জন্মদিন
‘জিন্দাবাহার’ : আত্মজৈবনিক কণ্ঠস্বর

বাংলা উপন্যাসের কিংবদন্তিতুল্য লেখক ইমদাদুল হক মিলন (জন্ম ৮ সেপ্টেম্বর , ১৯৫৫) দীর্ঘদিন সৃজনশীলতার কঠিন পথ পরিভ্রমণ করছেন। তাঁর রয়েছে একাধিক শিল্পোত্তীর্ণ গল্প-উপন্যাস-নাটক। জনপ্রিয় এই কথাসাহিত্যিক-নাট্যকার অনেকদিন ধরে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’য় সবচেয়ে বেশি বিক্রীত গ্রন্থের তালিকায় রয়েছেন। তবে সারা বছরই তাঁর গ্রন্থের চাহিদা রয়েছে পাঠকদের কাছে। শিল্পমানসম্পন্ন বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন ইমদাদুল হক মিলন। জনপ্রিয় এই কথাশিল্পীর শিল্পমানসম্পন্ন, ব্যতিক্রমী ও জীবনঘনিষ্ঠ উপন্যাসের আরো একটি সংযোজন হলো ‘জিন্দাবাহার’ (২০১৬)। পুরান ঢাকার ষাটের দশকের জীবনকে ইমদাদুল হক মিলন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘... আমি খুব গ্রাম দিয়ে আচ্ছন্ন একজন মানুষ। ১৯৬১ সাল থেকে ঢাকায় থেকে বছরে বহুবার আমি গ্রামে গিয়েছি। ঘুরে বেড়িয়েছি। গ্রামের জীবন, প্রকৃতি, মানুষ আমার খুব প্রিয়। প্রিয় বিষয়টি ঘুরেফিরে আমার কাছে আসে। হয়তো ঢাকার জীবনও একটা পর্যায়ে আমার প্রিয় হয়েছে বা ঢাকার জীবনে আমি হয়তো সেভাবে চোখ রাখবার চেষ্টা করিনি বা পুরান ঢাকা আমার ছেলেবেলার ঢাকা, ডেভেলপ হওয়া ঢাকায় আমি হয়তো ভালোভাবে ঢুকিনি। তেমন করে দেখিনি। এখন দেখেছি। তাই আগামী কয়েক বছর আমি এই জীবন নিয়ে, ঢাকা শহর নিয়ে বড় লেখা লেখার চেষ্টা করব।’ (ইমদাদুল হক মিলন হীরকজয়ন্তী সংবর্ধনা গ্রন্থ) এই প্রচেষ্টার প্রথম ফল হলো ‘জিন্দাবাহার’ উপন্যাস। উপন্যাসটি লেখক লঞ্চে করে একটি পরিবারের ঢাকায় আসা ও তাদের কথোপকথন দিয়ে শুরু করেছেন। মা ও তাঁর সন্তানদের ঢাকায় আসা ও ষাটের দশকের পদ্মার বর্ণনাও তিনি দিয়েছেন। হঠাৎ করেই চারদিকের পরিবেশটা খারাপ হয়ে গেল। একদিকে ঢেউ, অন্যদিকে হাওয়া। মা ও আম্মা দুজনই দোয়া পড়ছেন। সন্তানদের মধ্যে আজাদ ছাড়া কেউ সাঁতার জানে না। তাই তাঁরা চিন্তা করছেন। কিন্তু অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবা লঞ্চঘাটে উপস্থিত। তখনো সদরঘাট টার্মিনাল হয়নি। ঘাট থেকে বের হয়ে একটা ঘোড়ার গাড়ি। লেখক সেই সময়ের সামগ্রিক চিত্র তাঁর লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সদরঘাটে নানা ধরনের দোকান-কাপড়, মুদি, খেলনা ইত্যাদি। হারিকেনের ও হ্যাজাকবাতির সময় তখন। বাতি জ্বলছে। গ্রাম থেকে আসার পথে তেমন খাওয়া হয়নি। চারদিকে অনেক খাবারের দোকান। ঘোড়ার গাড়ি চলছে, সঙ্গে আব্বাও আছেন। আহসান মঞ্জিল ও বুলবুল ললিতকলা একাডেমির পাশ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। এই দুই বাড়ির মাঝ দিয়ে রাস্তা। দূরে আলো দেখা গেলেও পুরো রাস্তায় তেমন আলো সেই সময় ছিল না। এভাবেই উপন্যাসের শুরু হয়েছে। খুব সহজ ও সাবলীল ভাষায় কাহিনী এগিয়ে চলেছে।
