গল্প পড়ার গল্প
মনে নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ান অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি প্রথম পড়ি অধুনালুপ্ত এক্ষণ পত্রিকায়,‘শাদা অ্যাম্বুলেন্স’। তা প্রায় বছর চল্লিশ আগের কথা। সেই গল্প আমাকে আজও আবিষ্ট করে রেখেছে। ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, ‘মানুষের ঘরবাড়ি’, ‘অলৌকিক জলযান’, ‘ঈশ্বরের বাগানে’র লেখক অতীন মানুষের কষ্টকর জীবনের কথা যে ভাবে বলেন, তা মনের ভিতরে দাগ রেখে যায়। তাঁর ‘শাদা অ্যাম্বুলেন্স’ গল্পটি ছিল এক কিশোর ভৃত্যের। তার গায়ে মায়ের দয়া বেরিয়েছে, তাকে তার প্রভু বাড়ির লোকজন রাস্তায় একটি গাছের তলায় রেখে যায়। সে ছিল মানুষের নিষ্ঠুরতার গল্প। নিরূপায়তার গল্প। অতীন ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ ও ‘মানুষের ঘরবাড়ি’ লিখে চিরায়ত হয়ে গেছেন। তাঁর গল্পে পাই মানুষের নিষ্ঠুরতা, মানুষের ভালোবাসা, জীবনের অনিশ্চয়তা এমনি নানান অনুভূতির কথা যা কি না মনে ছাপ রেখে যায় দীর্ঘস্থায়ী।
অতীন কৈশোর অতিক্রান্ত বয়সে জাহাজিয়া হয়ে বহুদেশ ঘুরেছেন। তিনি ছিলেন সামান্য নাবিক। জাহাজের কোলবয়। সেই অভিজ্ঞতা তাঁর নানা গল্প ও উপন্যাসে এসেছে। আমার মনে পড়ে যাচ্ছে বহুদিন আগে পড়া সেই কৃশকায় উপন্যাস ‘নগ্ন ইশ্বরে’র কথা। দেশভাগ, এপারে এসে শৈশব আর কৈশোরের বঞ্চনা, দুঃখ, দারিদ্র্য তাঁর গল্পের বিষয় যেমন, তেমনি মানুষের আদিমতা, নারী-পুরুষের প্রেম ও বিরহের কথা তিনি লেখেন অনেক গভীর থেকে। তাঁর গল্পে অসীম বৈচিত্র্য। আমার মনে পড়ে যাচ্ছে ‘চিনেমাটির পুতুল’, ‘নদী নারী নির্জনতা’, ‘টিনের বাক্স’, ‘সমুদ্রে অশরীরি’ ...এমন কত গল্পের কথা।
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি জাহাজের গল্প শোনাই এখন। গল্পটির নাম ‘প্রতিপক্ষ’। এই গল্পের প্রধান চরিত্র সুকোমল কৈশোরে ছিল জাহাজের কোলবয়। এখন সে পঞ্চাশ পার। জীবনে প্রতিষ্ঠিত। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে বড় সংসার। সময় ১৯৮৬, বিশ্ব ফুটবলে ম্যারাডোনার আবির্ভাব। এই মানুষটি আর্জেন্টিনার সমর্থক। এই সুকোমল তার কৈশোরে জাহাজিয়া হয়ে বুয়েনসএয়ারস বন্দরে গিয়েছিল। অতীন কী সুন্দর বর্ণনা করেন সমুদ্রপথের। কলকাতা থেকে পাটের গাঁট, কিছু কাঠ আর হেরন পাখি নিয়ে মালবাহী জাহাজ কলম্বো বন্দর থেকে রসদ নিয়ে চলল ইস্ট আফ্রিকার উপকূল বরাবর। দাঁড়িয়েছে লরেঞ্জো মরকুইসে। সেখানে মাল খালাস করে ডারবান-কেপ টাউন হয়ে সোজা দক্ষিণ আমেরিকা। সমুদ্র পথে মন্টিভিডিও এবং স্যান্টিসে মাল খালাস করে আর্জেন্টিনার বুয়েনসএয়ারস। অতীনের সমুদ্র পথে আমারও ভাসা হয়। কল্পনার দুয়ার যেন খুলে যায়। কী নিবিড় বর্ণনা তাঁর। জাহাজের ডেক থেকে কুয়াশায় ঢাকা শহর। খুব ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে জাহাজিয়ারা। সুকোমল অবাক হয়ে দেখছে কুয়াশার ভিতর থেকে ক্রমশ ফুটে ওঠা শহর।
