কুরোসাওয়া কথা
তোগাশি ফুপু
ভূমিকা
জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া (২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘ড্রিমস’সহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, ‘কুরোসাওয়া কথা’ শিরোনামে, ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে এখানে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।
আকিতা প্রিফেকচারে আমার দিনগুলোর গল্প শেষ করার আগে, সেখানকার একজন মানুষের কথা আমাকে লিখতেই হবে। তিনি বাবার বড় বোন। তার বিয়ে হয়েছিল আকিতার ওমাগারি শহরের তোগাশি পরিবারে। এই তোগাশি পরিবারটি ছিল সেই বর্ডার ক্যাপ্টেন তোগাশির বংশধর—যিনি বিখ্যাত কাবুকি নাটক কাঞ্জিঞ্চোতে বেনকেই চরিত্রটি পাঠ করতেন—যে নাটক অবলম্বনে ১৯৪৫ সালে ‘দ্য মেন হু ট্রিড অন দ্য টাইগার’স টেইল’ ফিল্মটি বানিয়েছিলাম আমি।
তোগাশি তালুকে খুব বেশি জায়গা-সম্পত্তির দখল ছিল না যদিও, তবে বাড়িটি ছিল ভীষণ বড়, আর এর চারপাশ ছিল পরিখা দিয়ে ঘেরা। রিজপুলটি ছিল সুমো রেসলারদের ছবি খোদাইকৃত কাঠের তৈরি; যেন আধুনিক যুগের প্রথম পর্যায়ের কিংবদন্তি আর্কিটেক্ট-স্কাল্পটর হিদারি জিঙ্গোরোর কোনো কাজের মতোই। নিশ্চয়ই কাঠের তৈরি যেকোনো ভালো ভাস্কর্য দেখলেই হিদারি জিঙ্গোরোর কথা মনে পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক; তবে এই রেসলারদের চিত্রকর্ম তিনিই তৈরি করেছিলেন কি না—তা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারব না। তোগাশি পরিবারে থাকা একটি ছোট্ট তলোয়ারকে, ত্রয়োদশ শতকের মাস্টার সোর্ডমেকার ওকাজাকি মাসামুনের কাজ বলে মনে করা হলেও, সেটি আমি অবশ্য নিজ চোখে দেখিনি। তবে এ বাড়ির দিকে একনজর তাকালেই, আপনি পরিবারটির সামাজিক মর্যাদার অবস্থান খুব সহজে অনুমান করতে পারবেন। আমি অবশ্য আমার ফুপুর আচার-আচরণের ভেতর দিয়েই, এ পরিবারের সামাজিক মর্যাদার একটি ছবি নিজের মতো করে পেয়ে গিয়েছিলাম।
আমার তোগাশি ফুফুর উপস্থিতির মধ্যেই ছিল একটি সত্যিকারের আতঙ্ক-জাগানিয়া আবহ, এক প্রবল দাপুটে হুকুমদারি ব্যাপার—যা তার পাশের সবাইকে চুপসে দিত। তবে আমাকে অবশ্য তিনি স্নেহ করতেন। ফলে তাকেও বিশেষ পছন্দ করতাম আমি। তিনি যখন টোকিওতে আসতেন আমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে, বাবা চরম বিনম্র হয়ে যেতেন তার সামনে। আমরা প্রায়ই সান্ধ্যভোজে বান-মাছ খেতাম তখন। এ খাবারটি তখনকার দিকে খুবই দামি ছিল; ফলে খুব কম সময়ই খাওয়ার সুযোগ পেয়েছি আমরা। কিন্তু ফুফু সব সময় অর্ধেকটার মতো অংশ না ছুঁয়েই রেখে দিতেন। তারপর ডাক দিতেন, ‘আকিরা...’, আর আমাকে খেতে দিতেন সেটুকু।