‘জিন্দাবাহার’ উপন্যাসের ভাষা স্বতন্ত্র। কারণ, তার আখ্যান নতুন। এর আগে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার ও বিষয় বিন্যাসে তিনি সমাজের নানা স্তরের মানুষের জীবনকে রূপায়ণ করেছেন। লেখকের অভিনবত্ব আবিষ্কারের জন্য আমাদের অবশ্যই তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা ‘কেমন আছ, সবুজপাতা’ (২০১২) পাঠ করে তাঁর কথাসাহিত্যে প্রবেশ করতে হবে। কারণ, এ রচনায় তিনি নিজের বেড়ে ওঠার কথা বলেছেন। তাঁর গ্রাম, প্রকৃতি, আড়িয়াল বিলের জীবন, মানুষ, ভাষা, হাটবাজার সবই উন্মোচিত হয়েছে। একই সঙ্গে আদি ঢাকার সঙ্গে বিক্রমপুরের যোগাযোগ, লেখকের নিজের এলাকার হিন্দু জনগোষ্ঠীর জীবন, দেশভাগ, দাঙ্গা প্রভৃতি রূপ লাভ করেছে। এই স্মৃতি অভিজ্ঞতার পথ ধরেই তাঁর বাল্য-কৈশোর-যৌবন উত্তীর্ণ হয়েছে। তিনি নিজের সৃজনশীলতার পথে অগ্রসর হয়েছেন। হয়তো এ কারণে প্রথম উপন্যাস ‘যাবজ্জীবন’ (১৯৭৬ সালে পত্রিকায় প্রকাশিত) থেকে বিক্রমপুরের গ্রাম-জীবনের কাহিনী রূপ লাভ করেছে। গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে সংলাপ ও বর্ণনায় আঞ্চলিক শব্দ অবলীলায় উপস্থাপিত হয়েছে সেখানে। গ্রামীণ নিম্নবর্গের কথায় তিনি তাঁর মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন। দেশভাগ ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তাহীনতার প্রকৃত চিত্র রয়েছে তাঁর একাধিক উপন্যাসে। মানবচরিত্রের অতলে ডুব দিয়েছেন তিনি। একদিকে গ্রামীণজীবন, মানুষ, প্রকৃতি অন্যদিকে আধুনিক নগরজীবন, প্রেম, যৌনতা তাঁর কথাসাহিত্যের মূল উপজীব্য। আবার মুক্তিযুদ্ধ তাঁর কথাসাহিত্যের অন্যতম অনুষঙ্গ। সেখানে তাঁর দৃষ্টি ও ভাবনার জগত প্রসারিত; মুক্তিযুদ্ধোত্তর হতাশামগ্ন সমাজের চিত্র একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ইতিহাস অন্বেষায় তিনি নির্মোহ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত গল্পগুলো তার সাক্ষ্য বহন করে। মূলত তিনি নিজ জীবনের অভিজ্ঞতাকে সাহিত্যে উপস্থাপন করেছেন। গ্রামীণ জীবনে নারীর অবস্থান চিত্রিত করেছেন দরদের সঙ্গে। প্রকৃতিময়তা ও দ্রোহ নারীর অবস্থান রূপায়ণে তাঁর অনন্যতার স্বাক্ষর রয়েছে ‘নূরজাহান’ উপন্যাসে ; দ্রোহ চেতনার প্রতীকে পরিণত হয়েছে নূরজাহান। অন্যদিকে নারী ‘হাসু’র পুরুষ লিঙ্গান্তর আর ‘কালোঘোড়া’ উপন্যাসের বারিক-নয়নার সমকামিতা বাংলাদেশের উপন্যাসে নতুন চরিত্রের আস্বাদন এনে দিয়েছে। আরো আছে বিচিত্র পেশার মানুষের দারিদ্র্য ও বেঁচে থাকার লড়াইয়ের অভিব্যক্তি।
২.
