গল্প পড়ার গল্প
অন্য সাহিত্যের স্বাদ দেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
পাঁচ বছর হয়ে যাচ্ছে তাঁর প্রয়াণের। সামনের সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখ প্রয়াণ দিবস। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে আমি কবে প্রথম পড়েছি, তা আর স্মরণে নেই। আলাপ হয়েছিল তাঁর কর্মস্থল আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে লেখক রমাপদ চৌধুরীর ঘরে। তিনি বোধ হয় সদ্য আমেরিকা থেকে ফিরেছেন। আপ্লুত হয়েছিলাম তাঁকে দেখে, কথা বলতে পেরে। তখন আমি তাঁকে পড়ে ফেলেছি কিছুটা। ‘গোঘ্ন’ পড়েছি, ‘পুষ্পবনে হত্যাকাণ্ড’, ‘জাতীয় মহাসড়ক’, ‘বুঢ়া পীরের দরগা তলায়’, ‘উড়োচিঠি’ এমনি কত সব গল্প।
হ্যাঁ, হয়তো আমার ভুল হতে পারে। কোনো গল্প হয়তো পরে পড়েছি, কত দিন হয়ে গেল তারপর। আমার মনে হয়েছে, সিরাজ বহন করেছেন তারাশঙ্করের প্রকৃত উত্তরাধিকার। কেমন সেই উত্তরাধিকার? সিরাজ কি তারাশঙ্করের সৃজনকে অনুসরণ করেছেন? তাঁকে পড়লে কি তারাশঙ্করের কথা মনে পড়ে? একবিন্দুও নয়। তাঁর লেখায় ছিল না তারাশঙ্করের কোনো ছায়া, বরং আমি অন্য লেখকের লেখায় তা দেখেছি। আমি বলতে চাইছি অন্য কথা। বাংলা সাহিত্যে তারাশঙ্করই প্রথম অন্ত্যজ মানুষকে নিয়ে আসেন গল্প-উপন্যাসের প্রধান চরিত্র করে। তাঁর আগে আমাদের গল্প-উপন্যাস মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত বাঙালি আর জমিদার, ভূসম্পত্তিমাণ মানুষের কথা বলেছে। বিভূতিভূষণ ছিলেন আশ্চর্য ব্যতিক্রম। দরিদ্র হতশ্রী বাংলার রূপ তাঁর লেখার পরতে পরতে।
গত শতকের পঞ্চাশের দশকে যে লেখকদের আবির্ভাব, তাঁদের ভেতরে সিরাজ, শ্যামল, মহাশ্বেতার লেখায় অন্ত্যজ মানুষ এসেছে তাঁর রক্ত-মাংস নিয়ে। আর সিরাজ এখানে নিজেকে আলাদা করে নিলেন অন্ত্যজ বাঙালি মুসলমানকে আমাদের সাহিত্যে নিয়ে এসে। হ্যাঁ, স্বাধীনতার পরে এই বাংলায় সিরাজই প্রথম অর্গল খুলে দিলেন। তার আগে সেভাবে কিছু ছিল না। দেশভাগের পর ওপার বাংলায় বাঙালি মুসলমান তাঁর আত্মপরিচয় লিখেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবু ইসহাক, মাহমুদুল হক থেকে পঞ্চাশের দশকের হাসান আজিজুল হক বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। এই বাংলায় আরম্ভ করলেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ।
সাহিত্য তো আমাকে দেশ চেনায়, কাল চেনায়, চেনায় মানুষ। সিরাজ মুর্শিদাবাদের হিজল অঞ্চলের অন্ত্যজ হিন্দু-মুসলমানের জীবন চরিতে প্রবেশ করেছেন তাঁর গল্প-উপন্যাস নিয়ে। উড়োচিঠি, গোঘ্ন, বুঢ়া পীরের দরগা তলায়, বাগাল, মৃত্যুর ঘোড়া, রানীরঘাটের বৃত্তান্ত, সূযর্মুখী, পুষ্পবনে হত্যাকাণ্ড—কত যে প্রিয় গল্প আছে আমার। সময়ে-অসময়ে পড়ি। পড়ে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। বেলা যেন পড়ে আসে।
‘সূযর্মুখী’ গল্পটির কথা মনে করি। সেই যে কাপুড়ে নবীন আর সেই মেয়ে। নবীন এক কাপড়ের ফেরিওয়ালা, রাঙা ব্লাউস, সাদা লেসের নকশাকাটা সুনীল শায়া, রং ঝিলমিল ফ্রক, ডোরাকাটা পেন্টুল, কত কিছু বেচে গাঁয়ে গাঁয়ে। মাঠ পার হচ্ছে সে। মাঠ নয় যেন নদী। তাকে অনুসরণ করছে এক মেয়ে। একে সে কোথায় দেখেছিল, কোন গাঁয়ে? কী নামে সে ডেকেছিল একে? মেয়েটি তো তাকে চেনে। তারা ধুলোউড়ির মাঠ পার হচ্ছে...
