গপ্পো তক্ক যুক্তি
কন্টেন্ট হচ্ছে ফিল্মের মূল বিষয় : সুজয় ঘোষ
আন্তর্জাতিকভাবে এটা নতুন কোনো ব্যাপার নয়। ফিচার ফিল্মের বাঘা বাঘা নির্মাতারা শর্ট ফিল্মও বানিয়েছেন দেদার। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে এই ধারাটা তেমন প্রচলিত নয়। পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি বানিয়ে যাঁদের অভ্যাস, তাঁরা স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির দিকে সাধারণত যান না।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের অনুরাগ কশ্যপ, সুজয় ঘোষ এরা কিছুটা পরিবর্তন আনতে পেরেছেন। ফিচার ফিল্মের পাশাপাশি শর্ট ফিল্ম বানিয়েও তারা বেশ সাড়া জাগিয়েছেন। সর্বশেষ সুজয় ঘোষের ‘অহল্যা’ তো ইন্টানেটের দুনিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছে। ছবিটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা দুটোই হয়েছে সমানতালে। ইউটিউবে এখন পর্যন্ত ৩০ লাখেরও বেশিবার দেখা হয়েছে অহল্যা। ছবিটি নিয়ে সিনেমাবিষয়ক ভারতীয় ওয়েবসাইট জামুরার সঙ্গে কথা বলেছেন পরিচালক সুজয় ঘোষ।
প্রশ্ন : স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি কেন করলেন?
সুজয় ঘোষ : কনটেন্ট বা স্ক্রিপ্টের দিক থেকে কিন্তু ফিচার ফিল্মের চেয়ে শর্টফিল্মের চাহিদা অনেক বেশি। এর কারণটা হচ্ছে ১০ বা ১৪ মিনিটের মধ্যে আপনি পুরো একটা সিনেমা দেখিয়ে ফেলছেন। এই জিনিসটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি একটা সিনেমা বানাতে চেয়েছি। আমি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি বানাতে চাইনি। আমি এমন একটা ছবি বানাতে চেয়েছি, যেটা প্রশ্ন তৈরি করবে, মানুষকে আগ্রহী করে তুলবে। এমন কিছু যেটার অস্তিত্ব নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা হবে, তর্ক-বিতর্ক হবে। অহল্যার গল্পের মধ্যে একটা জাদু আছে। কিছুটা পরাবাস্তব এবং একটা গল্পেই অনেক রকমের অনুভূতির মিশেল। লালসা, ভালোবাসা, নৈতিকতা, ষড়যন্ত্র – সবগুলো জিনিস এক জায়গায় চলে এসেছে। এ রকম অন্য আরো গল্প ছিল, যেগুলো ভালো ছিল। কিন্তু আমি গল্পটা একটু পরিবর্তন করেছি, যাতে দর্শক সিনেমাটা দেখে মজা পান।
প্রশ্ন : গল্পটা অবশ্যই দর্শকদের সংযুক্ত করেছে। মজার বিষয় হচ্ছে ছবির ভাষা বাংলা (অবশ্যই ইংরেজি সাবটাইটেলসহ)। কিন্তু দর্শকরা এমনভাবে ছবিটা ইন্টারনেটে হুমড়ি খেয়ে দেখেছে, মনে হয়েছে যেন আরেকটা নতুন পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি রিলিজ পেয়েছে!
সুজয় ঘোষ : এটা মনে হয় ছবিটার থিমের কারণে। এটা আমাদের আশার আলো দেখিয়েছি, আমরা যাঁরা মনে করি সিনেমা, সিনেমাই। ভাষা সিনেমা বোঝার ক্ষেত্রে কোনো বাধা তৈরি করতে পারে না। মানে আমি বলতে চাচ্ছি, সিনেমায় যদি কোনো সীমাবদ্ধতা থাকে তাহলে সেটা তার কনটেন্ট। আপনাকে কনটেন্টটা ঠিকঠাক তৈরি করতে হবে।
প্রশ্ন : আপনার কী মনে হয়, সিনেমার ক্ষেত্রে ভাষা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে?
