূরগ্রামের ডাক
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/08/17/photo-1502955717.jpg)
ভূমিকা
জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া (২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘ড্রিমস’সহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, ‘কুরোসাওয়া কথা’ শিরোনামে, ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে এখানে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।
আমার বাবা হলেন হনশু দ্বীপের উত্তরাঞ্চল—আকিতা এলাকার মানুষ। দৃশ্যতই এ কারণেই আমার নাম ‘টোকিও অ্যাসোসিয়েশন অব আকিতা প্রিফেকচার ন্যাটিভস’-এর তালিকাভুক্ত হয়েছে। তবে আমার মা জন্মেছিলেন ওসাকা শহরে। আর আমার নিজের জন্ম টোকিওর ওমোরি অঞ্চলে। ফলে আকিতা প্রদেশের একজন দেশি লোক পরিচয় হিসেবে, কিংবা এটি কোনোভাবে আমার নিজেরই ভিটা— এমনতর অনুভূতি আমার ভেতর সত্যিকার অর্থেই কাজ করে না।
ব্যাপারটা এমন : জাপান এমনিতেই অনেক ছোট দেশ, ফলে এটিকে আরো ছোট ছোট টুকরো করে বিচার-বিবেচনা করার ঠিক কী দরকার— আমার মাথায় ঢোকে না। জগতের যে প্রান্তেই যাই না কেন, যদিও আমি কোনো বিদেশি ভাষায় কথা বলতে পারি না, তবু সেটিকে আমার ‘বিদেশ’ বলে মনে হয় না। আমি মনে করি, সারা দুনিয়াটাই আমার দেশ। সবাই যদি এভাবে ভাবতে পারত, তাহলে মানুষ বুঝতে পারত, এইসব আন্তর্জাতিক সংঘাত কী যে হাস্যকর জিনিস; আর তারা পারত এ সবের শেষ টানতে। আমরা মূলত এতই সংকীর্ণ মানসিকতার, এইসব মামুলি ভূকেন্দ্রিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে ভাবি। দুনিয়ার বাইরে স্যাটেলাইট পাঠাতে শুরু করে দিয়েছে মানুষ; অথচ এখনো তারা বুনো কুকুরের মতো দুনিয়ায় নিজেদের পা নিজেরাই চাটতে ব্যস্ত। আমাদের এই গ্রহটির আসলে ভবিষ্যৎ কী?
আকিতার প্রান্তিক গ্রামে আমার বাবার জন্মগ্রাম এখন নিষ্ঠুরভাবে বদলে গেছে। গ্রামটির মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট নদী। আমার বাবা জন্মেছেন সেখানেই— যেখানে একদা ছিল চোখ জুড়ানো ঘাস আর ফুলের সমাহার। এখন সেখানে যত জঞ্জালের ছড়াছড়ি : চায়ের কাপ, বিয়ারের বোতল, টিনের কৌটা, শ্রমিকদের রাবারের জুতো এবং এমনকি নী-বুট। গ্রামটির খেয়াল প্রকৃতি অবশ্য সযত্নেই রেখেছিল। প্রকৃতিকে কুৎসিত বানিয়েছে শুধু মানুষের স্বভাব।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার দিনগুলোতে যখন আমি আকিতার গ্রামাঞ্চলে বেড়াতে যেতাম, তখন মানুষগুলো ছিল সত্যিকারের সহজ-সরল। তার মানে এই নয়, সেখানকার দৃশ্যপটই ছিল পুরোদস্তুর ছবির মতো সুন্দর। বরং তা ছিল একেবারেই সাদামাটা। তবে একইসঙ্গে তা পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল সাদামাটা সৌন্দর্য্যের সমারোহে। এ ব্যাপাটি একেবারে নির্দিষ্ট করতে চাইলে বলতে হয়, আমার বাবা যে গ্রামটিতে জন্মেছিলেন, সেটির নাম ছিল তোয়োকাওয়া ভিলেজ। আকিতা প্রিফেকচারের সেনবোকু-গুন অঞ্চলে ছিল এর অবস্থান। ট্রেনে চড়ে আট কিলোমিটার পাড়ি দেওয়ার পর, বাকি পথ হেঁটে যেতে হতো। মনে পড়ে, উদ্ভট সব নামের স্টেশন ছিল রেললাইনের পাশে : একটির নাম গোসাননেন [‘তিন বছর পর’], আরেকটির নাম জেনকুনেন [‘নয় বছর আগে’]। দ্বিতীয় স্টেশনটির এখন আর অস্তিত্ব নেই। দৃশ্যতই, মধ্যযুগীয় গেঞ্জি যোদ্ধাদের জাতভাই, হাচিমানতারো বংশের বিখ্যাত লড়াইয়ের ওপর নাম রাখা হয়েছিল এ দুটি পল্লীর। ট্রেনে বাম হাতের দিকে তাকালে, চোখে পড়বে একগুচ্ছ পর্বত— যেখানে কিংবদন্তি যোদ্ধা হাচিমানতারো ইয়োশিয়ে স্বয়ং নিজের যুদ্ধ-শিবির গেঁড়েছিল। পরবর্তীকালে আমি জানতে পেরেছি, এই প্রাচীন ঘটনাগুলোর সঙ্গে বস্তুতপক্ষে আমারও একটা সংযোগ রয়েছে।