জিন্দাবাহার থার্ড লেনের সাত নম্বর বাড়ি। নিম্নবিত্তের বহু মানুষের বাস এই বাড়িতে। মিলু নামের সাত বছর বয়সী এক শিশু তার চোখ দিয়ে দেখছে বাড়ির বিচিত্র মানুষগুলোকে। তাদের পেশা, প্রতিদিনের জীবন, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার প্রতিচ্ছবি দেখছে তার সরল চোখে। কখনো আনন্দ এসে ভাসিয়ে নিচ্ছে তাকে, কখনো বেদনার ভারনত করছে। কখনো কৌতূহলে দিকশূন্য হয়ে যাচ্ছে সে। কখনো সে আকাঙ্ক্ষা হয়ে যাচ্ছে কাঙাল। মিলু ও অন্যান্য চরিত্রের মনস্তত্ত্ব ও অনুপুঙ্খ উন্মোচন ইমদাদুল হক মিলনের গল্প বুননের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। যেমন, ‘বাঁকা জল’, ‘ভূমিকা’, ‘নদী উপাখ্যান’, ‘কালোঘোড়া’, ‘ভূমিপুত্র’, ‘রূপনগর’, ‘কালাকাল’, ‘টোপ’, ‘এক দেশে’, ‘বনমানুষ’, ‘যাবজ্জীবন’, ‘পরাধীনতা’ ইমদাদুল হক মিলনের এই উপন্যাসগুলোর বিষয় বিচিত্র : মুক্তিযুদ্ধ, প্রবাসী শ্রমিক, কখনো গ্রামের ভেসে বেড়ানো অসহায় বালক অথবা পুরো একটা গ্রামই উপন্যাসের নায়ক। পাত্রপাত্রীর পেশা ও চরিত্র রূপায়ণেও বৈচিত্র্য রয়েছে। দিনমজুর বেলদার অথবা গ্রাম্য বাজারের ভাসমান নিম্নবর্গ, সার্কাসের জোকার, নদীভাঙা মানুষ, পতিতাবৃত্তির হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা কিশোরী পারুল, যে শেষ পর্যন্ত জীবনের বিনিময়ে নিজেকে রক্ষা করে (‘টোপ’)- এ রকম আরো অনেক চরিত্রের জীবন্ত উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। মূলত ইমদাদুল হক মিলনের লেখক জীবনের বাছাই করা এ উপন্যাসগুলো নানা স্তরের গ্রামীণ মানুষের জীবনযাপনের চিত্র হিসেবে বিশিষ্ট। জীবনের অনুভূতি ও উপলব্ধির ভাষা পাঠকের নিজস্ব সম্পদ করে তুলেছেন তিনি।
কেন একজন লেখক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে আমরা পেয়ে যাই ঔপন্যাসিকের পাঠকের প্রতি সহৃদয়সংবেদ্য সঞ্চারি ভূমিকা। এটি তিনি সহজ-সরল কথন বিশ্বে প্রসারিত করেন অজস্রতায়। মামুলি কথার আখ্যান থেকে তিনি নিজেকে প্রসারিত করেছেন সমাজ-রাজনীতির সংকটের গভীরে। ‘নূরজাহান’-এর মতো বৃহৎ উপন্যাস লিখে লেখনীক্ষমতা ও মেধার পরিচয় ব্যক্ত করেছেন।
জনপ্রিয়তার মোহ ইমদাদুল হক মিলনকে চটুল কাহিনী বর্ণনায় প্রাণিত করেনি বরং নিম্নবর্গের জীবন রূপায়ণে তিনি নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। ‘ভূমিপুত্র’-তে আমরা দেখতে পাই, যে বেলদারদের আশ্রয়ে একসময় বেপারীরা দিনাতিপাত করত, কালের বিবর্তনে তারাই উচ্চবর্গে আসীন হয়ে নিঃস্ব অসহায় বেলদারদের কৃপা করছে। ধান কাটার মৌসুমে ধানের ভাগাভাগি নিয়ে কুদ্দুস বেপারীর লেলিয়ে দেওয়া গুণ্ডাদের আঘাতে দিনমজুর কাদেরের মৃত্যু হলে সেই নিঃসহায়তা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গ্রামীণ নিম্নবর্গের জীবন চিত্রণে ঔপন্যাসিক ইমদাদুল হক মিলন বিষয়ের সঙ্গে ভাষার ব্যঞ্জনা অভিদ্যোতিত করেছেন। আগেই বলা