ডুব
চরিত্রের অপ্রকাশের ভার দর্শকের ঘাড়ে
‘ডুব’ হুমায়ূন আহমেদের বায়োপিক, আবার বায়োপিক নয়ও। বড় ঘটনাগুলোয় মিল আছে। কিন্তু বড় ঘটনাগুলো যেভাবে ঘটেছিল, সেই ছোট ডিটেইলগুলো অনেক আলাদা, নিশ্চিতভাবেই আলাদা। কন্যার বান্ধবীকে জাভেদ বিয়ে করার পর অন্য সবার কী রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, কীভাবে সেগুলোর বোঝাপড়া হয়েছিল বা হতে ব্যর্থ হয়েছিল, এগুলো তো চিত্রনাট্যকারের কল্পনায় ঘটেছে। সেই কল্পনায় সবটা মূর্তও হয়নি। কারণ ‘ডুব’ অপ্রকাশের চলচ্চিত্র। কাহিনী কতকটা প্রকাশিত, কতকটা অব্যক্ত। সবটা বুঝতে হলে ডুব দিতে হবে চরিত্রগুলোর নিরুত্তাপ মননের গভীরে। সবটা বলে দেবার দায়িত্ব নিতে চাননি পরিচালক, কাহিনী তো জটিলতার, অস্বস্তির। সেই ভারের সবটা একা পরিচালক বইতে চাননি, দর্শকের মাথায় বাকিটা দিয়ে তিনি সটকে পড়েছেন।
ফলে ক্যামেরার ফ্রেমের ভেতরে কিছু ঘটছে, ফ্রেমের বাইরেও কম কিছু ঘটেনি। কখনো কখনো জরুরি বিষয়গুলোই পরিচালক ফ্রেমের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ধরা যাক, জাভেদের মৃত্যুর খবর যেভাবে এল প্রথম স্ত্রীর পরিবারে। সকালবেলায় ফোনটি ধরেছে প্রথম বা সাবেক স্ত্রী মায়া। এবার মূল ব্যাপার দাঁড়াবে, কন্যা সাবেরীর কাছে কীভাবে খবরটা পরিবেশিত হয়। কারণ এই চলচ্চিত্রের কেন্দ্রে রয়েছে বাবা জাভেদ ও কন্যা সাবেরীর সম্পর্ক। মায়া এসে ফ্রেমের বাইরে চলে গেল, সাউন্ড ট্র্যাকে শোনা গেল, মায়া সাবেরীকে বলছে, তোমাদের বাবা মারা গেছে। সাবেরীর কী প্রতিক্রিয়া হয়, দর্শকের জানা দরকার। কিন্তু তখনো সাবেরীকে দেখি না আমরা। সাউন্ড ট্র্যাকে সাবেরীর প্রতিক্রিয়া—মা এখন থেকে পোচ ডিম না করে পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ দিয়ে ডিম ভাজবা। পোচ ডিম খেতে আর ভালো লাগে না। তাহলে ফ্রেমে কী রাখা হয়েছে? মায়ার কাছে কাজের সূত্রে সকাল সকাল এক ভিজিটর এসেছেন, তাকে চা দেওয়া হয়েছে, তিনি চা খাচ্ছেন, খেয়েই চলেছেন—খুবই মামুলি এক চরিত্র, মামুলি তার ক্রিয়া, খবরটি শোনার পর প্রতিক্রিয়াও মামুলি, কিছুটা থমকে গেলেও, চা খাওয়া তিনি বন্ধ করেননি। কিন্তু পরের দৃশ্যেই আমরা সাবেরীকে দেখি স্নানাগারে, পানি পড়ছে, তার খেয়াল নেই, পানি বাথরুম পেরিয়ে সিঁড়িতে চলে গিয়েছে। ডিমের প্রত্যাশিত রান্নাসম্পর্কিত মামুলি মন্তব্যটি বাইরের, ভেতরের প্রতিক্রিয়া গভীর বেদনার, কিন্তু সেটা যেন প্রকাশের অনুমতি নেই। অন্যদিকে এই সংবাদের ভেতরে উটকো লোকটির উপস্থিতিও অপ্রত্যাশিত, কাহিনীবর্ণনায় কাম্য নয়। উৎকণ্ঠার সময়ে দীর্ঘক্ষণ অনাকাঙ্ক্ষিত লোকটিকে ফ্রেমে রাখা হয়েছে কোনো ধরনের পরিচয় করিয়ে দেওয়া ব্যতিতই। ঘটনা বর্ণনায় ক্ষুদ্রের আড়ালে বৃহৎকে পাঠিয়ে দেওয়ার এই কারসাজি, দর্শকের চলচ্চিত্র দেখার চেনা চোখে বিভ্রম তৈরি করে। গল্প বলার এই ভঙ্গি, গড় দর্শকের পছন্দ হবে না হয়তো। প্রশ্ন হলো পরিচালক সোজা পথ বাদ দিয়ে ভিনপথে কেন হাঁটলেন? এটা কি দর্শকের সঙ্গে পরিচালকের লুকোচুরি? নাকি দর্শককে পীড়িত করার গোপন বাসনা?
