ঢাকার কথা-৩
একটি প্রাচীন প্রশাসনিক কেন্দ্র
বাংলাদেশের প্রাচীন যুগে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অঞ্চলে অনেক ক্ষেত্রে নিরাপত্তার কারণে মাটির বা ইটের দুর্গ নির্মাণ করা হতো। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় মৌর্যরাজাদের প্রদেশ পুন্ড্রবর্ধনভুক্তির রাজধানী পুন্ড্রনগর ছিল ইটের দেয়ালে ঘেরা নগরী। আজকের বগুড়ার মহাস্থানগড়ই ছিল সে যুগের পুন্ড্রনগর। পুন্ড্রনগরের সমসাময়িককালে বাণিজ্য নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নরসিংদী জেলার উয়ারি-বটেশ্বরে। এই নগরীটিও এক সময় মাটির দুর্গে ঘেরা ছিল। এসব বড় উদাহরণ ছাড়াও ছোট ছোট অঞ্চলে দুর্গ গড়ার কথা জানা যায়। দুর্গঘেরা কোনো স্থান বা অঞ্চল অনেক সময় কোট বা গড় নামে পরিচিত। সাধারণত নদী পথের ধারেই কোট বা গড়ের অবস্থান ছিল। কোটবাড়ি নাম এই ধারণার প্রমাণ বহন করে। এই কোট বা গড়গুলো সাধারণত দুর্গঘেরা হতো। এখানে থাকত সেনাছাউনি, খাজনা আদায়কারী কর্মকর্তার অফিস ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র।
ঢাকা মহানগর এলাকায় প্রাচীনকালে এমন অন্তত তিনটি দুর্গ অবস্থিত থাকার কথা জানা যায়। মিরপুর ও গাবতলীর মাঝামাঝি এমন একটি দুর্গের অস্তিত্ব ছিল বলে সাম্প্রতিক গবেষণায় অনুমান করা হচ্ছে। এই এলাকার ভেতরে তিনটি স্থাননাম পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে কোটবাড়ি, দিয়াবাড়ি ও দরিয়াঘাট। এই নামগুলো সুলতানি যুগের পূর্ব সময়ের বলে মনে করা হয়। কারণ সুলতানি যুগপর্ব থেকে পরবর্তী সময়ে এখানে কোটবাড়ি ধরনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কাঠামো থাকার মতো ঐতিহাসিক প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। কোটবাড়ি জায়গাটি বর্তমানে গাবতলীর পর্বতা সিনেমা হলের পিছনের দিকে তুরাগ নদীর তীরে অবস্থিত। প্রাচীন বাংলায় তুরাগ নদী অনেক প্রশস্ত ছিল। নদীর উত্তর সীমায় ছিল সাভারের বিরুলিয়া আর দক্ষিণে ছিল মিরপুরের উঁচুভূমি। দরিয়াঘাট (বর্তমান গুদারাঘাট) নামকরণে নদীর বিশালতার একটি ভূমিকা থাকতে পারে। কোটবাড়ি নামের ব্যবহার মুসলিম পূর্ব যুগ অর্থাৎ প্রাচীন বাংলায় পাওয়া যায়। এ যুক্তিতে অনুমান করা যায় কৌশলগত কারণে তুরাগ নদীর এই তীরাঞ্চলে দুর্গ সুরক্ষিত শুল্ক আদায়ের একটি প্রশাসনিক ইউনিট স্থাপিত হতে পারে। আগেই বলা হয়েছে প্রাচীনকালে কোটগুলো নদীর তীরে প্রতিষ্ঠিত হতো। নদীর দিকটি খোলা রেখে বাকি তিন দিকে দেওয়া হতো মাটির উঁচু বেস্টনি দেয়াল।
মাটি কাটার কারণে মিরপুরের কোটবাড়ির তিনপাশেই ছিল গভীর পরিখা। কিছুকাল আগেও এই নিচু ভূমির অস্তিত্ব দৃশ্যমান ছিল। কয়েকটি স্থান নাম আমাদের ধারণাকে আরেকটু স্বচ্ছ করে। কোটবাড়ির কয়েক কিলোমিটার পূর্ব দিকে প্রথমে পাইকপাড়া এবং আরো পুবে সেনপাড়া পর্বতা বলে একটি স্থান রয়েছে। হিন্দু শাসন যুগে লাঠিয়াল যোদ্ধাদের পাইক বলা হতো। চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি বাংলার স্বাধীন সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের (১৩৪২-১৩৫৭ খ্রি.) সৈন্যবাহিনীর প্রধান শক্তি ছিল হিন্দু পাইক বাহিনী। পাইকপাড়া সম্ভবত সৈন্যবাহিনীর ব্যারাকের স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে। তবে এই নাম মুসলিম যুগ না হিন্দু যুগের স্মৃতি বহন করছে তা বলা মুশকিল। সুলতানি বা মোগল যুগে ঢাকার এই অংশে মুসলিম প্রশাসন বিস্তৃত হয়েছিল তেমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। অবশ্য মুসলিম প্রশাসন না থাকলেও মুসলিম বসতিহীন ছিল না। কারণ পনের শতকে এখানে সুফি শাহ আলী বোগদাদী খানকাহ স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করেছিলেন। শিলালিপি প্রমাণে তা নিশ্চিত করা যায়। মিরপুর ১নং সেকশনে সুফির সমাধি রয়েছে। এই হিসেবে পাইকপাড়ায় যদি সেন বংশের শাসনকালে সেনা ছাউনি গড়ে ওঠে তবে বেসামরিক সেন বংশীয়দের বসতি অঞ্চল হিসেবে দুই আড়াই মাইল দূরে লাল মাটির উঁচু ভূমি অঞ্চলে সেনপাড়া পর্বতা নাম থাকাটা অযৌক্তিক নয় বলে ইতিহাসের যুক্তিতে বলা যেতে পারে। অবশ্য আরো গবেষণার পথ ধরেই নিশ্চিত হতে হবে। এ জন্যই শেষ মন্তব্য করার মতো সময় এখনো আসেনি বলে আমরা মনে করি। তবুও কোটবাড়ি, পাইকপাড়া, সেনপাড়া স্থান নামের কারণে ও প্রাকৃতিক অবস্থানগত দিক পর্যবেক্ষণে অনুমান করা যায় সেন শাসনকালে অর্থাৎ এগারো শতকের শেষার্ধ বা বারো শতকে আজকের ঢাকার এই শহরতলীতে একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল।
এক সময় ঢাকা গবেষণায় গবেষকদের খোঁজে যথেষ্ট তথ্য সূত্র ছিল না। তাই মোগল-পূর্ব যুগে ঢাকা নগরীর অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ করার যথেষ্ট যুক্তি ছিল। তবে বিগত দুই দশক ধরে প্রত্নতত্ত্ব চর্চার ক্ষেত্র উন্মোচিত হওয়ায় এবং প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস চর্চার বদ্ধ দরোজা একটু একটু খুলে যাওয়ায় নতুন বিশ্লেষণ ও নতুন তথ্য বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস লেখার পথ করে দিচ্ছে। এ কারণে ঢাকা নগরী নিয়ে নতুন কথা বলার পথও প্রশস্ত হয়েছে। প্রাচীন বাংলার সময়কালেও ঢাকা যে একটি সমৃদ্ধ জনবসতি এবং বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল সে সত্য ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে।
সেন শাসন যুগে বিক্রমপুর যখন রাজধানীর মর্যাদা পেয়েছিল তখন ঢাকার কাছাকাছি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল সোনারগাঁও। সোনারগাঁও কেন্দ্রের অবস্থান শীতলক্ষ্যা নদীর আনুমানিক আট কিলোমিটার পূর্ব দিকে। কোনো কোনো সূত্র থেকে জানা যায় সেন আমলে অর্থাৎ মুসলিম শাসকদের আগমনের আগেই বাণিজ্য নগরী হিসেবে ঢাকা নিজ অবস্থান তৈরি করেছিল। রাজধানী সোনারগাঁওয়ের নিকটবর্তী হওয়ায় বাণিজ্য অঞ্চল বিস্তার করতে গিয়ে ঢাকার এই অংশে ক্রমে নাগরিক জীবনের বিকাশ ঘটে। সোনারগাঁও থেকে ঢাকায় নদী পথের যোগাযোগ থাকায় নগরায়নের পথ প্রশস্ত হয়।