হয়েছে, বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষার দক্ষ ব্যবহার তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একাধিক উপন্যাস রচনা করে তিনি চটুল আখ্যানের স্রষ্টা অপবাদ থেকে মুক্ত হয়েছেন অনেক আগে থেকেই। ‘রাজাকারতন্ত্র’, ‘কালোঘোড়া’, ‘ঘেরাও’, ‘বালকের অভিমান’, ‘মহাযুদ্ধ’, ‘দ্বিতীয় পর্বের শুরু’, ‘একজনা’, ‘সুতোয় বাঁধা প্রজাপতি’ তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। এসব উপন্যাসে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি, তাই অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্বের সূচনা করতে চেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। অর্থাৎ আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ ভিন্ন অনুসন্ধানী আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে। যেমন, ‘কালোঘোড়া’ উপন্যাসে তিনি প্রথাগতভাবে কাহিনী বর্ণনা করেননি। এমনকি কোনো নায়ক-নায়িকা সৃষ্টিতে মনোযোগী হননি। তিনি ছোট পরিসরে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাকে মুক্তিযোদ্ধা কাদের, মুন্না, আলম, খোকা ও তাদের সহযোগী হিসেবে রাজাকার সিরাজ চেয়ারম্যানের ছোটবিবি টুনটুনির মাধ্যমে দেশপ্রেমের মহিমা পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। আবার স্বাধীনতাত্তোর প্রকৃত যোদ্ধাদের হতাশাকে চিত্রিত করেছেন। কারণ, স্বাধীনতা এক মুক্ত দুর্বিনীত কালো ঘোড়া, যে থাকে কেবলই ধরাছোঁয়ার বাইরে।
প্রবাসী মানুষের দুঃখ ও দুর্দশা ‘পরাধীনতা’র কাহিনীতে উন্মোচিত হয়েছে। উত্তমপুরুষের জবানিতে জার্মান প্রবাসী নায়কের চাকরি ও বাসস্থানের অভাব এবং দেশে ফেলে আসা পরিজনদের জন্য কাতরতা গভীর মমত্বে চিত্রিত হয়েছে। ‘জীবনপুর’ এক ব্যর্থ যুবকের কাহিনী। তাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ঘৃণা করা সত্ত্বেও ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য, বেঁচে থাকার জন্য সেখানে আশ্রয় নিতে হয়। ট্র্যাজেডির অনেক কিছুই বিন্যাস করেন তিনি। পরাজয়, গ্লানি, হতাশা তুলে ধরেন। তিন খণ্ডে রচিত ইমদাদুল হক মিলনের ‘নূরজাহান’ শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠিতে পাঠক ও বিদগ্ধ সমালোচকের হৃদয় জয় করেছে। ‘নূরজাহান’-এর প্রথম পর্ব ২৮৬ পৃষ্ঠা. দ্বিতীয় পর্ব ৪৪৭ এবং শেষ পর্ব ৫৪২। মোট ১২৭৫ পৃষ্ঠায় তিনি মৌলবাদ, ফতোয়াবাজ এবং কাঠমোল্লাদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতি, মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও গ্রামীণ মানুষের জীবন ছবির মতো ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে।
