গল্প পড়ার গল্প
প্রচলিত ধারণা ভেঙে দেন সেলিনা হোসেন
‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ ও ‘পোকামাকড়ের ঘর বসতি’ উপন্যাসের লেখক সেলিনা হোসেন সুখ্যাত দুই দেশেই। বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশেই তাঁর পাঠক। তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল কলকাতায় দেশভাগ নিয়ে এক সেমিনারে। আমি তাঁর পাঠক। পড়েছি তাঁর অনেক গল্প। মেয়েদের যুদ্ধের কথা মেয়েদের চেয়ে বেশি কে বলতে পারে? সেলিনা হোসেন তাঁর গল্পে বাংলাদেশের মেয়েদের কথা বলেন সোজাসাপ্টা। সেই মেয়ে স্বামীর ঘরে নিযার্তিতা, সেই মেয়ে মুক্তিযোদ্ধা, খান সেনাদের হাতে ধর্ষিতা। সেলিনা হোসেন খুব স্পষ্ট ভাষায় স্পষ্ট কথা বলেন। রূঢ় বাস্তবকে রূঢ়তায় চিত্রায়িত করেন। এখানে কোনো অস্পষ্টতা নেই।
মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, নিম্নবর্গের মানুষ ঘুরে ঘুরে এসেছে তাঁর গল্পে। মইরম জানে না ধর্ষণ কী, পাগলের মা হওয়া, চার যুবকের বিলাপ, মতিজানের মেয়েরা, দু’রকম যুদ্ধ... কত গল্পের কথা মনে পড়ছে। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের সাহিত্যে বড় এক বাঁক এনেছে। আত্মত্যাগ কত মহিমাময় হতে পারে, তা সেলিনা হোসেনের দুরকম যুদ্ধ পড়লে প্রত্যয় হয়। গল্পটি গ্রামের সামান্য মেয়ে নূরজাহানের। চাষি ঘরের মেয়ে। বাবার কাছে অবসরে কিসসা শুনত। কী কিসসা? না, সোনাভানের কিসসা। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের গল্প তা। বাবা দাওয়ায় বসে জাল বুনতে বুনতে সোনাভানের কাহিনী শোনাত। বাবা সুর করে বলত, ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল...। সেই গান শুনে ভাই বোনেরা হেসে গড়িয়ে পড়লেও নূরজাহান স্বপ্ন দেখত সোনাভানের।
আকাশের তারায় খুঁজে বেড়াত সোনাভানের ঘোড়া। সে ছিল সাহসী আর ডানপিটে মেয়ে। পাকবাহিনী যুদ্ধ শুরু করল দেশের মানুষের বিরুদ্ধে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে লাগল। নূরজাহান তখন বাবাকে বলল, মুক্তিযুদ্ধে যাবে। মেয়েমানুষ যুদ্ধে যায়! সব্বোনাশ হয়ে যাবে যে তার। শত নিষেধেও সে গেল মুক্তি শিবিরে। গ্রেনেডের পিন খোলা আর রাইফেল চালানো শিখেও সে আর আবুবকর ধরা পড়ল পাক খান সেনাদের হাতে। ধর্ষিতা হয় নূরজাহান। আবুবকর তার সঙ্গেই আটকে আছে খান সেনাদের শিবিরে। নূরজাহান সেই বন্দিদশা থেকেই চেষ্টা করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে। আবুবকর যখন তাকে বলে সাবধান হতে, খান সেনারা টের পেলে তাকে খুবলে