সাক্ষাৎকার
এখনকার রাজনীতি নিজের জন্য : হাসান আজিজুল হক
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/07/18/photo-1437204712.jpg)
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক এ যুগের বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক দর্শনের অধ্যাপক হাসান আজিজুল হকের লেখনীর তীক্ষ্ণতা ও শব্দ নিয়ে খেলা করার সৌন্দর্য পাঠকদের নিয়ে যায় ভাবনার গভীরে। আজকের এ প্রথিতযশা মানুষটি একদিনেই গড়ে ওঠেননি। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে বেড়ে ওঠা মানুষটির শৈশব বারবার নাড়া খায়-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও সাতচল্লিশের দেশ ভাগের দুর্বিষহতায়। শৈশব ও কৈশোর নিয়ে কথা বলতে বলতে হাসান আজিজুল হক হারিয়ে যান ফেলে আসা দিনগুলোতে। সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার অডিটরিয়ামে, ২০১২ সালে। তিনি ওই সময় নতুন উপন্যাসের জন্য লিখে যাচ্ছেন পাতার পর পাতা। লেখার মাঝেই শুরু হলো আলাপচারিতা।
শৈশবের সুর
লেখকের শৈশবের বেশির ভাগ সময় কেটেছে পশ্চিমবঙ্গে। জন্মের পর থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত-জন্মস্থান যবগ্রামই ছিল তার একমাত্র পরিচিত ভুবন। পাঠশালা, স্কুল সব এখানে। আজিজুল হক বললেন, ‘এখনকার বিশ্বকে তো বলা যায় করতলে বিশ্ব। যেখানে শারীরিক সান্নিধ্যের প্রয়োজন নেই। ঘরে বসেই পরিচিত হই বিভিন্ন মানুষ, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে। তবে আমাদের সময়টা এমন ছিল না। বলতে পার এক ধরনের চাষাভুষোর ছেলেদের মতোই বড় হয়ে ওঠা। নাপিতের ছেলে, কামারের ছেলে, চাষার ছেলে সবাই-আমরা একইভাবে বড় হয়ে উঠেছি। বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল খুবই ক্ষীণ।
বললেন, আমাদের সময়টা ছিল একটা ভীষণ ক্রাইসিস মোমেন্ট। সেটা এ জেনারেশনের তেমনভাবে বোঝা সম্ভব নয়। পায়ে জুতো নেই, জামা নেই, বাড়িতে মশারি নেই। চারদিকেই তখন একটা হাহাকার ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জন্ম হয়েছে আমার। সম্ভবত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু হওয়ার প্রথম দিনই। যুদ্ধের কারণেই সময়টা এত কঠিন হয়ে উঠেছিল। হেসে বললেন, হয়তো পৃথিবীটাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দেওয়ার জন্যই সে সময়ে আমার জন্ম (হাসি উচ্চস্বরে)।
দুষ্টুমির শৈশব
শৈশবের সময়টা অনেক কঠিন হলেও দুষ্টুমি কিন্তু থেমে থাকেনি। শৈশবের স্বভাবসুলভ চাঞ্চল্যে দুষ্টুমিও করেছেন অনেক। কখনো হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করতে গিয়ে ফেলে দিয়েছেন হ্যারিকেনের তেল, তালগাছে চড়ে পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছেন। আবার কখনো হয়তো কাঁটাভরা ঝোঁপে ঢুকে গেছেন শেয়াল তাড়াতে। মজার দুষ্টুমির কথা জানাতে গিয়ে বললেন, ‘একবার ঝোঁপের ভেতর লাল টুকটুকে একটি কুল পাড়তে গিয়েছিলাম। ঝোঁপে এত কাঁটা ছিল যে, সহজে হাঁটা সম্ভব ছিল না। তাই কাঁদামাটির বড় বড় দলা মাটিতে বিছিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছি, গিয়ে দেখি এক শেয়াল। ভয় না পেয়ে শেয়ালটাকে তাড়াবার চেষ্টা করলাম, সঙ্গে সঙ্গে জুটে গেল কিছু কুকুর, আর বাঁদরসদৃশ কিছু বালকও। সবাই মিলে শেয়াল তাড়িয়ে, কুল নিয়ে হইচই করতে করতে বাড়িতে ফিরলাম।’
দুরন্ত ছেলেবেলা প্রসঙ্গে হক বলেন, ‘রান্না করতে গেলে যেমন অনেক মশলা দিতে হয়, তেমনি একটি শিশু বড় হয়ে উঠতেও অনেক কিছুর প্রয়োজন। দুষ্টুমি, বিশেষ কারো আদর, কারো সান্নিধ্য, বইপড়া সব কিছু মিলিয়ে একজন মানুষের বেড়ে ওঠা, আমার বেড়ে ওঠা।
বন্ধু হে আমার
হাসান আজিজুল হক ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন খুব মিশুক প্রকৃতির মানুষ। তাঁর বন্ধুর তালিকাটাও বেশ বড়। গ্রামের রাখাল থেকে শুরু করে কেউকেটা ব্যক্তিটির সঙ্গেও তাঁর ভাব ছিল। তিনি বলেন, ‘সবার সঙ্গে মিশতে আমার ভালো লাগে। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মিশে আমি লেখার জন্য বিভিন্ন চরিত্র খুঁজে পাই। তবে আমার অনেক ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধু রয়েছে। নাম সমরেশ নন্দী, যার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল সেই ছোটবেলায়, আজও তা আছে। সে থাকে গ্রামে। তবে ব্যস্ততার জন্য সরাসরি দেখাটা হয় না আমাদের। ফোনে কথা হয়। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ব্যাখ্যার অতীত।’