সুজয় ঘোষ : অবশ্যই। কারণ নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এখন অনেক বেশি সচেতন আমাদের সময়ের তুলনায়। আমাদের চেয়ে তাদের দেখার পরিমাণ বা বিস্তৃতি অনেক বেশি। আমাদের সময়ে আমরা শুধু হিন্দি ছবি দেখতাম, এখন নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা মেক্সিকান, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, কোরিয়ান ছবি দেখছে। আপনি বাহুবলি দেখছেন, সঙ্গে সঙ্গে আপনি অন্য সব ভাষার ছবি দেখছেন, যা পাচ্ছেন সেটা দেখে নিচ্ছেন। তাই আপনার ক্ষেত্রে ছবিটাই বড় ব্যাপার, ভাষাটা এখানে তেমন কোনো পার্থক্য তৈরি করে না। অহল্যা দিয়ে সেটা প্রমাণ হয়েছে। প্রথমদিকে আমিও বেশি দ্বিধায় ছিলাম যে আসলে কজন বাঙালিই বা অহল্যা দেখবে! তবে এখন মনে হয় মিছেমিছি ভয়ে ছিলাম।
প্রশ্ন : অহল্যা খুব প্রশংসিত হয়েছে। মনে হয় ‘কাহানি’ ছবিটার চেয়ে বেশি দর্শক অহল্যা দেখেছেন।
সুজয় ঘোষ : এটা আসলেই অনেক বড় ব্যাপার। সব প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গেছে। আমি এতটা আশা করিনি। ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো কোনো শর্টফিল্ম নিয়ে সবগুলো বড় পত্রিকা খবর ছেপেছে। এমনকি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকাতেও ছবিটির রিভিউ ছাপা হয়েছে।
প্রশ্ন : অনলাইনে আপনি পয়সা বানাতে পারছেন না। বিশেষ করে শর্টফিল্মের ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যটা থাকে আলাদা। পয়সা বানানোর চেয়ে ছবিটা মানুষকে দেখানোই থাকে মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু আপনার কি মনে হয় অদূর ভবিষ্যতে এটা পাল্টে যাবে। অনলাইনেই ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউশনের প্রধান চ্যানেল হয়ে উঠবে?
সুজয় ঘোষ : ইন্টারনেটই ডিস্ট্রিবিউশন মডেল হবে। আগামী পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে অনেক ছবিই ইন্টারনেটে রিলিজ হবে। একটা উদাহরণ দিই, আমি যখন কাহানি বানাই, আমি ওই আট কোটি টাকার জনসংযোগ এবং বিজ্ঞাপনের চাপ নিতে চাইনি। আট কোটি টাকার মার্কেটিংয়ের চাপ আমি নিতে চাইনি। আমি কেনই বা চাইব? এর চেয়ে বরং ওই আট কোটি টাকা দিয়ে আমি নতুন একটা ছবি বানাব। তারপর ১৬ কোটি টাকা দিয়ে ছবি বানাব। তাহলে আমি কেন মার্কেটিংয়ের বাড়তি চাপ নেব? কারণ সেটা থেকে যে টাকাটা আসবে সেটা প্রযোজকের ঘরে যাবে, তাঁর ঘর আরো সুন্দর করে সাজানো হবে।