ইমদাদুল হক মিলনের কয়েকটি উপন্যাসের কাহিনী এক প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু হয়েছে। তবে পরিণতিতে অন্য প্রসঙ্গ এসে জুড়ে বসেছে। তবে তাঁর গল্প বলার অভিনবত্ব সর্বত্র দৃষ্টিগোচর হয়। সাদামাটা গল্পকথনের ক্লিষ্টতা থেকে পাঠককে নতুন জগতে প্রবেশ করিয়েছেন তিনি। বিশেষত একই কাহিনীতে সর্বজ্ঞ লেখকের বর্ণনা থেকে বের হয়ে উত্তমপুরুষের ‘আমি’তে গল্প বলেছেন অনেক ক্ষেত্রে। ভাষার সাবলীলতা, মানবজীবনের বিচিত্র সংকটের দরদি উপস্থাপন ও নানা চরিত্রের রূপায়ণে তিনি জনপ্রিয়। ইমদাদুল হক মিলনের মতে, লেখকের দায়িত্ববোধ বিশ্বের সব মানুষের জন্য। তাঁকে ভাবতে হয় সমাজ, দেশ, জাতি নিয়ে। সর্বোপরি সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে তাঁকে লিখতে হয় মানুষ নিয়ে। আর এই লেখার বিষয়বস্তু কোনো একটি দেশের সীমানায় আবদ্ধ থাকে না, হয় সর্বজনীন এবং বিশ্বের সব মানুষ নিয়ে। গ্রামীণ পটভূমিতে কথাসাহিত্যের বিষয় নির্মাণে তাঁর ভাষার ওপর অধিকারের স্বাক্ষর সুস্পষ্ট। তাঁর অনেক বর্ণনাই বাংলা গদ্যে নতুন সংযোজনা; প্রকাশভঙ্গিতে ভিন্ন স্বর সংযুক্ত। বিষয় ও প্রতীতি অনুযায়ী ভাষার স্থানিক উদ্ভাস নিজস্ব মেজাজে ব্যক্ত করেন তিনি। এটি ব্যাপ্তিতে ও গভীরতায় অন্যান্য কথাসাহিত্যিকদের তুলনায় ভিন্ন। তবে ইমদাদুল হক মিলনের কাহিনীর জন্য অনিবার্য।
৩.
ইমদাদুল হক মিলন ‘জনপ্রিয় বা অজনপ্রিয়’ ধারায় বিশ্বাসী নন। তিনি তাঁর মত করে লেখেন। তাঁর ক্ষমতা অনুযায়ী লেখেন। তাঁর মেধা অনুযায়ী লেখেন, তাঁর ভঙ্গি অনুযায়ী লেখেন। সেই ভঙ্গি পাঠক বেশি গ্রহণ করতে পারেন, আবার পাঠক কম গ্রহণ করতে পারেন। ‘জিন্দাবাহার’ উপন্যাসে তিনি নিজের মতো করে স্মৃতির দুয়ার খুলে দিয়েছেন। তিনি তাঁর আনন্দের অনুভূতি দিয়ে লিখেছেন, তাঁর জীবনদর্শন এখানে আত্মপ্রকাশ করেছেন। সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও মমত্ববোধ যেমন তাঁর গ্রামীণ জীবনভিত্তিক উপন্যাসের মূল সুর। তেমনি ঢাকার জীবন নিয়ে লেখা এই আখ্যানের মৌল অনুষঙ্গ। এ ছাড়া দেশের প্রতি লেখকের দায়বদ্ধতা রয়েছে। তিনি ঢাকা শহরে জীবন কাটাচ্ছেন ১৯৬১ সাল থেকে। অর্থাৎ পঞ্চান্ন বছর ধরে তিনি ঢাকায় আছেন। কিন্তু ঢাকার জীবন তাঁর লেখায় এর আগে সেভাবে এতটা আসেনি। পুরান ঢাকার যে জীবনটা তিনি দেখেছেন তার বিস্তারিত বিবরণ এখানে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় উঠে এসেছে। বিক্রমপুরের যে জীবন তিনি দেখেছেন সে জীবনই তিনি ‘নূরজাহান’-এ লিখেছেন, ‘কেমন আছ, সবুজ পাতায়’ তুলে ধরেছেন। ‘কালোঘোড়া’য় তার বর্ণনা আছে। ‘বাঁকাজল’, ‘নিরন্নের কাল’, ‘রূপনগর’- এসব লেখায় বিক্রমপুর জীবনের কথা তিনি অনেকখানি লিখেছেন। ওই সব আখ্যানের মধ্যে তাঁর জীবনের কথাই প্রকাশ পেয়েছে। ঢাকায় যে এতখানি জীবন কাটিয়েছেন সেটা এতদিন পর তুলে ধরলেন। জিন্দাবাহার লেন জীবন্ত হয়ে উঠল, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে পারিবারিক বন্ধন আর নিজেদের টিকে থাকার লড়াই আত্মপ্রকাশ করল।