সমগ্র জীবনে, বাবার জন্মগ্রামে আমি মাত্র ছয়বারই গিয়েছি। এই প্রমোদভ্রমণের দুবারই ঘটেছিল আমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার দিনগুলোতে। একবার গিয়েছি যখন, তখন আমি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র; আরেকবার ঠিক কখন গিয়েছিলাম, কিছুতেই মনে পড়ছে না। এমনকি এও মনে পড়ছে না— কী কী ঘটেছিল সেই দ্বিতীয় ভ্রমণে; প্রথম ভ্রমণটির স্মৃতিই আমার মাথার ভেতর ওতপ্রোতভাবে গেঁথে আছে।
যখনই সে কথা ভাবতে বসি, শুধু এটুকুই মনে পড়ে, আমার সেই দুটি ভ্রমণের মধ্যভাগে, গ্রামটিতে কোনো ধরনের পরিবর্তন আসেনি। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, ছোটনদী ও গাছপালা, এমনকি পাথর, ঘাস ও ফুলগুলো— সবই অবিকল রয়ে গিয়েছিল। ফলে এ দুটি ভ্রমণকে আমি আলাদা করে তুলতে পারি না। ব্যাপারটি এমন যেন, গ্রামটিতে সময় ছিল স্থির দাঁড়িয়ে; মানুষগুলোও রয়ে গিয়ে একেবারেই অবিকল— জগতের কোনো তোয়াক্কা না করে। ব্রেডেড পর্ক কাটলেট কিংবা রাইস কারি— এ ধরনের ‘বিদেশি’ খাবার সেখানকার অনেক মানুষই কোনোদিন খায়নি। কোনো কারামাল কিংবা কুকিজও বিক্রয় হয়নি তোয়োকাওয়ায়; কেননা, দোকান হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে— এমন কোনো বাড়ি অস্তিত্বই সেখানে ছিল না। এমনকি সেখানকার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকটিও কোনোদিন টোকিও দেখেননি। তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছিল, ঘুরতে গেলে টোকিওর মানুষেরা কী বলে সম্ভাষণ জানায়; ব্যাপারটা এমন যেন, টোকিওর লোকজন কোনো উদ্ভট, দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলে!
বাবার লেখা একটি চিঠি সঙ্গে নিয়ে, গ্রামটির এক বাড়িতে একবার হাজির হয়েছিলাম আমি। সদর দরজার কাছে এগিয়ে এসে বুড়ো লোকটি আমার আসার কারণ জানতে চেয়ে ক্ষণিকের জন্য শুনল, তারপর ছুটে গেল অন্দরমহলে। তার জায়গায় এরপর এলো এক বুড়ি। আমাকে পরম আতিথেয়তায় নিয়ে বসাল তাতামিমাত ফ্লোরঅলা ফরমাল রুমটিতে; সেখানে আর্ট অ্যালকভের দিকে পিঠ করে, সম্মানিত অতিথির পজিশনে আমাকে বসাল সে। তারপর উধাও হয়ে গেলেন।
অবশেষে সেই বুড়োটির দেখা মেলল আবার। পরনে কাঁধের কাছে পারিবারিক ক্রেস্ট লাগানো ফরমাল কালো আলখেল্লা, আর ফরমাল কালো হাকামা ট্রাউজার। মেঝের দিকে মাথা নুইয়ে আমার প্রতি সম্মান জানাল সে। মাথা নত অবস্থায় শ্রদ্ধাচিত্তে বাবার চিঠিটি নিয়ে পড়তে শুরু করল।
ঠিক সেদিনই সন্ধ্যায়, আমি, আর্ট অ্যালকভের পিলারের দিয়ে পিঠ দিয়ে বসেছিলাম আরেকবার। অতিথি হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মানের পজিশনে ছিল আমার অবস্থান; গ্রামের সব বুড়ো-বুড়ি ও পূর্ণবয়স্ক লোকগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে ছিল কক্ষে। আর শুরু হয়ে গিয়েছিল ড্রিংকিং পার্টি। এই আয়োজনকে মহিমান্বিত করতে ছুটে আসা গ্রামের বালিকাদের দিকে প্রত্যেক গ্রামবাসী নিজের কাপটি বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। প্রথমজন ‘টোকিওর উদ্দেশে’— এ কথাটি বলেই নিজের কাপটি করছিল পেশ। তারপর দ্বিতীয়জনও বলল, ‘টোকিও...’; এমনকি তৃতীয়জনও।
