দ্বিজেন শর্মা : নিছক নিসর্গী নন

দ্বিজেন শর্মা খাঁটি নিসর্গপ্রেমী ছিলেন, এ কথা সত্য। কিন্তু নিসর্গের প্রতি ভালোবাসা তাঁর ব্যক্তিত্বের একটা মাত্র প্রকাশ, যার জন্ম প্রকৃতি ও প্রাণের বন্ধনবিষয়ক গভীর দার্শনিক উপলব্ধি থেকে। নিসর্গ কে না ভালোবাসে? সবচেয়ে বড় প্রকৃতি ধ্বংসের সিদ্ধান্তটা যিনি নেন, ঘুষের অর্থটা দিয়ে তিনি হয়তো গাছপালা ঘেরা একটা বাড়ি কেনারই স্বপ্ন দেখেন। প্রায়ই তো দেখা যাবে, আমরা বাগান সাজাই, উদ্যান পরিকল্পনা করি, গাছ-লতাপাতা-পাখি পছন্দ করি—কিন্তু বড়জোড় আমাদের চারপাশ সুন্দর থাকলেই আমরা খুশি। আর মাঝেমধ্যে ঘুরতে যাওয়ার জন্য যেন কিছু নিসর্গের টিকে থাকাটা দরকার।
আমাদের প্রয়োজনের বাইরে প্রকৃতির অস্তিত্ব নিয়ে, সত্তা নিয়ে কোনো ভাবনার, কোনো উপলব্ধির তাহলে আর প্রয়োজন পড়ে না। এই অর্থে যিনি যত গাছ চেনেন, তিনি তত বড় নিসর্গী। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা যদি পুঁজির স্বার্থে সীমায়িত হয়, অরণ্য-পাহাড়-নদীর মৃত্যু বড়জোর কিছু ভীরু ভীরু ক্ষোভ, কিছু অভিমানের জন্ম দেয়। কোনো চিন্তাশীলতা, কোনো বিকল্প জীবনব্যবস্থার সন্ধানে যাওয়াটা তখন বড় কঠিন হয়ে পড়ে। নিছক দৃশ্যপ্রেম প্রকৃতি আর মানুষের গভীর বিচ্ছেদ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় না। দৃশ্য তখন একটা বাজার-সম্ভাবনাময় পণ্য, ফলে অনতিবিলম্বে তার উৎপাদকরাও হাজির হন নাগরিক জীবনে। আজকের ঘোরতম প্রকৃতি বিপর্যয়ের কালে জন্ম নেন এক একজন মিষ্টি নিসর্গী। সুন্দরবনটাকে বাঁচাতে হাঁক দেবেন, দলবেঁধে প্রাণপণ করবেন এমন অজস্র প্রকৃতিবিদ আমরা তাই দেখি না।
অতি অবশ্যই দ্বিজেন শর্মাও একজন নিসর্গী। কংক্রিটের এই নগরে তিনি নিসর্গটুকু বাঁচিয়ে রেখেছিলেন সাদাকালো অক্ষরে। জাগিয়ে তুলেছিলেন জীবন আর প্রাণের প্রতি ভালোবাসা। দৃশ্যের সৌন্দর্য উপভোগ করতে জানতেন, সেটা শেখাতেনও আশ্চর্য পারঙ্গম ছিলেন। সৌন্দর্যের বোধও আসলে মানুষের সহজাত নয়, বরং তা শিক্ষার বিষয়। তাঁর সান্নিধ্য যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা সৌভাগ্যবান। যাঁদের লেখালেখির মাঝে, তৎপরতার মাঝে নিসর্গের রূপ-শোভার রস উপলব্ধিতে শক্তিটুকু ফুরিয়ে যায় না, তাঁদের বড় অংশই দ্বিজেন শর্মার শীর্ষস্থানীয়, তাঁদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি কীভাবে ফুলের, পতঙ্গের রূপটুকু দেখতে শেখানোর সঙ্গে সঙ্গে ফুলের সঙ্গে পতঙ্গের সম্পর্কের তাৎপর্যটুকুও দ্বিজেন শর্মা তাদের মনে গেঁথে দিয়েছেন।