‘ধুল্লোউড়ির মাঠে রে ভাই
রোদ ঝনঝন করে।
পানের সখার সঙ্গে দেখা
বেলা দুপহরে...’
কী আশ্চর্য এক অনুভূতির জন্ম দেয় এই গল্প। অদ্ভুত এক ভালোবাসার ছোঁয়া। সেই মেয়ের নাম ‘সুজ্জমুখী’। তাকে সেই নবীন কাপুড়ে দেবে, তাকে মানায় এমন রঙের ব্লাউজ, এমন রঙের কাপড়। এই গল্পের পরতে পরতে ভালোবাসার আবছা ছায়া লেগে থাকে। যতবার পড়ি, মুগ্ধ হই। রাঢ়ের সেই দিগন্তে প্রসারিত প্রান্তর চোখের সমুখে ভেসে ওঠে।
উড়োচিঠি গল্পের উত্তর-পশ্চিম রাঢ়ের সেই প্রত্যন্ত গ্রাম কালুডিহির কথা আমার মনে পড়ে। কালুডিহির বুড়োরা সবাই একেকজন ব্যস মুনি। এপিক পুঁথির ভারে কুঁজো হয়ে ঠুকঠুক করে পা ফেলছে শ্মশান কিংবা কবরের দিকে। কত গল্পের ঝাঁপিই না খুলে বসে। আমার মনে হয়েছিল, এ যেন মহাকবি কালিদাস বর্ণিত সেই সব গ্রাম বৃদ্ধ, যারা সন্ধ্যায় বসে রাজা উদয়ন ও বাসবদত্তার গল্প বলে। কালুডিহির বদরুবুড়ো এক চিঠির কথা শোনায়। যে গাঁয়ে কোনোদিন খাজনা আদায়ের লুটিস দিতে আসা তহশিলদারের পিয়ন ব্যতীত আর কেউ কখনো ঢোকেনি, সেই গাঁয়ে এক চিঠি নিয়ে এলো ডাকপিয়ন। কত পথ হেঁটে এসেছে সে, আমোদ আলি সাকিন কালুডিহি ডাক : সোনাতলা ঠিকানাওয়ালা চিঠি নিয়ে। কী অপূর্ব এই গল্প। গ্রামের মানুষের হৃদয়টিকে একটু একটু করে উন্মোচন করেছেন সিরাজ। কে আমোদ আলি? কই, ওই নামে তো কোনো মানুষ নেই কালুডিহিতে? ঘর্মাক্ত ডাকপিয়ন হতাশ হয়। দু’পয়সা বকশিশের আশা ছিল তার, হবে না। গুড়-পানি খেয়ে ঠান্ডা হয়েও কী বলবে, ধরতে পারে না। তখন গাঁয়ের লোক, বুড়ো থেকে জোয়ান, বুড়ি থেকে ঘোমটা ফেলা বউরা বলে, চিঠিটা পড়ে শোনাও দেখি। সেই চিঠিতে কোনো এক মামোদ আলি খড্ডা থেকে লিখেছে, ভাই আমোদ আলি, আমি তুমার ভাই মামোদ আলি, আমি দুরারোগ্য ব্যাধিতে শয্যাশায়ী, মৃত্যু আমার সমুখে, তুমি আমাকে লইয়া যাও।
আহারে, ভাই বড় আদরের ধন। সে মরছে কতদূরে। চিঠির কথা শুনে কালুডিহির মোড়ল থেকে বেওয়াবুড়ি, সকলের চোখ বুঝি ভিজে যায়। কে আমোদ, তার ভাই মরছে কোন দেশে। ভাই মামোদ আলি। হয়তো আমোদ আলি ছিল, এখন নেই। কবরে আছে। তারা কবরের দিকে তাকায়। কত মানুষ জন্মেছে এই কালুডিহিতে, কত মানুষ মাটি নিয়েছে। তার ভেতরেই আছে নিশ্চয়। কিন্তু কোন ঘরের তারা? ওই আমোদ মামোদ। তখন এক প্রাচীনা স্মরণ করল