ব্যাপার কী— যখনই বোঝার চেষ্টা করছিলাম, সব বালিকা তখন এক এক করে কাপগুলো আমার দিকে বাড়িয়ে দিতে থাকল। আমার বসার জায়গায় উঠে এসে, প্রথম বালিকাটি আমার সামনে রেখে দিল কাপটি। আমি যখন সেটি হাতে তুলে নিলাম, তখন তিনি পুরো কাপটি ভরে দিলো পানীয় ঢেলে। এর আগে কখনোই মদ খাইনি আমি; ফলে অস্বস্তি নিয়েই চুমুক দিলাম। তা করতেই, দ্বিতীয় বালিকাটি এসে নিজের কাপটি বাড়িয়ে দিল, আর দিল পূর্ণ করে। তৃতীয় বালিকাটিও তা-ই করল। অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে, মাতাল হয়ে গেলাম আমি।
কিছুক্ষণ পর চোখ দুটো চকচক করতে শুরু করল আমার। তখনো কণ্ঠস্বরগুলো বলেই চলল— ‘টোকিও’, ‘ টোকিও...’। শব্দটি ধীরে ধীরে মিহি থেকে আরো বেশি মিহি হয়ে ওঠতে থাকল প্রতিধ্বনির মতো। আমার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক বাড়তে থাকল বিশ্রীভাবে। আমি আর বসে থাকতে পারছিলাম না; ফলে উঠে দাঁড়িয়ে, টলতে টলতে বেরিয়ে পড়লাম। তারপর পড়ে গেলাম ধানক্ষেতে।
পরে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ‘টোকিও’ বলতে তারা আসলে বুঝিয়েছিলেন— ‘টোকিও থেকে আসা অতিথির সম্মানে...’; অর্থাৎ, আমাকে জানানো হয়েছিল সম্মান। একটি স্রেফ বাচ্চা ছেলেকে মদ খাইয়ে তারা নিশ্চিতভাবেই খারাপ কিছু করেনি; কেননা, এখানে তারা শিশুদেরও মদ খাওয়ান। [নিঃসন্দেহে শিশুরাও এতে অভ্যস্ত হয়ে যায়।]
গ্রামের প্রধান সড়কের প্রবেশপথের কাছেই ছিল অতিকায় এক পাথর। সেটির মাথায় সবসময়ই ফুল দিয়ে রাখা হতো। এ পথ দিয়ে আসা-যাওয়ার কালে সব শিশুই বুনোফুল নিয়ে আসত সঙ্গে, আর রেখে দিত পাথরটির চূড়ায়। কেন তারা এটা করে— এই ভেবে অবাক হয়ে যখন জানতে চেয়েছিলাম। শিশুরা বলল, কারণ জানা নেই তাদের। পরে গ্রামের এক বুড়োকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম আমি। শতবর্ষ আগের বশিন যুদ্ধে [১৮৬৮-১৮৬৯], ঠিক এ জায়গাটিতেই কেউ একজন মারা গিয়েছিল। তার প্রতি মমতা দেখিয়ে, গ্রামবাসী তাকে এখানেই কবর দিয়েছিল। তারপর কবরের ওপর রেখে দিয়েছিল এই পাথর। আর পাথরটির ওপর এখনো রেখে যাচ্ছে ফুল। এই ফুল হয়ে উঠেছে এ গ্রামের এক রীতি। শিশুরা এর আসল কারণ না জেনেও সেই রীতি বজায় রেখেছে।
এই গ্রামে এমন এক বুড়ো থাকত, বজ্রপাত যে একদমই পছন্দ করত না। বজ্রপাত শুরু হলে, বজ্রের গর্জন থেকে নিজেকে বাঁচাতে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ত বিশাল এক মাচার নিচে। বজ্রপাত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখান থেকে বের হতো না।
একবার এক কৃষকের বাড়িতে গিয়েছিলাম আমি। সে আমাকে ঝিঁনুকের খোলসে করে খেতে দিয়েছিল মিসো বিন-পেস্ট সস দিয়ে রান্না করা এক সবজির খাবার। বলে রাখি, খাবারের এ স্টাইলকে গ্রামটির এ অঞ্চলে কাইয়াকি বলে ডাকা হয়। সঙ্গে আমাকে খেতে দিয়েছিল মাছ। নিজের খাবারের ওপর মদ ঢেলে দিতে দিতে, গাম্ভীর্যপূর্ণ উচ্চারণে লোকটি আমাকে বলেছিল, ‘এ রকম এক খুপড়ি ঘরে জীবন কাটানোর আর নোংরা খাবার খাওয়ার মধ্যে ইন্টারেস্টিং কী-ই-বা থাকতে পারে— তা ভেবে হয়তো তোমার অবাক লাগবে। দেখো, আমি বলি কি, স্রেফ বেঁচে থাকাটাই তো ইন্টারেস্টিং এক ব্যাপার।’
তোয়োকাওয়া গ্রামে ৫০ বছর আগে মানুষের জীবনযাপন সম্পর্কে যা আমি শুনেছি ও দেখেছি, তা যে কোনো বিবেচনাতেই ছিল অদ্ভুত ধরনের সহজ-সরল এবং অনেকটা বিষণ্ণ রকমের শান্তিপূর্ণ। এখন সে সব মনে করতে গেলে, এ জায়গাটির স্মৃতি কোনো ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা— ছোট থেকে আরো ছোট ও ঝাপসা হতে থাকা কোনো দূরবর্তী গ্রামের মতোই ঘোলাটে হয়ে ওঠে।
(চলবে)