পশ্চিমে প্রকৃতি আজ জীবন দর্শনে বলি, প্রাত্যহিক ভাবনায় বলি, রাজনৈতিক সংগ্রামে বলি—অন্যতম বিবেচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই আবর্তন খুব পুরোনো নয় যদিও, ৭০ থেকে ৯০ দশক পর্যন্ত গিয়েছে তার প্রচারকাল। কিন্তু ক্রমে প্রকৃতি-সচেতন পশ্চিম থেকে পূর্বে পালিয়ে আসতে বাধ্য হওয়া শিল্পকারখানা আমাদের দেশে এখনো যথাযথ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে প্রায় সক্ষম হয়নি কিংবা খুব শ্লথ, খুব ধীরগতিতে পেরেছে। ফলে প্রকৃতি ভাবনা এ দেশে নিসর্গপ্রেমের স্তরেই আটকা পড়ে আছে, যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পৃষ্ঠপোষকতা সূত্রে একে সীমায়িত করে ফেলা, সংকীর্ণ করে আনা নানান বাণিজ্যিক স্বার্থ।
দ্বিজেন শর্মা একদিন খানিকটা মজা করেই বলছিলেন তাঁর সিলেটি টানে, বাংলাদেশের প্রকৃতি সুরক্ষা নিয়ে আইনকানুন এত কড়া, অনেক পশ্চিমা দেশেও তা মিলবে না। কেন বাংলাদেশে এত অগ্রসর আইন করা হলো, তার কারণ ভাবতে ভাবতে তিনি বুঝে ফেললেন এর রহস্য। জার্মানিতে যদি একটা আইন হয়, তাদের সেইটা বাস্তবায়নও করতে হয়। ফলে ওরা লোক দেখাতে আইন করে না। কিন্তু বাংলাদেশে আইন করলেই তো হয়, মানার কোনো ব্যবস্থা লাগে না, ওদিকে এই সব আইন দেখিয়ে দেখিয়ে, এই পুরস্কার, সেই পুরস্কারও মেলে। এ জন্যই বাংলাদেশে আইন করায় উৎসাহ, প্রকৃতি রক্ষায় উৎসাহ নেই।
২.
দ্বিজেন শর্মার এই চেতনা সময়ের ফসল। ষাটের দশের রাজনীতির বোধ অজস্র মানুষের মধ্যে বিচিত্র উপায়ে কাজ করেছে। আন্তর্জাতিকতা ও বিশ্বমানবের মুক্তি নিয়ে ভেবেছেন একদল, আরেকদল আলোড়িত হয়েছেন জাতীয়তাবাদী চেতনায়। দ্বিজেন শর্মা মানসিকভাবে প্রথম দলভুক্ত ছিলেন, সক্রিয় রাজনীতি না করলেও দিন-রাত তাঁদেরই সঙ্গে ওঠাবসা ছিল, তবে দ্বিতীয় দলভুক্তদের সঙ্গেও তাঁর মেলামেশা কম ছিল না। খুব করে বলতেন তাঁর বন্ধু, অধুনা বিস্মৃতপ্রায় সিদ্দিকুর রহমানের কথাও, শ্রমিক-কৃষক-সমাজবাদী দলের এই কর্মীর মোটরসাইকেলের পেছনে বসে ঢাকা শহর চষে বেড়াবার গল্প। বলতেন ঢাকার বিখ্যাততম আড্ডাবাজ খালেদ চৌধুরীর অবিশ্বাস্য সব গল্প, আর দুঃখ করতেন এই রকম একটা মানুষকে নিয়ে একটা স্মারকগ্রন্থও প্রকাশ পেল না! তাঁর আড্ডার বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক, ছিলেন হায়াৎ মামুদ।