ওই যে বাঁশঝাড়ের ধারে ছড়া বাস্তু—পরিত্যক্ত এক ভিটে, ওইখানে থাকত যে এক বেওয়া, বুধনি বহরি, তার ছিল দুই ছেলে, তারাই হবে আমোদ মামোদ। সেই যে একবার রাজার হাতি এলো কালুডিহিতে, সেই হাতির পিছু পিছু বুধনির এক ছেলে হারিয়ে গেল। কত বালক হাতির পিছু ধরেছিল, সবাই ফিরে এলো, ফিরল না বুধনির এক বেটা। তাকে রাতভর খুঁজল তার মা ডেকে ডেকে, কিন্তু পেল না। জিন তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ঠিক। ধীরে ধীরে উন্মোচন করেন সিরাজ। কেমন সেই উন্মোচন, কতখানি আত্মীয়তা থাকলে এই উন্মোচন হয়। হ্যাঁ, হতদরিদ্র সে কালুডিহির মানুষের সঙ্গে, বুঢ়া পীরের দরগাতলার বেন্দাবনের সঙ্গে, বাগাল গল্পের বালক হরিবোলা, রানীর ঘাটের বৃত্তান্ত গল্পের সুরি পাগলির বেটা ফালতু সূর্যমুখী গল্পের সেই কাপড়ওয়ালা—নিরুপায় কিন্তু হৃদয়বান মানুষগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কালুডিহির মোড়ল সাজিয়েছিল গো গাড়ি। আমোদ আলি নেই বলে তার ভাই, গাঁয়ের ছেলেটি দূর দেশে একা একা মরে যাবে, তা কখনো হতে পারে?
মোষের গাড়ি সাজিয়ে তারা অন্ধকারে রওনা হয়েছিল মৃত্যুপথযাত্রী মামোদ আলিকে নিয়ে আসতে। কিন্তু যাবে কোথায়? খড্ডায়। খড্ডা কোথায়? ডাকপিয়নের কাছে জিজ্ঞেস করা হয়নি। হায় হায়। কেউ জানে না কোথায় সেই জায়গা। সোনাতলার গোমস্তামশাইও খড্ডার নাম শোনেনি। তার বাড়িতে গাড়ি রেখে কালুডিহির জোয়ানরা তিন দিন ধরে বড় বড় জায়গায় খোঁজ করে বেড়াল। কেউ বাপের জন্মে খড্ডার নাম শোনেনি। তারা ফিরে এলো শূন্য গাড়ি নিয়ে। সেই শোক সামলাতে অনেক দিন লেগেছিল। শোকই বটে। কী হলো সেই মামোদ আলির?
গল্পটি বলেছিল ত্রিকালজ্ঞ বদরু বুড়ো। খড্ডা হলো জিন-পরীদের দেশ। সেখানে হিরের গাছে মানিক ফলে। মামোদ আলিকে জিনে নিয়ে গিয়েছিল। সেখেন থেকে কেউ ফেরে না। ফেরে না তাই মামোদ আলি ফেরেনি। কালুডিহির এই যে কাহিনী, মিথ, তাতে কখনো খড্ডা হবে না খড়দা। বুড়ো বদরু কবরে গেলে এই যে কাহিনী, এই যে হারিয়ে যাওয়া মামোদ আলির জন্য অশ্রুপাত, সব লুপ্ত হবে। অথচ মামোদ আলির মতো কতোজন কালুডিহি ছেড়ে গেছে, যাচ্ছে সেই জিন-পরীর শহরের টানে। গল্পটি আমার কাছে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে লৌকিক এক গাথা-কাহিনী।