খাবে, সে বলে, দেশই যদি স্বাধীন না হয়, এ শরীর দিয়ে কী হবে? কী যুদ্ধই না করল সে! সেনাশিবির থেকে মাইন চুরি করে পেটে আর বুকে তা বেঁধে ভোর ভোর মুক্তি শিবিরে হাজির। তারপর সেই মাইন পথে বসিয়ে ফিরে যায় খান সেনাদের ক্যাম্পে। যাওয়ার আগে নদীতে স্নান করে ভিজে কাপড়ে ফেরে সেনাদের মনোরঞ্জনের জন্য। সেই মাইনে ট্রাকসমেত খান সেনাদের একটি দল ধ্বংস হয়। তখন শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন। নূরজাহান মুক্তিযোদ্ধা, তা বুঝতে পেরেছিল খান সেনারা। এই হলো গল্প। আসলে এই গল্পে যে অসামান্য মেয়েটিকে এঁকেছেন সেলিনা হোসেন, তা মনে থেকে যায়।
মুক্তিযুদ্ধে একটা জাতির স্বাধীনতা এসেছিল। মুক্তিযুদ্ধে কত সাধারণ মানুষ নিজেদের নিবেদন করেছিল জন্মভূমির মুক্তিতে। একটি সাধারণ মেয়ের কথা শুনিয়েছেন সেলিনা, যে কি না নিজের দেহের পরোয়া করেনি। সমস্ত পুরোনো মূল্যবোধ ভেঙে দিয়েছেন তিনি এই গল্পে। দেহের শুদ্ধতা দেশ মুক্তির চেয়ে বড় নয়। সেলিনা হোসেনের আর এক গল্প ‘মতিজানের মেয়েরা’ আরেক অনন্যসাধারণ মেয়ের গল্প। সেই মেয়ে মতিজান এক দুস্থ বাবা-মায়ের সন্তান। বাবা বিয়েতে ঘড়ি আর সাইকেল কবুল করেছিল, কিন্তু দিতে পারেননি। তার শাশুড়ি গুলনূর খুব দাপুটে মহিলা। কম বয়সে বেওয়া হয়েছিল, জমি ভিটে আঁকড়ে ছেলে নিয়ে এতকাল কাটিয়ে গেল। সবকিছুই তার দখলে। গাঁয়ের লোক বলে গুলনূর খুব শক্ত মহিলা। স্বামীর মৃত্যুর পর কোনো আত্মীয়স্বজনের কাছে সাহায্যের জন্য হাত পেতে দাঁড়ায়নি। মতিজান তার ছেলে আবুলের বউ। সমস্ত দিন নিদারুণ বাক্যবাণে তাকে বিদ্ধ করে গুলনূর। মতিজানের স্বামী আবুল এক গাঁজাড়ু। তা ব্যতীত গঞ্জে তার এক বাঁধা মেয়েমানুষ আছে। তার কাছে গিয়েই পড়ে থাকে সকাল থেকে অনেক রাত পর্যন্ত। মতিজান একা। শাশুড়ির গালি থামে না। তার মা-বাপকে গালি দেয় সাইকেল আর ঘড়ি দেয়নি বলে। সে উদয়াস্ত খাটে সংসারের জন্য। কিন্তু সংসার তো তার নয়, গুলনূরের। তার স্বামী খুব ভয় করে মাকে। মতিজান কিছু বলতে গেলে থামিয়ে দিয়ে চলে যায় ঘর ছেড়ে। যখন চুলের মুঠি ধরে মতিজানকে হেনস্তা করে গুলনূর, আবুল কিছু বলে না, বরং হেসে প্রকারান্তরে মাকে সমর্থন জানায়।