না। প্রথমত, বিশ্ব চলচ্চিত্রে কাহিনীর এই ধরনের বর্ণনা অপ্রচলিত নয়। দ্বিতীয়ত, কাহিনীর কেন্দ্রে রয়েছে অস্বস্তি, নীরবতা, কষ্ট গোপনের তীব্র অনুভূতি এবং কাহিনীরই শর্ত এই যে সব বড় চরিত্রকে তীব্র এই অনভূতিগুলোকে গোপন করে রাখতে হবে। চলচ্চিত্রের প্রতিটি বড় চরিত্র যেন ক্লেদাক্ত কষ্টের এই অভিশাপ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে—মায়ার স্বামী কন্যার বয়সী একজনকে বিয়ে করেছে ও তাকে ডিভোর্স দিয়েছে, সাবেরীর বান্ধবী নীতু তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। আর সবচেয়ে বড় অভিশাপ যেন জাভেদের ওপর, নীতুকে বিয়ে করে সে হারিয়েছে স্ত্রী-পুত্র-কন্যার সঙ্গে সম্পর্ক, সমাজে হয়েছে নিন্দিত, আর চলচ্চিত্রে কারণ ব্যাখ্যা না থাকলেও বলা যায়, এই অপ্রকাশের ভার বইতে না পেরেই যেন তিনি আগাম মৃত্যুবরণ করেছেন। কাহিনীর কেন্দ্রে যদি চরিত্রগুলোর বেদনা আড়াল করার পরিস্থিতি থাকে, তবে তার বর্ণনায় তা প্রকাশ্য করার সুযোগ কমে আসে। আমরা তাই ‘ডুব’ চলচ্চিত্রে অনেক মামুলি বিষয় জানলেও অনেক জরুরি বিষয় জানতে পারি না। যেমন বিয়ের আগে জাভেদ ও নীতুর কিছু ঘটনাবলি আমরা জানলেও, বিয়ের পর তাদের কোনো রোমান্স করতে দেখি না, বরং নীতুকে ব্যস্ত থাকতে দেখি নতুন সংসারের দখল নিতে, পুরোনো পরিবারের সামান্য সংশ্রবও ঝেড়ে ফেলতে। একবারই আমরা দেখি জাভেদ নীতুকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরছে, কিন্তু দর্শককে অবাক করে দিয়ে সেই আলিঙ্গনের দৃশ্য থেকে ক্যামেরা প্যান করে চলে যায় পাশের ঘরের কোরআনপাঠে, অর্থাৎ জাভেদের মৃত্যু হয়েছে। কোনো রেফারেন্স নেই, আভাস নেই, শারীরিক অসুস্থতা নেই, জাভেদের মৃত্যু যেন এক সফট ডিসমিসাল। স্বাভাবিক বিচারে এই মৃত্যু হতে পারত পূর্বাভাসসহ আয়োজনের, সেলিব্রেটি পরিচালকের মৃত্যু হতে পারতো দিগবিদারী—কিন্তু আমাদের জানা হয়ে গেছে, পরিচালক গুরুতর তথ্যগুলো আমাদের দেবেন না। সম্পাদনার ভাষায় যাকে বলে ‘ইলেপসিস’, কাহিনীর ধারাবাহিকতা ভঙ্গ করে ছোট লাফ দেওয়া, এ রকম বহু ইলেপসিস আছে ‘ডুব’ চলচ্চিত্রে। ফলে আমরা যদি চিত্রনাট্যেও গাঁথুনি খুঁজতে যাই, হতাশ হবো। সুবিন্যস্ত চিত্রনাট্যের প্রতিশ্রুতি এই চলচ্চিত্র দেয় না। ঘটনাক্রমের প্রায় অসংলগ্ন বর্ণনা এই চলচ্চিত্রের কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য।