বখতিয়ার খলজীর হাতে নদীয়া পতনের পূর্বে সোনারগাঁও ছিল সেনদের অন্যতম শাসনকেন্দ্র। নদীয়া পতনের পর লক্ষণ সেন পূর্ববঙ্গে চলে আসেন এবং বিক্রমপুরের শাসনভার গ্রহণ করেন। সোনারগাঁও তখন বিক্রমপুরের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। মিনহাজ-ই-সিরাজের বর্ণনা অনুযায়ী ১২৬০ খ্রিস্টাব্দেও বঙ্গ লক্ষণ সেনের উত্তরসূরীদের শাসনাধীনে ছিল। তবে তবকাত-ই-নাসিরীতে সোনারগাঁওয়ের নাম উল্লিখিত হয়েছে। মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর এক শতক পর্যন্ত সোনারগাঁও থেকে কোনো মুদ্রা জারির প্রমাণ নেই। মুহাম্মদ বিন তুঘলকের (১৩২৫-১৩৫১ খ্রি.) রাজত্বকালেই সোনারগাঁও সর্বপ্রথম মুসলিম শাসনকেন্দ্রে পরিণত হয়। মধ্যযুগের শুরু থেকে সোনারগাঁও ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ শাসনকেন্দ্র। সুলতানি যুগে একটি শহরের অবস্থানকে নিশ্চিত করতে মুদ্রার সাক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারতের মুদ্রার ইতিহাসে বাংলার বিশেষ মর্যাদা এ জন্য যে, মধ্যযুগে এখানে একটি জাতীয় মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। এ যুগে শুধু সরকার ব্যবস্থা পরিচালনার কেন্দ্রগুলো থেকেই মুদ্রা জারি করা হতো না, ছোট খাটো শহরেও টাকশালের অস্তিত্ব ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। সুলতানি যুগ অবসানের পর বারভুঁইয়াদেরও অন্যতম শাসনকেন্দ্র ছিল সোনারগাঁও। ঈশাখাঁ এবং তাঁর পুত্র মুসাখাঁ শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন শীতলক্ষ্যার পূর্ব তীরে। বারভুঁইয়াদের দমন করার জন্যই ইসলামখাঁকে ঢাকায় মোগল রাজধানী স্থাপন করতে হয়। শীতলক্ষ্যার পূর্বাঞ্চলে যে শক্তির উৎসভূমি তাকে কাছে থেকে মোকাবিলা করার জন্য ইসলামখাঁ স্বাভাবিকভাবেই নদীর পশ্চিমাঞ্চলকে নিজ অবস্থান হিসেবে বেছে নেন। সে কারণেই বারভুঁইয়াদের সঙ্গে ইসলামখাঁর শেষ নৌযুদ্ধ হয়েছিল শীতলক্ষ্যা নদীতে।
সুলতানি যুগে ঢাকার দক্ষিণাংশে আজকের পুরনো ঢাকায় বাণিজ্য কেন্দ্রের পাশাপাশি মুসলিম বসতি গড়ে উঠেছিল। একই সাথে বলা যায় উল্লেখযোগ্য শহরতলী হিসেবে ঢাকার উত্তরাঞ্চলেও সুলতানি যুগে গড়ে উঠেছিল মুসলিম বসতি। মিরপুরে শাহ আলী বোগদাদীর (রা.) সমাধি সংলগ্ন একটি সুলতানি মসজিদ এর প্রমাণ। যদিও আধুনিকায়নের দাপটে বর্তমানে তা অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। বাংলায় মোগল ইতিহাসের অন্যতম আকর গ্রন্থ মির্যা নাথানের ‘বাহারিস্তান-ই-গায়েবী’। ইসলাম খানের সৈন্য বাহিনীর অন্যতম সেনাপতি নাথান উল্লেখ করেছেন মোগলরা ঢাকায় আসার আগেই বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় ‘ঢাকা দুর্গ’ নামে একটি দুর্গ অবস্থিত ছিল। এটি সংস্কার করে ইসলাম খানের বাসস্থান বানানো হয়। দুর্গটি সম্ভবত আফগান শাসন যুগে নির্মিত হয়েছিল। অর্থাৎ সুলতানি যুগে ইকলিম মুবারকাবাদের রাজধানী ঢাকা বারোভুঁইয়াদের শাসনকালেও নিজ গৌরব ধরে রাখতে এবং নগরীর বিস্তার ঘটাতে পেরেছিল।
লেখক : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়