আবুল যে অন্য নারীতে আসক্ত, এই অভিযোগেও গুলনূর চুপ করে থেকে ছেলেকে সমর্থন করে। মতিজান বিয়ে করতে চায়নি, কাজ করে বাঁচতে চেয়েছিল, কিন্তু সমাজ কী বলবে, জোর করে তাকে বিয়ে দিয়েছে বাবা। শ্বশুরবাড়িতে বসে গোপন অশ্রুপাতে দিন কাটে তার। এরই ভেতর শাশুড়ি তাকে বাঁজা বলে গালি দিতে থাকে। কিন্তু সন্তান হবে কী করে, আবুলের সঙ্গে তার শারীরিক কোনো সম্পর্কই যে নেই। এহেন মতিজান একদিন ফুঁসে ওঠে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যা হয়। সংসারের কাজ শেষে ভাত খেতে গেলে গুলনূর তাকে বলে ভাত হবে না। সে পাল্টা জিজ্ঞেস করে, কেন হবে না, সে সকাল থেকে সংসারের যে কাজ করছে, তার জন্যও তো ভাত প্রাপ্য তার। গুলনূরের বাধা এড়িয়ে সে বুকে আঁকড়ে ধরে ভাতের থালা নিয়ে খেতে থাকে, যাতে শাশুড়ি কেড়ে না নিতে পারে। ক্ষুধার্ত মানুষের এই প্রতিক্রিয়ায় গুলনূর হতবাক। সে ভাবতেও পারেনি, এমনটা হতে পারে। আবুল প্রায়ই বাড়ি ফেরে না। শুনেছে সে আগের মেয়েমানুষের পরিবর্তে নতুন মেয়েমানুষ জুটিয়েছে গঞ্জে। সওদা পাঠিয়ে দেয় তার স্যাঙাৎ লোকমানের হাতে। ঘোর দ্বিপ্রহরে সওদা নিয়ে আসে লোকমান। তখন গোলনূর ঘুমায়। নিস্তব্ধ দুপুরে লোকমানকে প্রশ্রয় দেয় মতিজান। সেই প্রশ্রয়েই সে গর্ভবতী হয়। এবং তার বাঁজা নাম ঘোচে। কিন্তু শাশুড়ি আর স্বামী বলে বংশরক্ষা চাই। ছেলে হয় যেন। হলো না তা। হলো মেয়ে।
নাতনির মুখই দ্যাখে না গোলনূর। সেই মেয়েসন্তান নিয়ে ডুবে থাকে মতিজান সারা দিন। শাশুড়ি খোঁটা দেয়, মতিজানের দ্বারা তার বংশ রক্ষা হবে না। আবার গর্ভধারণ করে মতিজান। আর এবারও সেই মেয়ে। এবার শাশুড়ি ঘোষণা করে যে বউ বারবার মেয়েসন্তানের জন্ম দেয় তাকে রাখবে না সংসারে। এর দ্বারা বংশরক্ষা হবে না। তালাক দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে আবার বিয়ে দেবে ছেলের। মতিজান জবাব দেয় না। সারা দিন কাটে তার দুই কন্যাসন্তান নিয়ে। ক্লান্তও থাকে খুব। মাসখানেক বাদে আবুল ফিরলে শাশুড়ি ওই কথা আবুলকে শোনালে, সে চুপ। ফ্যালফ্যাল করে মতিজান ও তার মেয়েদের দ্যাখে, তারপর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। গুলনূর চিৎকার করতে থাকে। তখনই বের করে দেবে মতিজানকে। মতিজান তাকে থামাতে চায়, পারে না।
পড়শিরা এসে দাঁড়িয়েছে উঠানে। গুলনূর বলছে, আজ থেকে তার সংসারে মতিজানের ভাত নেই, ছেলেকে আবার বিয়ে দেবে সে, বংশে বাতি দেওয়াবে। এই কথা শুনে খিকখিক করে হাসে মতিজান, বলে, বংশে বাত্তি, গুলনূরের ছেলের আশায় থাকলে সে ওই মেয়ে দুটোকেও পেত না। স্তম্ভিত পড়শির ভেতরে এই কথা বলে দিয়ে শাশুড়িকে দুমড়ে দিল। মতিজানের মেয়েরা তার মায়ের বুক আঁকড়ে জুলজুলে চোখে সকলকে দেখছে তখন। এই গল্পেও সেলিনা হোসেন ভেঙে দিয়েছেন প্রচলিত মূল্যবোধ। তাঁর গল্পের মেয়েরা এমন। এমন ভেঙে দিতে পারে সমস্ত অচলায়তন। তাই মনে থাকে মতিজান, নূরজাহানদের।