ইন্টারনেট মূল ঝামেলাটা হচ্ছে, আমাদের দর্শকদের কাছে পৌঁছানোর পথ তৈরি করে নিতে হবে। যে লোকটা তার স্মার্টফোনে সিনেমা দেখে তাদের কাছেও আমাদের পৌঁছাতে হবে। তাই ছবি বানানোর সময় আপনাকে মাথায় রাখতে হবে যে ছবিটা স্মার্টফোনের একজন দর্শকের জন্যও বানানো হচ্ছে। সেভাবে শট নিতে হবে, সম্পাদনার সময় সেভাবে সাজাতে হবে, ঠিকভাবে লেন্সটাকে কাজে লাগাতে হবে। এইখানে লেখাপড়ার এবং ব্যাপারগুলো বোঝার একটা ব্যাপার আছে। আমি ওই লেখাপড়াটা করতে চাই কিন্তু মার্কেটিংয়ের আট কোটি টাকার চাপটা মাথায় নিতে চাইনা।
প্রশ্ন : অনেক ফিল্মমেকার এটার জন্য প্রস্তুত নয়। তবে জিনিসটা মজার।
সুজয় ঘোষ : হয় তো তারা তৈরি না। কিন্তু এটা অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত উপায়। কারণ একজন দর্শকের কাছ থেকে ২০০ রুপি নেওয়ার চেয়ে ১০০ রুপি নেওয়া আমার পক্ষে সহজ।
প্রশ্ন : আরেকটা ব্যাপার ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে। শর্টফিল্মগুলো ফিচার ফিল্মের প্রিক্যুয়াল হিসেবে বানানো হচ্ছে। প্ল্যানেট অব দ্য অ্যাপস এবং আগলি ছবির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঘটেছে। এমন কী হতে পারে যে, ছবির প্রথম ভাগটা মানুষ বিনামূল্যে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেবে আর তার সাফল্যের ওপর নির্ভর করে পুরো ছবিটা তৈরি হবে?
সুজয় ঘোষ : সত্যি বলতে আমি কখনো এভাবে ভেবে দেখিনি। কিন্তু আমি নিশ্চিত এটা ভালো একটা বুদ্ধি। আপনার সামনে কিন্তু অফুরন্ত সুযোগ, যদি শুধু আপনি মিডিয়াকে অপব্যবহার না করেন। দর্শকদের আপনার মূল্যবান কিছু দিতে হবে যাতে আপনার ছবি দেখে তাদের সময় নষ্ট না হয়, তারা যেন ছবির কনটেন্ট দেখে মুগ্ধ হয়। সময় হচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস। তাই আপনি যদি কারো সময় নেন, তাহলে সেটার মূল্য আপনাকে শোধ করতে হবে ভালো কিছু দিয়ে। নাহলে মানুষ আপনার পরের ছবি আর দেখতে আসবে না। বড় হোক আর ছোটই হোক, আপনি আপনার ১৪ মিনিটই খামোখা কেন নষ্ট করবেন?
প্রশ্ন : তরুণ ফিল্মমেকারদের কী পরামর্শ দেবেন?
সুজয় ঘোষ : মূল কৌশলটা হচ্ছে কনটেন্ট। আপনি কেন কাজটা করবেন? কোন ধরনের ছবি বানাবেন? যে কোনো ধরনের ছবি আপনি বানাতে পারেন, তবে মনে রাখতে হবে জিনিসটা যেন টিকে থাকে, মানুষ যেন মনে রাখে কাজটা।
শর্টফিল্ম বানানোর ক্ষেত্রে আপনাকে দর্শকদের কথা খুব সাবধানে চিন্তা করতে হবে, খুব সাবধানে। কারণ এসব দর্শক কিন্তু ফিচার ফিল্ম দেখে অভ্যস্ত। অল্প সময়ে তাদের ফিল্মের সেই স্বাদটা দিতে হবে। আপনি কিন্তু প্রচুর দর্শকের কাছে পৌঁছে যাবেন, তাই আপনাকে খুব সতর্কভাবে কাজ করতে হবে। কারণ আপনার শর্টফিল্মের জীবন নির্ভর করছে দর্শকদের মুখের কথার ওপর। আমি জানি এটা বলাটা খুব সহজ কিন্তু করাটা কঠিন। কিন্তু আমি যা বলছি, সেটাই বিশ্বাস করি, কনটেন্ট হচ্ছে ফিল্মের মূল বিষয়।