‘জিন্দাবাহার’ উপন্যাসটি ইমদাদুল হক মিলনের ‘কেমন আছো, সবুজপাতা’র দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম পর্বে ছিল তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা গ্রাম, প্রকৃতি ও মানুষের কথা। সেখানে প্রকৃতির অন্তর্লীন সৌহার্দ্যে ঔপন্যাসিক নির্মাণ করেছিলেন স্বপ্নের ভুবন। আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কেমন আছ, সবুজ পাতা’ সম্পর্কে ইমদাদুল হক মিলন বলেছেন, ‘এই লেখাটা আমার খুব মায়া লাগানোর মতো লেখা, আমি নিজেকে দেখতে পাই এই লেখায়। আমার ছোট ভাই খোকনও এই বইটা পড়েছিল। তখন সে আমেরিকা থাকে। বইটা পড়ে ও সারা রাত কেঁদেছিল। আমার এ জীবনটা তার জানা ছিল না। আমার দশ বছর বয়সের ঘটনা। আমার ভাইবোনরা প্রত্যেকে এটা পড়ে কেঁদেছিল। আমার এক জুনিয়র বন্ধু আছে কাজী ইনজামাম, জাপানে থাকে ত্রিশ বছর ধরে। সে এই বইটা ব্যাগে নিয়ে ঘোরে। সে একটা লেখা লিখেছিল যে আমাদের প্রত্যেকেরই একটা গ্রাম আছে, গ্রামটিকে আমি মনে করার জন্য ‘কেমন আছ, সবুজ পাতা’ উপন্যাসটি লিখেছি। আবু হাসান শাহরিয়ার এটা নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলেন। যাই হোক আমি বইটির কথা এ কারণে বলছি যে আমার সমগ্র ছেলেবেলাটি খুব ডিটেইলে ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। বইটা পড়লেই, বইটার দিকে তাকালেই সময় কেটে যায়, একটা মায়া লাগা বই। আমার খুব মায়ার জায়গা।’ এই কথাগুলো ‘জিন্দাবাহার’ উপন্যাসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এ আখ্যানে তিনি আত্মজৈবনিক ঢঙে তুলে ধরেছেন পুরান ঢাকার স্থানিক ভূগোল এবং বিচিত্র মানুষের স্বপ্নভঙ্গের বাস্তবতা। আসলে নিম্নবিত্ত মানুষের আখ্যান ‘জিন্দাবাহার’। আগেই লিখেছি, জিন্দাবাহার থার্ড লেনের সাত নম্বর বাড়িকে কেন্দ্র করে মিলু নামের সাত বছর বয়সী শিশু তার চোখ দিয়ে দেখছে বাড়ির বিচিত্র মানুষকে। তাদের পেশা, প্রতিদিনকার জীবন, সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনার ভেতর দিয়ে কেটে যাচ্ছে দিন। বাড়ির বাইরে গলির পর গলি। সেখানেও কত মানুষ। জিন্দাবাহার নামের মতোই যেন বছরব্যাপী এক অদ্ভুত বসন্তকাল বিরাজ করে মিলুর বসতির এলাকায়। ষাটের দশকের শুরুর দিককার পুরান ঢাকার জীবন নিয়ে এক মায়াবী উপন্যাস ‘জিন্দাবাহার’।
জিন্দাবাহারের থার্ড লেন থেকে ঔপন্যাসিক যখন মিলুকে গ্লোরিয়ায় নিয়ে গেছেন তখন কাহিনীতে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। বিনাখালার স্নেহজাত সম্পর্ক এবং সেখানকার প্রকৃতির অবারিত সৌন্দর্য শিশু মনস্তত্ত্ব উন্মোচনে অনিবার্য প্রভাব ফেলেছে। রেলগাড়ির চলে যাওয়া আর পাখির সঙ্গে মিতালি পাতানো মিলুর শিশু মন একদিকে শহর আর অন্যদিকে গ্রামীণ বাস্তবতায় মথিত হয়েছে। ঔপন্যাসিক নিজের কাহিনী বলছেন। তবে খুব সতর্কতার সঙ্গে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কগুলোকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে তুলে ধরছেন। সেখানে মিলুদের যৌথ পরিবারের