এই প্রজন্মের একটা দিক যেমন ছিল অসাম্প্রদায়িকতা, আরেকটা বিষয় ছিল বিজ্ঞানমনস্কতা। এটা ষাট দশকের পাকিস্তানবিরোধী রাজনীতিরই প্রত্যক্ষ ফল। দ্বিজেন শর্মা সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন, সাহিত্যগুণও তাঁর ছিল। কিন্তু সত্যি বলতে কি, বিজ্ঞানমনস্কতাই তাঁর প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল বলেই মনে হয়েছে। এ সময়ের আরেক কৃতী পুরুষ আবদুল্লাহ আল মুতী, কিশোরদের জন্য বিজ্ঞানের বই লিখে যিনি বাংলাভাষায় প্রাতঃস্মরণীয় আছেন, তাঁরও সাহিত্য ও চলচ্চিত্র বিষয়ে আগ্রহ, জ্ঞান ও লেখালেখি নিয়ে দ্বিজেন শর্মাকে বলতে শুনেছি। বলতেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জহুরুল হকের কথা, যিনি বাংলা ভাষায় প্রথম অনুবাদ করেছিলেন অঁতোয়ান দ্যা স্যাঁৎ-একজ্যুপেরির লেখা ছোট্ট রাজপুত্র বইটি। সৌভাগ্যক্রমে এ বইটির সূত্র ধরই তাঁর সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা, আনন্দমীয় মজুমদারের অনুবাদে এই গ্রন্থটির একটি নতুন প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ততার সুবাদে, তিনি এটির একটি দীর্ঘ ভূমিকা তৈরি করে দিয়েছিলেন। বইটি তাঁর অত্যন্ত প্রিয়, সেই জহুরুল হকের অনুবাদটি পড়ার সময় থেকে, দীর্ঘ জীবনে যেখানেই গিয়েছেন, এই বইটির নানান সংস্করণ সংগ্রহ করেছেন, মানুষকে উপহার দিয়েছেন। একটা বই মানুষকে কতটা প্রভাবিত করতে পারে, তার নিদর্শন ছোট্ট রাজপুত্র বইটার সঙ্গে তার দীর্ঘ জীবনের সম্পর্ক। এমনি আরো কিছু বইয়ের গল্প করতেন, একটি যেমন সি পি স্নো রচিত ‘টু কারচার’। তাঁর সব লেখা পড়া হয়নি, এখন মনে হচ্ছে তাঁর প্রজন্ম প্রভাবিত হযেছেন এমন বইগুলো সম্পর্কে তাঁর সায়াহ্নকালের মূল্যায়নটা জেনে নেওয়াটা খুব জরুরি ছিল, হয়তো লিখে রেখেছেন। একটা আত্মজীবনী লেখার জন্য অনেকবার অনুরোধ করেছিলাম, সব কথা লেখা যাবে না, জানিয়েছিলেন।
দ্বিজেন শর্মার প্রকৃতিবোধ সম্ভবত তাঁর বিজ্ঞান চেতনা আর সাহিত্যিক বোধের একটা যৌথ রসায়নের ফল। একদিকে সংবেদনশীলতা তাঁকে পৃথিবীর গভীর, গভীরতর অসুখটা সম্পর্কে সচেতন করছিল, আরেকদিকে তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতা সমাধান খুঁজছিল। তাঁর সেই সিলেটি সুরেই তিনি বলতেন, বিজ্ঞানের দিক দিয়ে ভাবলে সমাধান তো আছে, কিন্তু সংকীর্ণ স্বার্থের প্রাবল্যের দিক দিয়ে ভাবলে তো তার হতাশ লাগে। ৭০-৯০ দশকের বৈশ্বিক প্রকৃতিচেতনার উন্মেষের কালটাতে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিলেন অনুবাদক হিসেবে, সেই নিয়ে বহুবার বলেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি পারমাণবিক বোমার ভাণ্ডার না বানিয়ে বিশ্বের জন্য বিকল্প সস্তা আর নিরাপদ প্রযুক্তি বানাত, সমস্ত গরিব দেশ, গরিব মানুষ তার দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হতো।
৩.