তিনি যখনই ঘুরবে বের হতেন, আমিও সঙ্গী হতাম তার। তত দিনে তার বয়স হয়ে গিয়েছিল অনেক। তার সাদা চুলগুলো মুখের চারদিকে ছোট করে কাটা থাকত। দেখতে তাকে লাগত সামন্তযুগের বিবাহিতা নারীর তুলনায় বরং যেন অন্য রকমই। তাকে দেখাত নোহ নাটকের জাদুকরি কোনো পুঁচকে বুড়োর মতো যেন। বাইরে বের হওয়ার সময় তিনি পরতেন কিমোনো ওভারকোট। হাঁটার সময় হাত দুটো পুরে রাখতেন আস্তিনের ভেতর। আমি বলছি না, তিনি আলসেমি করে কিংবা স্নিকি ফ্যাশনের মতো নিজের হাত দুটো আস্তিনের ভেতর স্রেফ পুরে রাখতেন; বরং বলছি, তিনি হাত দিয়ে আস্তিনের একদম ভেতরে মুঠো করে রাখতেন। আর আস্তিনগুলো একদম ফুলিয়ে রেখে দিতেন হাঁটা। তাই তাকে দেখে মনে হতো লড়াইয়ে প্রস্তুত কোনো মুরগি কিংবা সারস পাখির মতো। পথচারীরা সব সময় অবাক চোখে তাকিয়ে দেখত তাকে। তার পাশে হাঁটতে আমার খানিকটা অস্বস্তি লাগলেও, এ ছিল একেবারেই বিশেষ এক অনুভূতি।
হাঁটার সময় ফুপু কখনোই কথা বলতেন না। কিন্তু যখনই সে বাড়ি পৌঁছে যেতাম আমরা—যেখানে যাওয়ার জন্য তিনি বেরিয়েছিলেন, তখনই আমার দিকে ঘুরে, আমার হাতে কাগজে মোড়ানো পঞ্চাশ-সেনের [জাপানি মুদ্রা] একটা কয়েন দিয়ে বলতেন, ‘সারাবা’; অর্থাৎ, উত্তরাঞ্চলীয় ভাষায়—‘বিদায়’। তখনকার দিনে কোনো শিশুর জন্য পঞ্চাশ সেন মানে অনেক টাকা। কিন্তু টাকার জন্য তো আমি ফুপুর পাশে পাশে আসিনি। বরং ‘সারাবা’ শব্দটির এমনই ক্ষমতা ছিল, আমার সারা শরীর কেঁপে ওঠত। ফুপুর এ আচরণের মধ্যে, অন্তর্নিহিত উষ্ণতা ও মমত্বের এক তুখোড় ভাণ্ডার নিহিত ছিল।
তোগাশি ফুপুর শরীর-স্বাস্থ্যের যা অবস্থা ছিল, সেই বিচারে কম করে হলেও ১১০ বছর আয়ু পাওয়া উচিত ছিল তার। কিন্তু এক ফালতু ডাক্তার তাকে তার আয়ুবর্ধনের জন্য পাইন কাঠ ও গাছগাছালির শিকড়ের মতো আজব ধরনের খাবার খাওয়ার বুদ্ধি দিয়েছিলেন। আর এ কারণেই, নব্বই বছরে পৌঁছানোর আগেই মারা গিয়েছিলেন তিনি।
তিনি যখন মুমূর্ষু, বাবা তাকে দেখতে যাওয়ার সময় করার আগেই যদি তিনি মারা যান, এ কারণে আমি আগেভাগে পৌঁছে গিয়েছিলাম। ফুপুর বালিশের কাছে গিয়ে বসলাম। তখন শান্তভাবে শুয়ে ছিলেন তিনি। আমাকে দেখে বললেন, ‘আকিরা? ব্যথা! তোমার বাবা?’ তাকে জানালাম, বাবার আসতে একটু দেরি হবে, এ কারণে আমাকে আগেভাগে পাঠিয়েছেন, তবে বাবা রওনা দিয়ে দিয়েছেন। রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম আমি। তিনি আমাকে পিছু ডাকলেন; আবারও বললেন, ‘আকিরা, সে কি আসেনি এখনো?’ অবশেষে বাবা যখন টোকিও থেকে এখানে এসে পৌঁছলেন, আমি ততক্ষণে ফেরার পথ ধরেছি। এর অল্প কিছুদিন পরই মারা গেলেন ফুপু।
এমন আজব খাবার খাওয়ার বুদ্ধি ফুপুকে দিয়েছিলেন বলে সেই ডাক্তারটিকে আমি কোনোদিনই ক্ষমা করতে পারব না। হাতের কাছে পেলে তার মুখে পাইন গাছের গুঁড়ি সেঁটে দিতাম আমি!
(চলবে)