কুরোসাওয়া কথা
গোলকধাঁধা
ভূমিকা
জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া (২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘ড্রিমস’সহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, ‘কুরোসাওয়া কথা’ শিরোনামে, ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে এখানে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।
যে বছর আমি আঠারোতে পা দিলাম, সেই ১৯২৮ সালে, ‘৩-১৫ ইনসিডেন্ট’-এ কমিউনিস্ট পার্টির বিপুলসংখ্যক সদস্যকে গ্রেপ্তার এবং মানচুরিয়ান ওয়ারলর্ড জাং-জুলিনকে হত্যা করে জাপানি সেনা কর্মকর্তারা। পরের বছর দুনিয়াজুড়ে অর্থনৈতিক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। জাপানের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রবল ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’-এর [বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট; ১৯২৯-১৯৩৯] ঘূর্ণিঝড়, দেশটির অর্থনীতির ভিত একেবারেই নাড়িয়ে দেয়। সর্বহারা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ফাইন আর্টের ময়দানও এ থেকে রেহাই পায়নি। আরেকটি চরম ব্যাপার ছিল, একটি শিল্প-আন্দোলনের আবির্ভাব। আর তা কঠিন সময়ের বেদনাবিধুর সেই বাস্তবতা থেকে পালানোর পথ উসকে দেয়, যেটিকে এক ধরনের জনসাধারণের মুখের ভাষার মতো করে, ডাকা হতো ইরোগুরো নানসেনসু [‘কামাতুর উদ্ভট নির্বোধ’] নামে।
সামাজিক অস্থিরতার মধ্যে, আমার পক্ষে নিজের ক্যানভাসে চুপচাপ মুখ গুঁজে পড়ে থাকা সম্ভব হলো না। তার চেয়েও বড় কথা, ক্যানভাস ও পেইন্টিং সাপ্লাইয়ের দাম এতই বেড়ে গেল, পরিবারের আর্থিক সংগতির কথা বিবেচনায় নিয়ে, তাদের এসব কিনে দেওয়ার মিনতি জানানো কঠিন হয়ে পড়ল আমার পক্ষে। নিজে পেইন্টিংয়ে পুরোপুরি মগ্ন হতে না পেরে, সাহিত্য, থিয়েটার, মিউজিক ও ফিল্মের প্রতি আগ্রহ বাড়ালাম।
এ সময়ে ‘ইয়েন বুকস’ নামে এক ধরনের বই ছাপার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। বইগুলোকে এ নামে ডাকার কারণ, প্রতিটি বইয়ের দাম ছিল এক ইয়েন করে; আর তাতে জাপানি সাহিত্য ও বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদে সয়লাব হয়ে গেল বাজার। পুরোনো বই বিক্রির দোকানে গেলে এ বইগুলো পঞ্চাশ সেন দিয়েই কেনা যেত, এমনকি কখনো কখনো ত্রিশ সেনেও মিলে যেত। আমি তাই যত সম্ভব এই বইগুলো কিনতে থাকলাম। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় মন দিয়ে সময় কাটানোর প্রয়োজন নেই—আমার মতো এমন একজন মানুষের পক্ষে ফলে বই পড়ার জন্য প্রচুর সময় মজুদ ছিল হাতে। কোনো বাছবিচার না করেই, ধ্রুপদি থেকে সমকালীন, বিদেশি থেকে জাপানি সাহিত্য—সবই পড়তে থাকলাম। রাতে বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে, দিনে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে—কতভাবেই না বই পড়েছি তখন!