দ্বিজেন শর্মা আড্ডাপ্রিয় মানুষ ছিলেন। বন্ধু রেজাউল করিম সুমনের সৌজন্যে তাঁর বাড়িতে শেষ তিন বছর বহুবার আড্ডায় মেতেছি। এমন সহজ আর আন্তরিক বন্ধুত্ব গড়ে তোলার ক্ষমতা ছিল তাঁর—রাজনীতি, ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য, প্রকৃতি, সোভিয়েত অভিজ্ঞতা—বিষয়ের অভাব ঘটত না। নতুন কিছু জানতে, জানাতে এবং তাৎপর্য আলোচনা করতে তাঁর আগ্রহ ছিল কিশোরদের মতই। একদিন একজন চিকিৎসকের কাছে শুনলাম, যিনি দক্ষিণ ভারতীয় একজন কবিরাজের পরামর্শে বেশ উপকার পেয়েছেন। এরপর সেই কবিরাজের বিদ্যাবত্তার পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি জানালেন, দক্ষিণ ভারতের কবিরাজি নাকি আদি আয়ুর্বেদ অনেকখানি ধরে রেখেছে। কেননা, উত্তর ভারতে দীর্ঘ মুসলমানি রাজত্বে সেখানে মিশ্রণ ঘটেছে আরবি-গ্রিক ইউনানি চিকিৎসাপদ্ধতির সঙ্গে, ফলে সেখানে রাসয়নিক উপাদানের ব্যবহার প্রচুর। দ্বিজেন শর্মাকে এই কথা জানানো মাত্র তার হাসিভরা মুখটা দেখলাম: দেখো তাইলে, ইতিহাস কেমনে শাস্ত্র বদলায়ে দিল! তারপর জানালেন, তাঁর পিতা কবিরাজ ছিলেন, এক নিশ্বাসে বেশ কয়েকটি রাসায়নিকের নাম বললেন, যা তিনি অনুপান হিসেবে ব্যবহার করতেন। মৌলভীবাজারের বড়লেখার গাছগাছালির মাঝে বেড়ে ওঠা, কবিরাজ পিতা, বিজ্ঞানের ছাত্র, সাহিত্য অনুরাগী, সমাজ সচেতনতা—এসব কিছুর টানে যা হওয়ার তাই হয়েছেন দ্বিজেন শর্মা।
অনুবাদক হিসেবে দ্বিজেন শর্মার কৃতিত্ব নিয়ে অনেকেই বলেছেন। প্রসঙ্গক্রমে অন্য একটা বিষয়ে বলি, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার সীমাবদ্ধতা এবং সম্ভাবনা বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল বিপুল। এই কাজটি যে করা প্রয়োজন, তা বহুবার বলেছেন, বহুবার হতাশও হয়েছেন বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচিন্তার প্রকাশের দীনতায়। খানিকটা উত্তেজিত হয়েই বললেন, সেই রকম ভাষা তো নির্মাণ করতে হবে। তার জন্য মেধা, শ্রম, অর্থ, সময় দিতে হবে। তার তো কোনো উদ্যোগ নেই!