বন্ধু আমার বইও
ছোটবেলা থেকেই লেখকের বইপড়া পছন্দের বিষয়। শৈশব থেকে তারুণ্যে পা দিতে দিতেই পড়ে ফেলেছিলেন কিটস, শেলি, দস্তয়ভস্কি, তলস্তয়ের মতো লেখকদের গুরুগম্ভীর বই। আর রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিম তো ছিলই। ছোটবেলাতেই পড়েছিলেন যগেন্দ্রনাথ মিত্রের বই। স্মৃতিচারণা করে হক বললেন, ‘সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন সব ধরনের বই আমি পড়তাম। আর ছোটবেলা থেকে গল্পও বলতে ভালোবাসতাম। কথার পিঠে কথা সাজিয়ে নিজের মনের রঙ মিশিয়ে বলতাম অনেক গল্প। ডিটেকটিভ গল্প, শিকারের গল্প। শ্রোতারও অভাব ছিল না, আমার বন্ধুরাও সেসব গল্প বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনত। শেষের দিকে সেসব গল্প নিয়ে হয়তো কিছু লিখতাম। পড়ার কারণে অভ্যাসটি তৈরি হয়েছিল।’
হাতছানি দেয় তারুণ্য
স্কুল ফাইনাল পাস করার পর এ বাংলায় চলে আসেন লেখক। থাকতে শুরু করেন বড় বোনের কাছে। কলেজেও ভর্তি হন সেখান থেকে। ধীরে ধীরে শৈশবের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে জানতে শুরু করেন নতুন মানুষ, পরিবেশ এবং বিশ্বকে। এর সাথে যোগ হলো ৪৭-এর দেশভাগ, লেখক বললেন, ‘কলেজে ভর্তি হয়ে জগতকে জানতে শুরু করলাম। জানতে শুরু করলাম অর্থাৎ শুধু চোখ-কান খোলা হিসেবেই জানা নয়। জগতকে ভোগ করে তবেই জানতে শুরু করলাম।’
সে সময়ে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন হাসান আজিজুল হক। বুঝতে শুরু করেছেন, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের কারণ, পুঁজিবাদের নাগপাশ। হক বলেন, ‘তখন ছাত্ররাজনীতির একটি আদর্শ ছিল, আমরা দেশ নিয়ে ভাবতাম। এখনকার ছাত্ররাজনীতির মতো সেটি নয়। এখনকার রাজনীতিটা অনেক বেশি নিজের জন্য। অপরের জন্য নয়। আমাদের আদর্শ ছিল বাঁচার জন্য বাঁচা, সবার জন্য বাঁচা। জীবনে কখনো আমি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিনি।’
লক্ষ্যের পথে
অনেক আগে থেকেই লেখার হাতটা থাকলেও ১৯৬০ সালের দিকে সিদ্ধান্ত নেন লেখক হবেন। হক বলেন, ‘লেখা ছাপা হতো আমার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। তবে দৃঢ়ভাবে লিখবই এ চিন্তাটা আসে ষাটের দশকে।’
প্রেরণার মানুষ
হাসান আজিজুল হক বলেন, ‘আমার প্রেরণায় রয়েছে অনেক মানুষ। অনেকেই আমাদের জীবনের বিভিন্ন সময়ে প্রেরণা জুগিয়েছেন। তবে আমার বড় বোন এবং আমার স্ত্রী দুজনের প্রেরণা আমার জীবনে অতুলনীয়। আমার স্ত্রী আমাকে সংসারের বিভিন্ন কাজ থেকে নিবৃত্তি দিয়ে লিখতে সাহায্য করেছে।’
হরেক রঙের তারুণ্য
নিজের তারুণ্য নিয়ে লেখক বলেন, ‘একটা স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণবন্ত সময় ছিল তখন। তাই সব কিছুই চলেছে একই সঙ্গে। এমনকি প্রথম প্রেমিকাকে চিঠি লেখাটাও।’ মজা করে প্রেমিকার নামটি জানতে চাইলে বললেন, ‘কিছু জিনিস গোপন থাকাই ভালো। সব কথা বলার প্রয়োজনও তো নেই।’ তারুণ্যের জীবনযাপন নিয়ে কথা হলে তিনি বললেন, ‘তখন চারআনা পয়সা দিয়ে কিনে খেতাম একটা সিঙ্গারা, একটা সন্দেশ। এখনকার ছেলেমেয়েদের মতো তখন তো আর ফাস্টফুড ছিল না। তাই এটা খাব, ওটা খাব করতে পারিনি। তবে খুব ভালো লাগত হোটেলে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে চা খেতে। এর মাঝে সব সময় চিন্তা থাকত কাজের। পোস্টার লিখতে হবে অথবা ভাসানী সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে হবে ইত্যাদি।’
তরুণ তোমার জন্য
লেখক প্রত্যাশা করেন এখনকার তরুণরা আরো একাগ্র হবে। আত্ম অচেতনতা মুক্ত হবে। তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘অনুভব করো- আমি তরুণ, সেই তারুণ্যে উদ্যমতা থাকবে তবে সেটা যেন গা-ভাসিয়ে দেওয়া না হয়। জানতে হবে আমি কী করছি। আবার এমনও নয় যে, কাঁধের ওপরে একটি লাঙল চাপিয়ে হাঁটা শুরু করা। সময়টি হবে সুস্থভাবে তারুণ্যকে উপভোগ করা, প্রয়োগ করা। তারুণ্যকে জানতে হবে, তারুণ্যকে অনুভব করতে হবে জীবনের অন্তিমকাল পর্যন্ত।’