ইতিহাস
প্রাচীন ঢাকার কথা (১)
আজকের বাংলার সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবনের সোনাফলা উৎস খুঁজতে গেলে মধ্যযুগের ইতিহাচর্চা জরুরি। কিন্তু আমাদের এ সময়ের ইতিহাস গবেষকদের বেশির ভাগের গবেষণা অঞ্চল ঔপনিবেশিক যুগের ভেতরই আটকে গেছে। তাই ঐতিহ্য ভাবনা হয়ে পড়েছে অস্পষ্ট। এ কারণে মধ্যযুগ নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণার সাথে যুক্ত হতে না পারায় সাতপুরোন ধারণা থেকেই মনে করা হচ্ছে সতের শতকের শুরুতে মোগলদের পূর্ববাংলা দখল ও ঢাকায় রাজধানী স্থাপনের মধ্যদিয়েই ঢাকার নাগরিক জীবনের শুরু। আর এই খণ্ডিত ধারণা থেকে দেশবাসীকে ইতিহাস বিভ্রান্ত করে কোনো কোনো মহল থেকে ঢাকা নগরীর ৪০০ বছর বা রাজধানী ঢাকার ৪০০ বছরের ধারণা দেওয়া হয়েছে । এই বাস্তবতায় ইতিহাসের সত্যকে একবার খুঁজে দেখা যেতে পারে।
মোগল-পূর্ব ঢাকা
বাংলায় বহিরাগত মুসলমান সুলতানদের শাসনের শুরু হয় তেরো শতকের সূচনায়। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজির মধ্যদিয়ে ১২০৪ খিস্টাব্দে বাংলা বিজয়ের সূচনা ঘটে। বখতিয়া খলজি বাংলা বিজয় সম্পন্ন করেননি সূচনা করেছিলেন মাত্র। এরপর শতাধিক বছর ধরে দিল্লির মুসলিম সুলতানদের পাঠানো সেনাপতি ও গভর্নররা একটু একটু করে বাংলায় মুসলিম শাসনের বিস্তার ঘটাতে থাকেন। চৌদ্দ শতকের প্রথম পর্বেই বাংলার তিন অংশে তিনটি মুসলিম শাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ফার্সি ভাষায় এই শাসন কেন্দ্র বা প্রদেশকে বলা হতো ইকলিম। এগুলো হচ্ছে উত্তর বাংলায় ইকলিম লখনৌতি, পশ্চিম বাংলায় ইকলিম সাতগাঁও এবং পূর্ব বাংলায় ইকলিম সোনারগাঁও।
১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে প্রভাবশালী কর্মকর্তা ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ সোনারগাঁওয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিল্লি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এই স্বাধীনতার সূত্র ধরেই শুরু হয়ে যায় দুইশ বছরব্যাপী বাংলার স্বাধীন সালতানাতের যাত্রা। এই সময়কাল থেকে একটি ছোট্ট শহর হিসেবে ঢাকার অস্তিত্ব ইতিহাসের সূত্রে পাওয়া যায়।
সতের শতকের শুরুতে ঢাকায় মোগল অধিকার প্রতিষ্ঠার আগের এ যুগের আকর গ্রন্থ বাহারিস্তান-ই-গায়েবিতে মির্জা নাথান প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতায় ঢাকার যে অবস্থার বর্ণনা করেছেন, তা অনেকটা এমন- শহরটি প্রতিষ্ঠিত ছিল বুড়িগঙ্গার পূর্ব তীরে । বর্তমান বাবু বাজারের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বে কয়েক মাইল পর্যন্ত প্রলম্বিত ছিল এই শহর।
পুরনো ঢাকার অনেক স্থান-নাম হিন্দু নামে দীর্ঘকাল ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। অনুমান করা হয় এখানে প্রাচীনকাল থেকেই হিন্দু বসতি এবং তাদের বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। হাকিম হাবিবুর রহমান উর্দু ভাষায় লেখা তাঁর ‘ঢাকা পঁচাশ বরস পহেলে’ গ্রন্থে বলেছেন বিক্রমপুর যখন সেন রাজাদের রাজধানী তখন ঢাকার দক্ষিণাংশে হিন্দু বসতি গড়ে উঠেছিল। সেই যুগের স্মৃতি বিজড়িত নামগুলো হচ্ছে লক্ষ্মীবাজার, বাংলাবাজার, সূত্রাপুর, জালুনগর, বানিয়ানগর, গোয়ালনগর, তাঁতিবাজার, সুতারনগর, কামারনগর, পাটুয়াটুলি, কুমারটুলি ইত্যাদি। এই নামগুলো মোগল-পূর্ব যুগে হিন্দু নিয়ন্ত্রিত নানা পেশাজীবীদের অবস্থানও নিশ্চিত করছে। রাজধানী সোনারগাঁওয়ের নিকটবর্তী হওয়ায় বাণিজ্য অঞ্চল বিস্তার করতে গিয়ে ঢাকার এই অঞ্চলে ক্রমে নাগরিক জীবনের বিস্তার ঘটে। সোনারগাঁও থেকে ঢাকার নগরায়নের পথ প্রশস্ত হয় নদী পথের যোগাযোগ থাকায়। প্রাক-মোগল যুগে ঢাকার দক্ষিণ ও পূর্ব সীমা নির্ধারণ করে যথাক্রমে বুড়িগঙ্গা ও দোলাই খাল (একদা দোলাই নদী)। সুনির্দিষ্ট তথ্যের অভাবে প্রাক-মোগল ঢাকার পশ্চিম সীমানা নির্ধারণ করা কঠিন।
১৬১০ সালে সুবাদার ইসলাম খাঁ বারো ভুঁইয়াদের পরাজিত করে ঢাকায় মোগল রাজধানী প্রতিষ্ঠা করার আগেই বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগার অঞ্চলে ‘ঢাকা দুর্গ’ নামের একটি দুর্গ ছিল। দুর্গের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত ঘাটটির নাম ছিল দাঁদনীঘাট। বাহারিস্তান-ই-গাইবির বক্তব্য অনুযায়ী এই অংশে তখন দুটি অঞ্চলের বিকাশ ঘটে। এই চাঁদনীঘাটটিই পরে চকবাজার নামে পরিচিত হয়। দুর্গ থেকে চাদনীঘাট পর্যন্ত বাজারের বিস্তার ছিল। ঢাকা নগরীর বিস্তারের যুগে ইসলাম খান (১৬০৮-১৬১৩ খ্রি.) এখানে রাজধানী স্থাপন করেন এবং সম্রাটের নাম অনুসরণে এর নাম রাখেন জাহাঙ্গীরনগর, এক শতকের চেয়ে সামান্য বেশি সময় ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই সময় প্রশাসনিক বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বিকাশ অব্যাহত থাকে।