জাহাজের বুড়ো সারেং তাকে সাবধান করে দিয়েছিল, একা যেন রাস্তায় পা না দেয় সে। শহরের ভুলভুলাইয়াতে সে হারিয়ে যাবে। কেউ তার কথা বুঝবে না। জেটি থেকে নেমে দাঁড়ালেই শহর। বড় বড় রাস্তা, ঘরবাড়ি, ফুলের বাগান আর ফুলের মতো সব নরনারী। সে যেন দেব-দেবীদেরই দেশ। গল্প আরম্ভ হয় বিশ্ব কাপ ফুটবলে আর্জেন্টিনা ও ক্যামেরুনের খেলার দিন থেকে। সকাল থেকে খেলা দেখার আয়োজন আরম্ভ হয় সুকোমলের। ঘরটিকে যেন পবিত্র মন্দির করে তোলে সে। বিছানার চাদর বদলায়, টেবিল পরিষ্কার করে, কাচের আলমারি থেকে বই বের করে ঝাড়ন দিয়ে পরিষ্কার করে আবার গুছিয়ে রাখে। যেন ঘরে অতিথি আসবে কেউ। ছেলেমেয়েরা অবাক। বাবা আর্জেন্টিনার অসম্ভব সমর্থক। খেলার দিন সকাল থেকে সুকোমল সেই চিঠিগুলো খুঁজছে। চিঠির কথা তার স্ত্রী অমিতা জানে। কোলবয় সুকোমলকে একটি গরম কোট আর প্যান্ট দিয়েছিল বাটলার সোলেমান। পরিবর্তে তার হিসেবের খাতা লিখে দিত সে। সেকেন্ড হ্যান্ড মার্কেট থেকে একটি ফেল্ট-ক্যাপও কিনে নিয়েছিল সে। বুয়েনসএয়ারসের ঠান্ডায় বেরোতেই পারত না সে মলিন জাহাজি পোশাকে। দরিদ্র বাবা মায়ের সন্তান। জাহাজে বসে, বন্দরের শহরের পার্কে বসে সে দেশের কথা, গ্রামের কথা, ভাই বোনের কথা, তার সাইকেলটির কথা ভাবত।
অচেনা সেই বুয়েনসএয়ারস শহরে সে সোজা রাস্তায় হাঁটত। পার্কের ধারে দাঁড়িয়ে দেবকন্যার মতো তরুণীদের উচ্ছ্বাস আর অচেনা ভাষা শুনত। একদিন পথ হারিয়ে ফেলে সে। তার ইংরিজি তো কেউ বুঝবে না। কী করে জাহাজে ফিরবে সে? ভুলভুলাইয়ার পড়ে সে কেঁদে ফেলেছিল। তাকে ফেলে রেখে জাহাজ যদি ছেড়ে যায় বন্দর? পৃথিবীর এক পিঠে তার দেশ, সে আছে অন্য পিঠে। তখন এক বয়স্ক মহিলা তাকে উদ্ধার করে জাহাজে পৌঁছে দেয়। সে ইংরেজি জানত। এরপর সেই সেই দয়াশীলা রমণী তাঁর মেয়ে এলসাকে পাঠান জাহাজে সেই গান্ধীর দেশের সুন্দর সেলর যুবকটিকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যেতে। তাকে ভালো লেগেছিল তাঁর। সেই মহিলার কন্যা ষোল বছরের এলসার সঙ্গে তার বন্ধুতা, তা থেকে প্রেম হয়। এলসা তাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। তার সঙ্গে সে সেই শহরে ঘুরে বেড়াত। জনপ্রিয় অভিনেত্রী ইভা পেরনের সমাধি, পার্ক, সমুদ্রতট। এলসা বলে যেত তার মায়ের কথা। মায়ের বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি। সে বলত নিজের গ্রাম নদীর কথা।
এলসাদের বাড়িতে ট্যাঙ্গো নাচ হতো। এলসা তার প্রেমে পড়েছিল। তার মা বলেছিল তাকে থেকে যেতে। তার তো ওই একটিই মেয়ে। যা আছে জীবন চলে যাবে। সেলর থাকেনি। কেন থাকেনি, তার মা বাবা ভাই বোন, গ্রাম, নদী ছেড়ে বিদেশে থাকবে কী করে? তার মুখের দিকে চেয়ে আছে কতগুলো মুখ। তার পাঠানো টাকার জন্য অপেক্ষা করে থাকে তারা। সে ফিরে এসেছিল। সঙ্গে এলসার ছবি আর চিঠি। সেই ছবি সে সমুদ্রে বিসর্জন দিয়েছিল। চিঠিগুলো রেখে দিয়েছে এতকাল। খেলার সময় সে আর্জেন্টিনা, এলসার দেশের জন্য উদ্বেগে ভোগে। খেলার দিন চিঠিগুলি ছুঁয়ে থাকে। এ এক অদ্ভুত প্রেমের গল্প। আর পড়তে পড়তে মনে হয় এই গল্প ১৯৯০-এর বিশ্বকাপ। যে বিশ্বকাপে মারাদোনাকে ক্ষতবিক্ষত করে নিজের খেলা খেলতে দেয়নি প্রতিপক্ষ। সে নিজেই যেন সেই ব্যর্থ নায়ক হয়ে যায় মনে মনে। সেই চিঠি কখনো তার স্ত্রী লুকিয়ে ফেলে। চিঠিগুলি তো তারও প্রতিপক্ষ।
স্বামীর সেই প্রথম যৌবনের প্রেমকে সম্মান দিয়েও সে এলসা অথবা আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ। যে কোনো গল্পই লেখার গুণে হয়ে ওঠে শিল্প। অতীন তাঁর লেখার গুণেই আমাকে আবিষ্ট করেন। দরিদ্র নাবিক, আর সেই রূপকথার দেশ, জাহাজিয়াদের খুঁটিনাটি, মায়াতে ভরে যায় মন। তিনি সব সময়ই যেন নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে দেন শূন্যে।