মেইজি-যুগের কাবুকি থিয়েটারের বিকাশ ঘটিয়ে গঠিত হওয়া শিনকোকুগেকিতে [ইংরেজিতে, ‘দ্য নিউ ন্যাশনাল থিয়েটার’] আমি গিয়ে মঞ্চনাটক দেখতাম। মঞ্চনাটক বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দুতে ভূমিকা রাখা নাট্যকার-নির্দেশক কাওরু ওসানাই প্রতিষ্ঠিত সুকিজি লিটল থিয়েটারের পরিবেশনা দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে যেত আমার।
আমার এক বন্ধু ছিল সংগীতপ্রেমী। ওর ছিল ফোনোগ্রাফ ও রেকর্ড কালেকশন। ওর বাড়ি গিয়ে আমি মূলত ক্ল্যাসিক্যাল রেকর্ডিংগুলোই শুনতাম আমি। কম্পোজার-কনডাক্টর হিদেমারো কোনোয়ের নিউ সিম্ফোনি অর্কেস্ট্রার রিহার্সেল শুনতেও প্রায়ই হাজির হতাম।
একজন স্বপ্নবাজ পেইন্টার হিসেবে, জাপানি ও ওয়েস্টার্ন—দুই ধরনের পেইন্টিংয়েরই যেকোনো এক্সিবিশনে আমি যে হাজির থাকতাম, তা তো স্বাভাবিকই। তখনকার দিনে পেইন্টারদের আর্টবুক ও প্রিন্টেড মনোগ্রাফ খুব একটা সহজলভ্য ছিল না; তবে নিজের সাধ্যের মধ্যে এমন কিছু পেলে, আমি কিনে ফেলতাম। আর যেগুলো কেনার সামর্থ্য আমার হতো না, সেগুলো কোনো বইয়ের দোকানে গিয়ে, বারবার, বারংবার উল্টেপাল্টে দেখে, গেঁথে ফেলতাম মগজে। এ সময়ে আমি যে আর্টবুকগুলো কিনেছিলাম, তার অধিকাংশই প্যাসিফিক যুদ্ধের [১৯৪১-১৯৪৫] টোকিওর ওপর চালানো বিমান হামলায়, আমার সংগ্রহের অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তবে সেগুলোর মধ্যে অল্প কয়েকটি এখনো আছে আমার কাছে। সেগুলোর বাঁধাই নষ্ট হয়ে ও ছিঁড়ে গেছে, প্রচ্ছদ ও সাধারণ পৃষ্ঠাগুলো হয়ে গেছে একাকার, আর পড়ে গেছে অজস্র আঙুলের ছাপ—যার মধ্যে কিছু তো নিশ্চিতভাবেই রং-মাখানো আঙুলের ছাপও রয়েছে। এখন এই বইগুলোর দিতে তাকালে আমার ঠিক একই রকম অনুভূতি সহসাই ফিরে আসে, যেমনটা হয়েছিল প্রথমবার পড়ার সময়।
মোশন পিকচার বা সিনেমার প্রতিও মুগ্ধ হয়ে উঠেছিলাম আমি। আমার ভাইয়া—যিনি কি না বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে, জীবন কাটাতেন এক বোর্ডিংহাউস থেকে আরেক বোর্ডিংহাউসে—রুশ সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন তিনি। তবে একই সঙ্গে নানা ফিল্মের প্রোগ্রাম নোট নানা ছদ্মনামে লেখালেখিও করতেন। মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিদেশি সিনেমার শিল্পের ওপরই বিশেষ লেখালেখি করতেন ভাইয়া।
সিনেমা ও সাহিত্য—উভয় ক্ষেত্রেই আমি ভাইয়ার বুদ্ধিবৃত্তির কাছে ভীষণ ঋণী। ভাইয়া যে সিনেমাগুলোর নাম বলতেন, সেগুলোর প্রতিটির প্রতি সবিশেষ যত্ন দেখতাম আমি। সেই দূর অতীতে, যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম, ভাইয়া যখন একটি ভালো সিনেমার কথা বলেছিলেন, মনে পড়ে, সেটি দেখার জন্য সারা পথ হেঁটে পৌঁছেছিলাম আসাকুসায়। সেখানে ঠিক কোন সিনেমাটি দেখতে গিয়েছিলাম, এখন আর মনে নেই; তবে মনে পড়ে, এক অপেরা থিয়েটারে দেখানো হয়েছিল সেটি। লেট-শোর ডিসকাউন্ট টিকেট সংগ্রহের জন্য, লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার কথা মনে পড়ে আমার; আরও মনে পড়ে, আমরা বাড়ি ফেরার পর বাবার কাছে ভাইয়া বকুনি খেয়েছিলেন আচ্ছামতো।
