উইংস অব ফায়ার
এক স্বপ্নসংগ্রামী মানুষের গল্প
কাজের বেলাভূমিতে যদি পদচিহ্ন রেখে যেতে চাও, তবে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাও। নিজের আত্মজীবনীতে কথাগুলো লিখেছিলেন ভারতের সদ্যপ্রয়াত প্রেসিডেন্ট, বিজ্ঞানী ও লেখক এ পি জে আবদুল কালাম। পুরো নাম আবুল পাকির জয়নুল আবদিন আবদুল কালাম (এ পি জে আবদুল কালাম)। ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত, আর খুব সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই মহান মানুষটি পৃথিবীর বহু তরুণের জন্য অনুপ্রেরণার নাম হিসেবে বেঁচে থাকবেন।
অতি দরিদ্র ঘরের সন্তান হয়েও ভারতের মতো বৃহদাকার একটি রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়া, দেশটির পরমাণু কর্মসূচিতে অবদান রেখে ‘মিসাইলম্যান অব ইন্ডিয়া’ খেতাব অর্জন করা এই ব্যক্তিটি তাঁর জীবনের সব অর্জনের পেছনের সংগ্রামী জীবনের গল্প লিপিবদ্ধ করে গেছেন আগামী প্রজন্মের জন্য ‘তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ উইংস অব ফায়ার’-এ। সহলেখক ছিলেন এ পি জে আব্দুল কালামের বন্ধু বিজ্ঞানী অরুণ তিওয়ারি। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে, ইংরেজিতে। এরপর ভারতের প্রধান প্রধান ভাষাসহ বিশ্বের ১৩টি ভাষায় অনূদিত হয়। বিক্রি হয় ১২ লাখের বেশি কপি। বইটিতে সাতটি বিভাগে ভাগ করে এ পি জে কালাম তাঁর জীবনের বাল্যকাল থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার গল্প লিপিবদ্ধ করেছেন।
তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমের এক মৎস্যজীবী পরিবারে জন্ম নেওয়া আবদুল কালাম তাঁর বেড়ে ওঠাকালে যে অভাব অনটন সহ্য করেছেন তার কিছুই এড়িয়ে যাননি এই বইতে। তিনি খুব সরলভাবে তাঁর জীবনের দুঃখভরা দিনগুলোর কথা বলেছেন। ছোট্ট শহরে থেকে বড় স্বপ্ন দেখার গল্প শুনিয়েছেন আমাদের। খাবার জোটাতেও পরিবারকে সহায়তা করতে মাত্র আট বছর বয়সে খবরের কাগজ বিক্রি করতে থাকা এক শিশু স্বপ্ন দেখেন যুদ্ধবিমানের পাইলট হওয়ার।
আর তখন সেটি আকাশকুসুম কল্পনা মনে হলেও পরে আরো কয়েকধাপ এগিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন রকেটবিজ্ঞানী এবং ভারতের প্রেসিডেন্ট। ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের ১১তম প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন।
বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি ভারতের প্রথম প্রেসিডেন্ট এবং মুসলিম হিসেবে ছিলেন তৃতীয়। দেশটির সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘ভারতরত্ন’ ছাড়াও ‘পদ্মভূষণ’ ও ‘পদ্মবিভূষণ’ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন।
‘তবে এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’- এমনটি ঘটেনি এ পি জে কালামের বেলায়। তাঁকে সব কিছু সংগ্রাম করে অর্জন করে নিতে হয়েছে। মৌখিক পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় এয়ার ফোর্স অফিসার হওয়া হলো না- ভেঙে পড়লেন তিনি। আর তখনই তাঁর দেখা হলো স্বামী শিবানন্দের সঙ্গে। স্বামী শিবানন্দ শোনালেন সেই অমোঘবাণী ‘তুমি যেই কারণে জন্মগ্রহণ করেছ সেই গন্তব্যস্থলকে গ্রহণ কর আর তা নিয়েই ভবিষ্যতের পথে যাত্রা কর। হতে পারে তুমি এ পথের পথিক নও, হয়তো বা তুমি এয়ার ফোর্স অফিসার হওয়ার জন্য জন্মাওনি। তোমার গন্তব্য হয়তো বা আরো মহান কোনো পথে, সেই পথ তুমি এখনো খুঁজে না পেতে পার কিন্তু তা অবশ্যই পূর্বলিখিত। নিজের অস্তিত্বের সন্ধান কর আর অস্তিত্বের কারণ খুঁজে বের কর।’ এই কথাতেই নতুন করে ঘুরে দাঁড়ান তিনি। বাকিটা কেবলই ইতিহাস আজ। আত্মজীবনীতে এসব কথা ব্যক্ত করেছেন আবদুল কালাম।
শৈশব থেকেই এ পিজে আবদুল কালাম ছিলেন অত্যন্ত অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। আত্মজীবনীতে এমনই একটি ঘটনার কথা বর্ণনা করেন তিনি। ‘আমি তখন রামেশ্বরম এলিমেন্টারি স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ি। স্কুলে একজন নতুন শিক্ষক এলেন। আমি সাধারণত সবসময় টুপি পরতাম, যে কারণে খুব সহজেই বোঝা যেত যে আমি মুসলমান। তবে আমি বসতাম আমার বন্ধু রামেন্দ্র শাস্ত্রীর সঙ্গে- যে কি না পৈতে পরত। একজন হিন্দু ব্রাহ্মণের ছেলের সাথে একজন মুসলমান ঘরের সন্তানের একসাথে বসাটা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে হজম করতে পারলেন না ওই শিক্ষক। তিনি আমাকে উঠিয়ে পেছনের বেঞ্চে পাঠিয়ে দিলেন। সেদিন যে নিজেকে কতটা হীন মনে হচ্ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমরা দুজনই আমাদের বাসায় এই ঘটনা জানালে রামেন্দ্রর বাবা লক্ষণ শাস্ত্রী ওই শিক্ষককে ডেকে বললেন তিনি যাতে সামাজিক বর্ণবৈষম্যের কালো বীজ তাঁর ছাত্রদের মাঝে ছড়িয়ে না দেন।’
এই বইয়ের শেষ দিকে আবদুল কালাম তাঁর তৈরি অগ্নি, পৃথ্বী, আবাশ, ত্রিশূল ও নাগ ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর নেপথ্য-কাহিনী শুনিয়েছেন। তবে তিনি তাঁর আবেগ ও অনুভূতিকে দিব্যি চেপে গেছেন। তিনি যে কেন চিরকুমার হয়ে কাটিয়ে দিলেন, তার উত্তর দিলেন না। সাধারণত জীবনীমূলক গ্রন্থে একজন ব্যক্তিকে আমরা যেভাবে পাই, এখানে সেভাবে আবদুল কালাম আমাদের সামনে আসেন না। জীবনীকার আবদুল কালাম ক্ষেপণাস্ত্র-বিষয়ক আলোচনায় অনেকখানি ঝুঁকে পড়েছেন। ফলে সাধারণ পাঠক কিছুটা অংশ পড়ে অতটা মজা পাবেন না।
বইটির ভাষা খুব সরল ও সুখপাঠ্য। এ পি জে আবদুল কালাম ইচ্ছে করেই ছোট ছোট বাক্যে এবং কমিউনিকেটিভ স্ট্যাইলে লিখেছেন। পড়তে পড়তে মনে হয় যেন তিনি পাঠকের সঙ্গে কথা বলছেন। ভারতের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষের খেতাব অর্জন করা এই মহান মানুষটির আত্মজীবনী পাঠকদের, বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত তরুণদের জন্য অবশ্যপাঠ্য একটি বই।