দারিদ্র্যময় জীবন উঠে এসেছে। পিতার একমাত্র ছোট চাকরির বেতনে পুরো সংসারের জীবন-যাপন এবং প্রাত্যহিক নানা উপদ্রব ষাটের দশকের নাগরিক নিম্নবিত্তের যথাযথ চিত্র। রয়েছে ঢাকা শহরের মানুষের ক্ষুদ্র সরকারি চাকরির বাস্তবতা। তবে ষাটের দশকের উত্তাল বাংলাদেশের রাজনীতি এ উপন্যাসকে স্পর্শ করেনি। যদিও মিলুর মজিদমামার সূত্রে রাজনীতির কিছু আঁচ পেয়েছি আমরা। উপন্যাসে প্রতীকী ঘটনার উপস্থাপনা রয়েছে একাধিক। যেমন মিলুর লাগানো ডালিমচারা। এই চারাটি গ্লোরিয়ায় থেকে ফিরে সে আর দেখতে পায়নি। হয়তো গ্লোরিয়ার উজ্জ্বল আলো আর ডালিমচারার তিরোধান দুটোই তার জীবন থেকে অন্তর্হিত হয়।
৪.
‘জিন্দাবাহার’ উপন্যাসের চরিত্র রূপায়ণের ক্ষেত্রে ইমদাদুল হক মিলন সহানুভূতিশীল, হৃদয়বান, ভাষা সচেতন ও অনুভূতিশীল আখ্যান নির্মাতা। রচনার বর্ণনাভঙ্গিতে নিরীক্ষাপ্রবণতা লক্ষণীয়। উত্তম পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে কাহিনী বর্ণনা করতে করতে একসময় সর্বজ্ঞ লেখকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। চরিত্রের মধ্য দিয়ে উত্তমপুরুষ বর্ণনা পদ্ধতি সেই যে প্রথম উপন্যাসে ১৯৭৬ সালে সংযুক্ত হয়েছে, তারই সার্থক প্রয়োগ ও অভিনবত্ব ‘জিন্দাবাহারে’ লক্ষণীয়। মিলুর বাবার জৌলুসপূর্ণ জীবন ধীরে ধীরে সাধারণ হতে হতে নিম্ন পর্যায়ে চলে যায়। তার চাকরি না থাকায় একসময় না খেয়ে থাকার যন্ত্রণা, তখনকার মনস্তত্ত্ব, একটু খাবারের জন্য বড়লোকের বাড়িতে যাওয়া, একটু পয়সার জন্য প্রেসের সিসার টুকরা সংগ্রহ, চরম অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে বাবার ভেঙে পড়া জীবন, মায়ের পরাজিত মুখ। একসময় হেরে গিয়ে, বেঁচে থাকার সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য আবার তাদের গ্রাম-দেশে চলে যাওয়ার ভেতর দিয়ে শেষ হয়ে যায় এই করুণ আখ্যান। মাঝখানে সময়ের ব্যাপ্তি মাত্র এক-দেড় বছর। সময়টাই যেন ঘোরের। জিন্দাবাহার এলাকাটাই যেন ঘোরের। এই ঘোরের মধ্যে সত্যিকার ঘোর নিয়ে আসে মিলু নামের শিশুটি, যে আচ্ছন্ন করে রাখে ‘জিন্দাবাহার’ উপন্যাসের প্রতিটি পৃষ্ঠা। ঢাকা শহরের এই ঘোর একসময় তাকে বেদনার দিকে নিয়ে যায়। উপন্যাসটি শেষ হয়ে যায়।
উপন্যাসের শেষের পরিচ্ছেদগুলো মিলুর পিতার চাকরিহীন দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রামের ঘটনা দিয়ে পূর্ণ। কিন্তু আশাবাদী ইমদাদুল হক মিলন জীবনকে নিয়ে গেছেন শুশ্রুষার দিকে। এ জন্য উপন্যাসের শেষে হতাশা, যন্ত্রণা এবং না খেয়ে থাকার বাস্তবতার মধ্যে গ্রামে ফেরা মিলুদের পরিবারের ঢাকা শহরের জীবনের দুঃসহ স্মৃতি সঞ্চিত থাকলেও জন্মঠিকানায় ফিরে যাওয়া একধরনের আনন্দময় যাত্রা-কাহিনীতে রূপ লাভ করেছে। মূলত শহুরে রঙিন জীবনের অনটনের সমাপ্তি অঙ্কন করে লেখক মানুষকে ইতিবাচক অনুধ্যানে জাগ্রত করেছেন। উপন্যাসটি এদিক থেকে মানুষ ও মানবতার জয়গান গেয়েছে।
৫.