সে সময়ে যে সিনেমাগুলো দেখেছিলাম, তার বেশ কয়েকটিই সিনেমার ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে বলে আমি সত্যিই অবাক হয়ে যাই। এ জন্য ভাইয়ার কাছে আমি ঋণী।
১৯ বছর বয়সে, ১৯২৯ সালে, যখন আমার চারপাশের পৃথিবীতে অনেক কিছু ঘটে যাচ্ছে, তখন ল্যান্ডস্কেপ ও স্টিল-লাইফের পেইন্টিং আঁকায় অস্বস্তিতে ভুগতে শুরু করলাম আমি। প্রোলেটারিয়ান আর্টিস্টস’ লিগ-এ [সর্বহারা শিল্পী গোষ্ঠী] যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার এ উদ্দেশের কথা ভাইয়াকে জানাতেই তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে। তবে সর্বহারা আন্দোলন এখন ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো ছড়িয়ে গেছে। খুব শিগগির এ জ্বরের অবসান ঘটবে।’ খানিকটা বিরক্ত হলাম তাঁর এ মন্তব্যে।
এ সময়ে বড় এক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন ভাইয়া। সিনেমার তুখোড় অনুরাগী হিসেবে তিনি স্রেফ ফিল্মগুলোর প্রোগ্রাম নোটই লিখতেন না, বরং হয়ে উঠেছিলেন নির্বাক ফিল্মের পেশাদার ন্যারেটর। ন্যারেটরেরা তখন শুধু ফিল্মগুলোর প্লটই পড়ে শোনাতেন না, বরং কণ্ঠস্বর ব্যবহার ও সাউন্ড ইফেক্টের সমন্বয়ে আবেগও ফুটিয়ে তুলতেন তাঁরা, আর পর্দায় চলমান ঘটনা ও ইমেজগুলোর দিতেন শিল্পসম্মত বর্ণনা : তাঁদের কাজটি ছিল অনেকটাই বুনরাকু পাপেট থিয়েটারের ন্যারেটরদের মতো। সবচেয়ে জনপ্রিয় ন্যারেটরেরা নিজগুণে একেকজন তারকায় পরিণত হতেন, কোনো নির্দিষ্ট থিয়েটারের পৃষ্ঠপোষকতার প্রধান দায়ভার থাকত তাঁর ওপরই। বিখ্যাত ন্যারেটর—মুসেই তোকুগাওয়ার নেতৃত্বে, একটি একেবারেই নতুন আন্দোলন ডানা মেলছিল তখন। তিনি ও তাঁর সমমনা একদল ন্যারেটর সুনির্মিত বিদেশি সিনেমাগুলোর উচ্চমানসম্পন্ন ন্যারেশনে নিবেদন করেছিলেন নিজেদের। ভাইয়াও যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের দলে; যদিও সেটি ছিল একটি তৃতীয় শ্রেণির থিয়েটার, তবে নাকানোর শহরতলির সে সিনেমা-হলটির চিফ ন্যারেটরের চাকরিটি পেয়েছিলেন ভাইয়া।
আমি ধরে নিয়েছিলাম, জীবনে সফল হওয়ার কারণেই রাজনীতির প্রতি উন্নাসিক হয়ে পড়েছেন ভাইয়া; তাই যে বিষয়টি আমি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি, তিনি সেটি নিয়ে হালকা চালের কথা বলছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে টের পেলাম, আমার সর্বহারা অনুভূতিগুলো একেবারেই সে অবস্থায় পর্যবসিত হয়েছে—যেটির ভবিষ্যদ্বাণী ভাইয়া করেছিলেন। অনিচ্ছুকভাবে আমাকে মানতেই হলো, তিনি ঠিকই বলেছিলেন; তবু সেই আন্দোলনের সঙ্গে কয়েক বছর জড়িয়ে থাকতে হলো আমাকে। মাথাভর্তি চিত্রকলা, সাহিত্য, থিয়েটার, মিউজিক ও ফিল্মবিষয়ক জ্ঞানের বোঝা নিয়ে, উদ্ভ্রান্তের মতো আমি, উদ্দেশ্যহীন খুঁজে বেড়াতে থাকলাম এমন এক জায়গা—যেখানে এ জ্ঞান কাজে লাগানো সম্ভব।