নগরের প্রকৃতি নিয়ে বিশেষ করেই ভাবতেন এবং নগর-পরিকল্পনা, স্থাপত্য আর উদ্যানবিদের মাঝে যোগসম্পর্কের বিশেষ চেষ্টাও করে গেছেন। হাতিরঝিল প্রকল্পের গাছপালা নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন, কেননা এই পরিকল্পকরা বিশেষজ্ঞদের কাছে এসে শোনেন বটে, কিন্তু কাজটা নিজেদের মতই করে ফেলেন। যেখানে অর্থ বেশি খরচ হবে সেটাতেই তাদের আগ্রহ তাই বেশি। কেন ছায়া দেওয়া, ফুল-ফল-মধু-পতঙ্গের আশ্রয় দেওয়া দেশি গাছের বদলে নিছক সৌন্দর্যের নামে কিছু বিদেশি গাছ অপরিকল্পিতভাবে রোপণ করা হবে, সেই বিষয়ে বহুবার উষ্মা প্রকাশ করতে দেখেছি তাঁকে। এখন যেটা উচ্চ আদালতের সীমানাভুক্ত, আগে ছিল সড়ক ভবন, সেটা আদিতে ছিল মাতৃবৃক্ষের একটা উদ্যান। বিশাল সব মহীরুহ সেখানে ছিল, যাদের থেকে বীজ ও চারা সংগ্রহ করে নানান জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া হতো। এই মাতৃউদ্যানের সড়ক ভবনে পরিণত হওয়ার মাঝে দ্বিজেন শর্মা দেখেছেন ঢাকা নগরীর অবক্ষয়, পরিকল্পনাহীনতা আর দুর্নীতিপ্রবণ জবাবদিহীনতাকে। ষাট দশক থেকে যে শ্যামলী নিসর্গ রাজধানী ঢাকার বুকে ছায়া দিয়ে রেখেছিল, তাদের অবসান কিংবা ক্ষতবিক্ষত হওয়া দ্বিজেন শর্মার বিশাল দীর্ঘশ্বাসের উৎস ছিল। বিশেষ অপরিকল্পনার শিকার হয়ে রমনার মহুয়া গাছটির মৃত্যু নিয়ে বেশ কবার দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু অনেক বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন নিয়ন্ত্রণহীন কলকারখানার বর্জ্য নদী-বন-প্রকৃতিতে যেভাবে বিনাশ করছে সেটি নিয়ে। সুন্দরবন নিয়েও তাঁর আশঙ্কার সীমা ছিল না। আর খুব আগ্রহ ছিল ঢাকার নানান সড়ক, উদ্যাগন, মুক্ত পরিসর, স্থাপনা আর প্রতিষ্ঠানগুলোর উপযুক্ত বৃক্ষপরিকল্পনার একটা সমন্বিত চেষ্টায়।
৪.
স্কয়ার হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করলেও দীর্ঘদিন তিনি বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। চিকিৎসাপদ্ধতি ও চিকিৎসকদের দৈনন্দিন প্রতিবেদন নিয়ে পরিবার ও সুহৃদদের অসন্তুষ্টি ছিল বলেই শেষ মুহূর্তে তাকে স্কয়ারে সরিয়ে নেওয়া হয়। ২৩ জুলাই থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি বারডেমে কাটান, প্রায় ১৭ লাখ টাকার ব্যয়ে দ্বিজেন শর্মার সর্বাঙ্গে তখন বেডসোরের ক্ষত। চিকিৎসকরা বলেছিলেন তাঁর নিউমোনিয়া। ফুসফুস প্রায় অকেজো। স্কয়ারে জানা গেল নিউমোনিয়া নেই, ফুসফুস প্রায় স্বাভাবিক। বার্ধক্য আর শরীরের শক্তি ফুরিয়ে আসাতে স্বাভাবিকভাবেই হয়তো তিনি মারা যেতেন, কিন্তু পাওনা শুশ্রূষাটুকু পাননি, এই অভিযোগ তাঁর স্বজনদের থাকল। কিন্তু এসব অভিযোগ-অনুযোগ থাক। মহৎহৃদয়ের এই মানুষটির জীবনটুকু আরো বড় সত্য হয়ে দেখা দিক। দ্বিজেন শর্মা আমাদের কৈশোরের জাদুকর। কৌতূহল। অনুবাদক হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য। কথক হিসেবে, গল্প বলিয়ে হিসেবে আর একজন দ্বিজেন শর্মার জন্ম হতে বহুকাল লাগবে হয়তো। আজ যাঁরা প্রকৃতি বিষয়ে মানুষকে জাগাচ্ছেন, তাঁরা প্রায় সকলে তাঁর শিষ্যকুলভুক্ত। প্রকৃতিকে ভালোবাসার নীরব অহিংস যুদ্ধে তিনি একজন পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবেন। প্রকৃতিমঙ্গলের এই কবির সান্নিধ্যের ছোঁয়া আজীবন স্মৃতিময় হয়ে থাকবে।
খুব কম মানুষ বৃদ্ধ হতে জানেন। দ্বিজেন শর্মা তাঁদের মাঝে একজন। এ রকম মানুষদেরই আমরা চিরতরুণ বলি।