এই চলচ্চিত্রের কাহিনীর মোটা দাগগুলো হুমায়ূন আহমেদসূত্রে আমাদের সবার জানা। তাই আমরা এই কাহিনী কীভাবে বলা হলো, তা নিয়ে আলোচনা করতে পারি। অথবা চরিত্রগুলোর আন্তঃসম্পর্কের ধরন বিশ্লেষণ করতে পারি। সবটা না জানলেও আমরা সবচেয়ে বেশি জেনেছি জাভেদেও পয়েন্ট অব ভিউ, সাবেরী আর মায়ার পারস্পেক্টিভও কিছুটা ধরতে পারা যায়। কিন্তু নীতুর পারস্পেক্টিভ অনুপস্থিত। নীতু কেন শৈশবের বান্ধবীর বাবার প্রতি আকৃষ্ট হলো? জাভেদ তার চলচ্চিত্রে শৈশব থেকেই সাবেরীর চাইতে নীতুকে বেশি পরিসর দিতো বলে? নীতুর অভিনয়প্রতিভার প্রতি জাভেদের আস্থায় কাবু হয়েছে সে? হতেও পারে। কিন্তু নীতু তার প্রেমে বেয়াড়া, ফিল্ম সিটির দেয়াল টপকে সে জাভেদের কাছে যায়, রাত্রিযাপন করে। নীতু সিগারেটের মতোই জাভেদের সঙ্গে জীবন শেয়ার করতে চেয়েছে। কিন্তু সাবেরীর দৃষ্টিতে নীতু ছোটবেলা থেকেই সবসময় সাবেরীকে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছে, জাভেদের কাছেও মেয়ের সমান আদর চেয়েছে, তা সম্ভব নয় জেনে স্ত্রী হয়ে সাবেরীকে হারিয়ে দিয়েছে। নীতু তাই শেষপর্যন্ত কাহিনীতে দ্বন্দ্ব বা ক্লাইমেক্স তৈরীর উপাদান হিসেবেই থেকে গিয়েছে।
সাবেরী নীতুকে শাস্তি দিতে চায় নি বা পারে নি। কিন্তু সে পেরেছে বাবাকে শাস্তি দিতে। জাভেদ যেন তার প্রথম পরিবারের কারো সঙ্গে যোগাযোগ না রাখতে পাওে তার ব্যবস্থা করেছে, বাবার পাঠানো গিফট সে বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে। সেই ছিল বাবার সবচেয়ে প্রিয়, বা বাবা ছিল তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। তাই জাভেদ যখন বাড়ি ছেড়ে যায়, যাওয়ার সময় এক গ্লাস পানি খুঁজে পায় না, চুরি করে বাবার জন্য এক গ্লাস জল সে বিদায়বেলায় নিয়ে হাজির হয়। সেই পানি খেয়ে জাভেদ যখন চলে যায়, সাবেরীর কান্না তখন দর্শককে স্পর্শ করে। আবার বহু বছর পর, হয়তো মৃত্যুর আগ দিয়ে জাভেদ হঠাৎ ফোন করে সাবেরীকে, কাতর গলায় বলে, সে সামথিং... এনিথিং। সাবেরী কিছু বলে না, ছোট ভাইকে ফোন এগিয়ে দেয়, কিন্তু তার চোখে কান্না। সেই কান্নাও দর্শককে স্পর্শ করে। আবার জাভেদেও মৃত্যুর পর, চিরশায়িত বাবার কফিন ধরে সাবেরী কাঁদে, এইতো আমি তোমাকে বাবা বলে ডাকছি... এই কান্না দর্শককে স্পর্শ করে। এই মর্মন্তুদ অভিব্যক্তিগুলো অভিনেত্রী তিশা চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। জাভেদের চরিত্রে বিখ্যাত ভারতীয় অভিনেতা ইরফান খানের সীমাবদ্ধ বাংলা উচ্চারণটুকু বাদ দিলে বরাবরের মতোই অসাধারণ। ইরফান খান বরাবরই শারীরিক অভিনয় না করে, কেবল চোখ ও মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তি দিয়ে চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলেন। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। নীতু চরিত্রে পার্নো মিত্র ছিলেন দারুণ। অল্প কিছু দৃশ্যে তাকে দেখা গেলেও নাছোড় প্রেমিকা আর অধিকার-টনটনে স্ত্রীর ভূমিকায় তিনি বেশ মানানসই। মায়া চরিত্রে গুণী অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী যথার্থ, অনভ্যস্ত হলেও, স্বামীর অনুপস্থিতিতে ছেলেমেয়ে নিয়ে মায়া চরিত্রটি ক্রমশ দৃঢ়চেতা হয়ে ওঠে, গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে যেন সে ছেলে-মেয়ে-সংসারের বাকি দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়।
আলফ্রেড হিচককের সুনির্মিত চলচ্চিত্র ‘ভার্টিগো’ কিংবা ‘রেয়ার উইন্ডো’ বিশ্লেষণ করে লরা মালভি দেখিয়েছেন কীভাবে পুরুষের দৃষ্টি নারীর শরীরের প্রতি নিক্ষিপ্ত হয় এবং গোপনে নারীকে অনুসরণ করে পুরুষ-দৃষ্টি তুষ্টি লাভ করে। এরকম গভীর সমালোচনাত্মক বিশ্লেষণে গিয়ে বলা যায়, জাভেদের পুরুষ-মনস্তত্ত্ব ও যৌনচেতনা ‘ডুব’ চলচ্চিত্রের প্রধান বিষয়ানুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। তাকে ঘিরেই তিন নারীর জীবন আবর্তিত হয়। জাভেদ মনে করে সে স্বামীর চাকরি করছে আর মায়া স্ত্রীর, জাভেদই মধ্যবয়সে এই চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে তরুণী নীতুর কাছে যায়। জাভেদের প্রতি তীব্র ভালোবাসা থেকেই সাবেরী নিজেকে সরিয়ে নেয় বহু দূরে। জাভেদের মৃত্যুই আবার তিন নারীকে বদলে দেয়—মৃত জাভেদের দৃষ্টিতে বলা হয়, মৃত্যু ভালোবাসা-মমতা ফিরিয়ে দেয়। জাভেদের মৃত্যুর পর মায়া পুরোনো ছবির ফ্রেম আবার টেবিলে সাজায়, জাভেদ মৃত্যুর পর ছবি হিসেবে হলেও মায়ার জীবনে ফিরে আসে। জাভেদ ছাড়া এই তিন নারীর জীবন যেন অসম্পূর্ণ, অপূর্ণাঙ্গ।
‘ডুব’ চলচ্চিত্রের সিনেমাটোগ্রাফি অসাধারণ। বান্দবনের পাহাড় হোক কিংবা ঢাকার কৃষ্ণচূড়া হোক, কিংবা গাড়ির ওপর ঝুম বর্ষণ হোক, ক্যামেরা সবকিছুকেই জীবন্ত করে তোলে। কিন্তু শেখ রাজিবুল ইসলামের ক্যামেরাকর্ম বিশেষভাবে মনোগ্রাহী হয়ে ওঠে অসংখ্য ফ্রেম উইদিন ফ্রেম শটের কারণে। চরিত্রগুলোর বিষাদের আর অপ্রকাশের ভার যেন ক্যামেরা তুলে নিয়েছে কাব্যিক গীতলতার আশ্রয়ে— প্রায়শই ফ্রেমের কিছু অংশ জুড়ে চরিত্র থাকে, বাকি অংশ ঢাকা থাকে অন্ধকারে বা অনুজ্জ্বলতায়, যেমনটি আমরা চরিত্রগুলোর অনুভূতির কতকটা জানতে পাই, কতকটা পাই না। তবে আমি দুয়েক কথা বলতে চাই শব্দগ্রাহক রিপন নাথের জন্য। বান্দরবানে যখন মায়া আর জাভেদ হেঁটে আসছে, এক্সট্রিম লং শটে তাদের ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে দেখা যায়, ভিজুয়ালে ঝড়ো বাতাসের