‘জিন্দাবাহারে’ বর্ণনার সঙ্গে ঔপন্যাসিক ঢাকাইয়া ভাষার সংলাপ ও শব্দ ব্যবহার করেছেন। তবে তিনি আঞ্চলিক ভাষা ও শব্দ প্রয়োগ করে প্রথম উপন্যাস ‘যাবজ্জীবন’ লেখেন ১৯৭৬ সালে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত ‘জিন্দাবাহার’ ঢাকা শহরের কাহিনী। এই উপন্যাসটা লিখতে গিয়ে তিনি দেখেছেন পুরান ঢাকাকে, অতীতের প্রেক্ষাপটে। ব্যবহার করেছেন স্মৃতির পাতায় জাগ্রত থার্ড লেন ও আশপাশের শব্দরাশি। সেই ষাটের দশকের ঢাকার অলি-গলি, বাজারে বিভিন্ন স্তরের মানুষ আনাগোনা করে এবং তারা তাদের ভাষায় কথা বলে। আমরা দেখেছি যে বাংলা সাহিত্যে ঢাকা শহরনির্ভর উপন্যাসে, যেমন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির প্রমুখের লেখাতে দেখা গেছে চরিত্রগুলো ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলে। আর লেখক বর্ণনা করে যাচ্ছেন পরিশীলিত বাক্যে। ইমদাদুল হক মিলন যখন ‘জিন্দাবাহার’ উপন্যাসটা লিখেছেন তখন তাঁর মনে পূর্ববর্তী লেখক ও সমকালীন রচনার অভিজ্ঞতা কার্যকর থেকেছে। এ জন্য কিছু প্রচলিত শব্দ আছে যেগুলো অনায়াসে পরিশীলিত বা শুদ্ধ বাক্যের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন তিনি। গ্রামীণ জীবনভিত্তিক উপন্যাসের মতোই তাঁর এই এক্সপেরিমেন্ট সার্থক হয়েছে। অন্যদিকে তিনি আগে থেকেই বিক্রমপুরের শব্দ ঢাকার শব্দে শুধু বাক্যের মধ্যে, বর্ণনার মধ্যে প্রবেশ করিয়েছিলেন। অথচ ‘নূরজাহান’-এর পুরোটাতেই তিনি বিক্রমপুরের ভাষাকে নানা রকমভাবে ব্যবহার করেছেন। ‘কালাকাল’ উপন্যাসটি পুরোটাই আঞ্চলিক ভাষায় লিখেছেন। পক্ষান্তরে পুরো উপন্যাস ঢাকাইয়া ভাষায় না লিখেও তাঁর উপস্থাপনার ভিন্নতায় ‘জিন্দাবাহার’ শিল্প সৌকর্যে অনন্য। আসলে তিনি কী রকম করে মানুষকে নিয়ে লিখেছেন সেটা হলো লেখকের কৌশল। জীবনের কাছাকাছি না গিয়ে জীবনঘনিষ্ঠ না হয়ে মানুষ লিখতে পারে না। তিনি তাঁর জীবনের কথাটা লিখেছেন- ‘কেমন আছ, সবুজ পাতা’য়। আর তারই আরেক অধ্যায় আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘জিন্দাবাহার।’
(জিন্দাবাহার, ইমদাদুল হক মিলন, অনন্যা, প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ, মূল্য : ৪০০ টাকা।)
লেখক : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়