দৃশ্য আর সাউন্ড ট্র্যাকে বাতাসের শব্দ দৃশ্যটাকে গতিময় করে তোলে। একইভাবে গতিময় বাতাস আমরা বইতে দেখি মায়ার জন্মদিন উদযাপনের আশুলিয়া সিকোয়েন্সে, বাতাসের শব্দসহ। আর বান্দরবানে চা খেতে খেতে যখন মায়া আর জাভেদ কথোপকথন তিক্ততার দিকে ধাবিত হয়, তখন সাউন্ড ট্র্যাকের মাছির ভনভনে শব্দ যেন এই দাম্পত্য সম্পর্কের নাজেহাল দশাকে কটাক্ষ করতে থাকে।
পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নিজেকে ভেঙেছেন ‘ডুব’ চলচ্চিত্রে। ‘ব্যাচেলর’ থেকে ‘ডুব’ পর্যন্ত তার যে পথচলা, তা দেখে বলা যায়, ‘ডুব’ই হয়ে উঠেছে সত্যিকারের আর্টহাউস চলচ্চিত্র। তাঁর অন্যান্য চলচ্চিত্রের অনেক বৈশিষ্ট্যই এই চলচ্চিত্রে অনুপস্থিত। ধরা যাক, তার চলচ্চিত্রে থাকে হিউমার, সেটা কমিক রিলিফ না হয়ে কখনো কখনো সার্কাস্টিক হয়ে পড়ে, চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তুর যে সিরিয়াসনেস তার জন্য যা বাধা তৈরি করে। ‘ডুব’ চলচ্চিত্রে এই ব্যাপারটিও নেই। প্রথম দিকের জাভেদ-মায়ার বিয়ে নিয়ে যে লুকোচুরির কাহিনী, তা হয়তো আগের বৈশিষ্ট্য ধারণ করেই বর্ণিত, তা কাহিনীর মর্বিড প্রকৃতির জন্য তেমন বিঘ্ন ঘটায়নি। তবে মজার এক ঘটনা এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করতে হয়। জাভেদের মৃত্যুর পর দেখা যায়, নীতুর ঘরেও জাভেদের এক পুত্রসন্তান রয়েছে। জানাজার সময় মায়ার ছেলে আহির আর নীতুর শিশুটি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, তাদের চাচা বা জাভেদের ছোট ভাই নিয়মানুযায়ী জানাজায় সমবেত সকলকে অনুরোধ জানান যেন জাভেদকে সবাই ক্ষমা করে দেন। এরপর সবাইকে জিজ্ঞেস করেন, আপনারা আমার ভাইকে ক্ষমা করেছেন? সাউন্ড ট্র্যাকে আমরা সম্মিলিত কণ্ঠে শুনি, হ্যাঁ। কিন্তু ভিজুয়ালে দেখানো হয় জাভেদের সেই শিশুসন্তানটিকে, যে হাত উঁচিয়ে বলে, হ্যাঁ। এভাবে দৃশ্যটিতে ভিন্ন এক দ্যোতনার সৃষ্টি হয়।
স্কুলের রিইউনিয়নের দৃশ্য দিয়ে শুরু, সাবেরী আর নীতু আগের মতোই স্কুলের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির অপরিহার্য দুই সদস্য হিসেবে হাজির, কাছাকাছি বসে আছে তারা। কিন্তু তাদের মধ্যে এক অস্বস্তিকর ও অদৃশ্য দেয়াল। চলচ্চিত্র শেষও হয়েছে এই দৃশ্য দিয়ে—এর মধ্যে আমাদের বলা হয়েছে সব কাহিনী। জাভেদই নেই এখন, তাই সেই অস্বস্তির দেয়াল যেন আর রাখার দরকার নেই, নেপথ্যে বেজে ওঠে রবীন্দ্রনাথের গানের টিউন—পুরোনো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়...।
সাবেরী আর নীতুর কি পুনর্মিলনী হবে তাহলে? তাই হোক।
৩১ অক্টোবর, ২০১৭